পুনরুত্থানের কবিতা ও কবি গৌতম বসু – বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী

পুনরুত্থানের কবিতা ও কবি গৌতম বসু – বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

কবিতার ইতিহাস শুধু কবিতার কথাতেই রচিত হতে পারে না—সঙ্গে থাকতে হবে কবির কথাও। কবিতা কেমন রচিত হবে তা মূলত নির্ভর করে ‘কবি’ সত্তাটি কেমন, তার ওপর। এ-যাবৎ অনেক কবির কবিতাপাঠের সৌভাগ্য হয়েছে আমার এবং সেসব কবিতাপাঠের‌ পাশাপাশি আমি ধন্য হয়েছি সংশ্লিষ্ট কবির অন্তরাত্মার সন্ধান পেয়ে। একমাত্র কবিতার পঙ্‌ক্তিসমূহের মধ্য দিয়েই আমি পৌঁছতে পারি কবির কাছাকাছি। অনেক ক্ষেত্রেই কবিকে চাক্ষুষ দেখা, তাঁর সঙ্গে কথা ও ভাব-বিনিময় করা, তাঁর কাব্যভাবনা (যদি গদ্যাকারে লিখিত হয়ে থাকে) পাঠ করা বাড়তি মাত্রা এনে কবিতাপাঠককে‌ এক প্রকার দায়বদ্ধ করে তোলে—সেই দায়বদ্ধতা থেকে পাঠকের কবিতা সম্পর্কে উপলব্ধি হয় ও সংশ্লিষ্ট কবিসত্তাটিকে হৃদয়ঙ্গম করাও সহজসাধ্য হয়; তবে এ-প্রসঙ্গে একথাও সত্যি হতে পারে যে কত কবিকেই তো চাক্ষুষ দেখিনি আমরা, তবু সেইসব কবিরা কি আমাদের চেনা নন—অন্তত আমাদের মধ্যে যারা সংবেদী পাঠক, তাঁদের আত্মারই অংশ হয়ে যাননি কি সেসব কবিরা?

তেমনই একজন কবি আমার আত্মীয় হয়ে গেছেন আমারই অগোচরে, ইতস্তত কয়েকটি পত্রপত্রিকায়, হঠাৎই একটি চটি কাব্যগ্ৰন্থ হাতে এসে পড়ায় কিছু কবিতা, ওই কবির, পড়ার সুযোগ পেয়ে, ক্রমশ তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, মনে মনে। এমন আরো কয়েকজন আবহমানকালের কবিকে, আরো অনেক কবিতাপাঠের‌ মতোই, আমার পরমাত্মীয় মনে হয়—বলতে শ্লাঘাবোধ করছি কবি গৌতম বসু তেমন একজন। সম্প্রতি ওঁর ‘কবিতাসমগ্ৰ’ গ্ৰন্থটি হাতে এসেছে আমার। ‘সমগ্ৰ’ বলতে যেমনটা বোঝায়, এটি তেমন কিছু নয়—মাত্র ৩ ফর্মার চটি এই ‘কবিতা সমগ্ৰ’-এ মুদ্রিত কবিতা আছে ৪১ পৃষ্ঠা জুড়ে—অধিকাংশই ছোট আকারের কবিতা হওয়ায় ১৩৮৮ (১৯৮১) থেকে ১৪১৪ (২০০৭)—এই সময়পর্বে মাঝে মাঝে প্রকাশিত ৪টি কাব্যগ্ৰন্থের সমাহার এই ‘সমগ্ৰ’-এ ১০৫টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। অধিকাংশ কবিতাই প্রভূত আনন্দ দিয়েছে আমায়, যা আমি কবিতা পাঠে প্রথমেই পেতে চাই—তাঁরই কবিতার ভাষায় বলি: ‘…মুণ্ডিত মস্তক, ভাবমগ্ন এক অনিন্দ্যসুন্দর তরুণ নগ্নপদে চলেছেন, চলেছেন…’—কবিকে যেন এভাবেই দেখতে পাই আমি।

গৌতম বসু এমন একজন কবি যিনি স্বীয় সৃষ্ট কাব্যজগৎ-এর বাইরে কখনো পা রাখেননি—আপন অভ্যন্তরে যে আলো তিনি অনির্বাণ রেখেছেন, তারই ছটায় তাঁর মগ্ন পথচলা এবং সার্বিক অনুসন্ধান। আশ্চর্য হই তাঁর কবিতা পড়ে যে, কীভাবে এই ধর্মচ্যুত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় অহরহ বিরাজ করেও মহাকাব্যিক চেতনাকে তিনি বিসর্জন দেননি—তিনি লক্ষ করেছেন পথিপার্শ্বের নিতান্ত সাধারণ মানুষটিকে, অন্ধ ভিক্ষুক ‘এবাজুদ্দিন লস্কর’কে তাঁর ঘরবাড়িকে তিনি মনশ্চক্ষে দেখেছেন, দেখেছেন কীভাবে ট্রেনের কামরায় তিনি ভিক্ষা মাগেন—এবং “যে ছেলেটি তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়, তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে” কীভাবে “তিনি বলেছিলেন, ‘তোরাই তো আমার চোখ’।” কবির সঙ্গে ওই মানুষটির “আর কথা হয়নি বিশেষ, কিন্তু আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম”—এই যে ‘অনুসরণ-প্রবৃত্তি’—এটাই তো একজন সদা-জাগরুক কবির প্রকৃত ধর্ম, সবার অগোচরে অতিসামান্যকে অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে এক ‘অসামান্য বিভা’কে আবিষ্কার করা। গৌতম এই কাজ করেছেন কবিতায় কবিতায় এবং সঙ্গে সঙ্গে যখন যেখানে থেকেছেন কর্মোপলক্ষে, অথবা গেছেন বেড়াতে, তাঁর কবিসত্তার অন্তর্দৃষ্টি সেই জায়গাটিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছে—তিনি আপনসত্তার সঙ্গে জায়গাটির, তার আর্থ–ও–পরমার্থ যোগযুক্তির আন্তরিক মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন, তাঁর কাব্যভাষার মধ্য দিয়ে।

বাংলা কবিতার মূল যে‌ ধারাটি চিরকাল একটি মঙ্গলঘট স্থাপন করতে চেয়েছে কবিতাপাঠকের চেতনার দোরগোড়ায়, তাকে সচেতন করতে চেয়েছে এই বাংলার প্রকৃতি-জল-হাওয়া-মাটি-গাছ-আলো-অন্ধকার থেকে উৎসারিত রসধারায় কীভাবে সিঞ্চিত হয়েছে বাঙালির মনন, কীভাবে তিলে তিলে তার আবহমানকালের কৃষ্টি-সংস্কৃতি পুষ্ট হয়ে এসেছে, কীভাবে তার অভাবের সংসারে সংগৃহীত অন্নসংস্থানের পেছনে ঘাম-রক্ত-অশ্রুর গহন ভূমিকা সক্রিয় থেকে গেছে, কীভাবে তার মাথায় বিপর্যয়ের সর্বনেশে আঘাত নেমে এলেও মরিয়া হয়ে বাঁচার প্রয়াসে সে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে নতুন করে তার বাঁচার সংসার, আপনমনে গুছিয়ে নিয়েছে, বা কখনো পারেনি সেভাবে আর কীভাবে তার এই বাঁচার প্রয়াস সহনীয় করে তুলতে তার পাশে পাশে থেকে গেছে তার মনের মাধুরী দিয়ে গড়ে তোলা দৈবী প্রেরণা সমূহের কাল্পনিক মাতৃচেতনা ও তার প্রতিমূর্তি পাশাপাশি থেকে যায়‌ ‘প্রকৃত শ্মশানবন্ধু’ সেই ‘জল’—আর এসে পড়েন, সেই ‘জল’ হয়েই ‘রামপ্রসাদ সেন’। সামগ্ৰিক এই মুক্তধারা, যার বাইরে কখনোই নিজের কবিতাকে নিয়ে যাননি কবি গৌতম বসু; বরং সেই ধারাকে তিনি প্রসারিত করতে চেয়েছেন বৃহত্তর পটভূমিকায়, ভারতবর্ষের বিচিত্র, বিস্তৃত ও ঐতিহ্যপূর্ণ প্রেক্ষাপটে—যখন যেখানে গেছেন, অথবা না গিয়ে মনশ্চক্ষেও এক মহাকাব্যিক উপলব্ধি ঘটে গেছে তাঁর—আর কবিতায় সেই উপলব্ধির গহন গভীর ছাপ ফুটে উঠেছে।

