পোখরায় আমরা (তৃতীয় পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য
তিন
পোখরায় নেমে খানিক ভেবলে গেলুম বললেই মনে হয় সঠিক বলা হবে। আমার বাস যে শহরে সেখান থেকেও শীতকালে সারাদিন ধরেই ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায়। তাই পাহাড় নিয়ে আদিখ্যেতা আমার বা আমাদের নেই বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে ওটি যে একটি চেয়ে থাকার বস্তু তা জেনেছি বেশ খানিক বড়ো হয়েই। তার আগে স্বভাবিকভাবে শীত আসলে যেমন সোয়েটার মাফলার পড়া লোক দেখা যায় তেমনি ঝকঝকে পাহাড় দেখা যাবে এটাই জানতাম। তাই যাবার খবর জানানোর সময় তাপস যখন বলেছিল ঝকঝকে পাহাড় দেখা যায়, ভেবেছিলাম সেটা কি আবার দেখবার কোনো জিনিস হল নাকি?
কিন্তু সত্যি বলতে পোখরায় নেমে মাথাটা মনে হয় খারাপই হয়ে গেল। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি বটে শীতকালে। কিন্তু বুঝি যে সে আছে অনেক দূরে। কিন্তু এখানে পোখরয় মাউন্ট অন্নপূর্ণা, স্থানীয় লোকের ভাষায় মাছিপুছা, মানে জাস্ট মনে হচ্ছে মাথার ওপর। সকাল দশটা নাগাদ পোখরায় পৌঁছে খানিকক্ষণ সময় তাকে দেখতেই কেটে গেল। এছাড়া সারা আকাশ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্যারাগ্লাইডাররা। মাঝে মাঝে মাথার ওপর দিয়ে চক্কর কেটে যাচ্ছে হেলিকপ্টার বা ছোটো ছোটো প্লেন। পরে শুনেছি সেগুলো নাকি এভারেস্ট ঘুরিয়ে আনে।
এসব দেখে তো চক্ষু একেবারে ছানাবড়া। যাই হোক উত্তেজনা খানিক থিতু হলে বেরোলাম হোটেল খুঁজতে। আর বন্ধুভাগ্য বলতে! আমার বন্ধুকে খানিক সময় দিলে সে যে কোনো জায়গায় সব থেকে ভালো হোটেলটি সব থেকে কম দামে ঠিক করবে তা আমি নিশ্চিত জানি। এই ব্যাপারে ওর ব্যুৎপত্তি যা লেভেলের তাতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হোটেল খোঁজারুর তকমা আমি ওকে দিতেই পারি। এখানেও আমার সেই আত্মবিশ্বাস দেখলাম বজায় থাকল। ফেওয়াতালের বা ফেওয়ালেকের কাছেই একটা এপার্টমেন্ট মতো জায়গায় আমরা ঘর পেলাম। তার ছাদ থেকে মাউন্ট অন্নপূর্ণাকে মনে হচ্ছে যেন হাত দিয়ে চাইলেই ছুঁয়ে দেওয়া যায়।
এসব করতে করতে দেখি বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে। আর সবকিছুর পর যখন একটু ফাঁকা হলাম বুঝতে পারলাম পেটের একদম আকাশ খাই পাতাল খাই ব্যপার। আর সব থেকে দুঃখের কথা আমাদের এপার্টমেন্টে খাবার তখন শেষ এবং ওরা দুঃখের সাথে জানাল যে এ বেলা ওরা আর খাবার দিতে পারবে না। ছ জনের দলের চারজন বলল সাথে যা খাবার আছে তা খেয়ে আমরা কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারব। কিন্তু তাপস আর আমার মতো ভেতো বাঙালির তো ভাত চাইই চাই। অতএব সেই বিকেলে শুরু হল আমাদের অন্ন অন্বেষণ।
আর এবারে দেখলাম তাপস একটু বাজে খেলল। মানে বিকেলের মেঘলা ওয়েদারে পোখরার পিচে বল একটু বেশি স্যুইং করাতে ও ঠিকঠাক জমিয়ে খেলতে পারল না। মানে আমরা ঠিকঠাক খেতে পারলাম না। একে তো খিদের জ্বালায় পেটের নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে। তারপর পোখরা, সোজা কথায় বললে বিদেশিদের শহর। ভারতীয়দের সেখানে পাত্তা দেয় না বললেই চলে। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর আমরা এক জায়গায় ঠান্ডা ভাত, ডাল, শাক আর পাঁপড়ভাজা পেলাম। তা দিয়েই তখনকার মতো ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হল।
হোটেলে ফিরে আসতে সন্ধে। আর তখন ফেওয়ালেকে যেন মেলা লেগে গিয়েছে। আর মেলা লাগবে নাই-বা কেন। সূর্যাস্তের সময় ফেওয়াতালের যে সৌন্দর্যের বাহার দেখলাম তা ভাষায় বর্ণণা করা একরকম দুঃসাধ্যই। শুধু এটুকুই বলা যায় যে অস্তগামী সূর্য যে জলের ওপর এত রঙের সৃষ্টি করতে পারে আর তার সাথে লেকের বিভিন্ন রঙের নৌকোর যে শেডের কনট্রাস্ট তা না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের দলের সবাই দেখলাম সেখানেই একটা সুন্দর গাছের তলা বেছে নিয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্যের দিকে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে।আমরাও বসে পড়লাম সেখানে।