কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ৪)

কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্‌সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ৪)

শেয়ার করুন

চতুর্থ পর্ব

রানিখেত থেকে আলমোড়া হয়ে বিনসারের পথে

আমরা তিনটি পরিবার দুটি গাড়ি ভাড়া করে চলেছি আলমোড়া হয়ে বিনসারের পথে। ঘুরতে এলে মন যেন যাযাবর হয়ে যায়। একজায়গায় দু-চারদিন থেকে আবার অন্য জায়গায় পাড়ি। এক জনের মায়া ছেড়ে আরেকজনের দিকে চলেছি। যাকে ছেড়ে যাচ্ছি সেও পাহাড়, যার কাছে যাচ্ছি সেও পাহাড় আর যাদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সেগুলোও পাহাড়। কেমন মজার ব্যাপার দেখুন। আবার এই পাহাড় ছেড়েও নেমে যাব একদিন। থেকে যাবে এই পথের স্মৃতি। মনে পড়বে এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই যে ফলওয়ালার কাছ থেকে নাসপাতি কিনে খাচ্ছি। লোকটির মুখটি হয়তো মনে থাকবে না। তবে টাটকা নাসপাতির স্বাদ ঠিক মনে থাকবে। মনে থাকবে এখানকার নাসপাতির স্বাদ ভীষণ আলাদা, বেশ নরম ও মিষ্টি।

রানিখেত থেকে ১২ কিমি যেতেই পথে পড়ল একটুকরো সমতল গ্রাম। চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের ঢেউয়ের মাঝে হঠাৎ একটা সমতল গ্রাম মনকে যেন এক আশ্চর্য ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়। এখানেও আমাদের সমতল ভূমির মতো বড়ো না হলেও ক্রিকেট খেলার মতো মাঠ আছে, আছে ঘরের উঠোনের সাথেই পাশাপাশি একই পঙ্‌ক্তিতে বসে থাকা কৃষিজমি। এখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে আলমোড়ার দিকে অন্যটি সোমেশ্বর হয়ে কৌশানি। আমাদের গাড়ি ডানদিকে ঘুরে গেল। এরপরেই শুরু হল রাস্তার আসল খেল। মিনিট ফুরতে না ফুরতেই রাস্তা আড়মোড়া ভাঙছে, শ-মিটার অন্তর অন্তর এমন শার্প বেন্ড! যেটার ভয় ছিল সেটাই শুরু হয়ে গেল—সৃজার বমি। ব্যস গাড়ি থামাও। একটু ধাতস্ত হলে আবার চলা শুরু। ড্রাইভারও বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে চালাচ্ছে। এতে বাকিদের ভালো। চারদিকে পাইন সজ্জিত পাহাড়ের দৃশ্যগুলি অনেকটা সময় নিয়ে চক্ষু ও মন দিয়ে উপভোগ করতে পারছি।

‘আচ্ছা পাহাড়ে ড্রাইভাররা কখনও বমি করে না?’

আমার প্রশ্নে ড্রাইভারটি বলল – ‘এমনটি সাধারণত দেখা যায় না’, তবে একবার নাকি তার পরিচিত এক ড্রাইভার যাত্রীর বমি দেখে ও সেই গন্ধে বমি করে দিয়েছিল। আসলে পাহাড়ে ড্রাইভিং করার সময় মস্তিষ্ক পুরোপুরি সেই দিকেই সজাগ থাকে।

আমিও সজাগ মন ও মস্তিষ্ক দিয়ে আলমোড়ার পাহাড়ের রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে লাগলাম। 

