বিম্ব, প্রতিবিম্ব – বল্লরী সেন ( ইতি দিওতিমা পর্ব ৫ )

বিম্ব, প্রতিবিম্ব – বল্লরী সেন ( ইতি দিওতিমা পর্ব ৫ )

শেয়ার করুন

অষ্টম অধ্যায়

দরাগয় ম্যমা (ইভা স্পিয়েলরিনকে লেখা সাবিনার সেই চিঠি)

ফটকের ১৩২ নং এখন প্রায় দেখা যায় না, কিন্তু উত্তর ককেশস্ পর্বতমালা থেকে কখনও বাতাস আসে। ঝিরঝিরে তুষারের ছাই এসে প্রাসাদের লম্বা গাছেদের গায়ে প্রেতের মতো আটক হয়ে শুয়ে থাকে। লভ্যাংশের তোয়াক্কা করে না; এমনকি শরিয়তি আইনের রদবদলের জন্য অপেক্ষা করে না কবে সম্পত্তির ভাগ পাবে সেও। রুশ-জাপান যুদ্ধের সময়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ইভা, সেই হল সাবিনার নিজের লড়াইয়ে প্রত্যাগমন, তার নিজের শরীরের শমনপুঁজ টিপে দ্যাখা। ভাবছিল সকাল থেকে গারদ কেটে পালাবে, কেন যখন-তখন নষ্টস্মৃতি থেকে চুঁইয়ে নামবে একটা ভয়? আর কম্পন শুরু হলেই তাকে শুইয়ে দিতে হবে কেবিনের খাটে? সে কি এত নির্জীব! এতটাই ঘ্যানঘেনে! (পরের পাতাগুলি কাটা)

“আমি আজ পাগলের মতো খুশি, পাগলের মতো আর্ত, বিমর্ষ মাতাল। আনন্দে আমার হাতের তালুতে ঘাম, অশ্রু, ভাসানডুরি খুলে বয়ার ওপর ভাসছি ম্যমা। যুঙ্গা, যুঙ্গা আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন আর আমিও কাল প্রাণভরে কাতারে কাতারে ঘুমিয়েছি। খিদে নেই, তেষ্টা নেই, ওষুধ

লাগেনি, আমি ঘরময় যুঙ্গার করভেটের মধ্যে লুকিয়ে ঘুরছি, যেন একটা পুরুষ সাইকেলে যুঙ্গা আমায় দুই দিকে পা দিয়ে চাপিয়েছে। দেখছ, কী মজা। তোমার পাঠানো ১০০ রুবেল জমা আছে, কেবল বন্ধু রেহমীর অসুখে কিছু ব্যয় হল। যুঙ্গা আমার জুতো ছেঁড়া দেখে ১০ ফ্রাঁ দিলেন, তারপর আমরা দুজনে হসপিটাল রাউণ্ডে গেলাম। সামনের শুক্রবার আমায় নিয়ে যাবেন কাছের মার্কেটে, ততদিনের মধ্যে আমি borsht রান্না শিখে নিতে চাই মা।

লাল বিটরুটের পা থেকে সর

লাল হরিৎ বন্দরের দাঁড়

নোঙরের দাগ এই পিঠের উৎরাই

ক্রমে আমি আরও সুলুক শিখে

নেব তোমাকে দেখার

না, কোনও চিন্তা কোরো না, আমি সুস্থ আছি। যুঙ্গার ঝক্কি সামলে রান্না শিখছি, টক দইয়ের পুরু আস্তরণ মিশে যাচ্ছে আর কী তার বাহারি রং! মাংস স্টিউ বা কেভিয়ার না থাকলেও, যুঙ্গা রাগ করেন না একদম। আমি এই মুহূর্তে এক কালো সমুদ্রের ঠিক মাঝ বরাবর একটা পাথর চাতালে আছি, সাগরের তুফান এত বিরাট যে তা দিগন্তের মূর্ধা ছুঁয়ে ফেলছে বারংবার। তুমি আমায় এই পোড়া ক্লিটোরিসের ঘুমপাড়ানি আর শুনিও না; কেবল একটা প্রশ্ন। মা — আমি কি তোমার গর্ভজাত? আমায় কি তুমি গভীর অসূয়া থেকে পেটে ধরেছিলে, তাই এত এত রাগ-দ্বেষ আমার দেহের কানাচে, এত মিথ্যে, এত শ্বাপদ ছুঁচ। তোমাকেও বুঝি বিঁধেছিল এমনই করে, ক্রীতদাসের মতো, আর খুব টাটিয়ে উঠলে তুমি সুখ পেতে। আমিও ওইরকম যাতনার মধ্যে নিজেকে একা চুবিয়ে দিচ্ছি ওগো খ্যাপা জানোয়ার… বিরাট ভারটিকে নিজের ওপর চাপিয়ে আমি আকাশ বেয়ে চলেছি আর কেবল পা কেটে যাচ্ছে। আহা, কী যে ব্যথা, কী যে জলোচ্ছ্বাস!

একসময় মনে হল, যেন শুনলাম, কেউ কাঁদছে। পুরুষের কান্নার কথাগুলো বাজতে লাগল সারা ঘরে। আমি তাঁর মাথা কোলে তুলে নিলে, তিনি চুপ করলেন। তারপর, নেশার মতো তিনি আমাকে আটকে রাখলেন কতক্ষণ। ঘুমিয়ে পড়ার পরে, শুনলাম কাকে যেন বলছেন — মা, মেরো না আর করব না। বলতে বলতে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চাইলে, আমি জোর করে বারণ করেছি। সেই মুহূর্তে দেখলাম, কী উন্মত্ত তাঁর চেহারা হয়েছে। আবার যখন বিছানায় ছোটো শিশুর মতো টেনে শোয়ালাম, মনে হল — আমিই ওঁর চিকিৎসক, উনি আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলবেন আর আমি বলিয়ে নিতে পারব।”

(এর পরে ১৯১০-এর কোনও দস্তাবেজ দেখছি না) কিন্তু এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১১-তে যে মেয়েটি স্কিৎজোফ্রেনিয়ার অবচেতন বয়ান নিয়ে তার গবেষণাপত্র জমা দিয়েছিল, যার এই কাজের প্রথম সাকরেদ ছিলেন কার্ল ইয়ুং নিজে, তার এ সময়ের উত্তাল মনের টানাপোড়েনের সাক্ষী ছিলেন ইভা, তার মা। আরও একজন ছিলেন, তিনি সিগমণ্ড ফ্রয়েড স্বয়ং।

(ক্রমশ)

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২