হর-গৌরি অ্যাভেনিউ – অন্বেষা চক্রবর্তী

হর-গৌরি অ্যাভেনিউ – অন্বেষা চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

“এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে”—প্রাচীন প্রবাদটা পাহাড় ভ্রমণকারীদের মুখে মুখে ফেরে। উত্তর-পশ্চিমে জম্মু-কাশ্মীরের নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বে অরুণাচল প্রদেশের নামচাবারওয়া পর্যন্ত প্রায় ২৫০০কিমি বিস্তৃত আছে এক গিরিশ্রেণি। মৌসুমী বায়ুর উষ্ণ জলীয়বাষ্প দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এখানে আসে। এই পর্বতমালার দালানে বসে শীতল হয় আর এই উপমহাদেশের ভূখণ্ডে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে। সেই পৌরাণিক-ঐতিহাসিক পর্বতশ্রেণির নাম হিমালয়। কুমারসম্ভবের কবির কথায় যিনি নাকি পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে অবগাহন করেন। এ যেন পৃথিবী মাপার তুলাদণ্ড।

আমরা চলেছিলাম উত্তরাখণ্ডের পথে। হাওড়া থেকে দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার। উত্তরাখণ্ডের পশ্চিমে সগর্ব, কিছুটা ক্ষয়িষ্ণু গাড়োয়াল পাহাড়কে শিবের সাথে তুলনা করা হয়। পুবে গাঢ় সবুজের আধিক্য চোখে পড়ার মতো কুমায়ুন উপত্যকা হলেন পার্বতী। তখনও বাড়ি থেকে পালানোর জন্য লোকাল ট্রেনের উপর দিব্যি ভরসা করা যেত। আমরা জানতাম লাইনের সাথে চাকার চিরকালীন সহবাস।

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়

রাত বারোটার বেশি বাজে। ট্রেন আসানসোল ছাড়ল, ধানবাদ ঢুকতে ঘণ্টা দেড়েকের বেশি সময় লাগবে। কামরায় একটা একটা করে আলো নিভে গেল। রাজীবদা মোবাইলে গুগল ম্যাপ খুলে রেখেছে। আমরা দুজনেই দুদিকে ট্রেনের তিন তলার বাঙ্কে দুলছি, “গাড়োয়াল থেকে কুমায়ুন যাওয়ার বাস-রাস্তা আছে বুঝলি। কর্ণপ্রয়াগ থেকে গোয়ালদাম, বাগেশ্বর হয়ে আলমোড়া।” আলমোড়া! এতক্ষণে চেনা নাম পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম। এই সেই বিবেকানন্দ নিবেদিতার আলমোড়া, উদয় ও অমলা শঙ্করের ‘রামলীলা’র আলমোড়া! আমি যেন জেনে গেছি ম্যাজিসিয়ান কোটের হাতায় পায়রা লুকিয়ে রেখেছে।

ট্রেনের জানালা দিয়ে এমন একেকটা জায়গা চোখে পড়ছে যে, দূর দূর অব্দি গাছ দেখা যায় না। “এরকম ভাবে গাছ কাটলে পৃথিবীতে মানুষের আয়ু বড়োজোর আর ৫০ বছর”, অনিমেষের অমোঘ বাণী মনে পড়ে গেল। অনিমেষ একটা সংগঠন চালাত যার নামই হচ্ছে বাউন্ডুলে থিয়েটার। মেয়েদের মনে শিরশিরানি জাগানো গিটার ওর তোয়াক্কা পায়নি। ডুগ্গিতে আঙুলের তাল তুলে, মাথা দোলাতে দোলাতে মগ্ন অনিমেষ লোকসংগীতে ব্রতী হয়েছে। যাগ্গে, ওর গল্প অন্যদিন হবে। তা ওর নাকি অনেক কাজ পড়ে গেছে, না হলে আমাদের সাথে আসতোই।

ট্রেন দু’ঘণ্টা লেটে নামাল। ২০১৮, মে মাস। আগের গোটা দিনটা বিহার-ইউপির উপর দিয়ে, শুষ্ক গরমে ভাপা ইলিশ হতে হতে এসেছি। গা দিয়ে মোটেই ইলিশের সুগন্ধ বেরোচ্ছিল না। সকালে হরিদ্বারের অল্প ঠান্ডা হাওয়ায় পাহাড়ের গন্ধ নাকে এল। গরমের ছুটিতে ‘চারধাম যাত্রা’ উপলক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক এখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। “যা পাবো তাই ধরে ঋষিকেশ চলে যাব”- এই বলে রাজীবদা আমার হাতে একটা গাড়োয়ালের ম্যাপ গুঁজে দিয়ে গাড়ি ধরতে এগিয়ে গেল। আমার চা ভাঁড়ের তলানিতে, এদিক-ওদিক দেখতে লাগলাম। শাড়ি, ঘাগরায় গোলাপি ও কমলা রঙের আধিক্য। ছেলেদের মাথায় বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন মাপের পাগড়ি, কারো মাথায় নেহেরু টুপি, বেশিরভাগই অবশ্য খালি মাথা। “চল, গাড়ি সামনেই ছাড়ছে”, বলতে আমি ব্যাগ পিঠে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। গাড়িতে যেতে যেতে রাজীবদা রিল্যাক্স হল, “হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় এসেছিলাম সেবার। তা মাহেন্দ্রক্ষণে গঙ্গায় কে আগে স্নান করবে, এই নিয়ে শৈব সন্ন্যাসীদের বিভিন্ন আখড়াগুলোর মধ্যে একেবারে তলোয়ার চালিয়ে লড়াই বেঁধে গিয়েছিল।” আমি হাঁ, “বোঝো ঠেলা, এই একবিংশ শতাব্দীতেও?”

আজ যেখানে আমরা হিমালয় পর্বত দেখতে পাই সেখানে প্রায় ৭.১ কোটি বছর আগে টেথিস নামে এক অগভীর সমুদ্র ছিল। এর উত্তরের ভূখণ্ড আঙ্গারাল্যান্ড যা বর্তমানে ইউরেশিয়ান প্লেট ও দক্ষিণের ভূখণ্ড গন্ডোয়ানাল্যান্ড যাকে বর্তমানে ভারতীয় প্লেট বলা হয়। ভারতীয় প্লেট, এশীয় প্লেটকে দক্ষিণে ঠেলতে থাকে, ফলে টেথিসের পলির প্রান্তরে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। আর গড়ে ওঠে এই ৫৯,৫,০০০ বর্গকিলোমিটারের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ নবীন ভঙ্গিল পর্বতমালা। হিমালয়ের পাদদেশে রুদ্রপ্রয়াগ, পিথোরাগড়, কুমায়ুনের জনজাতিগুলোকে মানুষখেকো বাঘের হাত থেকে আগলেছিলেন শিকারি জিম করবেট। ওনার লেখায় বাঘ কীভাবে মানুষখেকো হয়ে ওঠে তার এক বর্ণনা পাই। গ্রামে মড়ক লাগলে বা কোনো মানুষ ছোঁয়াচে রোগে মারা গেলে দেহগুলোর মুখে আগুন দিয়ে পাহাড়ী নদী বা জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হত। এই মরা মানুষের মাংসের স্বাদ বাঘকে মানুষখেকো করে তুলত। জন্ম থেকেই কোনো বাঘের শাবক মানুষখেকো হয় না। তাকে জীবন অভিজ্ঞতায় পেতে হত মানুষের মাংসের স্বাদ। জিমের চোখে হিমালয়ে মানুষের জীবন-বৈচিত্র্যের কাছে গোটা ইউরোপ ছিল নগণ্য। যদিও পূর্বে অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া, ইতালি ও পশ্চিমে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর উপর বিস্তৃত আল্পসের সামাজিক বৈচিত্র্য ঐতিহাসিক রকমভাবে আমাদের কাছে পরিচিত।

