সাঁকোর উপরে কথোপকথন – মৌসুমি কন্দলি অনুবাদ: মিহির মজুমদার
Being pregnant is like crossing a narrow bridge. People can accompany you to the bridge. They can greet you on the other side. But you walk that bridge alone.
African Proverb
সাঁকোতে পা দিয়েই সে ভারী ভারী অতিকায় দুটো ডানা ধপধপিয়ে ঝাপটাল। বহুদিন হল–ডানায় ঘন
আঁধারের ঢেউ তুলে হার্পির নেমে আসা। বুকের ভয়াল বিশাল খাঁচায় বাসা বানিয়ে নেওয়ার… বুকে চেপে হার্পি, ওম দেয়। ওমে বসে। ডিমগুলো পুরুষ্টু হয়। ডিম ফোটে। ভীরু শাবক জাগে। জেগে ওঠা ভয়ের ছানাগুলোর আর্তরবে সবকিছু আউল-কাউল হয়ে যায়…
মনে আছে–দেওপানির দেবীদৌলের সেই সন্ধ্যার কথা? দেবীদৌলের আঙিনার সেই বটগাছটির কথা? সহস্র ফণা তুলে থাকা বাসুকি–সদৃশ সেই বটগাছের ঘন শিকড়জালের কথা? শিকড়জালের সেই সহস্র ফণায় ধড়ফড় করে একঝাঁক পাখি যে আর্তকূজন তুলেছিল! মনে পড়ে? কালের কণ্টক ভেদ করে চিরকালের জন্য, চেতনায় বাসর পেতে থাকা সেই ঘূর্ণির কথা মনে পড়ে? দিদির বিয়ের জন্য দেবীদৌলে মানত করে রাখা প্রদীপটি জ্বালব বলে আমরা মাকে নিয়ে সেই দেবীমন্দিরে গিয়েছিলাম। লাল কৌপিন পরা এক জটাধারি সাধুবাবা, ধূপ জ্বালিয়েছে। সাধুবাবার চোখ দুটোয় জ্বলে ওঠা দপদপ সেই ধূপের আগুন মনে আছে? আর্তস্বরের ঘূর্ণির দিকে আঙুল তুলে সেই জটাধারী যে হুংকার দিয়ে উঠেছিল—জগৎ নিরাংকার— সংগুরু নিরাংকার–
সাঁকোর উপরে পা রাখতেই, চেতনায় বাসা বেঁধে থাকা সেই ঘূর্ণির নিশান উজিয়ে আসছে। আর সেই আর্দ্র ঘূর্ণির সংগত করছে ভয়াতুর ছানাগুলোর চিল-চিৎকার। সহস্র ফণা মেলে সেই ভয়ানক শব্দগুলো যেন দু-পা জড়িয়ে ধরেছে। এটা… এটা কোন্ সাঁকোতে পা রাখলাম গো? কী এই সাঁকো? একটি, দুটি, নটি কালস্তম্ভে সাজানো? এখন রাতভোর না কাকভোর? দুর্ঘটনার পিছু তাড়া করে এলাম না তো? না অবচেতনে ওঁত পেতে থাকা ইচ্ছেগুলোর হাত ধরে এলাম? সাঁকোতে পা রাখতে না রাখতেই নাভির নীচে এক ধুকধুকুনি অবিরাম হাতুড়ি পেটাচ্ছে—কী যেন গোল, চাকা। পঞ্চভৌতিক তত্ত্বে জ্বলে ওঠা কী যেন একটা। ইস। গন্ধ-স্পর্শ-স্বাদের অতিসংবেদী হাজারও ইন্দ্রিয়জ রসনায় সে আমাকে লেহন করতে শুরু করেছে। আর, আর আমার ভিতরেই ফুলে স্ফীত হয়ে উঠছে এক নোনা জলের হৃদ—আর সেই জলের বিছানায় খলবল করে উঠছে একটা ছোট্ট গোলাপি রঙের মাছ… যতই ধিকধিক করে সন্তর্পণে এগোচ্ছি একাকীত্বের এই সাঁকো বেয়ে, যতই উথলে উঠছে সেই নোনা হৃদের জলরাশি, যতই উচ্ছল ছলছলতায় সেই জলমালায় ঢেউ খেলে উঠছে সেই জীবন্ত মাছ—ততই আমি হয়ে যাচ্ছি শীতল। বরফের মতো ঠান্ডা এবং অবশ। কারণ ঘূর্ণির সেই আর্তরবে তাকেও তলিয়ে নিয়ে যাবে বলে, হার্পির ছানারা তাকেও খুঁটে খুঁটে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে বলে, তামি অতল অভ্যন্তরের শেষ আর্দ্রতায় কেঁপে উঠেছি…
ওহ্!! কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! এই সাঁকোর উপর পা রেখে আর কেউ কি এমন ভয়ে হিম হয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ! আনন্দ আর উত্তেজনায় পাকা ডালিমের মতো ফেটে যাওয়া দেখেছি। তেমন ভয়ের ছানাগুলো কেন চিৎকার করে তোর ভেতরে? কেন তোর ভেতরে বারে বারে জেগে ওঠে হার্পির শাবক? কবে প্রথম জেগে উঠেছিল এই হার্পির শাবক?
