প্রতিপক্ষ: বিশ্বকাপের আবহে  বুয়েনস এয়ারস ছুঁয়ে থাকে কলকাতাকে – পারমিতা রায়

শেয়ার করুন

কাতার বিশ্বকাপে তাদের  প্রথম ম‍্যাচে আর্জেন্টিনা যখন সৌদি আরবের কাছে পরাজিত হল তখন অনেকেরই মনে পড়েছিল ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা বনাম ক‍্যামেরুন ম‍্যাচের কথা। ক‍্যামেরুন মেক্সিকো বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়েছিল সেবার। সেই ধাক্কা সামলে আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত ফাইনালে গিয়েছিল। অনেকেই সেই উদাহরণ দেখিয়ে আর্জেন্টিনা ঘুরে দাঁড়াবে এই বিশ্বাসে স্থির ছিল। ক‍্যামেরুনের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সেই ম‍্যাচের প্রসঙ্গ উঠতেই মনে পড়ে গেল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি গল্পের কথা। গল্পটির নাম ‘প্রতিপক্ষ’।

গল্পটি আবর্তিত হয় ১৯৯০-এর ৮ জুন তারিখটিকে ঘিরে। সেদিনই ছিল ইতালি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম‍্যাচ, প্রতিপক্ষ ক‍্যামেরুন। এই গল্পের নায়ক সুকোমল সেদিন সকাল থেকে ম‍্যাচ দেখার জন‍্য আয়োজন শুরু করেন। না, এখনকার মতো নীল-সাদা রঙে বাড়ি সজ্জিত করেননি, টাঙাননি আর্জেন্টিনার পতাকা। পরেননি নীল সাদা জার্সি, দেয়ালে সাঁটেননি টিম আর্জেন্টিনা কিংবা মারাদোনার পোস্টার। নব্বইয়ের শুরুতে অবশ‍্য এত আয়োজনের চলও ছিল না। যাই হোক, সুকুমার যেটা করলেন সেটা হল প্রথমেই তিনি নিজের ঘরটিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তুললেন। বিছানার চাদর পালটালেন, টেবিল পরিষ্কার করলেন, কাচের আলমারি থেকে বই বের করে ঝাড়ন দিয়ে ঝেড়ে আবার গুছিয়ে রাখলেন।  বাড়িতে অতিথি আসার কথা থাকলে বা কোনো অনুষ্ঠান থাকলে যেরকম সবাই করে থাকেন সেইরকম আর কি! হয়তো বা দল বেঁধে বন্ধুবান্ধব তাঁর বাড়ি খেলা দেখতে আসবেন, হতেও পারে। কিন্তু এরপর সুকোমল যখন বই গুছোবার ছলে ব‍্যাকুল হয়ে একটা চিঠি খুঁজতে থাকেন তখনই গল্পের পাঠকের মনে লাগে খটকা। কী ব‍্যাপার? আর্জেন্টিনার ম‍্যাচ দেখার আগে সুকোমল কোন্ চিঠির খোঁজ করেন? কেনই বা এই আকুলতা? গল্প এগিয়ে চলে সেই খোঁজখবর করতেই।

