শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা – এল. বীরমঙ্গল সিংহ
রবীন্দ্রনাথ যে মণিপুরি নৃত্যকে বৃহত্তর পরিচিতি করিয়েছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে রবীন্দ্রনাথের মণিপুরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেনি। মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা উপাখ্যান হয়তো কবিকে মণিপুর সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছিল। তাই ১৮৯২ সালে কবির লেখনীতে উঠে এল ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্য। ১৯৩৬ সালে এটাকে আবার তিনি নৃত্যনাট্য রূপ দিয়েছিলেন। তাছাড়া মণিপুরের তৎকালীন পলিটিক্যাল এজেন্ট স্যার জেমস জনসন ‘নাইন্টিনথ সেঞ্চুরি’ পত্রিকায় মণিপুরের যে বর্ণনা লিখেছিলেন তা পড়ে হয়তো বা কবির মানসপটে মণিপুরের একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছিল। তাই তিনি ১২৯৮ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ সংখ্যায় মণিপুর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “…স্থানটি রমণীয়। চারিদিকে পর্বত, মাঝখানে একটি উপত্যকা, বাহিরের পৃথিবীর সহিত কোন সম্পর্ক নাই। ভূমি অত্যন্ত উর্বরা, মানুষগুলি সরল এবং উদ্যোগী, রাজকর নাই বলিলেই হয়। রাজাকে কেবল বরাদ্দকৃত পরিশ্রম দিতে হয়। যে শস্য উৎপাদন হয় আপনারাই সম্বৎসর খায় এবং সঞ্চয় করে। বাহিরে পাঠায় না, বাহির হইতেও আমদানি করে না। …”
পরবর্তীকালে ত্রিপুরা ও সিলেটে মণিপুরি নৃত্য ও হস্তশিল্পের কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। যার পরিণতিতে তিনি ত্রিপুরা, কাছাড় ও মণিপুর থেকে মণিপুরি নৃত্যগুরুদের শান্তিনিকেতনে ডেকে নিয়ে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা চালু করেছিলেন। মণিপুরি নৃত্যকলা সংস্কৃতিতে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালের শেষের দিকে মণিপুর ভ্রমণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু সেদিনের দেশীয় রাজ্য মণিপুরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিতে হত। দরবারের প্রেসিডেন্ট তথা ব্রিটিশের পলিটিক্যাল এজেন্ট রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে না দেখে রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন। কারণ ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশের দেওয়া ‘স্যার’ উপাধি তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাই দরবারের পরামর্শে সেদিন মণিপুরের রাজা চূড়াচান্দ রবীন্দ্রনাথকে মণিপুর ভ্রমণের অনুমতি দেননি। যার জন্যে পরবর্তীকালে চূড়াচান্দ মহারাজের কন্যা মণিপুরের বিশিষ্ট সাহিত্যিক মহারাজকুমারী বিনোদিনী দেবী বড়ই লজ্জা পেয়েছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে আশ্রমে থেকে পড়াশোনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রচুর গান তিনি মণিপুরিতে অনুবাদ করে নিজে গেয়েছেন ও অন্য শিল্পীদের দিয়ে গাইয়েছেন। তাঁর অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি নাটক মণিপুরের বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি পিতার বিরূপ আচরণের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন বলা যায়।
পৃথিবীর সর্বত্র বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রায় তিনশো বছর আগে মণিপুরি সমাজ চৈতন্যের ভক্তিবাদের প্রভাবে বৈষ্ণব ধর্ম দর্শনকে গ্রহণ করেছিল। তাদের চিরাচরিত লোকসংস্কৃতির সঙ্গে বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শের সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল মণিপুরি নটসংকীর্তন ও রাসলীলার। রবীন্দ্রনাথ আবার এই মণিপুরি নৃত্যকে মেলালেন তাঁর নৃত্যধারার সঙ্গে এবং মণিপুরি নৃত্যকে পরিচিতি ঘটালেন সারা ভারতে এবং ভারতের বাইরে সুদূর কলম্বোতেও। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজাদের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। মহারাজা বীরচন্দ্র ছিলেন নিজেই কবি। তিনি চারটি কাব্যগ্রন্থ ও দুটি গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রিয়তমা রানি ভানুমতীর অকাল প্রয়াণে শোকাহত বীরচন্দ্র ‘প্রেম মরীচিকা’ নামে এক শোকগাথা রচনা করেন। সেই শোকের সময় তিনি তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের সদ্য প্রকাশিত ‘ভগ্নহৃদয়’ (১২৮৮ বঙ্গাব্দ) কাব্যগ্রন্থ পড়ে তৃপ্তি পেয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতিমান তরুণ কবিকে অভিনন্দন জানাবার জন্য মহারাজা বীরচন্দ্র তাঁর ব্যক্তিগত সচিব রাধারমণ ঘোষকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। রাজার কাছ থেকে অভিনন্দিত হয়ে তরুণ কবিও আপ্লুত হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ যখন শেষবারের মতন ত্রিপুরা ভ্রমণে এসেছিলেন তখন আগরতলায় ‘কিশোর সাহিত্য সমাজ’ কবিকে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। সেই সভায় কবি মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য সম্পর্কে বলেন, “জীবনের যে যশ আজ পাচ্ছি, পৃথিবীর মধ্যে তিনিই (বীরচন্দ্র) তার প্রথম সূচনা করে দিয়েছিলেন, তাঁর অভিনন্দনের দ্বারা। তিনি আমার অপরিণত আরম্ভের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েই তখনি আমাকে কবি সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলেন” (রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ : ২৭২)। তবে কবি বীরচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাধাকিশোরের নিমন্ত্রণে প্রথম ত্রিপুরা ভ্রমণে আসেন ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৯০০ সালে) বসন্তকালে। সেদিন কবিকে মণিপুরি নাচের দ্বারা সম্বর্ধিত করা হয়েছিল এবং কবিও প্রথম উপভোগ করেছিলেন মণিপুরি নৃত্য। এ বিষয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা’ গ্রন্থে সত্যরঞ্জন বসু লিখেছেন, “কবির সম্বর্ধনা আয়োজন হইল পুরাতন কুঞ্জবনের সুউচ্চ টিলার শ্রী পঞ্চমী বসন্তোৎসবে (১৩০৬)। ত্রিপুরার আদিবাসীদের টঙ ঘরের নমুনায় সম্বর্ধনা মঞ্চ তৈরী হইল। মুলীবাঁশের তৈরি মঞ্চের গড়ন ও ফুল পাতায় সজ্জা পরিপাটি শিল্প শোভার নিদর্শন। মঞ্চের উপর হইতে নজর পরে চারিদিকে উচ্চ নীচ পাহাড়গুলি থরে থরে ঢেউ খেলিয়া দূর দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে—আকাশের নীল চন্দ্রতপ দিগন্ত রেখাকে চুম্বন করিয়া ঋতু উৎসবকে আরও কমনীয় করিয়া তুলিয়াছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেষ্টনকে আরও সম্বর্ধিত করিয়াছে দলে দলে নৃত্যগীতরত মণিপুরি শিল্পীবৃন্দ। নগ্ন গাত্র পরিধানে বাসন্তী রং এর কাপড়, লম্বমান বাসন্তী চাদর গলায়-মাথায় বাসন্তী রং এর পাগড়ী, খোল মন্দিরা করতালের সমতালে পদবিক্ষেপ ও দেহভঙ্গিমা দীর্ঘলয়ে কীর্তনের সুর এক মোহময় আবেশ রচনা করিতেছিল। …” (রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ : ১৫ ) বিশেষভাবে উল্লেখনীয় যে আগরতলায় রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষ্যে মহারাজের ব্যবস্থাপনায় ত্রিপুরার নৃত্যগুরুদের উদ্যোগে মণিপুরি নৃত্যধারা এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাল। বলা যায়, প্রতিটি মণিপুরি নৃত্য