ঋষিকেশ থেকে আরও একবার গাড়ি ধরে এগিয়ে গেলাম জল যতদূর গড়ায়। গাড়িতে ওঠার আগে চানা-পুরি খেলাম। রাস্তার দু’ধারে দোকানে বিভিন্ন রকমের ডাল, নিরামিষ তরকারি, রুটি বা পরোটা, এমনকি ভাতও বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি সাইজের স্টেনলেস স্টিলের ডেকচিতে তরকারিগুলো ঢাকা। বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন আর গ্যাস ওভেনের ওপর রান্না হয়ে চলেছে। আমরা দেবপ্রয়াগ পেরোলাম। বদ্রীনাথ থেকে আসা অলকানন্দা ও গঙ্গার সঙ্গম। গাড়ি এগোচ্ছে শ্রীনগরের দিকে ,গাড়োয়ালের আগের রাজধানী, যার ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে, পাহাড়ে রাত খুব তাড়াতাড়ি নামে। আবার একটা গাড়ি আমাদের ডেকে নিল পিপলকুঠি হয়ে যোশীমঠ যাবে বলে। রাত ১০টায় ড্রাইভার ভায়া যোশীমঠের কোনো চেনা হোটেলে আমাদের জায়গা করে দিল। হরিদ্বার টু যোশীমঠ এভাবেই শেষ হল। আমাদের হোটেলের লালাজি আমাদের গরম ভাত ফুটিয়ে দিলেন। সঙ্গে মুলোর আচার, রাই শাক, সবজি আর গাড়োয়ালি ভাষায় এক প্লেট ‘চিক্কেন’ নিয়েছিলাম।

সকালে যোশীমঠের ডিএফও অফিসের ভাবগতিক দেখে বোঝা গেল, ট্রেকিং পারমিট হাতে পেতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। তার মানে রওনা দিতে কাল সকাল। রাজীবদা বলল, “দিন নষ্ট হবে না, চল উর্গম যাই।” আমি তো পথেই পথ চিনতে নেমেছি। পাহাড়ের কোলে ধাপ কেটে চাষ করা, কাটা ধাপের উপর বসানো বাড়িঘর মিলিয়ে উর্গম। হলুদ হয়ে আসা জমির পাশ দিয়ে মাথায় স্কার্ফ বাঁধা মেয়েরা উল বুনতে বুনতে হেঁটে চলে। এখানে আছে পঞ্চ কেদারের এক কেদার—কল্পেশ্বর (শিবের জটা) ও সাতটা বদ্রীর এক বদ্রী—ধ্যানবদ্রী। গ্রামের প্রায় শেষের দিকে কল্পেশ্বর শিবের মন্দির। উপর থেকে ঝরনার জল পড়ছে, তার পাশ দিয়ে কিছুটা চড়াই ভেঙে মন্দির পৌঁছোতে হয়। ধ্যানবদ্রীর মন্দির গ্রামের মধ্যেই এক রাস্তার পাশে। এইসব দেখে সেদিন বেলার দিকে একই জায়গায় ফিরে আসলাম।