জানি—কোন্ সন, কী বার ছিল সেই দিন। সে-ছিল একটা অতীব পুরনো দিন। তখন সময় একেবারেই অন্যরকম ছিল হে। দিন দুপুরেই খিড়কি দুয়ারে হুড়কো, দরজায় খিল দিতে কেউ শেখেইনি। কারণ, সময়গুলো ছিল নির্বিকার, নিশ্চিন্ত। নিরাপদ কহলের ওমে বোজা দুটি চোখ যেন। বস্তুত—চারপাশ ঘেরা পাহাড়গুলো, সারি সারি শাল-সেগুনের ফাঁকে গড়িয়ে আসা বাতাস, হাজারও নক্ষত্রখচিত ঝকঝকে আকাশখানি, দূর থেকে ভেসে আসা কাশ্বারাতি, দোতারার সুর আর শৃগাল-হুতুমের সমবেত সংগীত—এ সমস্তই সময়কে এক নিরাপত্তার নরম গালিচায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। তারই ছায়ায় ঢাকা ছিল আমাদের ঘর, তার উঠোনেই আমরা নিশ্চিত মনে হেসে-কেঁদে, হই-হুল্লোড় করেছি। হঠাৎ ওটা কীসের গমগম আওয়াজ? বাঁশঝাড়ে আগুন লাগর ফটফট শব্দ, একপাল গরুর হাম্বারব আর ঘোড়ার চিঞিহির সঙ্গে বাবার নিকট চিৎকার! আমড়া, সজিনা, তিতাচাপে গিজগিজ করা আমাদের বাগানের কোনার গরু-ঘরটি, দাউদাউ করে জ্বলে উঠল! খুটাগুলোর চারদিকে পাক খেয়ে খেয়ে কাজলি আর কান্তা গাইদুটি অসহায় ভাবে মাথা ঝাপটাচ্ছিল, পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ লেপটানো বাতাসে লকলকিয়ে উঠল একট জ্বলন্ত আগুনের দলা—কাজলি গাইয়ের ধবধবে সাদা বাচ্চাটা পুড়ে একসা! গরু ঘরের পাশে ঝকঝকে ফুটে থাকা কাপাস খেতের তুলোগুলো হয়ে যাচ্ছিল এক-একটি জলন্ত আগুনের পিণ্ড। কৃষ্ণবর্ণ আকাশের সেই আঁধার রাতের ক্যানভাসে, দাউদাউ জ্বলে ওঠা অমন অজস্র অগ্নিপিণ্ডের কাপাসগাছগুলো যেন রূপান্তরিত হয়ে গেছিল এক একটি অতিকায় দীপাধারে। যেন বিধ্বংসের সেই যজ্ঞের জন্যই প্রজ্বলিত হল সেই সারি সারি দীপাধার! ওহ! বিধ্বংসের অমন অবিস্মরণীয় রূপের সঙ্গে সেই আমাদের প্রথম সাক্ষাত। এমন সময় যোশেফ বর্লোকা হাঁপিয়ে-ঝাঁপিয়ে দৌড়ে এসে বাবাকে বললে,“ ওই পাহাড়ের ঢালু বেয়ে যেন কাদের দু’জনকে ধুপধুপিয়ে নেমে যেতে দেখলাম…”
আমাদের গরু ঘরটি পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া ঘটনাটি ছিল অনাগত দিনে নিরন্তর সংঘটিত হবার একটি অন্তহীন নাটকের প্রথম আখড়া। প্রকৃতপক্ষে, গোয়ালঘরের ভগ্ন স্তূপটি ছিল, আমাদেরকে দেওয়া, সেই নাটকের সূত্রধরগণের একটি প্রতীকী নির্দেশ, চিরদিনের জন্য অমাদের এই পাহাড় ছেড়ে চলে যাবার। তাদের মতে ওই পাহাড়ে আমাদের কোনো মালিকানা স্বত্ব ছিল না। মালিকানা স্বত্ব স্থির হয় জন্মের অধিকারে—হৃদয়ের অধিকারে নয়। সেই প্রতীকী সূচকগুলির অর্থ পাঠোদ্ধার করার সঙ্গে-সঙ্গে, হ্যাঁ, সঙ্গে-সঙ্গেই, ডানায় ঘন অন্ধকারের ঢেউ তুলে নেমে এল হার্পি—বুকের ভয়াতুর খোঁদলে বাসা বেঁধে নিরিবিলি বসল–একটা ডিম পাড়ল—আর সেই ডিম ফুটে দপদপিয়ে উঠল হার্পির প্রথম শাবক। হ্যাঁ তখনই, ঠিক তখনই জন্মাল ভয়ের প্রথম শিশু! আর আমরা চিরদিনের জন্য হারালাম আমাদের পাহাড়গুলো— আমাদের সুতিকাঘর, আমাদের ভিটে, সত্তার ভূমি। কখন–কোথায়–কীকরে নিশ্চিন্ততার সেই চাদরখানা সন্দেহের ইঁদুরে কেটে কুটিকুটি করে ফেলল! কখন–কোথায়–কীভাবে প্রেমের শয্যায় ঘৃণার আর জিঘাংসার ছারপোকাগুলো হুল ফোটাতে শুরু করল—আমরা টেরই পাইনি গো! তারপর? হুম—তারপর থেকে হারিয়ে যাওয়া সেইসব পাহাড়, ঝিল্লির ডাক, দোতারার সুর আর মৃত তারার মরা লাশগুলো কাঁধে বয়েই ফিরছি—ফিরছি খোঁদলে বাসা বেঁধে থাকা হার্পির ছানাগুলো নিয়ে। বয়ে বেড়াচ্ছি সেইসব চোখের স্মৃতি—লাল আংড়ার মতো সেইসব চোখের স্মৃতি। কারা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল এই সব লাল আংড়া? কারা? তারাই নাকি আমাদের আগে যারা এই পাহাড় বেয়েছিল? তারাই, আমাদের পূর্বজ যারা—তারাই অবিশ্বাসের পাথর ঘষে ঘষে সেইসব আগুন জ্বালিয়ে গেল নাকি? পাহাড়ের বাঁকে, ফেলে রেখে গেল, তাদের ভোগ করা নিষিদ্ধ ফলের বীজ আর অজস্র পাপের গুটিকা? সেইসব গুটিকা গজিয়ে, বেড়ে, বিস্তৃতিতে দূষিত করে ফেলল নাকি আমাদের পাহাড়গুলো? তার পবিত্র আলোরাশি? য়ু-লেই-শ্যেইলঙের আত্মা রক্ষা করে চলা সেই পাহাড়গুলো আলোকময় করে তোলা সেইসব ফুটফুটে সাদা গোলাপি চেরি ফুল! বিলাতি নরাবগরি এবং সুমিষ্ট নাশপাতিগুলো! কোথায়—সেই গাছগুলো তো এসেছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে। অথচ কীভাবে নিমেষে আপন করে নিয়েছিল পাহাড়গুলোকে। আমাদের পূর্বজগণ হতে পারল না, একটা চেরি ফুল? নরাবগরি বা নাশপাতি? পিতা–প্রপিতামহদের পাপের বোঝা আমরা লাভ করি উত্তরাধিকারসূত্রে। যেভাবে আদি মাতা ইভের পাপের বোঝা