পোখরায় আমরা (দ্বিতীয় পর্ব) – সত্যম ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

দুই

প্রতিটি শুরুর আগে তার কোনো একটা আসল শুরু থাকে। যেমন থাকে চমৎকার রান্নার আগে ঠিকঠাক মাপমতো তরকারিটা কাটা। না হলে কোনোটা বেশি সিদ্ধ হয়ে যায় আবার কোনোটা পড়ে থাকে সিদ্ধ না হয়েই। আমার এই ঘোরাঘুরির আসল শুরু কিন্তু বন্ধু তাপসের দেখা পাবার পরই। সেই গল্পটা একটু বলে না নিলে কেমন জানি একটু অসম্পূর্ণ থেকে যায় সব।

আমাদের সময়কার বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কারুরই মোবাইল ফোন ছিল না। আর আমরা যারা বেশিরভাগ সময়ই ক্লাস বাঙ্ক করে ক্যান্টিনে পড়ে থাকতাম তাদের কেন জানি কোনোদিন মনেই হয়নি বন্ধুদের ফোন নম্বরটা রাখা দরকার। সবাই সময় মতো ক্যান্টিনে এসে জুটবে আর তারপর সারা দিনটা একসাথে গান-গুলতানিতে কেটে যাবে এটাই ছিল রুটিন।

তারপর একদিন দুম করে পরীক্ষা এসে গেল আর পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম ভাঁড়ে মা ভবানী। দু বছর যাদের সাথে বেশির ভাগ সময় কেটেছে তাদের কারুর সাথেই যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই। সবার কথা মনে পড়ে। ফাঁকা ফাঁকা কাটে দিনগুলো।

কিন্তু জীবন চলমান। এ নিয়ে মন খারাপ করে পড়ে থাকারও অবকাশ নেই। জীবনযুদ্ধে তখন চাকর হবার তাড়া। রেজাল্টের সময় আমাদের সকলেরই নম্বর এত কমে গিয়েছে দেখাতে তখন কারুরই আর অন্যের ফোন নম্বর নেবার কথা মাথায় আসেনি। আর এইসব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের নামও তখন কেউ শোনেনি।

তা যাই হোক। ততদিনে চাকর হয়ে গিয়েছি। মাঝে কয়েক বছর চলে গিয়েছে। গিয়েছি কলকাতা বইমেলা ঘুরতে। পরিচিতজনেদের সাথে খানিক আড্ডা দেবার মাঝে একাই গিয়েছি সাইডে ধূমপান এবং তার পরের বা আগের কাজটি করে নিতে। সারি সারি হাফ বেড়ার মাঝে সবার সাথে দাঁড়িয়ে হাল্কা হয়ে নিতে নিতে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, তাপস। বললাম, ‘কী রে?’ ও খানিক ভ্যাবলার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ওই।’

তারপর দুই বন্ধুর সেই স্থান থেকে নেমে এসে সেভাবেই আলিঙ্গন এবং তারপরের কয়েক ঘণ্টা ধরে শুধু মাঝের সময়টুকু জুড়ে যাবার জন্য নিজেদের গল্পগুলো বলা আর অন্যেরটা শুনে যাওয়া। শুনলাম ও আমার মতোনই চাকরবৃত্তিতে প্রবেশ করেছে। বড়ো চাকরটা আমাদের কারুরই ততদিন অব্দি হয়ে ওঠা হয়নি।

যাত্রাপথে

আর আমার যেমন ততদিন পর্যন্ত ঘোরার ইচ্ছে মনের ভেতর থাকলেও ঘোরাঘুরি কিছুই হয়নি, ও কিন্তু দিব্যি হিল্লিদিল্লি করে বেড়াচ্ছে। আমি দেখলাম এবারে আর একে ছাড়া যাবে না। আগে পকেটে রেস্ত ছিল না। এখন সেটা খানিক রয়েছে। আর এর সাথে এবারে জুড়ে না গেলে সারাজীবন পস্তাতে হবে। আড্ডাটা শুরু হয়েছিল দুপুর নাগাদ। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে মাঝের কয়েক বছর জুড়ে নিয়ে দুই বন্ধু যখন আলাদা হলাম তখন সন্ধে। এবারে কিন্তু আর ফোন নম্বর নিতে ভুলিনি।

এই পুনর্মিলন হবার কয়েক মাসের মধ্যেই তাপস বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করে জানাল ও কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে শিলিগুড়ি হয়ে নেপাল যাচ্ছে। আমি চাইলে যেতে পারি। আর কি ছাড়ি! প্রথম সুযোগেই একেবারে বিদেশ। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। ততদিনে আমার শুধু ডুয়ার্সের সবুজে ছাওয়া আদিগন্ত বিস্তৃত চা বাগানেই বুক ভরে নিশ্বাস নিতে নিতে কেটেছে। তা নিয়ে মনে কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু বাইরেটাও তো দেখা দরকার। আর তা যদি হয় নেপালের পোখরার মতো কোনো একটা শহর যেখানে স্বপ্নের সূর্য অস্ত যায় ফেওয়াতালে আর সারা দিন শহরের আকাশ জুড়ে ঝকঝক করে মাউন্ট অন্নপূর্ণা। অথবা পাহাড়ের ওপরেই আছে ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা।

ভোরবেলা বাসে জেগে শুনি সেই তিন বন্ধু শুধু একে অপরের লেগ পুলিং করে যাচ্ছে। ভেবে ভালো লাগলো যে রসিকজনের সঙ্গই লাভ করেছি। খানিকপরেই বুঝতে পারলাম আমাদের নামবার সময় হয়ে গিয়েছে।

প্রথম দর্শনে পোখরা

(ক্রমশ)

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *