সাবিনা স্পিয়েলরিনের সেই ডায়ারি – বল্লরী সেন
(মৃতশরীরের বাষ্প থেকে ভুল ঘ্রাণের জলছাপ ধোঁওয়ার মতো, অবিকল আমার আঁতুড়, আমার স্নেহের ভাপে তখন সাদা হয়ে পাশঘরের খিদের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিগত চশমা, সিঁথিফুল, মাকড়ি। চোখ বুজে আছি কিন্তু দেখতে পাই; কানের পরশ করার ক্ষমতা হবে, বুঝি। হরফের স্বর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে হ্রদের সামনে। ওইপারে হংসপদিকার গান বেজে উঠল, এবার আমি শিঙের ফলায় নিজেকে কেটে ফালা করে ছুট্টে চলে যাব মেরুপ্রান্তের সূর্যমুখি গ্রামে)
॥ একাদশ অধ্যায় ॥
জুরিখ শহরের মেপল্, বার্চ, পাইনের গাছ ঘিরে রেখেছে বিরাট সরোবরটিকে। আর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপিত বেরঘলস্লি হসপিটাল, যার তিনতলার একটি বিলাসবহুল কেবিনে চিকিৎসাধীন ১৯ বছরের সাবিনা স্পিয়েলরিন—কার্ল ইয়ুং এর অন্যতম মনোরোগী, যাঁর দেখাশোনার সূত্রে ইয়ুং-এর শব্দ অনুষঙ্গের দ্যোতনা পরবর্তী ধাপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অন্যদিকে, সাবিনার ধ্বংসাত্মক স্পৃহার ধারণা থেকে প্রভাবিত হয়ে ১৯২০ সালে সিগমণ্ড ফ্রয়েডের চিন্তাবিশ্ব বদলে যায়। বলা যেতে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দৌলতে, ইয়ুং ও ফ্রয়েডের কথোপকথনের মধ্যবর্তী হয়ে নয়, বরং নিজের মেধার জোরে সাবিনা বা স্কিৎকোভার স্বকীয় যুক্তি ও মনোবীক্ষার শক্তিতে মনোরোগের বিভিন্ন কেন্দ্র ওঠে মনোবিজ্ঞানের সাম্রাজ্যে।সাবিনার ডায়েরি পেয়ে দেশ ছেড়ে আমার মতো এক অলসপ্রাণ আচমকা শরীরসুদ্ধ খলবলিয়ে উঠল, যেন একটা খুন-হওয়া প্রেতিনীর মুখ চেপে বসতে লাগল আমার মুখের সেলোফেনে, যেন ছাঁচ। আমি, আমার গত আমি কেবল একটা খাবলানো ছাঁচ, তার হাঁ এর কোলে ঢুকছে ১৯০৪, ১৯০৯, ১৯১৬—হ্রদের ঝড় বইছে বোধিবৃক্ষের শাখায়, সব পাখি বাসা ত্যাগ করে পালিয়ে যাচ্ছে অন্য দ্বীপে। কিন্তু ৫ দিন ব্যাপী টানা বর্ষণে জুরিখ লেকের জলের দানবরূপ কেবল একইভাব দামাল, নিরাসক্ত , নিষ্ঠুর। নটরাজের নৃত্যপর গর্জনে আমার যোনিকুণ্ডে মগজের ঘিলু তার দ্রবণে মিশে যেতে লাগল আর আমার হাত দুটো কেমন অবশ ও পঙ্গু। নিঃসাড়ে মনে হল কেউ চাবুক মারছে কাউকে আর তার শব্দে চমকে উঠছে আমার দুই হাঁটু, হাঁটুর নীচের ক্ষত, দুঃখদূরবীন দিয়ে দেখলাম আর স্তম্ভিত হলাম। এ কার অবয়ব! কার দেহপাঁজর? কার যকৃৎ…
বেরঘলস্লি হসপিটালে তখন ঝিরঝিরে তুষারপাত শুরু হয়েছে। অভিজাত মহিলাকেবিনের একটি দরজার বন্ধ ছায়ার নীচে বইছে ফায়ারপ্লেসের ঝিনিক; গীর্জার ক্লক টাওয়ারে সন্ধের ঘণ্টা বাজল ছ’বার। এলাহি সাটিনের কারুকাজে ভারী পর্দায় অন্তঃশায়ী কান্নার বোল্ ফুটছে নিভছে, আবার ঘন হচ্ছে নিঃশ্বাস। লেসের নক্সা তোলা লং ফ্লোয়িং গাউনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কুড়ি বছরের স্নিৎকোভা সারা ঘরময় পায়চারি করছে। চোখের তলায় ছায়াসংকেত, আচমকা ডুক্রে কেঁদে উঠল আর ঠিক তখনই কোথাও জোরে বেজে উঠল সাইরেন। না, এ নতুন কিছু নয়। কিন্তু ঠিক এর পরেই কার যেন ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল ক্রমশ বন্ধ দরজার দিকে। আর মুহূর্তে নিজের ফ্রিল দেওয়া গাউনের পিঠের বোতাম টেনে খুলে এক ঝটকায় গায়ে গলিয়ে নিল আধময়লা একটা ম্যাক্সি ড্রেস, কাঁধের এক জায়গায় সুতো ওঠা, মোচড়ানো। চুল এলোমেলো করে সিঁথি বদলিয়ে বেডের ওপাশে কাউচে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বইয়ে যেন ডুবিয়ে ফেলল নিজেকে। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই ধাঁ করে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। ঘরের অগোছালো অবস্থার দিকে নজর করে সোফার পাশে চেয়ারে বসলেন ও নাড়ী পরীক্ষা করে জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে চেয়ে বললেন:
“আমি কি তোমার জন্য একটা ঘন স্যুপ বলে আসব, এখন খেলে স্বস্তি পাবে?”