এরপর যেখানে গাড়ি দাঁড়াল সেখানে পাহাড়ের শরীর ফুঁড়ে একটি জলের সরু ধারা বেরিয়ে এসেছে। আমি ও অনিমেষদা বাচ্চাদের সামলাচ্ছি আর শিখা ও পূর্ণিমা নেমে গেল স্রোতটির কাছে জলের সন্ধানে। পাহাড়ে জলের এক প্রবল সমস্যা। শুধু জল সংগ্রহের জন্যই তাদের অনেকটা কায়িক পরিশ্রম ব্যয় করতে হয়। উত্তরাখণ্ডের প্রায় জায়গাতেই আমি দেখেছি যে যেখানেই এমন জলের স্রোত আছে সেই স্রোতের মুখটি তারা মন্দিরের কিংবা কোনও দেবতার মূর্তির আদলে বানিয়ে রাখে এক অতি পবিত্র স্থানের মতো। এরপর কিছুটা নামতে নামতে আমরা কোশী নামক একটি জনবহুল এলাকায় চলে এলাম। দোকান, বাজার, রেস্টুরেন্ট ও কিছু হোটেল সহ কোশী নদীর ধারে গড়ে উঠেছে একটি ছোটোখাটো নগর। কুমায়ুনের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীটি নাকি কৌশানির কাছে ধারাপানি ধার-এর থেকে উৎপত্তি হয়েছে। স্কন্ধপুরাণের মানসখণ্ডে এই নদীটি কৌশিকী নামে উল্লিখিত আছে। যেমন নাম তেমনই সুন্দর নদীটি। নামটি শুনে এই সময়কার বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তীর কথা মনে এল। নদীটি যেন এক স্বর্গীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে পৃথিবীর দিকে নেমে আসছে। তবে এই রেশ বেশিক্ষণ রইল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলমোড়ার নাগরিক কোলাহলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তবে আমাদের উদ্দেশ্য এবার আলমোড়া নয়, বিনসার। তাই শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম উত্তরদিকে। এখান থেকে আরও ৩০ কিমির যাত্রাপথ। পথে কপড়খান বলে একটি জায়গায় দুপুরের খাবারের খোঁজে থামতে হল। বেলা তখন প্রায় তিনটে বাজে বাজে। আসলে আমাদের প্ল্যান ছিল বিনসারে পৌঁছে রেস্টহাউসের ক্যান্টিনে খাব। কিন্তু পৌঁছতে দেরি হবে বলে ফোন করলে জানতে পারি দুপুরের খাবারের জন্য আগে থেকে অর্ডার করতে হয়, তাই ওদের পক্ষে আমাদের গোটা দলের খাবারের ব্যবস্থা সেই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আর আলমোড়ার ভিড় এড়াতে ড্রাইভার সেখানে দাঁড়ায়নি। ১০ কিমি দূরে কাঁসারদেবীতে দাঁড়াতে বললাম। সে বলে এখানে দাম প্রচুর। ড্রাইভার আমাদের সুবিধের জন্যই বলেছে সে ঠিক আছে কিন্তু তারপর আর কোনও দোকান-পসার নেই। শুধু নিদ্রিত নারীশরীরের মতো শায়িত পাহাড়ের শরীর জুড়ে পাইনের আচ্ছাদন আর শীতল বাতাসের অশরীরী হাতছানি।এইসব লোভনীয় দৃশ্য দেখে দেখে ভাতের খিদেকে স্তিমিত রাখি। কপড়খানে একরকম প্রায় জোর করেই ড্রাইভারকে থামালাম। নেমে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোনও রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম না। খুঁজতে খুঁজতে রেস্টুরেন্টের মতো দেখতে যে দোকানটির সামনে এসে দাঁড়ালাম সেটি একটি ম্যাগি পয়েন্ট! ভেতরে দুটি লাল রঙের প্লাস্টিকের টেবিল ও আটটি চেয়ার পাতা আছে, কোনও লোকজন নেই, তবে দুটি টেবিলে দুটি জলের মগ রাখা আছে। পাশেই একটি মুদি দোকান, তাতে কিছু ন্যাতানো শাকসব্জি ও নিস্তেজ ফলও সাজানো আছে, আর এসবের পেছনে বসে আছে একটি মধ্যবয়স্ক লোক। মুখটি তার শুকিয়ে যাওয়া বেদানার মতো। আমাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি কোনও ঠিকানার হদিশ দিতে পারলেন না। তবে জনৈক মুদি আমাদের আশ্বস্ত করল যে আধঘণ্টা সময় দিলে তিনিই শুধু ডাল আর ভাত রান্না করে দিতে পারবেন। প্রস্তাবটিতে রাজি হয়ে গেলাম এছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ও নেই। অনেকটা উঁচুতে আমরা উঠে এসেছি। এখানে মেঘ আসে আর যায়, হালকা হালকা বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল।

