বাংলা থিয়েটার প্রথম দিন থেকেই শাসকের রোষানলের শিকার – সায়ন ভট্টাচার্য

বাংলা থিয়েটার প্রথম দিন থেকেই শাসকের রোষানলের শিকার – সায়ন ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

একটি স্বপ্নের স্থান হয়ে উঠছে ‘কলিকাতা’। রুজি রোজগারের এই আবাসস্থলেই ১৭৯৫ সালে ২৭ শে নভেম্বর বেজে উঠেছিল বাঙালি নাট্যপিপাষুদের জন্য প্রথম – থার্ড বেল। শহরের বাঙালি অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের দিয়ে প্রথম নাটক অভিনীত হয় , যে ইতিহাস বা বলা ভালো বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে সেই নাটকের নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই তখন। সেই নাটকের নাট্যকার কে? কী সেই নাটকের নাম? উনি কি কোনও বাঙালি? না, বাঙালি নন – একজন ইউরোপীয়, রুশ দেশিয় ভাষাবিদ, সংগীতজ্ঞ পন্ডিত গেরাসিম স্টেপানোভিচ্ লেবেদিযে়ভ্ । ভারত বন্ধু লেবেদিয়েফের হাত ধরেই বাংলায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়।

‘ক্যালকাটা গেজেট’ এর পাতা উল্টালে দেখা যাবে ৫ই নভেম্বর ১৭৯৫ সালের একটি বিজ্ঞাপননে লেখা আছে ‘দ্য ডিজগাইজ’ নামক একটি নাটক অভিনীত হবে – নাটকটি একটি কমেডি। ইংরেজি নাটকের অনুবাদ তাহলে প্রথম বাংলার রঙ্গমঞ্চে উঠে এল। নাট্যকার রিচার্ড পল জড্রেল। কলকাতার থিয়েটার একজন অখ্যাতনামা ইংরেজ নাট্যকারকে সম্মান দিলেন। তাঁর নাটকের বৈশিষ্ট্য কোনও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল এবং অ্যলার্ডাইস নিকল সাহেবের A History Of English Drama গ্রন্থে তাঁর রচিত নাটকের নাম উল্লেখ পাই বটে কিন্তু নাট্যকার সম্পর্কে কোনও আলোচনা সেখানে নেই। তাঁর অডিন অক্টাভো আকারে ১৭৮৭ সালে প্রকাশিত একমাত্র গ্রন্থ ‘Select Dramatic Pieces’-র নামপত্রেই লেখা ছিল নাটক লেখা হয় ‘Provincial Theatres’, এবং কিছু নাটক ‘Private Performance And Country Amusement’ অর্থাৎ মফস্বলের চটুল বিনোদনের জন্য নাটকগুলি লেখা হয় ।

বাঙালির জন্য থিয়েটার হল ১৭৯৫ সালে খুলে গেলেও কলকাতার সঙ্গে থিয়েটারের সম্পর্ক কিন্তু বিগত চার দশক পুরোনো। তবে অবশ্যই তা বাঙালির কলকাতা নয়, সাহেবের কলকাতার সঙ্গে সম্পর্কিত। কলকাতায় প্রথম রঙ্গমঞ্চ চালু হয় ১৭৫৩ সালে – দ্য প্লেহাউস। সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চের বিপরীতে, বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিং এর পূর্ব দিকে। এই অংশে এখন মার্টিন বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি। ইতিহাস বলে – এই থিয়েটারের জন্য অর্থ অনুদান আসত লন্ডন থেকে ভুবন বিখ্যাত শেক্সপিয়রের বরপুত্র নট ডেভিড গ্যারিকের সহায়তায়।
১৭৫৬ সালে পলাশির যুদ্ধের প্রাক্কালে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে এই থিয়েটার হলটি আগুনে ভষ্ম করে দেয়। প্রথম নাট্যশালার পাদপ্রদীপের আলো নিভে যায় এক স্বল্পাযু় কালরেখায়। তারপর ১৯ বছর থিয়েটার শূন্য ছিল কলকাতার জীবন। পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর কলকাতাকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা, রাজনৈতিক মানচিত্রে একক আধিপত্য তৈরি করতে করতে আবার থিয়েটার হলেরও নব্যনির্মান প্রকল্পে হাত দেয় সরকার বাহাদুর। ১৭৭৫ সালে এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হেস্টিংস, জনসন, রিচার্ড বারওয়েল, স্যার এলিজা ইম্পে, হাইড, চেম্বার্স এবং সর্বোপরি আবার ডেভিড গ্যারিক।এবার গ্যারিক শুধু অনুদানই পাঠালেন না সঙ্গে শিল্পী বানার্ড মেসিঙ্ক ও তাঁরই নির্দেশে আঁকা বহু দৃশ্যপটও এল লন্ডন থেকে কলকাতার নাট্য অঙ্গনে। রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, অর্থাৎ ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির ‘Hickye’s Bengal Gazette or calcutta gerngernral Advertiser ‘। হিকির বেঙ্গল গেজেট এবং বিভিন্ন লেখক লেখিকার সেই সময়কার স্মৃতিচারণা মূলক রচনা যেমন ‘দি অরিজিনাল লেটারস ফ্রম ইন্ডিয়া ‘ মিসেস এলিজা ফের, ‘ইন দ্য ডেজ অভ দি কোম্পানি’র ডগলাস ড্যুয়ার, ‘ দ্য গুড ওল্ড ডেজ অফ দ্য জন কোম্পানি’ র ডব্লু এইচ কেরীর থেকে জানা যায় কোন ধরনের নাটক ও নাটকের সঙ্গে জনগনের সম্পর্ক চিত্রটিও অনুধাবন করা সম্ভব । ‘হিকির বেঙ্গল গেজেট ‘র বিজ্ঞাপনে(প্রথম সংখ্যা) আসছে নাট্যকার জর্জ ফারকুহারের ‘দি বোস্ট্র্যাটাজেম’ নাটক অভিনীত হবে। এরপর একে একে দি ফেয়ার পেনিটেন্ট, ভেনিস প্রিজার্ভড, বনটন, দি প্যাডলক, দি পুয়োর সোলজার, রিচার্ড দি থার্ড, দি মার্চেন্ট অব ভেনিস, দি রিভেঞ্জ, সি স্টুপস টু কঙ্কার নাটকের অভিনয়ের সংবাদ প্রকাশ হতে থাকে। অর্থাৎ কলকাতার জল হাওয়ায় শেকসপিয়র থেকে বেন জনসন, টমাস অটওযে় থেকে শেরিডান -এর নাটক অভিনয় হওয়ার মাধ্যমে পাশ্চাত্য থিয়েটার সংস্কৃতি বাঙালির জনসংস্কৃতির মাটিতে তার শিকড় বিস্তার করতে শুরু করেছিল অন্তরালে। কিন্তু বাংলার জনচেতনা ও অর্থনীতি এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্যের ভেদরেখা শ্রেনীগত ভাবে বাঙালির প্রবেশ একরকম বেডা়জাল করে রেখেছিল থিয়েটার হল থেকে। পরবর্তীকালে ,হিন্দু কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বহু আগে,প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের সেতু বন্ধনকারী শিল্পী লেবেদিয়েভ পাশ্চাত্য রঙের থিয়েটারের দেহে বাঙালির স্নায়ু ও হৃদপিণ্ড স্থাপন করলেন।