গল্পের তরী ভেড়ে বুয়েনস এয়ারসের জেটিতে। সুকোমল একসময় জাহাজের কোল বয় ছিলেন, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মতো। এদেশ ওদেশের বন্দরে বন্দরে কাজের সূত্রে সুকোমলের যাতায়াত চলত। একবার জাহাজ ভিড়ল বুয়েনস এয়ারসের জেটিতে। জেটি থেকে নেমে দাঁড়ালেই শহর। অচেনা সেই শহরে ঘুরে বেড়ায় তরুণ সুকোমল। একদিন পথ হারিয়ে ফেলে। কী করে জাহাজে ফিরবে সে। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে পথনির্দেশ সে উপায়ও তো তেমন সহজ হয় না। আর্জেন্টিনার বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি বলতেও পারেন না, বুঝতেও পারেন না। অবশেষে বিভ্রান্ত সুকোমলের সঙ্গে আলাপ হয় ইংরেজি জানা এক বয়স্ক মহিলার।সুকোমলকে তিনি নিজে জাহাজে পৌঁছে দেন। গান্ধীর দেশের সুকোমলকে তাঁর ভীষণ ভালো লাগে। মেয়েকে পাঠান জাহাজে, সুকোমলের খোঁজখবর নিতে। মায়ের নির্দেশে ষোল বছরের এলসা সুকোমলকে তাঁদের বাড়ি নিয়ে যান। ক্রমে যা হওয়ার তাই হয়, দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়েন ঘুরে বেড়ান এদিক সেদিক। ইভা পেরনের সমাধি, পার্ক, সমুদ্রতট তাঁদের ভালোবাসার সাক্ষী থাকে।এলসা বলে যেতেন তাঁর মায়ের কথা, সুকোমল বলতেন নিজের গ্রাম, নদীর কথা। এলসাদের বাড়িতে ট‍্যাঙ্গো নাচ হত। সুকোমলের মনে লাগে দোলা। যথারীতি  তাঁদের মধ‍্যে বিয়ের কথা ওঠে। এলসার মায়ের ইচ্ছে সুকোমল তাঁর মেয়েকে বিয়ে করে এই দেশে থেকে যান, তাঁর যে এলসা ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু সুকোমল পারেন না এলসার মায়ের এই প্রস্তাবে রাজি হতে। তাঁর গ্রাম, তাঁর দেশ, তাঁর পরিবার তাঁকে যেন দেশে ফিরে আসার আকুল বার্তা পাঠায়। তাঁর পাঠানো টাকার জন্য অপেক্ষায় থাকে প্রিয় মুখগুলি। অগত্যা সুকোমল দেশে ফিরে আসেন।

আজ তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। স্ত্রী পুত্র কন‍্যা নিয়ে এখন তাঁর ভরা সংসার। কিন্তু এলসাকে ভুলতে পারেন না  একমুহূর্তের জন‍্যও। সেদিন যখন বুয়েনস এয়ারস থেকে ফিরে আসার জন্য জাহাজে উঠেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিল এলসার ছবি আর এলসার লেখা  চিঠি। ছবি অবশ্য সঙ্গে রাখেন না। সমুদ্রেই সেই ছবি বিসর্জন দেন। কিন্তু চিঠিগুলো সযত্নে নিজের কাছে রেখে দেন। দিন চলে তার নিজস্ব নিয়মে। আপাত সুখী এই মানুষটি তাঁর মনের গহনে থাকা প্রেমকে ব‍্যক্ত করবেন কী উপায়ে। অবশেষে একটা উপায় তিনি খুঁজে পান। ১৯৮৬-তে মেক্সিকো বিশ্বকাপে মারাদোনার আর্জেন্টিনা যখন চ‍্যাম্পিয়ন হয়,  তখন থেকেই সুকোমল তাঁর প্রেমকে প্রকাশ করার একটা অবলম্বন খুঁজে পান। খেলার সময় তিনি এলসার দেশের জন‍্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। আর্জেন্টিনা! মারাদোনা! এই দুটি শব্দ তাঁর ভালোবাসার বারান্দায় ফুল ফোটাতে শুরু করে। তখন থেকেই টিভিতে যখন আর্জেন্টিনার খেলা দেখায় তখন ঘর সাজিয়ে, গোপন কুঠুরি থেকে চিঠিগুলো বের করে ছুঁয়ে থাকেন সুকোমল। মারাদোনারা যখন মাঠে খেলেন তাঁদের খেলা দেখতে দেখতে আর চিঠিগুলোর পরশ পেতে পেতে সুকোমল যেন বা এলসার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় বুয়েনস এয়ারসের রাস্তাঘাটে।

এই চিঠির কথা পরিবারের আর কেউ না জানলেও স্ত্রী অমিতার অজানা থাকে না, থাকার কথাও নয়। ক‍্যামেরুনের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ম‍্যাচের দিন সুকোমল আর চিঠি খুঁজে পান না। তাঁর স্ত্রী চিঠি লুকিয়ে রাখেন। চিঠিগুলো যেন তাঁর স্ত্রীর প্রতিপক্ষ। স্বামীর প্রথম যৌবনের প্রেমের জন‍্য তাঁরও মন কেমন করে, কিন্তু পাশাপাশি এলসা আর আর্জেন্টিনা কি তাঁর প্রতিপক্ষ নয়?

এ গল্প যখন পড়েছিলাম, অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল।পড়েছিলাম যে কোথায় তা আজ অবধি মনে পড়ে না।আমার ধারণা আমি নিশ্চয়ই অধিক যতনে কোথাও জমিয়ে রেখেছি সেই পত্রিকা অথবা কাগজের পাতাটিকে। আজ অবধি তার হদিশ পেলাম না। তাই গল্পটির দ্বিতীয় পাঠ এখনও হয়ে উঠল না। এরই মধ‍্যে হঠাৎই একদিন এক বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবারের পাতায় গল্পটিকে ফিরিয়ে আনলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অমর মিত্র। তাঁর গল্পপাঠের কলামে  এই গল্পটির কথা পাঠ করে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। আশ্বস্ত হলাম। কী সুন্দর করে যে গল্পটি পাঠকের কাছে উপস্থাপিত করলেন অমর মিত্র। গল্পটিকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে তীব্র হল, কিন্তু দিশা পেলাম না। অতীন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কে ফোনও করলাম। উনি তখন অসুস্থ। বললেন, গ্রন্থিত হয়েছে, কিন্তু কোথায় তা তাঁর মনে নেই। অমর মিত্রর সঙ্গে তখনও যোগাযোগ করিনি। সম্প্রতি কলিকাতা লিটল ম‍্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে অমর মিত্রর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি হদিশ দিয়েছেন। আশা করছি গল্পটি আবার পড়তে পারব। ইতিমধ্যেই ‘গল্পসরণি’র অতীন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বিশেষ সংখ‍্যায় অমর মিত্রর ‘প্রতিপক্ষ: অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামে লেখাটা সংকলিত হল। আবার তা পড়লাম। এর ফলে হল কি ‘প্রতিপক্ষ’ আমার কাছে কেবল অতীন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের লেখা গল্প হয়ে থাকে না, অমর মিত্রর ভাবনাতেও প্রবলভাবে প্রভাবিত হই। তিনি লিখেছেন বলেই গল্পটি ফিরে এল আমার কাছে। গল্পটি সম্পর্কে অমর মিত্র লিখেছেন ‘এ এক অদ্ভুত প্রেমের গল্প।আর পড়তে পড়তে মনে হয় এই গল্প ১৯৯০-এর বিশ্বকাপ। যে বিশ্বকাপে মারাদোনাকে ক্ষতবিক্ষত করে নিজের খেলা খেলতে দেয়নি প্রতিপক্ষ’। সুকোমলও যেন ব‍্যর্থ নায়ক হয়ে যান মনে মনে। কিন্তু তিনি লড়বেন কার সঙ্গে, ছায়ার সঙ্গে? আসলে মানুষ তো তাই-ই করে। সুকোমলের প্রতিপক্ষ কে? কে তাঁকে নিজের খেলা খেলতে দেয়নি? কেউ কি নিজের খেলা খেলতে পারেন? পারেন না বলেই  মারাদোনাদের আঁকড়ে ধরেন। যদি তাঁরা পারেন, সেই পারার মধ্যেই থেকে যাবে আম আদমির ইচ্ছেপূরণ। তাই কেউ গ্যালারির ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে দেন, কেউ ঘরের নিভৃত পরিসরে টিভির সামনে সুকোমলের মতো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অপেক্ষা করেন চাওয়া-পাওয়ার হিসেব চুকোনোর আকাঙ্ক্ষায়।বিশ্বকাপের পাগল হাওয়া বইছে এখন। সুকোমলরা তো ফিরে আসবেনই এমন উতল দিনে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *