সিদ্ধান্ত – অনন্যা বন্দোপাধ্যায়

সিদ্ধান্ত – অনন্যা বন্দোপাধ্যায়

শেয়ার করুন
এই সময়টায় অফিসে প্রচন্ড প্রেশার থাকে ।একটা স্লট থেকে অন্য স্লটে চেঞ্জ হওয়ার সময়টুকু ডেস্কের কর্মীদের চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে ফেলে রাখে । তার সাথে বিজ্ঞাপন সব কিছু নিয়ে প্রায় নাজেহাল অবস্থা ।
এমন সময়েই  মোবাইল ফোন টা ল্যাপটপের পাশ থেকে গেয়ে উঠলো “আলোকের এই ঝর্ণাধারায়” । রিনি চট করে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে ফোনের ডিসপ্লেতে  ভেসে উঠছে কল্পনা মুখার্জী । নিমপাতা গিলে চিবানোর মত মুখ করে আবার কাজে ডুবে গেলো সে।
একে তো প্রতিদিনের ব্যস্ততা তার সাথে আজকাল আবার যুক্ত হয়েছে এই দিন , ওই দিন এবং তার প্রেক্ষিতে টি আর পি বাড়ানোর যত রকম অদ্ভুত অদ্ভুত শো এর চাপ । আজ আটই মার্চ , নারী দিবস , যত ফেমিনিস্টদের উৎসব ।
এসব ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই কাজ করে যাচ্ছিল সে, আবার মোবাইল টা গেয়ে উঠতে কর্মধারায় বিচ্ছেদ পড়ে গেলো । স্ক্রীনে সেই একই নাম । অফিসে বেরিয়ে এসে যেটুকু খোলা হাওয়া সে পায় সেটুকুও কি রাখতে দেবেন না এই মহিলা ? যাই হয়ে যাক না কেন ওনার ফোন ধরবে না কোনোমতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রিনি উঠে পড়লো নিজের চেয়ার থেকে।
অফিসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে  স্লেট রঙের ব্যস্ত কলকাতা দেখতে দেখতে হঠাৎ ই মাথায় আলতো টোকা|
ওর বন্ধু আবির দাঁড়িয়ে আছে , হাতে ওর মোবাইল । “কি রে কখন থেকে তোর ফোন বেজে যাচ্ছে একটানা, তোর শাশু মা বোধ হয় আজ খুব মিস করছে তোকে । …নে, ধর” বলে ফোন টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো ।
বিয়ের পর থেকেই দেখে শুনে পছন্দ করে আনা মেয়েকে ঠিক নিজেদের স্টেটাসের সাথে মেলাতে পারেন নি বলে আক্ষেপের শেষ নেই শ্বশুর শাশুড়ির । বর নামক যে অপরিচিত মানুষটিকে ভরসা করে এসেছিল ধীরে ধীরে দেখেছিলো সেও কেমন ভিন গ্রহের ।
বিখ্যাত পরিবারের বউ এর তকমা দিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ওর নিজস্ব জগৎ । ওর গান , ওর প্রেম , ওর পূজা । শুধু আভিজাত্যের আবরণে দামি শাড়ি , গয়না , অভিজাত গাড়ির গন্ধে পা ফেলা । ভালো লাগতো না কোনদিন ই রিনির , সে এড়িয়ে যেতো আর এখান থেকেই শুরু সমস্ত গল্পের ।
প্রথম যেদিন ভিতরের চাপান উতোর সামনে এসেছিলো সেদিন টা ছিলো ওর বাবার জন্মদিন , সকাল থেকেই উশখুশ করছিলো বাবার কাছে যাওয়ার জন্য , বাড়িতে বেশ কয়েকবার বলেওছিলো কিন্তু রাতে ক্লাবে শাশুড়ির বান্ধবীর কিটি পার্টি থাকায় তাকে আটকে দিয়ে বলা হলো “এতদিন তো বাবার জন্মদিনে তো নাচানাচি করেছ, এখনও কি এমন আদিখ্যেতা দেখানোর আছে?”
খুব অপমানিত হয়েছিল, আর সব থেকে খারাপ লেগেছিলো ওর বাবার জন্য । সারাদিন আজ মা বাবা দুজনেই অপেক্ষা করে রয়েছে ওর জন্য ।
চিৎকার করে বলতে না পারার ব্যর্থতা কুড়ে কুড়ে খেয়েছিল ওকে। এর পর চলতে থাকে টুকিটাকি সবেতেই নানারকম অপমান।
এভাবে চলতে চলতে একদিন নিজের যোগ্যতা কে কাজে লাগিয়ে একটি নামী মিডিয়া হাউজে চাকরিতে ঢোকার সময়েই ফের শুরু হয়ে গেল শ্বশুর শাশুড়ি এবং বরের অকথ্য অপমান ।
হাতে পাওয়া নতুন স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেনি । ঘরের বউ হয়ে নিজের নারীজন্মকে বিড়ম্বনায় পড়তে দেয় নি রিনি , অপমানের যোগ্য জবাব দিতে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এসেছিলো নিজের নতুন পিজি তে । জেলার মফঃস্বলে থাকা মা বাবা কে ভরসা জুগিয়েছিল। এ সব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেলো ছোট্ট একটা কাজ বাকি । আবারও বাজতে থাকা মিসেস কল্পনা মুখার্জীর ফোন কেটে দিয়ে ছোট্ট করে আঙ্গুল ছোঁয়াল কি প্যাডে অফিসেরই এক কোলিগের দেওয়া নতুন নাম্বারটি…
তারই এক পরিচিত ল’ইয়ার এর ।
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২