মন্দির কেন্দ্রিক ও ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সংবর্ধনায় সার্বজনীন মণিপুরি নৃত্য প্রদর্শনের ঘটনা সম্ভবত আগরতলায় প্রথম ঘটেছিল। সেদিনের এ ঘটনার কুড়ি বছর পর মহারানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স এলবার্ট ভারত ভ্রমণে আগমন উপলক্ষ্যে কলকাতায় ভারতীয় নৃত্য প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে মণিপুরি রাস প্রদর্শনের নিমন্ত্রণ পেয়ে মণিপুরের রাজা চূড়াচান্দ-এর নেতৃত্বে ১৫০ জনের এক নৃত্যদল মণিপুর থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিল। এটিই ছিল মণিপুর থেকে বহির্মণিপুরে প্রথম মণিপুরি নৃত্য প্রদর্শন। আজকের দিনে হয়তো এটা এক তাজ্জব ঘটনা বলে মনে হবে। সেই ১৫০ জনের নৃত্যদল গরুর গাড়িতে করে ইম্ফল থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। তখনকার আসামের ডিমাপুর রেল স্টেশন পৌঁছোতে তাদের চার পাঁচদিন লেগেছিল। এরপর তারা ট্রেন করে কলকাতা গিয়েছিল।
যাইহোক সেই অনুষ্ঠানে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নৃত্য পরিবেশনের পর মঞ্চে মণিপুরি রাসনৃত্য পরিবেশন করার জন্য বলা হলে উদ্যোক্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় মণিপুরি রাস মঞ্চে উপস্থাপন সম্ভব নয়। রাসমণ্ডপ তৈরি করে পূর্ণিমার রাতে প্রদর্শন করতে হবে রাস। পরদিন ছিল পূর্ণিমা। তাড়াহুড়ো করে একদিনে রাসমণ্ডপ তৈরি করে নাকি পূর্ণিমার রাতে রাতভর মণিপুরি রাসলীলা প্রদর্শন করা হয়েছিল। জওহরলাল নেহরু মণিপুর ডান্স একাডেমি, ইম্ফল কর্তৃক প্রকাশিত ‘গুরু হাওবম অতোম্বা সিংহ’-এর জীবনী গ্রন্থ থেকে এইসব তথ্য জানা গেছে। বলা বাহুল্য মণিপুরের তিন প্রবাদপ্রতিম নৃত্যগুরু মাইসনাম অমুবী, হাওবম অতোম্বা ও অমুদান শর্মার প্রচেষ্টায় কেবল চল্লিশের দশক থেকে মণিপুরি নৃত্য মঞ্চে উপস্থাপন শুরু হয়েছিল। যদিও এর বহু আগেই রবীন্দ্রনাথের সহযোগিতায় ত্রিপুরার নৃত্যগুরু ঠাকুর নবকুমার সিংহের উদ্যোগে বিশের দশক থেকেই কলকাতায় মণিপুরি নৃত্য মঞ্চে উপস্থাপিত হয়েছিল। উপরোক্ত গ্রন্থ থেকে আরো এক তথ্য জানা যায়—নৃত্যগুরু হাওবম অতোম্বার একক প্রচেষ্টায় মণিপুরের বাইরে বিশেষ করে আসামে মণিপুরি নৃত্য প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই নৃত্যগুরু ১৯২৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা দিয়েছিলেন। সেনারিক সিংহ, বিপিন সিংহ, সবিতা বেন মেহতা, ঝাবেরি বোন, রিতা দেবী প্রমুখ দিকপাল মণিপুরি নৃত্যগুরু ও শিল্পীরা ছিলেন তাঁর শিষ্য। মণিপুরের অন্যতম প্রবাদ-প্রতিম এই নৃত্যগুরু শিষ্য-শিষ্যাদের সঙ্গে নিয়ে বহির্মণিপুরে মণিপুরি নৃত্য প্রদর্শন করে টাকা রোজগার করছে এই অভিযোগ পেয়ে রাজার নির্দেশে সেদিনের গোড়া মণিপুরি ব্রহ্মসভা তাঁকে সমাজচ্যুত করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নৃত্যগুরু হাওবম অতোম্বাকে কর্মোদ্যোগ থেকে বিরত করাতে পারেননি। অবশেষে রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুরু অতোম্বাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে সমাজে তুলে নেন। ত্রিপুরার নৃত্যগুরুদের অবশ্য কোনোদিন এধরনের রাজরোষে পড়তে হয়নি। বরং মণিপুরি নৃত্যগীত প্রচার ও প্রসারে ত্রিপুরার রাজারা সর্বদাই তাঁদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ১৯০১ সালে (৭ই পৌষ ১৩০৮) ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পাঁচজন ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হয়েছিল। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কবি সঙ্গীত, অভিনয় ও চিত্রকলার চর্চাকে শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছিলেন। ইচ্ছে থাকলেও তিনি প্রথম থেকে নৃত্যকলা চর্চা শুরু করতে পারেননি। ১৯১৮ সালে (৮ই পৌষ ১৩২৫) মহাসমারোহে বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন হল। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষার প্রচলন শুরু করেছিলেন। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ মণিপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে শিলং হয়ে গুয়াহাটি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু মণিপুর প্রবেশের অনুমতি না পাওয়ায় তিনি গুয়াহাটি থেকে সিলেট ও আগরতলা হয়ে কলকাতায় ফিরেছিলেন। ৩০শে অক্টোবর ১৯১৯ প্রমথ চৌধুরীকে লেখা এক পত্রে কবি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “কাল আমি শিলং ছেড়ে গৌহাটি যাব— তারপর সেখান থেকে আমাদের মণিপুর যাবার কথা চলছে। তাহলে আরো দিন দশেক পরে আমরা ফিরব।” (রবিজীবনী ৭ম খণ্ড, পৃ : ৪৪২)।
১৯১৯ সালের ৫ই নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ সিলেট পৌঁছোন। ৬ নভেম্বর দুপুরে মাছিমপুর পরিদর্শনে যান। এ প্রসঙ্গে প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, “মণিপুরিদের বস্ত্র বয়ন নৈপুণ্য দেখে মণিপুরি তাঁতি ও তাদের জীবনযাত্রা দেখার উদ্দেশ্যে তিনি মাছিমপুর পরিদর্শনে যান। কলানিপুণ মণিপুরিরা পল্লীর প্রবেশপথে সারি দিয়ে কলা গাছ পুঁতে কাগজ কাটা ফুল-লতা-পাতা দিয়ে একটি সুন্দর তোরণ নির্মাণ করেছিল। মণিপুরি ছেলেদের রাখাল নৃত্য দেখার পর মেয়েদের নাচ রাত্রে দেখবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিকেল তিনটের সময় তিনি বাংলোয় ফিরে আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে (১৯৩৫ সালে) শান্তিনিকেতনের অন্যতম নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জী সেই রাখাল নাচের অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। সেখানেই কবির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। কবি খুশি হন নাচ দেখে। নগদ পাঁচ টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেন নীলেশ্বরকে।” (রবীন্দ্রনাথ ও মণিপুরি নৃত্য—পান্নালাল রায়, পৃ : ৬৯)।
১৭ই জুন, ১৯৩৬ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে নলিনীকুমার ভদ্র কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে সিলেটে মণিপুরি নাচ দেখার অনুভূতির কথা তিনি এভাবে ব্যক্ত করেছেন—“তুমি তো সিলেট থেকে আসচ। চোদ্দ পনেরো বছর আগে যখন সিলেটে যাই তখন দেখেছিলাম মণিপুরি নাচ। সে নাচ আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সুদূর কল্পলোকে, মনে জেগেছিল নৃত্যনাট্যের পরিকল্পনা, সে যেন আমার মনকে পেয়ে বসেছিল। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের মণিপুরি নাচ শেখাবার উদ্দেশ্যে ১৩২৬ সন থেকে ১৩৩৬ সন এই দশ বছরে তিন তিনবার ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সবসুদ্ধ ছয়জন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষককে আনিয়েছি শান্তিনিকেতনে। সম্প্রতি আছেন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষক নবকুমার। ‘নটরাজ’ অভিনয়ে প্রথম সংযোজন করলাম একটু অদলবদল করে মণিপুরি নাচ। মণিপুরি নৃত্যকেই ভিত্তি করে নাটকগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। নৃত্যনাট্যে যে বিশেষ রস সৃষ্টি করতে চাই তার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে মণিপুরি নাচ।” (নলিনীকুমার ভদ্র, যোগাযোগ—কবি প্রণাম)।
(পরবর্তী অংশ ওয়েবজিনের আগামী সংখ্যায়)