‘আমি মায়াবৃত, এই জন্মই আমার বন্ধন, তবু বন্ধনমাত্র নয়, আমি মুক্তির পথেই রয়েছি’… ‘পার্থিব সম্পদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার সূত্রে মানবসমাজ স্তরবিভক্ত, স্তরগুলি বিবাদের রক্তস্রোতে ভেসে চলেছে, এ অবস্থাই আমার বন্ধন, তবু বন্ধনমাত্র নয়, আমি মুক্তির পথেই রয়েছি’—পঙ্‌ক্তিগুলি গৌতমের ‘রসাতল’ কাব্যগ্ৰন্থের ‘বিভাব-কবিতা’ থেকে উদ্ধৃত। পঙ্‌ক্তিগুলি পাঠ করলে মনে হতে পারে এগুলি তো ঠিক কবিতার ছত্র নয়—যেন প্রবন্ধের মতো—এর মধ্যে কবিতা কোথায়—উপমা, চিত্রকল্প, ইমেজারি—এসব কিছুই তো নেই; বস্তুত ওঁর কবিতায় উপমার মতো প্রয়োগ কয়েকটি পাওয়া গেলেও ‘ইমেজারি’ প্রায় নেইই কোথাও—বরং ‘ইমেজারি’র বাস্তবীকরণ ঘটিয়েছেন যথার্থ স্বাতন্ত্র্যে—তাঁর ৪র্থ ‘নেতাজীকেবিন’ কবিতায় শুরুতেই পাই এরকম একটি ‘বিবর্তিত’ ইমেজারির প্রয়োগ—‘সকালে ও সন্ধ্যায়, নিত্যকাল খুঁজে বেড়াই/ আমার দু’পায়ের শব্দ সে হরণ করেছে,/ পৌরসভার গাড়িটি পাশে এসে দাঁড়িয়ে/শুধাই, আমি কোথায়, কোথা আমার বিছানা…’—পরক্ষণেই, আবার, ‘পৌরসভার গাড়ির ছায়ায় সহসা দেখি/ তোমায়, তোমার আগুনরঙের শাড়িখানি…’। এই ধরনের বাস্তবীকরণের ধারা বহমান, তিনি তার মধ্যেই আছেন, স্বকীয় বিভাসহ, যা‌ শেষ পর্যন্ত সেই ‘পথ’-এর কথাই বলে—‘পথ ভিজে আছে কালস্রোতে…’ আর তিনিও অবস্থান থেকে স্থানান্তরিত হন কল্পশক্তির বশে‌। এই কবিতাটি এযাবৎ অগ্ৰন্থিত ছিল—‘সমগ্ৰ’-এ রেখেছেন বলে কবিকে ধন্যবাদ। ‘চিত্রকল্প’ও প্রায় নেই, যা আছে উজ্জ্বল চিত্রের স্তরান্তরণ, বলা উচিত, স্তরোন্নয়ন—‘রসাতল’ কাব্যগ্ৰন্থের ‘রক্ষা’ কবিতায় যেমন‌—‘দূর থেকে দেখি, দালান থেকে রোদ ধীরে-ধীরে স’রে যাচ্ছে। আমাদের বেঞ্চির উপর একটা জলের কেটলি, হাতপাখা একটা, আর ফিরে ফিরে আসছে বাষ্পের চেয়েও সূক্ষ্ম সেই ভগ্ন পঙ্‌ক্তিমালা, সেই প্রজ্বলিত উক্তির অবশেষ।’ সামান্য কেটলি ও হাতপাখা অতঃপর ‘চিত্র’-ধৌত হয়ে উঠে ভাবোজ্জ্বল হল: ‘দিব্যোন্মাদ বাক্যসকল, জাগো, বল, আমরা হেঁটে এসেছি ধ্বংসের দিকে বেঁকে যাওয়া তমসাবৃত পথটিতে, ফিরে এসেছি, নির্মল ও সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে এসেছি।’ ‘চিত্র’ আঁকতে নিপুণহস্ত এই কবি এভাবে আত্ম-তীর্ণ হতে চেষ্টা করে যান—এটাই তাঁর ‘রক্ষা’ পাওয়ার হয়তো একমাত্র উপায়, বাঁচার পথ। ‘রসাতল’-এর ‘বিভাব-কবিতা’-র উদ্ধৃত পঙ্‌ক্তিগুলির মধ্য দিয়ে একটি ‘কবিমন’-কে আমি ছুঁতে পেরেছি, যিনি যাবতীয় কথার নির্যাসটুকু ধরতে চান কবিতারই মধ্য দিয়ে, বেঁচে থাকার পাশাপাশি এই কাজ তাঁকে সক্রিয় রেখেছে—এখান থেকেই পুষ্টি পায় তাঁর অমোঘ কবিসত্তা। এই কবি আত্মসিদ্ধ, মুক্তমনা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন—ফলত তাঁর কবিতাপাঠে একধরনের দার্শনিক অনুভূতি হয়—এই যে বলছেন উনি, ‘মানবসমাজ স্তরবিভক্ত, স্তরগুলি বিবাদের রক্তস্রোতে ভেসে চলেছে’—এর মধ্যে কবিতা নেই, নেহাৎই বক্তব্য; কিন্তু যখনই‌ তিনি উচ্চারণ করলেন: ‘এ-অবস্থাই আমার বন্ধন’—তখনই সবকটি পঙ্‌ক্তি কাব্যময় হয়ে উঠল, কোনো আগাম-নির্ধারিত শর্ত ছাড়াই—এই অসামান্য কর্মকুশলতা তাঁর আরো অনেক কবিতার মধ্যেই পেয়েছি।

মহাকাব্যিক চেতনাসম্পন্ন একজন কবি যখন‌ বর্তমান পৃথিবীতে পদচারণা করেন, তখন মহাকাব্যিক জগৎ ও বর্তমান পৃথিবী প্রায় একাকার হয়ে মিশে যেতে চায় পরস্পর, উভয়ের মধ্যেকার ভেদরেখাটি প্রায় অদৃশ্য হয়, বলা যায় অবলুপ্তি ঘটে যায় তার—তিনি চোখ মেলে দেখতে পান ‘দানশেষের দারিদ্র্যের নীচে একাকী কৃষাণ’; দেখতে পান ‘অন্ধ বিক্রেতার থেকে’ কীভাবে ‘ধূপকেনার সুযোগ নষ্ট হয়েছে’; দেখেন ‘নাট্যকর্মী’, ‘কলম-বিক্রেতা’, ‘টিউশন-শ্রমিক’, ‘ভিয়েনের বামুন’, আর একজন ‘ব্যর্থ প্রাবন্ধিক’ এই এই মরজগতে কীভাবে পাশাপাশি বিরাজ করছে। তাঁর কাছে কেউই বুঝি ব্রাত্য নয়—‘পুনর্বাসনের আশায় যারা পথে পথে চরে’; ‘পাষাণ যোনিসম্ভূত এই জীব/ কার কোপতলে চিড়ে গুড় মাথায় ফেরে’; ‘মোবিলের টিন হাতে বিষণ্ণ তোমার কন্যা সন্তান’; আর একজন ‘ভুবনেশ্বর বাহাদুর বিশ্বকর্মা, আজ প্রৌঢ়, একটা কোম্পানির উর্দি-ভরা ড্রাইভার’—যে কিনা ‘গল্প জুড়ে দেয় মালীর সঙ্গে’। তিনি সর্বত্রই প্রায় বিচরণ করেন, শোনেন ‘মানুষের কান্নার চেয়েও অসহায় কান্না/ কাঁদছে পদাহত কুকুর’—দেখেন ‘ফুটপাথের পাশে একপাশে একা টিউবকল/ পাতালের জল তুলে চলেছে আপনমনে/ আর কাঁদছে…’। এমনকি তাঁর নজর এড়ায় না ‘দূর আল, দু’হাতে ভিজে গামছা মেলে কেউ হেঁটে চলেছে’—আর তিনি জানেন, অন্য কবিদের মতো তাঁকে তাৎক্ষণিক হয়ে থাকলে চলবে না, তাৎক্ষণিকতার উর্ধ্বে উঠে তিনি উচ্চারণ করেন: ‘কালস্রোত/ ভিজে রয়েছে, হরসুন্দরী, পায়ের পাতায়’। বস্তুত, এই উদ্ধৃতিগুলি তাঁর ‘সমগ্ৰ’-এর চারটি কাব্যগ্ৰন্থ থেকেই নেওয়া—প্রায় ২৬ বছরের কাব্য প্রয়াসের নানা সময়পর্বেই ঘুরে ফিরে তিনি সামান্য মানুষের নিকটবর্তী থেকেছেন এবং তাদের নানা সঞ্চারপথে তিনিও পথিপার্শ্বস্থ আরও একটি সত্তার আড়ালে থেকে লক্ষ্য করে গেছেন ‘সামান্য’-এর আচার-আচরণ-অন্যমনা বেঁচে থাকা ও সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকলাপে মগ্ন থাকার নানা প্রকরণ—আর সেই প্রকরণ-উপকরণ ঘেঁটে তিনি ‘উজ্জ্বল অসামান্য’-এর অনুসন্ধান শেষপর্যন্ত চালিয়ে গেছেন—আর পাশাপাশি বজায় রেখেছেন তাঁর ঐতিহ্যের আহরণ, যাতে ভরসা করে তিনি আরোহণ করতে চান তাঁর কবি-আত্মার আরো একটি উন্নততর স্তরে।