আজও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি… উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করা এ সকল পাপের বোঝা তোর কাঁধেও নিক্ষিপ্ত হল বুঝি? লাল আংড়ার মতো সেই চাহনি তোকেও লেহন করবে নাকি? আশঙ্কায় আমার ভিতরেই, আরও একটা ডিম ফোটে, আরও একটা ভয়ের শিশু জন্মলাভ করে। হার্পির শাবক! কারণ—ঘৃণা সংক্রামক–ভয়ের মতোই। পার্থেনিয়ামের মতো খুব সহজেই অতি দ্রুত বেড়ে ওঠে ঘৃণার বীজ। এবং বিষাক্ত পানার মতো ছেয়ে ফেলে জলের স্বচ্ছ উপরিস্তর। কত দেখলাম—বিষাক্ত পানায় ছেয়ে-ফেলা পুকুর—ঘৃণার আবর্জনায় বুজিয়ে ফেলা একটা জীবন্ত ভরলু। কোথায় যেন দেখেছি? পল্টন বাজার বাসস্ট্যান্ডে কুঁকড়ে পড়ে থাকা সেই কালিঝুলি মাখা শরীরগুলোয়? ওদের কোনো একজনের মৃত ঠোঁটে একটা যে ভাত আটকে ছিল! নাকি রিখটার স্কেলে লাতুরের ভূমিকম্পের চেয়েও তীব্র কম্পনে নেমে আসা মাড়ওয়াড়ের সেই রাতের রেলের ভূমিকম্পে? এক ঝাঁক হতচকিত চোখের সামনে ত্রিশূলধারিরা আচমকা ছ্যাঁচড়ে নিয়ে রেলের ধাতব পাতে আছড়ে পিষে ফেলা হামিদ ভাইয়ের শরীরের সেই থপথপে লাল মাংসপিণ্ডে??? একটা থকথকে লাল মাংস, মাংসপিণ্ডে পরিণত হবার একটু আগে হামিদ ভাই ওদের দিকে এগিয়ে দেওয়া আখরোট আর বাদাম চিবিয়ে চিবিয়ে সেই ত্রিশূলধারিরা লাফিয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকার রাত্রির গহ্বরে। মাড়ওয়াড় পার হয়ে সেই রাতের রেলগাড়ি অন্ধকার চিরে চলে যাচ্ছিল এক অনিশ্চিত স্টেশনের অভিমুখে। এবং সারাটা পথ হার্পি বিছিয়ে গেল একটি-দুটি-অসংখ্য ভয়ের শাবক… ওরে, রাতের সেই রেলের মতোই যেন ভয় আর শংকার অজস্র অন্তহীন কামরায় এখন ভরে গেছে আমাদের জীবন… ভয়, আপন পাহাড় ও নদীগুলো চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলার ভয় লাল আংড়ার মতো দৃষ্টি না লেহন করে ছাই করে ফেলে! চারদিকে ক্রমে বেড়ে আসা অলঙ্ঘনীয় দেওয়ালগুলোর ভয়—আর এই সকল ভয় তোর ভিতরে সংক্রমিত হওয়ার ভয়। আহ্! যেন এখনই ভয়ের শাবকগুলো তোকে জাপটে ধরবে! যেন এক্ষুনি হার্পি তার সবচেয়ে বৃহৎ ডিমে তা দিতে বসবে—যেন ডিম ফুটে জন্মাবে সবচেয়ে অতিকায় ভয়ের শাবক!
—সবচাইতে বৃহৎ ভয়ের শাবক? কী সেটা? কোথায় গজিয়ে ওঠে তার বীজ? কে কর্ষণ করে তাকে?