এই চারধামের কার্নিভাল পাশে রেখে, আমরা ধরলাম যোশীমঠ থেকে যে রাস্তা ঢাক, তপোবন, লতা, জুম্মা হয়ে মালারি তিব্বতের সীমান্তে পৌঁছেছে। এটাই ছিল প্রাচীন তিব্বতে যাওয়ার পথ। জুম্মায় নেমে ধৌলিগঙ্গার পুল পেরিয়ে হাঁটাপথ শুরু। এক কিমি হেঁটে রুইন গ্রাম। পাইনের ব্যক্তবীজ, ভূর্জপত্রের ছাল (যা প্রাচীন পুঁথিতে ব্যবহার হত) ও ধুনোর গন্ধ আমাদের পথের সাথী ছিল। ঠাকুমা-দিদিমারা পান খেয়ে সন্ধে দিলে, নাতি-নাতনিদের কোলে তুলে চুমু খেলে, গল্প বললে, ওই পানের জর্দার গন্ধে যেমন মিষ্টি লাগে, পাহাড়ে ধুনোর গন্ধে অমন নেশা হল। যত ইচ্ছা দুহাত ভরে পাইনের মেল-ফিমেল কোণগুলো কুড়োতে কুড়োতে গ্রামে পৌঁছোলাম। রুইন গ্রামের উচ্চতা ২,৫৭৮ মিটার। এক প্রৌঢ়া গিরিবালা আমাদের রাত কাটাবার আশ্রয় দিলেন। মাইজির দেখিয়ে দেওয়া ঘরে ব্যাগগুলো রাখলাম। আর কে না জানে যে, পাখির ছানারা কখনও মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় না। তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছি, তাই এবার আশপাশটা একটু দেখতে বেরোলাম দুজনে। আমি কানের দুল, গলার হার পরতে, তবে নাকি ‘দুলহান’ লাগছে। যা হোক, একটা-দুটো ধাপ নীচে নেমে দেখলাম একটা বাঙালি দল টেন্ট করেছে। এই রাস্তায় কম টিমই আসে। একজন প্রবীণ ও তিন বিভিন্ন বয়সের মহিলা দলটায় রয়েছেন। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি ফলে অভিজ্ঞতা অফুরন্ত। বললেন, অলটিচিউড গেইন করার পর ঘুরে বেড়িয়ে নিজের শরীরকে অভ্যস্ত করে নেওয়া দরকার। ওনারা সঙ্গে করে কুক এনেছেন। টিমের এক দিদি আমাদের বেবিকর্ন স্যুপ দিলেন। ভূমিকম্পে নেপালের দরবার স্কোয়ারের ভেঙে যাওয়ার কথায় আলো কমে সন্ধ্যা নেমে এল। আড্ডা সেরে কয়েক ধাপ উঠে দুজনেই রাস্তার বাঁ দিকে গ্রাম পঞ্চায়েতের টয়লেটে ঢুকলাম। বেরিয়ে রাজীবদাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি ও পাহাড়ের ধারের দিকে, নীচে তাকিয়ে কী দেখছে। আমিও ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনেক নীচে বাগিনী নালার কাছে দেখি কোনো বড়ো কালো জন্তু নদীটা পার করার চেষ্টা করছে। ফিসফিস করে বললাম ,“ওটা কী?”
“বল তো কী?”
“ওটা কি ভাল্লুক??”
জন্তুটা নদী পার করে চলে গেল। আমরা উঠে এসে মাইজিকে জিজ্ঞেস করতে উনি বল্লেন, “হাঁ, রহেতা হ্যায়। ইধর নেহি আতা।”

যোশীমঠ থেকে দুধের প্যাকেট কিনে আনা হয়েছিল। রুকস্যাকের সাইড পকেট থেকে বের করে দিলাম। দুধ দেখে কর্ত্রী নাক সিঁটকালেন। ওনারা মোষের দুধ খান। চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। গ্রামেরই আরেকজন ওনার বয়সি মহিলা আমাদের সাথে জুড়লেন। বয়স্ক মহিলারা উপরে দ্রোনাগিরি গ্রামে চড়ে যেতে পারেন না, তাই ওনারা এখানেই থাকেন। নিজেরাই চাষবাস করেন। নিজের হাতে রান্নাবান্না যাবতীয় কাজ করেন। ছেলেরা তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেও ওনারা যান না। দুজনেরই একই পোশাক। একটু ঢিলা, মোটা কাপড়ের ছাই রঙের ব্লাউজ। সায়ার উপর গাঢ় মেরুন রঙের থান পেঁচিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনেছেন। দেখলেই মনে হয় মেঘে ঢাকা পাহাড়। মাছের ছাঁচের মতো ব্রোচ দিয়ে আঁচলটা আটকানো। তার মধ্যে আবার পশুদের দাঁতবাঁধানো চেন। এগুলো কোথায় পেলেন জিজ্ঞেস করাতে, ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিলেন, “এসব আর এখন পাওয়া যায় কই?”

রাত সারে আটটা বাজে, অন্ধকার রান্নাঘরে এক পলতের কেরোসিনের বাতি জ্বলছে আর কাঠের উনানে সেঁকা হচ্ছে হাতে চ্যাপ্টা করা মকাইয়ের (ভুট্টা) রুটি, আলুর সবজি দিয়ে মাইজি খেতে দিলেন। আমরা যে যার বাসনটা ধুতে গিয়ে রাতের আকাশের দিকে চোখ পড়ল। লক্ষ-কোটি তারার ভারে আকাশটা যেন ভেঙে পড়বে।আমাদের ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে মাইজি একটা ম্যাট্রেস বার করে রেখেছেন। স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে দেখি দরজার উপরের অংশ ফাঁকা। ভাল্লুক এসে উঁকি দেয় যদি! যদি নাকে কামড়ে দেয়! “বুদ্ধদেব গুহর বইতে পড়েছিস বলে এসব মনে হচ্ছে। সত্যি কোনোদিন সামনাসামনি হলে এসব মনে আসত না”, আমার উত্তেজনায় জল ঢেলে দেওয়া রাজীবদার উত্তর।