যে কবির যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ নামক একটি আশ্চর্য কাব্যগ্ৰন্থ দিয়ে, তিনি যে অনেকটা এগিয়ে থেকেই শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে যে তাঁর অন্তর্দহন তাঁকে, তাঁর কাব্যভাবনাকে‌ আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, এ-বিষয়ে শুরুতেই একটা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। এই কৃশকায় কাব্যগ্ৰন্থের ২২টি কবিতার থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে:

‘গহনার সব ধ্বনি ঝরে গেছে’;
‘একটি মানুষ ঘাসের জনতায় রয়ে গেছে’;
‘রাশি রাশি ছুটন্ত হাত, একটি ঘুড়ি আজকের ভোজন’;
‘শিকল রূপান্তরিত জল… এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন’;
‘দেখা যায় দুগ্ধ, গাভী, গাভীর পালক/ অন্যকালের সংঘর্ষ ও নারায়ণ’;
‘মাটির চোখের স্থায়ী অনিদ্রা’;
‘কিছু ভয় বৃষ্টির রাতের জন্য সঞ্চিত থাকতো’;
‘শূন্যতা থেকে আলোর ফাঁস ঝোলে, প্রথম রহস্য
অথবা সব রহস্যের শেষ, মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা’;
‘যেন ফিরিয়ে দেওয়াই বসন্তকাল…’;
‘পদদলন হয়ে ওঠে বিদ্যুৎলতা, মাটি স্বামীর বক্ষ’;
‘দুই বাহু বৃক্ষের অধিক…’;
‘আকাশ সর্বদাই আকাশ/ নির্মোহ ও চক্ষুকর্ণহীন’;
‘যে কেবল/ থেকেছে আর থেকেছে, তথাপি পথিকের’;
‘পথিক/ শ্রাবণীভূমি, ধনুক-প্রণাম’;
‘আজ দুবেলা উনুন জ্বালার মতো আনন্দ’;
‘গভীর ঘুম থেকে উঠে আলো অন্ধকার নির্ণয় করা জটিল…’;
‘নদীতে জল নেই, আগুন, উদ্বেগ এইজন্য…’;
‘পাতা খ’সে প’ড়ে, ভাসে,/ লোকে বলে বিবাহের ছড়া’;
‘অপেক্ষারত মানুষ নিজের আঙুলেও ধোঁয়ার সুতো লক্ষ করে’;
‘গন্তব্যের আগে নিজে শেষ হয়ে গেছে…’
‘সমাপ্তি যাদের সংক্ষিপ্ত করেছে… মৃত্যুর অনেক অসভ্যতা’;

অনেকগুলিই উদ্ধৃতি দিলাম—আরো দেওয়া যেত—বলতে গেলে প্রায় সব কবিতারই একটা-দুটো-বা-সবটা উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে—এবার ২২তম কবিতা দিয়ে বইটি শেষ হচ্ছে, কবি জানেন এবার থামার সময় হয়েছে—অনুপম কবির এই সংযম, তিনি জানেন একথা যে “মানুষ স্তব্ধতার ব্যবহার জানে… এই বর্ম/ স্বহস্তে খোলার জন্য নয়, যখন‌ সময় হবে/ সকলেরই হয়, সেদিন ঐ দায় ভাগ্যহীন সন্তানের।/ যে‌ জানে শেষাংশ কীভাবে গীত হবে সেই জন সমাপ্তির রাজা/ সেই বিদ্যা একমাত্র বিদ্যা, আমি মূঢ়/ আমার সঙ্গে বলো, ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’।”

অনবদ্য এই শেষ। তাঁর কণ্ঠস্বর আমরা শুনি এবং পালাগান শেষে ধুয়ো তোলার মতো আমরাও বলি: ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’—কবির অভিপ্রায় আমরা বুঝে যাই—শত বঞ্চনা, শত হাহাকার পেরিয়ে এসেও আমরা যেন শুভার্থী থাকি, সবকিছুর, এই জন্মের, এই জীবনের, আর এত আনন্দের সম্ভার এই ধরিত্রীর, ধারয়িত্রী এই ‘ধনুক-প্রণাম’-এর ছবিটির মতো চক্ষুষ্মানদশার, সব গঠনের প্রতি, সব উত্তরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি এই শুভকামনা—যেন বেঁচে থাকার একটা সদর্থ থাকে—আর তাকে এমন অর্থময় করে তোলার জন্য ‘অন্ন’-এর ভূমিকা উপেক্ষণীয় থাকতে পারে না—আমরা তাঁর সঙ্গে, তাঁর আবেদনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি—একজন কবি, সত্যি বলতে কি, সেটাই করেন, সেকালের চারণকবিরা যেমন‌ গাছতলায় জড়ো করতো কবিতাকে গানের আকারে পরিবেশন করে একদঙ্গল মানুষকে, কাছে টানতো—এই কবিও সেটা করেছেন এই কাব্যগ্ৰন্থের মধ্য দিয়ে—এটুকু অবশ্যই বাড়তি পাওনা কবিতাপাঠের‌ আনন্দ ছাড়াও।

একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে আসে ক্রমশ—পরিমিতিবোধ তাঁর শ্রেষ্ঠ সম্পদ—লেখেন কম—প্রকাশিত হয় আরো কম—কেন না তাঁর ২য় কাব্যগ্ৰন্থ ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’-র প্রকাশ ঠিক ১০ বছর পরে, বৈশাখ, ১৩৯৮, এবং রচনাকাল ১৩৮৮-১৩৯৭, অর্থাৎ একটি দশকের ফসল ১ফর্মার আরেকটি চটি বই, ৪টাকা দাম (প্রথমটি ১টাকা)—২৪টি কবিতা—সর্বাধিক ১১ পঙ্‌ক্তির, সর্বনিম্ন ৩ পঙ্‌ক্তির কবিতা সব। কবিজীবনের‌ ১ম ৫ বছরের ফসল ‘অন্নপূর্ণা…’ হলে ‘অতিশয়…’ পরবর্তী ১০ বছরের উৎপন্ন—কী উত্তরণ হলো তাঁর—কতটুকু হল? দেখা যেতে পারে একমাত্র কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে, পরে একটু বিশ্লেষণে।

‘সেই ক্রোধ যাকে প্রদান করা হয়েছিলো…’ (যশোহরি)
‘কাঁথা পবিত্র জেনে/ কাঁথার উপরের ও নীচের শূন্যতাকে
প্রণামের সময়/ আগুনের বসনকামনা…’ (পাদুকা)
‘…এই ছাগল গর্ভবতী, গৃহবিমুখ/ অতিদূর থেকে আপন
প্রসবকাতরতা লক্ষ করে…’ (আমিনপুর রোড)
‘…স্থলের মহিমায় তিনি জলকণা,/ কাদায় শতনাম এখানে
বৃষ্টির ও ভাঙনের/ সুধীর ভাষায় শতরূপে আবৃত…’ (জেলাশহর বহরমপুর)
‘সে জন্মতিলক কুড়িয়ে পায়, আমন জন্মে ভাসায়।’ (দোহালিয়া)
‘তার আনন্দগান প্রত্যহ চ’লে যেতে-যেতে/ এইখানে থামে…’ (হাটপাড়া)
‘…দেখি/ জগৎ জানে না যে জগৎ ভাসে, কোথায় ভাসে।’ (হাটপাড়া)
‘… মেঘমুক্ত তার ভাষা, যেই‌ পাঠ করতে যাই‌/ পৃষ্ঠা থেকে পদধূলি ঝ’রে পড়ে…’ (রামকৃষ্ণপুর)
‘…আলতা পা প্রদক্ষিণ করলো, যখন‌ এইভাবে/সীমানা চিহ্নিত
করো, আমি বুঝি,/ বুঝি শূন্যতার পা ছিল না…/ …ধোঁয়া মাটির
দিকে তাকায় আর বসবাসের কথা ভাবে/ এবার সংসারী হতে
হবে, সংসার নারীর পা…’ (শ্রী)
‘…আমি আগুনের চেয়েও নিরুপায়, জ্বলি…’ (গড়েরহাট)
‘একটি তিলার্ধ চিল অন্তরীক্ষের ছিদ্র/ খুঁজে ফেরে, মন্থর, চক্রবৎ—’ (মহাদেবের দুয়ার, উৎসর্গ: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
‘…এই স্থল প্রেতলোকের জন্য কাতর…’ (উত্তরপাড়া আবাদ)
‘যে গ্ৰামসীমা পার হয়ে গেল, তার বহনক্ষমতা অসীম…’ (শ্রীপুর)
‘…ওই কেশদামে কেবলই মেঘ ও রৌদ্র, দিগন্তরেখা কোথায়!’ (উত্তরপাড়া নিজ)
‘…কথা ফুরাবার আগে নীরবতায় রূপান্তরিত হও…’ (গোচারণ)

এমন উচ্চারণযোগ্য পঙ্‌ক্তি আরো ছড়িয়ে রয়েছে এই কাব্যগ্ৰন্থে। এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ—প্রথমটির তুলনায় এই গ্ৰন্থের কাব্যভাষা যে ব্যাপক পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনটা বলা যাবে না—বলতে গেলে শব্দ প্রয়োগে কবি প্রায় এক বৃত্তেই রয়েছেন—তৎসম শব্দের নিগূঢ় ব্যবহারে ১ম কাব্যগ্ৰন্থে যেমন তিনি দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, এই গ্ৰন্থেও প্রায় তেমনটাই পাই। বস্তুত, এই কবি শব্দ-নির্বাচনে ঐতিহ্য-অনুসারী—খুব কম ক্ষেত্রেই তিনি এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। ‘অন্নপূর্ণা…’-র ১৬-সংখ্যক কবিতায় ‘ভাতের হাঁড়ির নীচে আগুন নেই’ লিখলেন বটে, কিন্তু সেখানে ‘অগ্নি’ লিখলে বিষয়টা অস্বাভাবিক হত বুঝে তিনি তা করেননি; কিন্তু তেমন বাধ্যবাধকতা না থাকলে কবিতায় ‘অগ্নি’ লিখতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন—যার প্রমাণ পাই ‘অতিশয়…’-এর ১ম কবিতা ‘যশোহরি’-র ৪র্থ তথা শেষ পঙ্‌ক্তি: ‘অগ্নির, তবু অগ্নির নয়’—এই জায়গায় এসে। এখানে ‘আগুনের, তবু আগুনের নয়’—এভাবে হয়তো লেখা যেত—কিন্তু কবি বিষয়টিতে স্থায়িত্ব ও গাম্ভীর্য আরোপ করার জন্যই ‘অগ্নি’ লিখলেন—এটাই এই কবির বৈশিষ্ট্য—কোনো কারণেই কবিতাকে তিনি তরল করে তোলেন না—কিন্তু তা বলে ভাবগাম্ভীর্যের চাপে নুয়ে পড়ে না তাঁর কবিতা, খুব কম জায়গাতেই তিনি শিথিল হয়েছেন, যা‌ দু’তিন জায়গায় হয়েছেন, তাতে হয়তো তাঁর আবেগ তাঁকে পরিচালিত করেছে—নয়তো প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনিই তাঁর আবেগকে চালিয়ে নিয়েছেন—এমনকি শব্দ ব্যবহারে কোনো সংস্কারের তোয়াক্বাও করেননি এই কবি—কুণ্ঠিত না হয়ে অনায়াসে তিনি ‘চিরতরে’, ‘কৃষ্ণকেতন’, ‘বসনকামনা’, ‘গীতসাথে’, ‘চন্দ্রকিরণতলে’, ‘কানন আঁধার’—এমনসব অতিজীর্ণ শব্দ-ব্যবহার করেন—এবং তা মিশে যায় মূল কবিতার আবহে—কবিতার প্রয়োজনে তিনি পিছন ফিরে তাকাতে প্রস্তুত, সামনের দিকে তাকিয়ে।

আসলে এই কবি ’৭০-এর আগেকার সময়পর্বে যে বাংলা কবিতার আবহ বর্তমান ছিল, তা এক লহমায় যেন পেরিয়ে গেলেন প্রায় প্রথম কাব্যগ্ৰন্থ থেকেই। না, তাঁর কবিতায় স্পষ্টত তাঁর কোনো অগ্ৰজ কবির প্রভাব তো তেমনভাবে নেই—প্রচ্ছন্নভাবে থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু গৌতম তার সবটুকুই প্রায় আত্মস্থ করে নিয়েছেন নিজের কবিতায় এবং ভাষা নির্মাণে বিনীতভাবে ঐতিহ্যের দ্বারস্থ হয়েছেন—এতে তাঁর কবিতাকে কেউ যদি ‘মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতার রূপান্তরিত আধুনিক’-তকমা দেন, খুব সম্ভবত তাতেও তাঁর আপত্তি নেই—তিনি তো সচেতন স্বতঃস্ফূর্ততায় তার ভাবরাশিকে ওই একান্ত ভাষার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন—তা তিনি যা-ই করে থাকুন, পাঠক ‘আমি’-র প্রশ্ন: সব মিলিয়ে কবিতা হল তো? এখানেই কবি গৌতম বসুর উত্তরণ ঘটে গেছে—প্রায় প্রতিটি কবিতাই তাঁর কবিসত্তার ঊর্ধ্বগামিতাকে অনুসরণ করেছে—প্রকৃত কবির জয় বা পরাজয় বলে কিছু হয় না—কিসের তুলনায় জয়—কিসের তুলনায় পরাজয়—জয় বা পরাজয় শুধু নিজের কবিসত্তার কাছে; গৌতম সেখানেই জয়ী—প্রায় প্রতি কবিতাতেই তিনি আত্মজয়ী ও একক এবং সেই কারণে (হয়তো) কিছুটা নিঃসঙ্গ, এই বিপুল-বিস্তৃত বাংলা কবিতার আবহমণ্ডলে।