—সবচেয়ে বৃহৎ ভয়ের শিশু জন্মে মানুষেরই নির্ধারণ করা দেহজ সারাৎসারে। কোনো ঊর্ধ্ব দৈহিক চেতনার আঙিনায় নয়। তাকে সার-জল-বাতাসের যোগান ধরে কতকগুলো গতিহীন প্রাচীন চিন্তার সূত্র। মরা নদী-উপনদীর রূপ নেওয়া এই ধারাই শিশুটিকে আধার দেয়, তাই খেয়ে পোক্ত হয়ে ওঠে তার কায়া… আচ্ছা বল তো—সত্তায় কোনো পরিমাপক দণ্ড থাকে কি? এবং দেহ কি হতে পারে নাকি, সেই সত্তার পরিমাপক দণ্ড? না। সত্তার কোনো দেহ, কোনো লিঙ্গ থাকে না। কিন্তু পৃথিবীর মঞ্চে যখন সত্তা দেহজ পোশাক পরে প্রবেশ করে, তার অবস্থিতি নিরূপণ করে লিঙ্গ। আত্মার ওজন নেওয়া হয় দেহ দিয়ে ! হ্যাঁ— কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! দেহশিল্পের তত্ত্বে নির্মিত হয় সত্তার অবস্থিতি—দেহজ পরিমাপে মাপা হয় সত্তার উচ্চতা… যদি… যদি তোর শরীরও মঞ্চ প্রবেশকালে পরিধান করে নেয় আমারই দেহজ অনুরণনকে? যদি তোর শরীরেও গজিয়ে ওঠে দুটো ন্যাশপাতি? একটা শঙ্খফুল? হে ঈশ্বর! তখন আমার মতো তোকেও হাঁটতে হবে নাকি সেইসব অসূয়া পথে-পথে? তোর শরীরেও বেয়ে উঠবে নাকি সেইসব চাঁটালি? তোরও পথে ওঁত পেতে থাকবে নাকি সেইসব অজস্র দেহজ প্রলোভনের গহ্বর? আর একদিন—একাকীত্বের এই সাঁকোয় পা রেখে আমার মতো, তুইও শীতল হয়ে পড়বি নাকি!!!… এখন আমি কী করি? ভয়ের এই শিশুদের আর্দ্রতা থেকে কী করে তোকে রক্ষা করি? কীভাবে?
—আমাকে রক্ষা করার জন্য, আর্ত চিৎকারের ওই ঘূর্ণি থেকে, আগে তোকে নিজেকে মুক্ত হতে হবে। দেখছি—ক্রমশ শীতল হয়ে যাওয়া তোর শরীর—কোনোদিন রোদ স্পর্শ না-করা পাথর তলের ঘাসের মতো ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে তোর মুখ। এই শীতল শরীরে—এই চিপসে মুখে তুই কী করে রক্ষা করবি আমাকে? তোর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের বীজাণুগুলো আক্রমণ করবে বলে কি তোর ভয়? তোর ভিতরেও তো দেখছি কিলবিল করছে ভয়ের অজস্র বীজাণু! কেন তুই লালন করছিস ওদের? কেন বয়ে বেড়াচ্ছিস কেবল ভয়ের স্মৃতি? ভয়ের শাবক? … এখন তুই এই সাঁকোর উপরে–চেতনার জলস্রোতে চেয়ে দেখ, একবার নিজের ভেতরটাকে—বিরাট গভীর অন্ধকার নাদের ভিতর ঝুঁকে দেখে যেমন। দেখছিস– অজস্র অতিসংবেদী অনুভূতির তারে, তুই কেমন ঘনঘন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিস। তোর ইন্দ্রিয়জ চেতনা হয়ে উঠেছে তীক্ষ্ণ—ক্ষুরধার। সবই বিশুদ্ধ, খাঁটি—মৌল সারাৎসারে তুই চেতনার আদিম স্তরের