স্বরূপদাদের গাড়িটা অনেকটাই পেছনে ছিল। ফোন করে জেনে নিয়ে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা চলে এল। দেবশ্রী বৌদি ও দেবরূপাও (ওদের কন্যা) বমি করে কাহিল হয়ে পড়েছে। মাসিমা (দেবশ্রী বৌদির মা) একটু ঠিক আছে। জনৈক মুদি সময় নষ্ট না করে রান্না চাপিয়ে দিল। কথায় কথায় জানতে পারলাম নাম তার খেম সিং রাওয়াত। মুদির দোকানের পাশাপাশি চা ও ম্যাগিও বিক্রি করেন। সেনা থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতেই এই বিকল্প আয়ের বন্দোবস্ত করেছেন মি. রাওয়াত। এই রাস্তায় চালু পর্যটকদের ভিড় খুব কম, তাই তেমনভাবে বড়ো রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেনি। এদিকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে সবাই একটু ধাতস্ত হতে না হতেই ধোঁয়া ওঠা ডাল-ভাত ওমলেট সহযোগে সাজিয়ে দিল রাওয়াতজি। এই ক্ষুধাক্লান্ত শরীরে গরম গরম ডাল-ভাত যেন অমৃত সমান। এখানকার ভাতও খুব সুস্বাদু হয়, ভালো জাতের বাসমতী চালের বানানো যে। খেতে খেতে ভাবছি যে হাত দিয়ে আমাদের রাওয়াতজি দেশকে সুরক্ষিত রাখতে আগ্নেয়াস্ত্র চালাতেন সেই হাত দিয়েই একদল অভুক্ত শরণার্থীকে সুস্বাদু খাবার রেঁধে খাওয়াচ্ছেন। পেটে দানা পড়তে সবাই একেবারে চাঙ্গা। এবার আমাদের ফাইনাল গন্তব্যের দিকে রওনা দেবার পালা। আগেই খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে বিনসার একটি সংরক্ষিত বন। রাওয়াতজির কাছ থেকে আরও জানতে পারলাম যে সেখানে ও আশেপাশে কোনও দোকান-পসারও নেই। তাই বাচ্চাদের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ফাস্টফুড ও ফল কিনে নিলাম। রওনা দেবার সময় রাওয়াতজির শুকনো মুখে একটু হাসিও দেখতে পেলাম যেন। আপাত কঠোর চোয়াল বিশিষ্ট রাওয়াতজির এই অতিথিবৎসল হাসিটুকুও আমাদের মনে থেকে যাবে!  

ঘোড়াবালা রাস্তা

হালকা হালকা বৃষ্টির মধ্যেই এক অপরূপ পাহাড় সাম্রাজ্যের দোরগোড়ায় আমরা এসে পৌঁছলাম। স্থানটির নাম আয়ারপানি। এখানেই বিনসার সংরক্ষিত বনের চেকপোস্ট। বন্যজীব সংরক্ষণ কেন্দ্রে যেমন হয় এখানেও টিকিট কেটে প্রবেশের অনুমতি মিলল। বিনসার পাহাড় প্রাচীনকালে ঝান্ডীধার নামে পরিচিত ছিল। পাইনের এই ভুবনমোহিনী উপত্যকার সৌন্দর্য দেখে মনে গেয়ে উঠতে চায়- ‘কিয়া নজারে… কিয়া সিতারে…’। এক-দেড় কিলোমিটার গিয়েই একটি রাস্তা বাঁদিকে চলে গেছে। একটি সাইনবোর্ডে সেদিকে দিকনির্দেশ করে লেখা আছে—‘খালি এস্টেট’। আমরা অবশ্য সেদিকে যাব না।

—ভালা অ্যায়সা ভি কিসি ঘর-কা নাম হোতা হ্যাঁয় কিয়া?

আমার জিজ্ঞাসা শুনে গাড়ির ড্রাইভার অঙ্কিত বলল,

—ইয়ে এস্টেট এক আংরেজ সাহাব কা হুয়া করতা থা কিসি জামানা মে। আংরেজ চলে জানে কে বাদ ইয়ে এস্টেট কাফি সাল খালি পড়া হুয়া থা। তব্‌সে লোগ ইস্‌কো খালি এস্টেট কহ্‌নে লাগে।

—আচ্ছা! তো আভি ভি খালি রহ্‌তে হ্যাঁয় কিয়া?

—নেহি, নেহি! আভি তো উস্‌মে প্রাইভেট রিসর্ট বনা হুয়া হ্যাঁয়। আউর হেরিটেজ বিল্ডিং কা দর্জা ভি মিলা হুয়া হ্যাঁয়!

অঙ্কিতের জানা এই দু’একটা কথাই খালি এস্টেট সম্পর্কে শেষ কথা নয়। একটু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যাবে প্রায় ১৭৫ বছর পুরানো এই বাড়িটির উঠোন থেকে প্রতিটি দেওয়াল নানা ঘটনা ও তথ্যে সমৃদ্ধ। বাড়িটির মালিক ছিল হেনরী রামজে। হেনরী রামজে ছিলেন কুমায়ুনের কমিশনার (১৮৫৬ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত)। রামজের আগে ও পরে অনেক ইংরেজ শাসক এসেছে আর শাসন করে চলে গেছে, কিন্তু রামজের মতো দক্ষ, প্রজাহিতৈষী ও দয়ালু শাসক কুমায়ুনবাসী দ্বিতীয় আর দেখেনি। ৪৭ বছর ধরে কুমায়ুনেই নানা পদে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। অবসরের পরেও আট বছর এখানেই ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি এখানকার প্রকৃতি ও মানুষজনের সাথে মিলেমিশে এতটাই একাত্ম হয়ে গেছিলেন যে কুমায়ুনবাসীর কাছে ইংরেজ রামজে থেকে প্রিয় রামজী হয়ে উঠেছিলেন। কমিশনার তো ছিলেন তিনি কাগজে কলমে, কিন্তু এখানকার জনগণের হৃদয়ে তিনি কুমায়ুনের একচ্ছত্র রাজাসাহেব হয়েই রাজ করতেন। কমিশনার থাকা কালে এই বিনসার পাহাড়ে তাঁর গ্রীষ্মকালীন দপ্তর গড়ে তোলেন ১৮৬৬ সালে। বর্তমানে সেই হেরিটেজ তকমা পাওয়া ভবনটিতেও গ্র্যান্ড ওক ম্যানর নামে একটি প্রাইভেট রিসর্ট গড়ে উঠেছে। রামজে সেসময় বিনসারে আরেকটি বাংলো কেনেন। সেখানে তিনি না থাকলেও ভবিষ্যতে অবসরের পরে আমৃত্যু সেখানে থেকে যাবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু পুত্র তাঁকে একপ্রকার জোর করেই ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে তাঁর আর থাকা হয়ে ওঠেনি এখানে। বাংলোটি খালি পড়ে থাকত বলে নাম হয় খালি হাউস। ১৯২৯ সালে ব্যবসায়ী যমুনালাল বাজাজের উদ্যোগে ও বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের তত্ত্বাবধানে এই খালি হাউসেই ‘গান্ধী শৈলাশ্রম’ গড়ে ওঠে। প্রায় পাঁচ বছর এখান থেকেই কুমায়ুনের শৈল অঞ্চলে গান্ধী আশ্রমের নানা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সময় বদলেছে, সাথে বদলেছে মালিকানা, বদলেছে ইতিহাস। বাড়িটি একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে সবকিছুর সাক্ষী হয়ে।

পাইনের আধিপত্যের মধ্যেই পাহাড়ি রাস্তাটি সরু হতে হতে ক্রমশ এতটাই সরু হয়ে গেল যে কোনও মতে একটি গাড়িই যেতে পারবে। গভীর খাদ থেকে গাছের মাথাগুলি উঁকি দিয়ে দেখে কারা এল ওদের নির্জনতা ভঙ্গ করতে। বনের গভীরে লুকিয়ে পাখি ও বন্য জীবেরাও আমাদের দেখছে নিশ্চয়ই! আমরা ওদের দেখতে পাই বা না পাই। ওরা যেমন আমাদের ভয়ে মুখ লুকিয়ে আছে, আমরাও তেমনই খাদের অতল ভয়ঙ্করতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছি পাহাড়ের ধারে ঝুলে থাকা লতাগুল্মে অথবা পাখির ডাকের দিকে। আমাদের জীবনমরণ নির্ভর করছে এখন এক চালকের মনোযোগের উপর। মুহূর্তের অসতর্কতাতে আছি থেকে নেই হয়ে যেতে পারি। পিচ ওঠা এবড়ো-খেবড়ো টলোমলো এক পথে চলেছি প্রাণ হাতে লয়ে। চালকের কথায়, ‘ইয়ে হ্যাঁয় ঘোড়াবালা রাস্তা’।