‘রসাতল’ তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্ৰন্থ আরো ১টি দশক পেরিয়ে ১৪০৮ (২০০১)-এ প্রকাশিত—মধ্যবর্তী ১১/১২ বছরের কবিতা নিয়ে—এই পর্বে এসে তিনি অনেকটাই পাল্টলেন—বলা উচিত এযাবৎ চেনা কবিকে আরো বড় পটভূমে যেন ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল—এক মহাকাব্যিক বাতাবরণে কবির মনোচারণা শুরু হয়ে গেল—ফলত এই পর্বে রচিত ২৮টি কবিতাই (৪০পৃষ্ঠা, ১১টাকা মূল্য) গদ্যকবিতা এবং বহুলাংশেই গথিক-প্যাটার্নের। এই পর্বের কবিতা পড়ে এক দেশ-জনজাতি-কাল-উত্তীর্ণ বোধির সন্ধান পাই, যা‌ নির্মোহ হয়েছে, জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা অতিসামান্য ঘটনাগুলিকে মহত্ত্ব দান করেছে, আহ্বান জানিয়েছে সুস্থ ও স্বস্থতাকে, প্রাচীন মাঙ্গলিকী স্ব-মহিমায় ফিরে আসুক কামনা করেছে এবং আবিষ্কার করেছে ভারতবর্ষের মূল প্রবহমানতাকে।

আত্মজিজ্ঞাসার তাড়না তাঁকে দিয়ে এই কবিতাগুলি লিখিয়ে নিয়েছে—‘রসাতল’ এই জিজ্ঞাসা ও তার উত্তর খোঁজার নিদর্শনে ভরপুর। নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে অনেক কবিতাতেই:

‘…যে‌ নীরবতায় ভাবনার জন্ম হয়, গ্ৰন্থসকল রচিত হয়, এ কি সেই নীরবতা?
যে সত্যের সন্ধানে মানুষ কাতর ও ক্ষয়প্রাপ্ত, তার প্রসন্নমুখ এই
অতিকায় রাত্রির বুকে কি ভেসে উঠবে কোনোদিন?’ (ঘনায়মান)
‘নিজের মৃত্যুদণ্ডের নীচে দাঁড়িয়ে কে কবে অনুভব করেছে এমন বিমল বাতাস?’ (ঘনায়মান)
‘… কীভাবে প্রস্তুত করবো নিজেকে? এ-কোন ভাষার কোলে ভূমিষ্ঠ হলাম সহসা?
কাকে জানাবো দড়ি-বাঁধা এই পুঁথিগুলি নামিয়ে রেখেছি মাটিতে, এগুলি পাঠযোগ্য নয়?’ (সন্ধান)
“পথ থেকে একটি হলুদ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি,
‘এটি কি জীবনের প্রতীক, না মৃত্যুর?’
পরক্ষণেই উত্তর হয়: ‘জ্ঞানের, পরাজয়ের’।” (ঝরাপাতা)

কবি জিজ্ঞাসাদীর্ণ সত্তাকে নিয়ে গেছেন পথে-প্রান্তরে—নিতান্ত সাধারণ ঘটনাও সে-ঘটনায় জড়িয়ে-পড়া, সামান্য মানুষের কাছে, প্রকৃতির মধ্যে গড়ে-ওঠা মানুষের আকাঙ্ক্ষা সমূহের ভাস্কর্যরূপগুলির কাছে—লিখলেন অনবদ্য কবিতা: ‘গল্প’। এই কবিতায় তিনি পরিশীলিত ভাষায় বর্ণনা করলেন কীভাবে অসুরদের উপদ্রবে দেবতারা পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষের ইচ্ছাঠাকরুনের মৃণ্ময়ী বা প্রস্তররূপ ধরে গ্ৰামের মন্দিরে স্থাপিতা হয়ে ‘রাজরাজেশ্বরী’-রূপ ধারণ করেছিলেন; আর কীভাবেই বা সেই গ্ৰাম কালান্তরে কাদের ক্রোধের আগুনে ঘর-দুয়ার-কাছারি ও ধানের গোলা-সহ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল—‘বহুপূর্বে দেবী যেমন স্বর্গরাজ্য পিছনে ফেলে এসেছিলেন, প্রায় তেমনভাবেই রাতের অন্ধকারে, নৌকায়, গরুর গাড়িতে, ছেলে কাঁধে ও ঘটিবাটি মাথায় নিয়ে, পায়ে হেঁটে মানুষ পালাতে লাগল।…রাজরাজেশ্বরী ত্যাগ করতে পারলেন না সেই পুড়ে যাওয়া গ্ৰাম, প্রবাসের বিষণ্ণ মৃত্তিকা।’ দেবী রয়ে গেলেন এই আশায় যে একদিন গ্ৰামে মানুষ আবার ফিরে আসবে, কেন না দেবী একা তো আর দেবী নন, মানুষ না থাকলে ‘তাঁর আর দেবীত্ব’ কোথায়—তাদের উপস্থিতিতেই তাঁর মহিমা প্রোজ্জ্বল—আর এই জায়গাটাই, না-বলা এই কথাটাই কবি এই কবিতায় পাঠকের উপলব্ধির জন্য রেখে দিয়েছেন।

কবিতার চলতি ধারা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে শুরু থেকেই গৌতম চেষ্টা করে গেছেন স্বকীয়তা বজায় রাখতে। গদ্যকবিতা-ভরপুর ‘রসাতল’-এ এসে তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন এবং কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে। ‘অন্নপূর্ণা…’ এবং ‘অতিশয়…’ কাব্যগ্ৰন্থ দুটি যদিও তাঁর নিজস্ব বাক্‌ভঙ্গিতে বিশিষ্ট, তবুও এই দুটি কাব্যগ্ৰন্থে ‘জনপ্রিয় কবিতা’-র উপাদানও ছিল; কিন্তু ‘রসাতল’-এ এসে পাঠক এক শুদ্ধবাদী ধ্রুপদী কবি-কে দেখল, যিনি ছত্রে ছত্রে তাঁর স্থানিক চৈতন্যকে দেশজ মণ্ডল ছাপিয়ে বিশ্ববোধে উত্তীর্ণ করলেন। এখানে তাঁর কাব্যভাষা সরাসরি, ভণিতামুক্ত ও প্রায় সর্বত্রই প্রশ্নজর্জর-উত্তরসন্ধানি। ইতিহাসের, মহাকাব্যের, বিশ্বসাহিত্যের নানা পাতায় ভ্রমণ করেছেন গৌতম এবং বর্তমান জাগতিকতাকে সেখানে প্রতিস্থাপন করে একপ্রকার মানসিক সাযুজ্য খুঁজে পেতে চেয়েছেন—কখনো পেয়েছেন, কখনো পাননি—যখন পেয়েছেন, তখন শান্ত স্বরে কেউ যেন তাঁকে বলেছে: ‘আমি ভারাক্রান্ত, আজ তোমার কথা শুনি’; আর যখন পাননি, তখন: ‘আজ শালিকপাখির সঙ্গে বাক্যালাপ হল না, ঘাড় ঘুরিয়ে পিঠে ঠোঁট ঘষল না সে, খাবার ভাগ করে খেলাম না আমরা, এ-ওর থেকে দূরে, গগনপথে চেয়ে রইলাম শুধু।’ শালিকপাখি ও কবি পরস্পর পাশাপাশি থেকেও ‘গগনপথে’ আত্মত্রাণ খুঁজে চলেছেন, যে যার নিজের মতো করে—এই উপলব্ধি পাঠককে জীবন ও তার উদ্দেশ্য-বিষয়ে প্রশ্নার্ত করে তোলে।