সকালে রাজীবদা রুকস্যাক, আমি ন্যাপস্যাক নিয়ে বেরোলাম দ্রোনাগিরি গ্রামের উদ্দেশ্যে। বাঁ হাতে বাগিনি নালাকে (স্থানীয়দের ভাষায় দ্রোনাগিরি নদী) রেখে আজকে চললাম রুইন থেকে ৮কিমি দূরে দ্রোনাগিরি গ্রামে। আমাদের ক্লান্তি দূর করবেন পাহাড়ের ঢালে সারবাঁধা চেষ্টনাট, পাইন, ফারের বন। আর কয়েক জায়গায় পাহাড়ি ঝোরা তেষ্টা মেটাবেন। প্রথমে কিছুটা উতরাইয়ের পর ক্রমশ কষ্টকর চড়াই। রুদ্রদেবের দেশ এই গাড়োয়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে পাহাড়ের পাশ দিয়ে এক বাঁক পেরোচ্ছি। রাজীবদা চমকে দেওয়ার মতো এই গ্রামের এক মিথ শোনাল। এই গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করেন, হনুমান দ্রোনাগিরির কাছে বিশল্যকরণী চান। তা না দেওয়ায় হনুমান ছিঁড়ে ফেলেন দ্রোনাগিরির হাত। এই অঞ্চলের মানুষেরা হনুমানকে পূজা করেন না। দ্রোনাগিরি পর্বত ও ভূমিয়াল দেবতা এখানে পূজিত হন। লাল রঙের পোশাক এখানে নিষিদ্ধ। লাল রং হল দ্রোনাগিরি পাহাড়ের ছিঁড়ে যাওয়া হাতের রক্তের রং। পাণ্ডববর্জিত দেশের কথা তবুও শুনেছি, তাই বলে হনুমান বর্জিত হিমালয়—এইভাবে আগে তো ভাবা হয়নি, মজা হল।
আমার মনে পড়ল গন্ধমাদন পর্বত পেরিয়ে কুন্তী শতশৃঙ্গ পাহাড়ে ধর্মকে ডেকেছিলেন যুধিষ্ঠিরের আশায়।
রাজীবদা বলল, “সেসব তো মিথোলজিকাল ভেঞ্চার। তবে বাঙালি মেয়েদের একদল প্রথম ভার্জিন পিক ক্লাইম্ব করেছিলেন।”
—হ্যাঁ, সত্তরের দশকে।
—হিমাচলের লাহুল উপত্যকায়। ওনাদের দু’জন সদস্য মারাও যায়। পরে পিকটার নাম হয়েছিল ‘ললনা’।
এসব খেজুরে আলাপে ৮ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছোলাম দ্রোনাগিরি গ্রাম। প্রায় ৩,৬১৫ মিটার উচ্চতায় চলমান শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এরকম একটা গ্রাম কীভাবে তৈরি হল? পূর্ব দিকে অর্থাৎ আমাদের বাঁ দিকে পাহাড়ে অদ্ভুত নক্সাকাটা ঝুলন্ত বাগানের মতো রয়েছে গ্রামটা। ডান দিকে মানে পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে পঞ্চায়েতের গেস্টহাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ঘরগুলোয় বিছানাপত্তরও বেশ। বাড়িটার পশ্চিম দিকের ব্যালকনি থেকে, হাতির মতো দেখতে হাতি পর্বত আর ঘোড়ার মতো ঘোড়ী পর্বত আমাদের হাতছানি দিল। খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রামের মোড়লজির বাড়িতে হল। রাতে হাড়-কাঁপানো শীত, তায় এতটা রাস্তার ধকলে আমার শরীরটাও কাহিল। মোড়লজি আমাদের ঘরে খাবার এনে যত্ন করে খেতে বললেন। আমার নিজের শরীরের উপর রাগও হচ্ছিল, লজ্জাও করছিল, উনি এতদূর আসলেন বলে। “কোই বাত নেহি বেটি”, বলে আমাকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