বাংলা থিয়েটার তিনি ইংরেজি নাটকের দৃষ্টান্তে কেন রচনা করলেন, সংস্কৃত কিংবা যাত্রার আদলেও করতে পারতেন – কিন্তু না আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত বাঙালির নাটক দেখার রুচি তৈরি করা এবং সেই সময় ইংরেজ থিয়েটার কম্পানির বিরোধীতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন এই মর্মে – “for the benefit of the European public”। পরবর্তীকালে আবিষ্কার করা হয় নাটকটির কিছু অংশ ইংরেজিতে অভিনয় করা হয় । লেবেদিযে়ভ তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি ব্যবহার করে এটা বুঝেছিলেন যে সেকালে বাঙালির পৃষ্ঠপোষকতায় বৃহৎ নাট্যশালার ব্যয় বহন করা অসম্ভব। কলকাতার বাঙালি সমাজ থিয়েটারমুখী ছিল না বলেই ইংরেজ থিয়েটার কোম্পানি তাঁর নাট্যশালার সর্বনাশ করতে সফল হয় । ১৭৯৭ সালে ২৬শে জুলাই ইংরেজ কোম্পানির দ্বারা ‘সর্বস্বান্ত’ হয়ে লেবেদিযে়ভ কলকাতা থেকে লন্ডনের রুশ রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ভোরনসভ্-কে চিঠিতে সম্পূর্ণ ইতিহাসটি তুলে ধরেন – ” আশা করি , আপনি বিশ্বাস করিবেন যে, আমি শ্রম স্বীকার করিয়া অন্যান্য গ্রন্থ ছাড়া ডিজ্গাইজ নামে এক ইংরেজি কমেডির বাংলা অনুবাদ করিয়াছি। তারপর কোম্পানীর ম্যানেজার আমাকে কোন নাট্যশালা ব্যবহার করিবার অনুমতি না দেওয়ায় আমি অবশেষে নিজেই সাহস করিয়া চারিশত দর্শকের উপযোগী এক নাট্যশালা নির্মাণ করি। এই নাট্যশালাতেই একমাত্র আমার চেষ্টায় ও ব্যবস্থায় দুই রাত্রি বাঙালী অভিনেতা ও অভিনেত্রী দ্বারা বৃহৎ দর্শকমন্ডলীর সমক্ষে উক্ত কমেডিখানা অভিনীত হয় । এখানকার পরশ্রীকাতর নাট্যশালাধ্যক্ষগণ যদি আমাকে না ঠকাইতেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই অর্থশালী হইতে পারিতাম। এখন আমি ইহাদের চক্রান্তের ফলে সর্বস্বান্ত হইয়া পড়িয়াছি। এদেশের আইন ও শৃঙ্খলার রক্ষকদের নিকট হইতে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করিয়া তাহা পাই নাই।”
দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের রুশ ভাষার অধ্যাপক চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ইংরেজিতে ও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বাংলায় চিঠিখানি অনুবাদ করে বাংলা নাটকের একটি ঐতিহাসিক উৎসের দলিল তৈরি করে দেন ভবিষ্যৎ নাট্য গবেষণার ক্ষেত্রে ।
তাই তাঁর সমাধিফলকে শুধুমাত্র একজন ‘Indologist’ পরিচয় খোদাই করা থাকলেও নাটকের পর্দা ওঠা থেকে পর্দা নামা পর্যন্ত ইতিহাসের নাটমঞ্চে বাংলা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা রূপেই তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে থাকবেন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২