কতকগুলি অমোঘ উপলব্ধির সূত্রে এই কবি পাঠককে মনে করিয়ে দেন যে জীবন এত মূল্যবান, অথচ তা একইসঙ্গে ঠুনকোও বটে। তেমন একটি কবিতা হলো ‘অনন্যা’—একেবারে সংবাদ-পরিবেশনার ভঙ্গিতে শুরু হয়েছে কবিতাটি—মনে হচ্ছে এক মরমী সাংবাদিক ‘প্রতিবেদন’ লিখছেন এইভাবে: ‘কেউ বলেন রাস্তায় সহসা ছড়িয়ে-পড়া বইখাতা ডায়েরি থেকে পুলিশ বাড়ির ফোন নম্বর সংগ্ৰহ করে, কেউ অনুমান করলেন বন্ধুরা তো সঙ্গেই ছিল, খবরটা তারাই প্রথম পৌঁছে দেয়…’—এরপর অনন্যাদের বাড়ি, প্রতিবেশী-ভাই-বন্ধু-আত্মীয়দের ভিড় সেখানে, চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো বর্ণনা: ‘বারান্দায়, সিঁড়ির কোণে অসংখ্য চটিজুতো এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে’ এবং ‘আমরা কেউ-কেউ ইট পেতে পথের ধারেই বসে পড়েছি।’ কোথাও বলা হয়নি দুর্ঘটনায় অনন্যা মারা গেছে—শুধু একটু ইঙ্গিত-আভাস এরকম যে, ‘অনন্যাদের বাড়িটি এতদিন আড়াল ক’রে রেখেছে ফুলে ও পাতায় ভ’রে ওঠা যে বোগেনভেলিয়া গাছটি, সে এমন ব্যর্থ হলো কীভাবে?’ কবি বলছেন: ‘অকল্যাণের মৃদু হাওয়া বয়ে চলেছে…’—শেষে তাঁর মর্মান্তিক উপলব্ধি: ‘যে কোনো গৃহ থেকে শ্মশান খুব দূরের পথ নয়।’ এভাবেই আবিষ্কৃত হয় এক কবির নাগরিক মনন, যা কিনা নীরবে হাহাকার করে, সংগোপনে, কিন্তু অকালমৃত্যুর মতো অতিনির্মম ঘটনার পরেও উচ্চকিত হয় না; আপন বেদনার প্রতিচ্ছবি মৃতের বাড়িটির ভেঙে-পড়া বাতাবরণকে তুলে ধরে কবি এক সর্বজনীন ও চেনা উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পাঠকহৃদয়ে পৌঁছে দিতে চান।

বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলে রবীন্দ্রনাথের পর দেশজ ভাবানুষঙ্গ প্রায় অবলুপ্ত হতে বসেছিল বিশের কবিদের হাতে, বিশেষত ভাষ্যনির্মাণে—অস্বীকার করা যাবে না তাঁরা—জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-বুদ্ধদেব বসু-সুধীন্দ্রনাথ-অমিয় চক্রবর্তী-সমর সেন প্রমুখ কবিরা—পাশ্চাত্য কবিদের অনুপ্রেরণা কাজে লাগিয়েছেন—এবং এর ফলে বাংলা কবিতায় অন্যরকম বাতাবরণ ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হলেও এবং তা কবিতাপাঠকের‌ হৃদয়ে একরকম জায়গা পেয়ে গেলেও এতদ্দেশীয় কবিতা-ঐতিহ্যের সূত্র খুব একটা মানানসই ছিল না, এটা এখন প্রায় স্পষ্ট হয়ে এসেছে। ৪০-এর কবিরাও তেমন একটা বদল ঘটিয়েছিলেন, বড় অর্থে বলা যাবে না—যদিও এই পর্বে সুভাষ মুখোপাধ্যায়-রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী-নরেশ গুহ-অরুণ সরকার-সিদ্ধেশ্বর সেন প্রমুখ কবিরা অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতা লিখেছেন। ৫০-এ এসে প্রায় সবটাই এলোমেলো হয়ে গেল—বলতে গেলে ঐতিহ্য-অনুসারী তেমনভাবে না হলেও ৩০ ও ৪০-এর কবিকুল বাংলা কবিতায় যে গঠনমূলক সুস্থ আবহাওয়ার জন্ম দিয়েছিলেন, ৫০-এর সকলে না হলেও কিছু অপরিণামদর্শী কবির হাতে কবিতার অন্ত্যেষ্টি হতে বসেছিল। ৬০-এর কবিদের তেমনকিছু অবদান চোখে পড়েনি এই ক্ষেত্রে, অন্তত ঐতিহ্য-অনুসারিতার ক্ষেত্রে। ৭০-এ এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি কবিতার এক পরিবর্তিত ভাষা, পরিবর্তিত আন্দোলন—নতুন চেহারায়—যা ৮০-র দোরগোড়ায় এসে গৌতম বসু প্রমুখ কবিদের সচেতন আন্তরিকতায় স্বতন্ত্র মাত্রা পেল—‘রসাতল’ তার অন্যতম নিদর্শন।

এক-একটি টুকরো ছবি, এক-একটি অজানা ইশারা, এক-একটি সংবেদনশীল মুহূর্তের দেখা পাই ‘রসাতল’-এর কিছু কবিতায়—‘শ্রাবণ’ এমন একটি কবিতা। ‘অন্ধকার কেঁপে কেঁপে উঠছে বিদ্যুতের প্রহারে, নিমেষের জন্য তাঁর নতমুখের একপাশ প্রকাশিত হয়, আবার ঘন তমসা’—এই ‘তিনি’ কবির অন্তরাত্মা, নাকি ‘ঈশ্বর’, নাকি অন্য কেউ, অন্য কিছু, আমরা মাঝে মাঝে অনুভব করি, উপলব্ধিতে পেতে চাই, তাঁকে, কিন্তু সর্বদা নাগাল পাই না—‘অকস্মাৎ, আরও একবার আলোর পর্বত মাথার উপর ভেঙে পড়ে, দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত হবার পর তিনি স্পর্শ করেন আমায়, দেখি, নীচে, বহু নীচে, ওই রসাতল’—কবির আত্মদর্শন ঘটে যায় যেন প্রকৃতি-লীলাদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে—আর এর পরেই অতি সাধারণ কিন্তু চেনা ছবি, পৃথিবীতে বৃষ্টি নামার পর যা‌ রচিত হয়, এঁকে ফেলেন অসামান্য নৈপুণ্যে: ‘আঁচলের খুঁটে মাথা ঢেকে টুকুমাসি ছুটে-ছুটে ছাত থেকে শুকনো কাপড় তুলছে, রাজেনদের পায়রার ঝাঁক একসাথে তীরবেগে‌ নেমে আসছে অজানা পৃথিবীর দিকে’—এই ছবি কবিতারই অন্য নাম, যা তাঁর ভেতরের সংরক্ত আপনময়তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে—বৃষ্টি নামার পূর্ব মুহূর্তের বর্ণনার সঙ্গে ‘অজানা শক্তি’-র এমন গূঢ় মেলবন্ধন—কাব্যভাষার এমন সহজ প্রকাশ, এর আগে বাংলা কবিতায়—পাঠ-অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেও বলতে পারি সে ভাবে পাইনি।

মহাকাব্যিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ মধুসূদন-হেমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি এবং অনেকক্ষেত্রেই আমাদের সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বোধোদয় হয়েছে। মহাকাব্যের ঘটনা-চরিত্র-কেন্দ্রিক-জাগতিক-অতিজাগতিক পুনরাবর্তনে আমাদের একপ্রকার শিক্ষালাভ ঘটেছিল—উপরি-উক্ত কবিকুল সেই শিক্ষাকে তাঁদের নিজস্ব অনুভবে আরো অনেকখানি ধৌত-পরিমার্জিত করে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে ক্কচিৎ দু’একজনের কবিতায় তা বিক্ষিপ্তভাবে এলেও তেমন প্রগাঢ়ভাবে আমাদের চোখে পড়েনি। গৌতমের কবিতায় আবার যেন আমরা সেই বাতাবরণের আত্মবিধৌত হলাম। ‘লিও টলস্টয়ের অন্তিম চিঠি’ ও ‘সিঁড়ি’-শীর্ষক কবিতাদুটি আমাদের তেমনই আস্বাদ পেতে সাহায্য করল। ‘মহাভারত’-এর দুটি অন্তিমলগ্নের ঘটনা—প্রথমটি বলরামের ইচ্ছামৃত্যু এবং পরেরটি পাঞ্চালী-তথা-দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডবের স্বর্গারোহণপর্ব—অসামান্য ভাবে কবি এই দুটি কবিতায় তা বিধৃত করেছেন। কবির নির্মোহ উপলব্ধির এক চূড়ান্ত পর্যায়ের আত্ম-উত্তরণ দেখি এই দুটি কবিতায়, যা পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে আত্মশুদ্ধির কোন সীমারেখা পেরিয়ে সর্বদুঃখকষ্টরোগ-হরণকারী মহামরণের সীমানা পেরিয়ে কৃষ্ণসর্পরূপী উত্তরণকালে আত্মা সাগরের দিকে এগিয়ে যায়—অপরপক্ষে স্বচ্ছতর সিঁড়িটি ঊর্ধ্বারোহণের বার্তাসহ অন্তর্লোকে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