“—না। এখন না। রাত্রে। কফি খেয়েছি, ম্যারিয়েন পাঠিয়েছিল। আপনি তো ক্লান্ত হয়ে এলেন, আপনাকে এখন একটু মাংসের স্টিউ করে দিলে বেশ হত। মা খুব করতেন তুষারপাতের বাতাস দিলে, আজ ঠিক সেই রকমের একটা দিন।” স্কিৎকোভার মনের খবর তাহলে এই। এই জন্য তার ঘরে কেবল জামাকাপড় ডাঁই করা, আর তার পরনে কেমন ময়লা ঢিলে পোষাক। আসলে তার খিদে পেয়েছে আর তাই মনে পড়ছে নিজের মায়ের কথা। না আর কারও কথা নয়, বিশেষ করে বাড়ির কথা সে তেমন বলতে চায় না তা খুব স্পষ্ট। মা ইভার চিঠি আসে প্রতি হপ্তা, আর মনোরোগের উৎস সন্ধানে ডাক্তারের দায়িত্ব মেয়েটির হিস্টিরিয়ার কারণ খুঁজে বার করা। তাই কার্ল খুব সতর্ক থাকেন, নোট নেন, বা মনে করে রাখার চেষ্টা থাকে তাঁর। বেরঘলস্লির তিন তলায় এই ঘরটি ফিমেল পেশেন্টদের পছন্দ হবে ভেবে যত্নে দেয়ালের ফ্রেস্কো তৈরি। পর্দার রং, দেয়ালের বর্ণ হাল্কা মভ্। মনে থাকে না এটা হাসপাতাল। খাটের পাশে বুক শেল্ফ, গুছিয়ে রাখা জর্মান রূপকথা, ইতিহাস আর কাব্য। বাছাই অবশ্য ডাক্তার কার্লের নিজের।
“শুনছেন… আপনি আর চুরুট খাবেন না।” বলেই হাত থেকে কেড়ে নিয়ে চুরুট সটান নিজের ঠোঁটে সাজিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সে। কার্ল অবাক। কী যে অসহায় দৃষ্টি, ভয় করল আবার না সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
“বেশ তাই। এবার তাহলে আমাদের গল্প বলার আসর শুরু। এসো, তোমার জায়গা বেছে নাও শিগ্গির।” বলে সরাসরি নিজে জানলার দিকে ঘুরে স্পেস দিলেন মেয়েটিকে গুছিয়ে নেবার। ইভার পাকশালা তখন ম’ ম’ করছে থাইম, সেলেরি আর লেবুর গন্ধে। ডেকচিতে রসুন ফোড়ন দিয়ে মাংসের চৌকো টুকরোয় মাখা হচ্ছে সাঁতলানো নতুন জগতের শাক আর বিট, ফুটন্ত লাল ব্রথের মধ্যমণি সামান্য ক্রিম, যা ইভা শেষে প্রত্যেকের জামবাটিতে ঢেলে দেন। কার্ল দেখলেন সে অন্যমনস্ক।
“কেন চুরুট বন্ধ করলে বলো?”— বলে অপেক্ষা করছেন, হঠাৎ আধশোওয়া থেকে সটান দাঁড়িয়ে সোজা স্কিৎকোভা দাঁড়ায় তাঁর সামনে।
“আমার বাবা খান। আমার বাবা ওই সিগার দিয়ে আমার পিঠে কেমন সুড়সুড়ি দিতেন আর সারা রাত মনে হত কেউ আমার ঘরে রয়েছে, আমার পিঠের দাগ বরাবর সিগারের টান, দাগ বসানো নেকড়ে যেমন ফিরে ফিরে আসে শিকারের দিকে…