পরদিন সকালে বাঁ দিকের গ্রামের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে উপর দিকে চড়তে লাগলাম। সঙ্গে কিছু খাবার, জল, ওষুধ রয়েছে। আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে সঙ্গী হয়েছে ওই মোড়লেরই পনেরো কি ষোলো বছরের ছেলে। বলল ও স্কুলে পড়ে, এসব করে হাত খরচ চালায়। চড়াই ভেঙে একটা রিজের কাছে উঠলাম। রিজটা পেরোতেই গোলাপি রডোডেনড্রনের বন আমাদের হাসি মুখে আমন্ত্রণ জানাল। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রডোডেনড্রনের লাল রং ফ্যাকাশে হয়ে আসে। কিশোর গাইড পাশের পাহাড়ের গায়ে সরু মোষ চড়ানোর রাস্তা দেখাল। এসব পশু সমেত গৃহস্থালি নিয়ে ওরা শীতের আগে নীচে চলে যায়। আমাদের দাদু-ঠাকুমাদের বাংলাদেশ থেকে এপারে আসতে গিয়ে কী ঝক্কি না পোহাতে হয়েছিল! আর এঁরা কিনা বছরের ছ-মাসের বেশি কোথাও থাকতেই পারেন না!

এবার বাগিনি আমাদের ডান দিকে। তৃণভূমি অঞ্চলের শেষে শুরু হয় বাগিনি গ্লেসিয়ার। বাঁ দিক থেকে হরদেউল, ঋষি পাহাড়, সতমিনল—আমাদের স্থির করে দিল। শুধু বাতাসের শব্দ শোনা যায়, ক্ষণিকের জন্য মুখ শব্দ হারিয়ে ফেলল। বরফের গায়ে পড়া আলোর রিফ্লেকশন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আমরা কচি ঘাসের উপর বসলাম। মোড়লজির স্ত্রী আমাদের জন্যও রুটি পাঠিয়েছেন, সঙ্গে ঘরে তৈরি আপেলের জ্যাম। নীচে ফেরার পথে, গ্রামের দিকটা দেখতে গেলাম। বাচ্চারা পাথরের উপর খেলছে। নতুন-পুরোনো বাড়ি মিলিয়ে গ্রাম, মাথার উপর রয়েছে ভূমিয়াল দেবতার মন্দির। কাঠের নক্সাকাটা বাড়িগুলো মাটিতে বসে গেছে।

পরদিন সকালে সবাইকে বিদায় জানিয়ে নেমে আসার পালা—জুম্মা থেকে কর্ণপ্রয়াগ। কর্ণপ্রয়াগ অলকানন্দা ও পিন্ডারি নদীর সঙ্গম। রাতে পিন্ডারি নদীর উপর দিয়ে পুল পেরোচ্ছি, ভরা জোৎস্নায় কালো হীরের মতো নদীর জল পুলের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে। দূরে কালো দানব পাহাড়ের ছায়া। পাঞ্জাবি হোটেলে ঢুকে কড়াই চিকেনের অর্ডার দিলাম। রাতে এখানে মেয়েদের দেখা পাওয়া ভার। টেবিলের তলা দিয়ে অলিখিত দারুসারুও চলছে। তবে হোটেলের ভিতরে মদের কাউন্টার নেই।

সকালে বাস ধরার আগে আবার পাহাড়ি ছাগলের ঝোল দিয়ে ভাত খেলাম। পাহাড়ে মুরগির চেয়ে ছাগলের দাম কম। বাসে গোয়ালদাম হয়ে এঁকেবেঁকে চললাম বাগেশ্বরের পথে। টানা বৃষ্টি চলছে। পথে রাজীবদা দেখাল ঘোমটার মতো নন্দাঘুন্টি পর্বত। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ সেদিন সাক্ষী ছিলেন কিছু চাকুরিজীবী ছেলের দুঃসাহসে বাঙালির প্রথম পর্বত অভিযানের। এই পুরো অভিযাত্রা অসাধারণ রূপ পেয়েছিল তাঁর “নন্দকান্ত নন্দাঘুন্টি” বইতে।