প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান হয়েছিস। নাহ্—এটা কোনো মিস্টিক ফেমিনাইনের সংজ্ঞা নির্মাণের প্রয়াস নয়—না কোনো শরীরী রহস্যবাদীতার আচ্ছাদন—অথচ ফুঁ-মেরে উড়িয়ে দিতে পারার মতো নিছক হরমোন নিঃসরণের একটা ব্যাপারও নয়। তাহলে এগুলো কী? হুট করে বিশ্লেষণের চশমা জোড়া খুলে কেবল অনুভব কর, বিচিত্র এই সকল অনুভূতি–ভাবনা–ভঙ্গিমা—যা ক্রমশ তোকে আচ্ছাদিত করে ফেলছে… হ্যাঁ, বাছা বাছা মহিমামণ্ডিত শব্দে মিস্টিফিকেশনের আভরণোত্তীর্ণ এই সমস্ত প্রক্রিয়াকে, কেবল আনন্দ আর গৌরবের বর্ণনাই দেওয়া হয়। সেই গ্লোরিফাইড শব্দগুছেচ্ছর আবরণ ভেদ করে দেহমনের সংগোপনে ক্ষণে ক্ষণে ভকভকিয়ে জ্বলে ওঠা জ্বালার কণ্ঠস্বর—জলের ডোঙায় ভেসে ওঠা ফাঁপাফোলা যন্ত্রণাদগ্ধ আঙুলগুলোর অবশ আর্ততা—দ্বিতীয় অস্তিত্বে আগ্রাস করে নেওয়া প্রথম অস্তিত্বের অনুচ্চ গোঙানিগুলোর শব্দ শোনা যায়, তবুও—হ্যাঁ, তবুও সেইসব গোঙানি, সেইসব দগ্ধ ডাকের দুয়ার টপকে একবার অনুভব করে দেখ—অতি সক্রিয় হয়ে ওঠা তোর ইন্দ্রিয়জ–অতীন্দ্রিয় চেতনায় অনুভব কর–কীভাবে সরস হয়ে উঠেছে সকল স্পর্শানুভূতি—কীভাবে বেড়ে চলেছে, তোর ক্ষুধা—আগ্রাসী জিহ্বার লালা। দূর রাজপথের পাশে দেয়ালের তলায় ডোঙা–বাঁধা প্রস্রাবের গন্ধ, অথবা নিশিগন্ধার মৃদু সুবাস—এই গন্ধগুলোর এক অনায়াস তাৎক্ষণিক স্কেভেঞ্জার হান্টের জন্য, এই তো তুই সিদ্ধহস্ত হয়ে পড়লি—মাওফ্লাঙের শ্যাওলা ধরা শিলার গায়ে গালখানা আবারও একবার ঠেসে ধরবার জন্য, তুই উদ্গ্রীব—এবং তুই উদ্বেল হচ্ছিস কুমোরের চাকায় পেরা মাটির সরাগুলো চিবোতে আগুনে পোড়া ভরণশীল তাদের মিশমিশে গন্ধটা নাকে শুঁকতে। আসলে এইসব অনন্য স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ তোকে জীবনের সেই অনন্য ঠিকানার বার্তা দিচ্ছে–যাকে তুই ভুলে গেছিস—যার সন্ধান তুই কোনোদিন করলি না। এটাই জীবনের সারাৎসার। জীবনের সত্য। জীবনের অ্যান্টিবডি—যে অ্যান্টিবডি দিয়ে জীবনের ভয় এবং শঙ্কার বীজাণুগুলোকে প্রতিহত করতে পারি। একবার মন দিয়ে শোন। শুনছিস–সেনাগুলো শিবির গেড়েছে, তোর পঞ্চভৌতিক জিহ্বায়, চোখে, চামড়ায় স্তনচূড়ায়। ওদের তাঁবুর নিশান আধিভৌতিক আকাশ ধেয়ে কাপছে… এখন বোধের আলোর মশালে চেতন ও স্মৃতির আঁধারগুলো মাড়িয়ে খুঁজে আন জীবনের খনিজ—স্মরণ কর সমগ্র শুভ পবিত্র-সুন্দর-স্বাদ-স্পর্শ-গন্ধকে যা তিলে তিলে গড়ে দিয়েছিল জীবনের সত্যকে। স্মরণ কর রংপ্লিমপ্লামের সেই পাকা আমড়ার গন্ধ, কাথার গাঁওবুড়ার বাগানের সেই সুমিষ্ট সরস আঙুরগুলো… মনে পড়ছে? মনে পড়ছে মাথায় কচুপাতা ধরে ভিজে সপসপে হয়ে মৌলবী নানার গাঁয়ে যাওয়ার সেই বৃষ্টিমুখর দুপুরবেলার কথা? মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা লাল সুতোয় মেপে মৌলবি নানার কল্যাণ-খোঁজার কথা? চোখের পলকে যে-সুতো ছোটো হয়ে গেছিল—আর নানা মন্ত্র পড়ে পড়ে গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল দুটো তামার মাদুলি এবং গোবর-লেপা সাফ মেঝেতে নানির বেড়ে দেওয়া সেই অ্যানামেলের দু-থালা ভাত! পাঁঠার মাংসের সেই ভুরভুরে গন্ধ! আর আর ফতেহগঞ্জের সংকীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে ঝুপড়িটার মেঝেয় বসে শ্রীলংকার সেই রিফিউজি তামিল যুবকের পড়ে যাওয়া কবিতার সারিগুলো—“We are not the first one who have wept by the sea”—কেরোসিন তেলের স্টোভ ফুইয়ে-ফুইয়ে অহিলন পাকিয়ানাঠনের আম্মা যে সেই ঝুপড়ির কোণে সুস্বাদু পায়েসম্ রেঁধেছিল। মনে পড়ছে?… বিশুদ্ধ অস্তরে আমাদের হাতে তুলে নেওয়া রুটির টুকরোগুলিই জিশুর, আমাদের পিপাসার জলই হচ্ছে জিশুর পবিত্র রক্ত। জীবনের সকল পবিত্র, বিশুদ্ধ ভাবনার খাদ্যে সৃষ্টি এই রক্ত এবং দুধই মানুষকে সিঞ্চন করে, লালন করে। এবং রক্ষা করে শয়তানের কালো চোখ থেকে। জৈন-বৌদ্ধ সাধুদের একসঙ্গে পান করা চায়ের পাত্রে ঝলমলিয়ে ওঠে বোধিসত্ত্বের প্রতিমাকল্প। চা-দোকানের নীরব মেঝেতে উতলানো সেই চায়ের লৌহ-নির্মিত কেতলিটার ছন্দোময় ধ্বনিতেই তারা শুনতে পায়, বিদ্যুতে ঘর্ষণমুখর মেঘের গর্জন, সাগরপারের পাথরের বুকে মাথা আছড়ানো তরঙ্গরাশির কলরব—অথবা পাহাড়ের ঢালুতে মাঝরাতে বেজে ওঠা শ-শ পাইনের শিধ্বনি… তাহলে তুই কেন বারে বারে শুনিস হার্পি-শাবকের আর্তি? কোনো প্রিয় গানের স্মৃতি কি তোর নেই? নাকি হার্পির আর্তিতে কান উজিয়ে থাকতে থাকতেই একমাত্রিক হয়ে গেলি তুই। আর সব শুভ শব্দ ও গান—সবকিছু তোকে পরিত্যাগ করে, তোর সত্তার গণ্ডির বাইরে চলে গেল। এখন তুই সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে আবারও তাদের স্মরণ কর—তোর সমস্ত ইন্দ্রিয়জ, অতীন্দ্রিয় চেতনায়—নাম জপে ডাক ওদের এবং গোধূলিতে গোয়ালে ফিরে আসা আপন গরুগুলোর মতো আবারও ফিরিয়ে আন সত্তার গোয়াল-গণ্ডিতে… শুনতে পাচ্ছিস, ওদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিস?