‘রসাতল’-এর শেষ কবিতা ‘নদীর বক্ষদেশ’ মনস্ক পাঠককে নিয়ে যাবে এক অতি নৈসর্গিক পৃথিবীতে। কবির বাসনা রূপান্তরিত হয়ে এই কবিতা বিস্তৃত হয়ে পড়েছে ‘ভোর’ হওয়া থেকে শুরু করে ‘ব্রহ্মান্ত’ পর্যন্ত—মাঝখানে আছে ‘জলের চেয়েও ক্লান্ত’ এক ‘দেহ’—যার চেয়ে বেশি ‘ক্লান্ত’ আবার ওই ‘জল’—কেননা সে আসলে ‘সহস্রকণায় চূর্ণ’ ‘সূর্যালোক’—আবার বলা হল: ‘জল নিজেকে বহন করে’—এরপর ‘বেহুলার ঘুম ফুরিয়ে যাওয়া’—আর ‘তার কোলে ঘুমের শুয়ে থাকা’—‘তার দুয়ারে আলো এসে পড়া’—পরপর ঘটনাগুলো ঘটে যায়—আমাদের অতীতের আলো এসে পড়ে এই সময়ে দাঁড়িয়ে—আমাদের মধ্যে। এক আবহমানকালের ‘দুঃখিনী মেয়ে’, ‘ঘাটের সিঁড়িগুলি’, আর ‘পেয়ারাতলা’—যেখানে মেয়েটি ‘আর কোনোদিন আসবে না’—‘নদীর পাড়ভাঙা’—আর ‘কুয়াশা-গচ্ছিত এই পৃথিবী’। আমাদের বুকের কাছ-ঘেঁষা এই ছবি অনেকদিন আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। কবি আশ্চর্য উপায়ে তা আবার আমাদের ফিরিয়ে দিলেন যেন—এটা একরকম ‘পুনরুত্থান’-পর্ব বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে, বলতে পারি ‘রসাতল’ তথা ‘নদীর বক্ষদেশ’-এর শেষ পঙ্‌ক্তিটি এরকম:

‘সম্মুখে দেখা যায় সমুদ্রের মতো নদী, আকাশের মতো সমুদ্র, ব্রহ্মাণ্ডের মতো আকাশ।’

পৃথিবী যে‌ মণ্ডলে সর্বদাই বিরাজ করছে—তারই ভূচিত্র এঁকেছেন কবি এই পঙ্‌ক্তিতে—অথচ আশ্চর্য সব উপমার প্রয়োগে—অনুষঙ্গগুলি নিজেদের মধ্যেই বার্তা ও ভাববিনিময় করছে—এবং তার ফলে প্রত্যেক অনুষঙ্গই আপন সত্তায় বহুগুণিত সারবত্তা আরোপ করতে পেরেছে।

১৪১৪ (২০০৭) সালে প্রকাশিত গৌতম বসুর ৪র্থ তথা আপাতত শেষ কাব্যগ্ৰন্থ ‘নয়নপথগামী’-ও ১ফর্মার চটি বই, যাতে ২৪টি ছোট ছোট কবিতা গ্ৰন্থিত হয়েছে—এগুলির রচনাকাল ১৪১০-১৪১৪ (২০০৩-২০০৭), অর্থাৎ মোটামুটি বছর পাঁচেকের রচিত কবিতা থেকে নির্বাচিত। এই কাব্যগ্ৰন্থেও গৌতমের কাব্যভাষা যে বড় একটা বদলে গেছে, তার নিদর্শন পাই না—এমনকি তাঁর কাব্যভাবনার ক্ষেত্র ও পটবদল ঘটে গেছে, তাও নয়—শুধু যেটুকু লক্ষণীয়, এই কাব্যগ্ৰন্থে প্রযুক্ত শব্দগুলি তিনি সংস্কারমুক্ত মনেই ব্যবহার করেছেন। কিছু শব্দের নমুনা এরকম: অধর, ক্রন্দসী, নিদাঘ, আঁখি, সমাপন, মহারাতি‌, অযতনে‌, আশিস, বারিধারা ইত্যাদি। দূর-বা-নিকট সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় এজাতীয় শব্দ প্রয়োগের চল প্রায় উঠেই গেছে বলা যায়; তবু গৌতম এমন সব শব্দ কেন ব্যবহার করলেন তাঁর কবিতায়? এই ধারাটি অবশ্য তাঁর প্রথম তিনটি কাব্যগ্ৰন্থেও কমবেশি অনুসরণ করে এসেছেন এবং এটাই এখন বলা যায় যে এর বাইরে উনি বিশেষ যেতে চান না—হয়তো কবি এভাবেই কবিতা লিখতে অধিক স্বস্তিবোধ করেন। ‘কবিতা সমগ্ৰ’-এর সময়পর্ব ২৬ বছর (১৩৮৮-১৪১৪; ১৯৮১-২০০৭) ধরা আছে একত্রে—ফলত এই গ্ৰন্থের কাব্যভাষা প্রায় একটি ধাঁচকেই তুলে ধরছে—যে ধাঁচের প্রবণতা ক্রমশ ব্যাপ্ততর হয়ে উঠতে উঠতে একটি ছাঁচকে‌ আবিষ্কার করে ফেলা—এই কবি এইক্ষেত্রে অবশ্যই আবিষ্কারের ব্রাহ্মমুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন; তবে ‘রসাতল’-এর গঠন গদ্যমুখী এবং ভাবপ্রকাশে তা অনেকটাই ব্যতিক্রমী; কিন্তু ‘নয়নপথগামী’-তে তিনি আরো সন্ধানি হওয়ার পরিবর্তে যেন আরো বেশি আত্মস্থ হয়ে উঠলেন!

কবিজীবনটি‌ অতিক্রম করে চলার পথে অনুভবের সক্রিয় প্ররোচনা কবিকে কখনো কখনো অসহায় করে তোলে—তিনি তখন উদ্ধার পেতে চান। তিনি মনে করেন আসলে তিনি ‘অনাথ’—যে কারণে তাঁকে ‘অনাথ’ কবিতাটি লিখে ফেলতে হয়।

‘সামান্য একটা জীবনের মধ্যভাগ থেকে
ঊর্ধ্বে, অন্তরীক্ষের যেটুকু অংশ দেখা যায়
তা সামান্যই, আপনাকে বলার মতো নয়।
এই প্রদেশ থেকে পরলোক দেখা যায় না
গগনপথের কাদাজল, গরুর গাড়ির
চাকার দাগ, মাইলস্টোন—এসব কিছুই
ধরা দেয় না চোখে। তবু, প্রত্যহ, সিঁড়ি বেয়ে
উঠে আসি, ভাবি, সুদীর্ঘ, শান্ত এক অপেক্ষা
আমায় ঘিরে রয়েছে; সত্য তোমার প্রকাণ্ড শূন্যতা, ক্রন্দসী।’