বাস আমাদের ছেড়ে দিল বাগেশ্বরে। ভেজা পিচের রাস্তায় পা পড়তেই, কুমায়ুন জননী কোলে তুলে নিলেন। সবুজ বন শালের মতো গায়ে জড়িয়ে গেল। পরদিন সকালে বেরিয়ে কৌশানিতে গান্ধিজির অনাশক্তি যোগের আশ্রম দেখতে বেরিয়ে পড়ি। ১৯২৯ সালে উনি আর সরলাদেবী এসে দু’সপ্তাহ কাটান। এখান থেকে নন্দকোট, নন্দাঘুন্টি, পঞ্চচুল্লি পাহাড়গুলো দেখা যায়। গান্ধিজি পরে ওনার লেখায় কৌশানিকে “ভারতের সুইজারল্যান্ড” বলেন। এখানে জন্মেছিলেন কবি সুমিত্রা নন্দন পন্থ। কবি হরিবংশ রাই বচ্চনের সঙ্গে ওনার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। মিউজিয়ামের ছবিগুলোর মধ্যে কিশোর অমিতাভ বচ্চনকে দেখলাম। ঘন পাইনের বনে লুকানো কৌশানির দামি শালও বিখ্যাত। ফিরতে বিকেল। সরযূ ও গোমতী নদীর মিলনস্থলে রূপবান বাগেশ্বর। এখানকার মন্দির স্থাপত্যের চিত্রকল্প যেন আদি বৈদিক সভ্যতার নিদর্শন। এখানের মানুষ নুড়ি বিছানো পাহাড়ি নদীর শোল, মহাশোল মাছ খুব পছন্দ করেন। মানুষের কাজের গতি আজকের মতো কমে এসেছে। আমরা পাহাড়ি ট্রাউট আর রাজীবদার জোগাড় করে আনা কান্ট্রি লিকার ‘বাজপুর গুলাব’ দিয়ে শরীরের ক্লান্তি দূর করলাম।
কাত্যুরি রাজাদের (৯০০-১২০০অব্দ) আমলে তৈরি গোমতী নদীর তীরে বিস্তৃত মন্দির বৈজনাথ। এক বড়ো স্তূপের মতো শিব-গৌরীর মন্দির, তার প্রাঙ্গণে বিস্তৃত এক মানুষ সমান আরও কয়েকটি ছোটো ছোটো মন্দিরের মতো স্তূপ। সকালে গাছের ফাঁক দিয়ে চুড়োয় আলো পড়ে।

এবার বাসে চললাম আলমোড়ার পথে। রাস্তার শেষ বাঁকে দেখা গেল কুয়াশার ভারে নুয়ে পড়া এই পুরোনো পাহাড়ি শহর কার যেন অপেক্ষায়! ১৯০৫ সালের ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া পোস্ট অফিস ঐতিহ্যের ভার বহন করে চলেছে। যৌনতাকে অন্ধকারে ছুঁয়ে ফেলার পর, মানুষ ও পশুর বিভিন্ন বিভঙ্গ নন্দাদেবীর মন্দিরের গায়ে খোদাই করে চলা ভাস্করের চমক যেন আজও ভাঙেনি।

বিবেকানন্দ নিবেদিতা এই উপত্যকায় একসঙ্গে অন্য এক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। উদয় ও অমলা শঙ্করের যুগলবন্দী পাহাড়ের কোলে রামলীলার বৃহৎরূপ তৈরি করতে পেরেছিল। এই শহরের মেঘ কেটে পথ চলা ব্যাগপাইপার, তার পাইপের সুরে সব রহস্যকে পাহাড়ের গায়ে ঘনীভূত করে রেখেছেন।

কাঠগোদাম থেকে হাওড়া গামী ট্রেন চড়ে, গাড়োয়াল কুমায়ুন যাত্রাপথের ইতি টানা হল।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

  1. খুব ভালো লাগল। যেরকম লেখা পড়ে মন শান্ত হয়। শুনেছি পাহাড় থেকে মানুষ পাহাড়ের মতো হয়ে ফিরে আসেন। লেখা পড়তে গিয়ে বারবার সেকথা মনে হচ্ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২