পৃথিবীর আধুনিকতম নারী দ্রৌপদী – সেবিকা ধর
যে চিন্তা দ্বারা বিশ্বজ্ঞান তত্ত্ব ও বাস্তবের বিধি-বিষয় ব্যাখ্যাত হয়, দর্শন হল সেই বিশেষ চিন্তাজাল। আর এই দর্শনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বিনির্মাণ। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা তত্ত্ব ভাঙার খেলায় মত্ত। তাঁরা সমস্ত নির্মাণ-বিধিকে বিনির্মাণের আলোকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন এবং সত্য আবর্তিত সমস্ত পর্দাকে সরাতে উদ্যোগী৷ এক্ষেত্রে রামায়ণ, মহাভারত, পূরাণের তত্ত্বকে যেমন ভাঙা হচ্ছে ঠিক তেমনি আধুনিকতার তত্ত্বকেও ভাঙা হচ্ছে৷ তেমনি ভাঙা হচ্ছে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা পুরুষতন্ত্রের একচ্ছত্রতাকে৷ উত্তর আধুনিক মননে বিনির্মাণ পাঠে নারী একটি বিশেষ স্থান লাভ করে আছে৷ রহস্য শাশ্বত ও চিরন্তন। জগৎ পটে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে বৈপ্লবিক ভুমিকায় নারী। হ্যাঁ কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঘুম ভেঙে যাত্রা শুরু থেকে পরিপূর্ণ আলোক ও গোধূলির পথ বেয়ে জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রি সমস্ত কিছুই স্মরণের আলোকে বেড়ে ওঠে এক অমায়িক কণ্ঠস্বরে। এই কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছে সুদূর অতীতকাল থেকে। ধরা যখন প্রথম পূর্ণতা পায় তা মাতৃরূপে উদ্ভাসিত হয়েছিল। সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নারী কখনও মা, কখনও ভগিনী, জায়া রূপে বটবৃক্ষের ন্যায় বৈশাখী দাবদাহে জলন্ত হৃদয়কে আশ্রয় দিয়ে গেছেন।
মহাভারতের অন্যতম চরিত্র দ্রৌপদী ব্যসদেবের যেমন প্রিয় তেমনি কাশীরাম দাসেরও প্রিয়। দ্রৌপদী সমগ্র নারী সমাজকে সম্মানের স্থানে আসীন করেছেন। সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে বিশ্বদর্শনের প্রতি চোখ রাখলে দেখা যায় যে নারীকে এক নির্মাণ বিধিতে তৈরি করা হয়েছে। নারী মানেই সে এই কাজ করবে, এই বিষয়ে পারদর্শী অর্থাৎ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে নারীর ধারণা গড়ে উঠেছে৷ কিন্তু আজ যখন নারীকে নিয়ে বিনির্মাণের পাঠ উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ঠিক তখন তার ঢেউ পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণ সমগ্র দুনিয়াকে তোলপাড় করে চলেছে। মহাভারতের নারী দ্রৌপদীকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে দেরিদার থিওরি অবলম্বন করে বিশ্লেষণের প্রয়াস গৃহীত হয়েছে।
ব্যসদেব দ্রৌপদীর রূপ বর্ণনা করেছেন সুদেষ্ণার মুখ দিয়ে। দ্রৌপদীর পায়ের গোড়ালি সুসংহত, ঊরুদুটি পরস্পর সুসংলগ্ন। তিনটি বস্তু গম্ভীর— নাভি, কণ্ঠস্বর ও স্বভাব। চারটি উন্নত বস্তু— স্তন, নাসিকা, নিতম্ব ও মন। তিনটি স্থান রক্তিম— পায়ের তলা, হাতের তালু এবং অধর। কণ্ঠস্বর হাঁসের মতো শ্রুতিমধুর। ঘন কেশ, গায়ের রং শ্যামলা। কাশ্মীরি ঘোটকীর সাথে তুলনা করা যায়৷ চোখের পাতাগুলি বঙ্কিম, ঠোঁট দুটি বিম্বফলের মতো টুকটুকে লাল, কটিদেশ ক্ষীণ, গ্রীবাদেশ শঙ্খের মতো তিন রেখায় অঙ্কিত, শরীরের শিরাগুলি গৃঢ়, মুখখানি পূর্ণিমার চাঁদের মতো