—শুনছি। সে অনেকদিন পরে, বাবার কথা শুনতে পাচ্ছি। ঠাকুরঘর থেকে ত্রিসন্ধ্যা সেরে এসে সেইদিন সন্ধেবেলা বাবা বলেছিল—মা, মন্ত্রোচ্চারণ কেবলমাত্র আচরণবিধি নয় রে—এ হল কথোপকথন। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার। সূক্ষ্ম চেতনার সঙ্গে স্থূল সত্তার। ভূমির সঙ্গে ভূমার। কাবা ও প্রজ্ঞার এক একীভূত সংজ্ঞার বিরল মুহূর্তে, অথচ নিভাজ আনন্দ আর রহস্যময় চৈতন্যের আবেগঘন ক্ষণে, মানুষ এমনই কথোপকথনে নিমগ্ন হয়। তখনই সৃষ্টি হয় মন্ত্রের—যে মন্ত্রের বীজ নিহিত থাকে শব্দে, শব্দের শক্তি— নাদব্রহ্ম!… ওরে… এই একাকীত্বের সাঁকোয় পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে হলে আমাকেও মন্ত্র জপতে হবে—সংলাপের মন্ত্র। সেই মন্ত্র-ঝেড়ে তাড়িয়ে দিতে হবে শাবকগুলোকে। জানি, ফুটো চালাঘরের ততোধিক ফুটো বেড়াকে গোবর মাটিতে লেপে ঢেকে রাখার মতো, আমরাও কখনও শব্দবিভ্রমের জাল বুনি এবং ঢেকে রাখি বাস্তব সত্যের রূঢ়তাকে। আর সৃষ্টি করি সত্যের অপলাপ করা কিছু মিথ্যা মন্ত্র। কিন্তু আঁধার মুহূর্তগুলোতে পাকঘূর্ণি খেয়ে ফিরতে-ফিরতে, নিভৃত ওই আলো ছাড়া আর কে আমাদের সাথী হতে পারে, যে আলো গলে আসে বোধ ও বিশ্বাসের শব্দ থেকে—একদিন তুই হয়তো আমার ডাক শুনতেই পাবি না—আমার আঙুলের ফাঁকে তোর জন্য গজিয়ে ওঠা অদৃশ্য সূত্রগ্রন্থি তোকে পরে আর টানবেই না—পৃথিবীর নির্দয় ম্যানহোলগুলোতে খসে না পড়ে—কঠিন ও কণ্টকাকীর্ণ ফুটপাত ধরে যেতে যেতে তুই হয়তো ভুলেই যাবি, আমাদের এই নিবিড় গোপন কথামালার অনুচ্চ শব্দগুলি… তবুও—যদি কখনও-বা ঘুরে দাঁড়াস, জীবনপথের মাঝখানে—এবং যদি কোনো বিপথ তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকে—কী ঠিক, শোনা না-শোনা এই অনুরণনই হয়তো তোকে পেছন থেকে খামচে ধরবে–আর যদি হার্পির শাবকগুলি ফুসলিয়ে নিয়ে যায় তোকে–কী ঠিক, হয়তো আমার এই নিঃস্ব কণ্ঠস্বরের অস্ফুট ধ্বনিই তোকে হাত ধরে টেনে আনবে, আর্তির সেই ঘূর্ণি ছাড়ায়ে!
।। অনুবাদকের দেওয়া টীকা ৷৷
১. কাশ্বারাতি : দক্ষিণ ভারতীয় লোকসংগীত বিশেষ
২. ফ্লু-লোই শ্যেইলং : শিলঙের প্রাচীন নাম
৩ নরাবগরি : এক ধরনের বুনো কুল জাতীয় টক ফল বিশেষ।
৪. ভরলু : অসমের গুয়াহাটি শহরের বুক চিরে প্রবাহিত মৃত নদী, যা বর্তমানে নর্দমার সামিল।
৫. মাওফ্লাং মেঘালয়ে অবস্থিত একটি অরণ্য অঞ্চল।
৬. রংপ্লিমপ্লাম: অসমের কার্বি আংলং জেলার একটি প্রত্যন্ত দুর্গম আরণ্যক স্থান।
৭. কাথার গাঁওবুড়া: কাথার হল কার্বি জনজগোষ্ঠীর মানুষের উপাধি। যেমন— টেরন, ইংতি। আর গাঁওবুড়া হল গাঁয়ের সরকারি মুরব্বি।
৮. হার্পি: অতিকায় পাখি বিশেষ। শঙ্কা ভয় ধ্বংস আদির প্রতীক।