আমাদের পূর্বসূরিরাও যাঁরা এসেছিলেন এই পথে অতীতে, এসেছিলেন ঘোড়া কিংবা ডান্ডিতে চেপে অথবা একলা হেঁটে। এই পথ দিয়েই হেঁটে গেছেন আমাদের যুগ নায়ক বিবেকানন্দ! আবার এই পথ দিয়েই একসময় যাতায়াত করত প্রজামনে ভয় জাগানো এক অত্যাচারী রাজা। তিনি ছিলেন চন্দ বংশীয় রাজা পঞ্চম কল্যাণ চন্দ। কুমায়ুনের রাজা কল্যাণ চন্দ (শাসনকাল ১৭২৯- ১৭৪৭) প্রজার কল্যাণের চেয়ে অত্যাচারই হয়তো বেশি করেছিল। ইতিহাস বলে অশিক্ষিত এই রাজা ভিখারি অবস্থা থেকে রাজসিংহাসন প্রাপ্ত হন। শাসনকার্যে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন তিনি। নিজের সম্পদ ও সাম্রাজ্য বাড়াতে তিনি লুঠ ও আগ্রাসনের নীতিকেই সঠিক পথ বলে মনে করতেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজা নিজের রাজত্ব ধরে রাখতে ক্রমশ খুনের ও বদলার নীতিতে মেতে ওঠেন। ক্ষমতার নেশাই মানুষকে পশু করে তোলে এটা যেমন অতীতে সত্য ছিল, একইভাবে বর্তমানেও চরম সত্য। এসব মানুষ পার্থিব সুখ ও ভোগবিলাসীতায় জীবন কাটাবে এটাই স্বাভাবিক। প্রজার কল্যাণের কথা ভাবতে তাদের বয়েই গেছে। এই রাজা কল্যাণ চন্দ শীতকালে রাজধানী আলমোড়ায় থাকলেও গ্রীষ্মকালে চলে আসতেন এই বিনসারে। এখানে একটি মহলও বানিয়েছিলেন। রাজকার্যের গুরু দায়িত্ব থেকে দূরে এই নির্জন নৈসর্গিক পাহাড়ে রাজা তখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। সুরা ও নারীসঙ্গে পরিপূর্ণ। এইসময় তার মনে কোনও ভয় আসে না সে রাজ্য হারানোর হোক কিংবা খুন হবার। প্রজাদের লুঠ ও অত্যাচারের কাজটি তখন তার রাজকর্মচারী ও পরামর্শদাতাদের হাতে। রাজা তখন এসব থেকে দূরে ঝান্ডীধারে বসে বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হয়তো কিছুটা শান্তি পেতেন। আমরাও ভয় থেকে চোখ সরিয়ে প্রকৃতির এই রহস্য ও ইতিহাসের নির্মমতার কথা ভাবতে ভাবতে পাঁচ কিলোমিটার চলে এসেছি।

এইমুহূর্তে আমরা আরও এক আশ্চর্যের সামনে দাঁড়িয়ে। এখানে পাকদণ্ডী উধাও, জঙ্গল উধাও হয়ে একটুকরো সবুজ উপত্যকা আমাদের ভয় দূর করতেই যেন হাজির হয়েছে। আশেপাশে কোনও গ্রাম নেই, কোনও আগন্তুক নেই। শুধু একলা দাঁড়িয়ে একটি মন্দির। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ক্ষীণ জলস্রোত। ভক্ত নেই, পূজা-অর্চনা নেই, নেই ঘণ্টাধ্বনি। দেবাদিদেব একলা অধিষ্ঠিত নিজের প্রকৃতিতে। এই দৃশ্য দেখে এক দিব্য অনুভূতি খেলে গেল মনে। বিনেশ্বর মহাদেব নামের এই মন্দিরটিও রাজা কল্যাণ চন্দই তৈরি করিয়েছিলেন। তারপর থেকেই এই পাহাড়ের নাম হয় বিনসার। তারপরের আরও পাঁচ কিলোমিটার দুর্গম পথ আমরা এক দুর্নিবার আবেগে পেরিয়ে গেলাম। একেবারে পাহাড়ের মাথায় যেখানে পৌঁছলাম সেখানেই কেএমভিএন (KMVN) এর রেস্ট হাউস। 

স্যার হেনরি র‍্যামসে

তথ্য ও ঋণ স্বীকার: 1.kafaltree.com

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২