নিটোল। সেই দ্রৌপদীই কিন্তু নির্মাণে বিনির্মাণে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্না, ব্যক্তিত্বসম্পন্না, যুক্তিনিষ্ঠ, অন্যায়ের প্রতিবিধানে সদা সতর্ক, বিচক্ষণ। দ্রৌপদী কোনো অবস্থাতেই অন্যায়কে মেনে নেননি, প্রশ্রয় দেননি। নিজ বংশ গৌরবে গৌরবান্বিতা, কৃষ্ণের প্রিয় সখী, ধর্মপ্রাণা, সত্যনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ অধর্মাচরণকে মুখ বুঝে সহ্য করেননি৷ অন্যায়ের প্রতিবাদে, অন্যায়ের প্রতিবিধানে দ্রৌপদীর ধারাবাহিক প্রতিবাদ বাস্তবিকই তাঁকে বিরল সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
নারী মহিমার এক বিরাট বিস্ময় এক নারীর পঞ্চপতি। মহর্ষি ব্যসদেব অপূর্ব সুকৌশলে এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ বহুগামী হতে পারে কিন্তু নারীর একপতি হতেই হবে এ কেমন কথা? মহাভারত-কার অত্যন্ত সুকৌশলে বহুপতিত্বে নারীর অধিকার দ্রৌপদীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন। আসলে এক স্ত্রীর বহুপতি ভারতীয় সমাজে বোধহয় ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রচলিত ছিল না৷ এখনও দেখা যায় উত্তর ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহুপতি একপত্নী পরিবারের কথা৷ নারীর সংখ্যা স্বল্পতা হেতু অথবা সম্পত্তি বিভাজনের প্রশ্নে কিনা সেকথা স্পষ্ট নয়৷ আধুনিককালে আমাদের সমাজেও দুইপতি, এক বিবাহিত আরেক প্রেমিক।এখানে একপত্নীর সহাবস্থান বিরল নয়। এমনকি এক মায়ের বৈচিত্র সন্তানও দুর্লভ নয়। হলিউড অভিনেত্রী ল্যামার কিংবা এলিজাবেথ টেলর দশ বারোটা বিয়ে করেছেন। দৃশ্যত তাদের একটিই পতি৷ দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেও বিয়ের পরে নিয়ম হল, তিনি এক বছর এক এক স্বামীর সাথে সহবাস করবেন এবং সেসময় অন্য পতিদের সাথে স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এইভাবে দ্রৌপদী পঞ্চপুত্রের জননী হলেন পুরুষশাসিত সমাজে বিশেষত নারীর তরফে স্বামী তথা বহুগামিতাকে বেছে নিতেও দ্রৌপদী ইতস্তত করেননি। যৌন তথা দাম্পত্য স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেদিন অর্থাৎ দুহাজার বছর আগে দ্রৌপদী যে একটা ছোটোখাটো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল সে কথা সম্ভবত তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি।
আধুনিক নির্মাণ-বিনির্মাণ তত্ত্বের নিরিখে দেখলেও এই ঘটনার মধ্যে অতিরিক্ত তাৎপর্যের সন্ধান মিলতে পারে৷ আজ থেকে দুহাজার বছর আগের সেই প্রাক্-সামন্ততান্ত্রিক রাজা-রাজড়াদের যুগে বহুক্ষেত্রেই যেখানে পুরুষশাসিত কৌলিন্য প্রদর্শন হিসাবে প্রচলিত ছিল, “এক বর অনেক কনে” অর্থাৎ পুরুষের তরফে বহুবিবাহ প্রথা, সেই সময়ে, বিপরীত ঐতিহ্যে দ্রৌপদীর তরফে এই যে এক পত্নী পাঁচ পতিবরণ– সেটাও একধরনের ‘স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা’। যা অনেক সময়েই স্বাধীনতা ও প্রগতিবাদীতার অভিজ্ঞান হয়ে থাকে সমাজেতিহাসে। তাই অনেকেই দ্রৌপদীর দৃষ্টান্তকে “পর্যায়ক্রমিক একগামিতার” (serial monogamy) সুস্থ-সুশৃঙ্খল নজির হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসু দ্রৌপদীকে নির্মাণ করেছেন একজন মেধাবী তার্কিক হিসাবে। কারণ যুধিষ্ঠিরকে জীবনভর প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে যে তর্ক-বিতর্ক মীমাংসার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যতম হলেন দ্রৌপদী। বনপর্বে ক্রোধ ও অক্রোধ বিষয়ে দ্রৌপদী প্রহ্লাদের একটি উদাহরণ দেখিয়ে প্রমাণ করলেন যে বিরতিহীন ক্রোধ যেমন অশুভ, নিরবিচ্ছিন্ন ক্ষমাও তেমনি অনিষ্টসাধক। উত্তরে যুধিষ্ঠির তাত্ত্বিক দিক থেকে দ্রৌপদীর কথা মেনে নিলেন। ভাবা যায় সাধারণভাবে, একজন নারী হিসেবে এবং বিশেষভাবে স্ত্রী হিসাবে কতটা তীক্ষ্ণধার ও ক্ষমতাময়ী হলে, অন্তত প্রাথমিকভাবেও মহাভারতের তর্কাতীত ও শ্রেষ্ঠ সত্যদ্রষ্টাকেও নতিস্বীকার করতে হয়!
দ্রৌপদী ও যুধিষ্ঠির যে পারস্পরিক সম্ভ্রমে জড়িত, যে সুসংহত সম্পর্ক, তাদের সপ্রেম এতটাই আন্তরিকতায় উজ্জ্বল ছিল সমগ্র মহাভারতে তার আর কোনো নজির নেই। সমকক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত এই যে সুন্দরতম দাম্পত্য সম্পর্ক দ্রৌপদীর তরফে, একজন নারীর তরফে নারীর যে ক্ষমতায়ন এ ধরনের পূর্ণপ্রাপ্তি আজও দুর্লভ। একবিংশ শতকের সেই স্বপ্ন কত বছর আগে যেন দ্রৌপদীর মধ্যে ফুটে উঠেছিল। হোক দাম্পত্যে, হোক প্রেমের সম্পর্কে, শারিরীক সম্পর্কে ঐতিহ্যগত ভাবে ভারতীয় নারীর সাধারণভাবে যে কুণ্ঠা, লজ্জা ঠিক তার বিপরীতে ভীমসেনের মতো মহাগজ স্বামীর সঙ্গে দৈহিক সঙ্গমে দ্রৌপদীর কতখানি স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বাধীন সক্রিয়তা দেখা গেছে তা বিরলের মধ্যে বিরলতম।
রাজশেখর বসু দ্রৌপদীর চরিত্র বিশ্লেষণে বলেছিলেন যে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে দ্রৌপদীর মতো অন্য কোনো নারী তাঁর তুল্য জীবন্তরূপে চিহ্নিত হননি। বারো বছরের বনবাস শেষে যখন দ্রৌপদী ফিরে এলেন জয়দ্রথ তাঁকে হরণ করতে আসেন। তখন দ্রৌপদী যৌবনের শেষ প্রান্তে। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী ধারার ধারক ও বাহক হওয়া দ্রৌপদীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। যেমন ধীবর কন্যা সত্যবতীর সৌন্দর্য ছিল voluptuous sex gooddess এর মতো। যার মোহিনী আকর্ষণ তপোক্লিষ্ট মুনি কিংবা বিলাসমত্ত রাজা কেউই অস্বীকার করতে পারেননি। আশ্রম কন্যা শকুন্তলার সৌন্দর্য ছিল অনাশ্রিত পুষ্পের মতোই শান্ত সমুজ্জ্বল। কিন্তু দ্রৌপদীর আকর্ষণ ছিল বিদ্যুৎবহ্নির মতো যার মধ্যে মিশেছিল রূপবহ্নির সাথে বিদ্যুৎপ্রভ ব্যক্তিত্ব, যা তেজস্বিতায় ও মননস্বিতায় তুলনারহিত।
দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের নির্দেশে রাজসভায় আনতে গেলে দ্রৌপদীর কণ্ঠে শুনতে পাওয়া যায়, কোনো রাজপুত্র কি কখনও আপন ভার্যাকে নিয়ে খেলায় মাতেন? লাঞ্ছিতা দ্রৌপদী সভায় আসীন সকলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, কেউই যখন দুঃশাসনের আচরণের প্রতিবাদে মুখর নন, তখন বুঝতে হবে দুঃশাসনের আচরণে তাঁদের সম্মতি আছে। তাঁদের চরিত্রও নষ্ট হয়ে গেছে৷ সতী-সাধ্বী রমণী হলেও পঞ্চপাণ্ডবদের তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। কারণ তাঁদেরই চোখের সামনে ধর্মপত্নী লাঞ্ছিতা হতে দেখেও প্রতিবাদী