গোটা কবিতাটাই উদ্ধৃত করলাম। আমাদের এই অবস্থান ও তার অকিঞ্চিৎকর স্থিতি এবং কবিরও তাই—ফলত অবস্থানের গরিমা থেকে আহৃত আত্মশক্তির বলে উজ্জীবিত কবির যে‌ অন্তরীক্ষ তথা গগনপথে তাঁর উত্থানের আকাঙ্ক্ষা—সেই অজ্ঞাতলোকের বিষয়ে তাঁর অস্পষ্ট ধারণা অতি সহজেই ব্যক্ত হয় এই কবিতায়। এই সহজ কথাটি কাব্যের সত্যের সঙ্গে সাযুজ্য ঘটিয়ে কাব্যভাষায় ব্যক্ত করা কিন্তু কঠিন কাজ—এই কঠিন কাজটি গৌতম এই কবিতায় অনায়াসেই করেছেন; যদিও ‘ক্রন্দসী’ শব্দটি এক্ষেত্রে ভাষ্যের উচ্চতাকে সামান্য ভঙ্গুর করেছে বলেই মনে হয়েছে আমার—বিশেষত ‘সত্য’ যখন শেষপর্যন্ত এক ‘প্রকাণ্ড শূন্যতা’—তার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তিনি ‘অনাথ’ এবং ‘নয়নপথগামী’—সুতরাং অবিরল বর্তমান জীবনে অধিষ্ঠিত থেকে কবি-র আত্মোত্থানের তীব্র বাসনা এই কাব্যগ্ৰন্থে—শুধু এই কাব্যগ্ৰন্থে নয়, ‘কবিতা সমগ্ৰ’-এর নানা কবিতাতেই ধরা পড়েছে। বস্তুত, অকিঞ্চিৎকর জীবনযাপনের গ্লানি তাঁকে যতখানি সঙ্কুচিত, দীন ও বিনয়াবনত করে রাখে, ঊর্ধ্বগামিতায়‌ উত্তরণের বাসনা ততই তাঁর তীব্রতর হয়ে ওঠে। এভাবেই আমরা পেয়ে যাই শুদ্ধতাকামী এক কবিকে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে, যে-শুদ্ধতা আকাঙ্ক্ষা কখনো কখনো তাঁকে আবেগকাতরও করে তোলে, অন্তত শব্দ-ব্যবহারে।

গৌতম আবেগকাতরতাকে‌ কোথাও কোথাও লাগাম পরাননি, এমন কয়েকটি নিদর্শন, আমার যেমন‌ মনে হয়েছে, ব্যক্ত করি। ‘পৃষ্ঠা’ কবিতায়: ‘ছেঁড়া গ্ৰন্থের/ ছেঁড়া পৃষ্ঠার ছেঁড়া পংক্তির‌ ছেঁড়া শঙ্খধ্বনি’; ‘নিদাঘ’ কবিতায়: ‘অচেনা বৃক্ষের অচেনা ছায়া, অচেনা নিদাঘের/ অচেনা এই অর্জুনপুর’; ‘কারাগার’ কবিতায়: ‘বাজাও, পায়ের বেড়ি দু’খানি বাজাও/ … তোমার করতল, বাজাও কালো আলো,/ বাজাও, বধিরতা ভেদ ক’রে যে আসে/ সে যে অনুপম গীত, তাকেই বাজাও,/ বাজাও রুদ্রমূর্তি, বাজাও সমাপন।’

উদ্ধৃতিগুলিতে ‘ছেঁড়া’, ‘অচেনা’ ও ‘বাজাও’ শব্দের পৌনঃপুনিক প্রয়োগে কাব্যাত্মা কতখানি অক্ষুণ্ন থেকেছে, সেখানে আমার প্রশ্ন থেকেই গেল।

অনেক ভালো কবিতাই ‘নয়নপথগামী’কে সমৃদ্ধ করেছে—তার কয়েকটি: ‘ত্রয়োদশী’, ‘সৈকত’, ‘আকাশপথে’, ‘যমপুরী’, ‘বইমেলায়’, ‘প্রথম শনিবার’, ‘রাস্তার জন্য একটি’, ‘সুদর্শন’, ‘রথতলা’, ‘আনন্দগান’, ‘জন্মদিবস ১৪ মার্চ ২০০৭’, ‘ভূমিস্পর্শমুদ্রা’, ‘মীরা দাসী’, ‘বিসমিল্লা’। কবির কাব্যভাষার সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য: বিষয়ের বৈচিত্র্য থাকলেও সাধারণ একটি সূত্রে উনি বিভিন্ন কবিতার মেলবন্ধন ঘটান, যার মূল সত্য দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বিনীত পরিবেশনের ভঙ্গিমায়, অথচ স্বস্তির এটাই যে, একই সঙ্গে তাঁর দার্ঢ্য লক্ষণীয়, প্রায় সর্বত্রই। কোথাও বলছেন ‘সামান্য এই কবিজন্ম’ তো কোথাও বলে উঠছেন ‘মৃত্যুদাতা জন্মদাতা জানি, চিনি না জীবন’; কোথাও বলছেন ‘ফিরে এসেছি অতিক্ষুদ্র হয়ে’ তো কোথাও বলছেন, ‘…দুই চক্ষু ভ’রে দেখেছি অদূরে/ ওই তোমার চক্র ঘুরছে, নয়নাভিরাম’।

আসলে এই কবি দ্রষ্টা—‘সৃষ্টি’কে দেখেন নানাভাবে নানা অবস্থানে নিজেকে স্থাপন করে—‘অগ্ৰন্থিত কবিতা’ শেষের দিকে ৭টি রেখেছেন কবি—এই কবিতাগুলিও সম্ভবত একই কালপর্বকে ধারণ করে আছে—এদের মধ্যে ৩য় ও ৫ম কবিতা-দুটি বাদে বাকি ৫টিই আমার ভালো লেগেছে।

‘কবিতা সমগ্ৰ’ পড়ে ওঠার পর একটি যে সাধারণ অনুভূতি আচ্ছন্ন করেছে আমায়, তা এই অজস্র কবিতাগ্ৰন্থের ভিড়ে একটি স্বতন্ত্র কাব্যভাষায় যেন আমি ধৌত হয়ে উঠলাম—যে-কবিতাসমূহ পড়ে ওঠার পর আমার পাঠকসত্তা স্বস্থ ও সুস্থ হয়ে ওঠে—যে-সীমাবদ্ধতায় আমরা গ্ৰস্ত হয়ে আছি, যে অগাধ আকাঙ্ক্ষায় আমরা ঋদ্ধ হয়ে উঠতে চাই—এই দু’য়ের টানাপোড়েন যেন আমাকে ঋজু করে তোলে—আমার নুয়ে-পড়া সামান্য অস্তিত্ব কোথাও কিছুটা যেন সামান্যতর অর্থবহ হয়ে ওঠে—বেঁচে থাকার একটা মানে বুঝি খুঁজে পাই।

কবি গৌতম বসুর কবিতা এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার ঠিক কোন তলে অবস্থান করছে, তা আমার নির্ণয়ের বিষয় নয়—তা উতলে, না অবতারে, তাও, ঠিক জ্ঞাত নয় আমার। এই মুহূর্তে বেশ কিছু সুকবি বিরাজ করছেন বাংলা কবিতা ভুবনের নানান প্রত্যংশে—সকলের মধ্যে এই কবি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে, তা আগামীকালের আলোচকেরা হয়তো চিহ্নিত করবেন; আমার শুধু ব্যক্তিক লাভ লোকসানের হিসেব কষতে মন চায় যে একটি কাব্যগ্ৰন্থ বা যে কোনো গ্ৰন্থ কেন পড়ব আমি! পাঠান্তে যদি না আমার মানসিক পুষ্টি ঘটল কিছু, তবে সে গ্ৰন্থপাঠে বৃথা কালক্ষয় কেন—বিশেষত এই অনিশ্চয় ভরা ‘পদ্মপত্রে জলবিন্দু’-জীবনে?

এই কাব্যগ্ৰন্থসমগ্ৰ পাঠে আমার এতৎ-ধর্মী লাভ ঘটেছে বলেই মনে করি, এজন্য অন্তত কবি গৌতমের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর ‘সমগ্ৰ’-এর প্রথমার্ধটি আসলে পড়া হল আমার এই বিবেচনায় দ্বিতীয়ার্ধটির অপেক্ষায় রইলাম—কেন না এই বিশ্বাস আমার দৃঢ় যে আগামীদিনে তাঁর হাত দিয়ে বাংলা কবিতা আরো অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতার সম্ভারে সমৃদ্ধতর হবে—এবং সম্পূর্ণ আরেক অভিনব কাব্যভাষার জন্ম দেবেন তিনি।

মহাবাহু,
অষ্টম সংখ্যা, বর্ষা ১৪১৭

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২