হননি। যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন তিনি কি দ্যুতক্রীড়ার শঠতা বুঝতে পারেননি, ভীমের বাহুবলকে ধিক, অর্জুনের গান্ডীবকে ধিক বলেছেন। পাঁচ পতির ঔরসে তাঁর পাঁচ-পাঁচটি পুত্র জন্মেছে; এদের রক্ষা করার জন্যও স্বামীদের কর্তব্য ছিল তাঁকে রক্ষা করা৷ কিন্তু এরা সকলেই মুখ বুঝে তা সহ্য করেছেন। দ্রৌপদী ধর্মের সমালোচনাতেও মুখর হয়েছেন। যে ধর্মের কারণে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী এবং তার প্রিয় ভ্রাতাদের ত্যাগ করতেও সক্ষম। সেই ধর্মই যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করছে না৷ দ্রৌপদী নিশ্চুপ, নিরুত্তাপ যুধিষ্ঠিরকে উত্তেজিত করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নানাভাবে সচেষ্ট হয়েছেন। যুক্তির জাল বিস্তার করেছেন। কর্তব্যচ্যুতির অপরাধে অভিযুক্ত করেছেন, এমনকি অন্যায়ের প্রতিকারে বিরত থেকে যুধিষ্ঠির যে ধর্মাচরণেও ব্যর্থ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, দ্রৌপদী চরিত্র নির্মাণের পেছনে ব্যসদেবের উদারতা লক্ষ করার মতো। দ্রৌপদীর মতো নারী চরিত্র ভারতীয় সাহিত্যে বিরল। দ্রৌপদীর শাস্ত্রজ্ঞান অসাধারণ৷ তিনি যুধিষ্ঠিরকে মনু, বৃহস্পতিদের মতো মহামান্যদের অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন উপদেশ স্মরণ করাতেও দ্বিধাবোধ করেননি। গণিত শাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান অসামান্য। ব্যসদেব কিন্তু তৎকালীন সময়ে দ্রৌপদীর পথ অবলম্বন করে অনেক সামাজিক সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ জয় আসলে পাণ্ডবদের নয় শুধুমাত্র দ্রৌপদীর জয়। যা দ্রৌপদীর চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দ্রৌপদীকে আমরা বিদগ্ধা রমণী বলি। শুধু তার পঞ্চস্বামী নয়, এই সম্পর্কের বাইরেও তাঁর আরও এক সম্পর্ক ছিল কৃষ্ণের সাথে। সে সেতু বন্ধুত্বের। তৎকালীন যুগে এটা তো ভাবাই যায় না। একজন অসাধারণ পুরুষের সাথে এক অসামান্যা রমণীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক সময়েই প্রণয়ের প্রান্তদেশে ঝুঁকে পড়ে। কথাটা স্বীকার করাও কঠিন। কেননা যুগে যুগে যে সব ‘ইন্টেলেকচুয়াল পাওয়ার কাপল’ তৈরি হয়েছে, তাদের অনেকের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক সামান্য হলেও কখনও কখনও ঘটেছে। কিন্তু বৌদ্ধিক স্তরে ব্যাপারটা কেমন হয় সেকথা জানতে পারি সিম্যান দ্য বোভোয়ারকে পল সাঁত্রের লেখা চিঠিতে। একটা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “I wanted to bring you my conqueror’s joy and lay it at your feet, as they did in the Age of Sun King. And then, tried out by all the shouting, I always simply went to bed. Today I am doing it to feel the pleasure you don’t yet know, of turning abruptly from friendship to love, from strength to tenderness. Tonight I love you in a way that you have not known in me: I am neither worm down by travels nor wrapped up in the desire for your presence. I am mastering my love for you and turing it inwards as a constituent element of myself”.
কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে প্রথম দেখেছিলেন স্বয়ংবর-সভায়। যেদিন অর্জুন কন্যাপণ জিতে দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলেন। সেদিন থেকে কৃষ্ণের সাথে পাণ্ডবদের গভীর সম্পর্ক ঘটেছে। তারপর থেকে কৃষ্ণের সাথে দ্রৌপদীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে পাণ্ডবদেরই দুঃখ-সুখের প্রতিবিম্বপাতে। কিন্তু কখনও এমন হয়নি যে অনন্ত শক্তি থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণ কোনোদিন পাণ্ডবদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সেতুর বাইরে এসে দ্রৌপদীর সাথে অন্যথা সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এবং তা দ্রৌপদীও করেননি কোনোভাবে। কিন্তু কৃষ্ণের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও শত্রুরা কেন এমন করল? যে সম্পর্ক অর্থাৎ বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে৷ কৌরব সভায় যখন দ্রৌপদী লাঞ্ছিতা তখন পঞ্চপাণ্ডব নপুংসক, স্থবির এবং দুর্যোধনের দাস মাত্র। তবে সেখানেও কৃষ্ণের ভূমিকা নেহাতই অলৌকিকতা মাত্র। আমার মনে হয় সারা পৃথিবীর নারীরা তাঁদের বস্ত্র দিয়ে দ্রৌপদীকে সেদিন রক্ষা করেছিলেন। এখানেও নারী শক্তির প্রতিবাদ লক্ষ করার মতো। এই দ্রৌপদী আমাদের প্রতিবাদী দ্রৌপদী।
জয়দ্রথ কিছুতেই দ্রৌপদীর যোগ্য হতে পারে না। যেখানে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা রূপবান পুরুষ, সহদেবও চন্দ্র-সূর্যের মতো তেজস্বী, অর্জুন জিতেন্দ্রিয়, ভীম মহাবাহু ও যুধিষ্ঠির কৌরব শ্রেষ্ঠ৷ এই বর্ণনায় জয়দ্রথকে ভীত সন্ত্রস্ত করতেই দ্রৌপদী তাদের মহান বলেছেন। কিন্তু পাশা খেলায় দ্রৌপদী তো একা যুধিষ্ঠিরের ধর্মপত্নী ছিলেন না। তাঁর উপর সমান পতিত্বের অধিকার অন্য চার ভাইয়েরও। অতএব এখানেও যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে। দ্রৌপদী পরামর্শ দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে, কারা ক্ষমার যোগ্য আর কারা ক্ষমার অযোগ্য৷ কীচক বধের প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দ্রৌপদী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভার্যাকে রক্ষা না করলে সন্তানও রক্ষিত থাকবে না। আর সন্তান রক্ষিত না হলে তারা নিজেরাও রক্ষা পাবে না।
দ্রৌপদীর এই সন্তান রক্ষার পরিচয় পাওয়া যায় অর্জুনের সন্তান সুভদ্রার গর্ভে আসার পর। অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু৷ যেহেতু দ্রৌপদী অর্জুনকেই বিয়ে করেছিলেন তাই অর্জুনের সন্তানের মা হওয়ার গৌরব চেয়েছিলেন অবশ্যই। কিন্তু পরিণামে অর্জুনের ভালোবাসা তাঁকে ভাগ করে নিতে হল সুভদ্রার সাথে। কৃষ্ণের ভাগিনেয় বলে অভিমন্যু যদি এতটা প্রাধান্য পেয়ে থাকে তবে দ্রৌপদীর ছেলেরা কম কীসে। মহাকাব্যের নিয়মে দ্রৌপদীর মা হওয়াটা কেমন যেন সাদামাটা।পঞ্চপুত্র জন্মানোর পর দ্রৌপদীর আনন্দ হয়েছিল নিশ্চয়ই। আপন পুত্রদের সাথে অভিমন্যুকেও দ্রৌপদী উদার মনে সমান স্নেহ করেছেন অথচ মহাকাব্য তাঁর মাতৃসত্ত্বার প্রতি সুবিচার করেনি। দ্রৌপদীর ছেলেরা ও অভিমন্যু একসাথে বেড়ে উঠেছে অথচ পাঞ্চালীর ছেলেরা ঢাকা পড়ে গেছে অভিমন্যুর দক্ষতা ও উজ্জ্বল অস্তিত্বের আড়ালে। তাঁদের প্রশংসা করবার মতো কোনও গুণ ছিল না এমন তো হতে পারে না। জননী দ্রৌপদী কী পেলেন? তাঁর ছেলেরা যখন খুব ছোটো তখনই সেই ভয়ানক পাশা খেলা অনুষ্ঠিত হল। শিশুরা মায়ের সাথে অজ্ঞাতবাসে যেতে পারেনি। দ্রৌপদীর মাতৃহৃদয়ের যাতনার খবর কেউ রাখেনি। রাখেনি মহাকাব্যও। কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় হল, দ্রৌপদীর অন্তরের জ্বালা প্রশমিত হল কিন্তু এক ভয়ংকর নিষ্ঠুর সত্য যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। যুদ্ধ শেষের পর কৌরব পক্ষের অশ্বথামা মধ্যরাতে গোপনে নিদ্রিত পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে অকস্মাৎ হত্যালীলা শুরু করলে সেই তাণ্ডবে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের প্রাণ গেল। পুত্রশোকে দ্রৌপদী দিশেহারা। অবশেষে এক শূন্যতা যেন গ্রাস করে রেখেছিল তাঁকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
ভারতবর্ষের আঞ্চলিক মহাভারতে (ভীল মহাভারত) দেখতে পাই দ্রৌপদীর চরিত্রের ওপর বহু অলৌকিকতা ও দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছে৷ রয়েছে দ্রৌপদী ও বিসুখার দ্বন্দ্ব। এখানে ভীল লোককথাও স্থান করে নিয়েছে। এই লোককথায় বিসুখা একজন চমৎকার পুরুষ এবং তাদের যৌনতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। বিসুখাকে একজন শক্তিমান এবং মার্জিত প্রেমিক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যা একজন অগ্নিজাত মহিলার সাথে রাজযোটক। এটা কোনো ধর্ষিত হবার ঘটনা হিসেবে চিত্রিত হয়নি। ভীল দ্রৌপদী ছিলেন একজন ভয়ংকর নারী। তিনি অসীম ক্ষমতাসম্পন্না এবং স্বর্গীয় রাজতন্ত্রের অধিকারিণী এবং ভগবানের থেকেও উচ্চপদে আসীন। রাত্রিতে নয় সহস্র ভগবান তাঁর সম্মানে সমাবেশে হাজির থাকতেন। দ্রৌপদী সিংহের পিঠে আরোহণ করে একহাতে আলোকস্তম্ভ এবং অন্যহাতে তরবারি নিয়ে আবির্ভূতা হতেন। কাছাকাছি এসে পড়লে ভগবান তাঁর সিংহাসন ছেড়ে এগিয়ে এসে তাঁকে গ্রহণ করতেন এবং তারপর অনুষ্ঠানের সূচনা হত।
গায়েত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক দ্রৌপদী সম্পর্কে বলেছেন, “In the epic Draupadi’s legitimized pluralization (as a wife among husbands) in singularity (as a possible mother or harlot) is used to demonstrate male glory”। সামগ্রিক ভাবে মহাভারতের বিস্তৃত আলোচনার পর গায়েত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মিতালী ও সংঘর্ষের সাথে মিল রেখে দ্রৌপদী চরিত্র আলোচিত হয়েছে এখান থেকেই দেরিদাও তাঁর তত্ত্বের প্রয়োগ করেন। বিনির্মাণ তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা মহাভারতের দ্রৌপদীকে অন্যতম নায়িকা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। দেরিদার থিওরি অনুযায়ী আমরা বলতে পারি মূল কাহিনী নিশ্চিহ্ন না করে দ্রৌপদীর চরিত্রভাবনা নতুন নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
[শীর্ষচিত্র মুল শিল্পীঃ Rupatan Naskar ]