নারীদিবসের ভাবনা – দেবারতি ভট্টাচার্য্য

শেয়ার করুন

নারীদিবস নিয়ে লিখতে হবে,না নারীদের নিয়ে?। সোসাল মিডিয়ার কল্যাণে এইসব দিবস নিয়ে সবকিছুই কমবেশি জানা হয়ে যায় সব্বার। বিভিন্ন ধরণের সম্ভাব্য “ভাবনা”ও পড়া হয়ে গেল। আমি আর নতুন কী বলব বা লিখব?  নিজে নিতান্ত সাধারণ মানুষ, সব দিনগুলোই আমার কাছে একরকম। আলাদা করে নারীদিবসের কোন ভাবনা আসেনা। নারীদের নিয়ে লিখতে বললে তাও হয়ত দুলাইন গোরুর রচনা লিখতে পারি। আমাদের এক স্যর শিখ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন,তিনি যেকোনো বিষয়কে শিখ ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে দিতেন। ধরুন তাঁকে উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে বলতে বলা হল,তিনি  উত্তর-পূর্ব ভারতের শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভার নিয়ে কথা শুরু করবেন। তারপর আস্তে আস্তে শিখ অভিবাসনে চলে যাবেন। নিজের এই স্বভাব নিয়ে স্যর নিজেই ইয়ার্কি করতেন, বলতেন “গোরুর রচনা”। আমারও তেমনি ইতিহাস টেনে আনার বদঅভ্যেস আছে।
ইতিহাসের বিখ্যাত নারীদের কথা লিখতে পারি, বলতে পারি নিষ্ঠুর রানীদের কথা। সেইসব রানীরা,যাঁরা কারো স্ত্রী না হয়েই রানী হয়েছিলেন। মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা, ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া বা প্রথম এলিজাবেথের গল্প বলতে পারতাম। ভারতেই কি এমন মহিলারা ছিলেন না? ছিলেন তো,তাঁরা স্বামী বাবা বা ছেলের তোয়াক্কা না করে নিজের মত শাসন করেছেন। লিপি লিখেছেন,দান করেছেন,মূদ্রা বের করেছেন নিজের নামে। তাঁরা কি যুদ্ধ করেননি?সতীনকে,সৎ ছেলেকে বিষ খাওয়াননি?অবস্থাবিশেষে স্বামীকেও? তাঁদের সাফল্যের দিনগুলো কি নারীদিবস ছিল? নারীদিবস কি মানবিকতার বাইরে? আমি তো অন্যায়, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা এগুলোর কোন লিঙ্গভেদ দেখি না।

ইতিহাসের গোড়ায় নারীদের কৃষিকাজ আর বয়নের কথা লিখতে পারি, পুরুষরা যখন শিকারে হাত পাকাচ্ছে,নারীরা তখন শস্য বুনেছে। চাষবাস পুরোটাই মেয়েদের হাতে ছিল অনেকদিন পর্যন্ত। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর ইউরোপে বিয়ের সময় স্বামীরা পণ দিত বৌদের। কী পণ দিত? লাঙল আর চাষের অন্য যন্ত্রপাতি, কারণ চাষবাস তো বৌকেই করতে হবে। তারাই আবার বাগদত্তা নারী অন্য পুরুষের জামা বানালে তাকে শাস্তি দিত। তার মানে কী এই,যে প্রতি ঘরে জামা নারীরাই বানাত?সেই নারীদের জন্য স্বাধীনতার অর্থ কী ছিল? যত সভ্যতা এগিয়েছে, কৃষিকাজ পুরুষের হাতে চলে গেছে। একাদশ শতাব্দীর ইউরোপে দেখছি বস্ত্রবয়ন আর টেলারিং পুরুষদের হাতে চলে যাচ্ছে।

নারীদের সমানাধিকার আন্দোলনের কথা লিখতে পারি। যে নারীরা বারবার “রুটি চাই” বলে ফ্রান্সের রাজপথে ছুটে গেছে ফরাসী বিপ্লবের সময়, তাদেরই সবার আগে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ভারতের অনেক পরে ভোটাধিকার পেয়েছে ফ্রান্সের নারীরা। সম কাজে সম বেতনের জন্য আজকেও লড়ছে নারীরা। সেই নারীদের আলাদা নারীদিবস লাগে নাকি? নাকি তার কোন সার্থকতা আছে? ভারতে লোকসভায় নারীদের এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ আজকেও হয়নি বলেই জানি।

নারীদের আলাদা দিন নিয়ে এত মাতামাতি, পুরুষ দিবস কবে আমরা কজন জানি? সেটা ১৯ নভেম্বর, আমিও জানতাম না দুদিন আগেও। লেখার জিনিসের অভাব কী? কিন্তু এগুলো কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছেনা। এর চেয়ে একটা মেয়ের লড়াইয়ের গল্প লিখলে হত, একটা প্রেমের গল্প —- সবচেয়ে ভালো হয় যদি রূপকথা শোনাই।
চীনদেশে বুঝলেন একরকম নেকড়ে আছে,তাদের বলে ভিক্সেন। ভিক্সেনরা নারীর রূপ নিয়ে পুরুষের কাছে আসে। তাদের দেখতে হয় সুন্দরী, কাজেকর্মে কথাবার্তায় তাদের খুঁত পাবেন না আপনি। নার্স হিসাবে, গাইয়েবাজিয়ে হিসাবে, ডাক্তার হিসাবে, এমনকি স্ত্রী হিসাবেও তাদের জুড়ি নেই। অনেকসময় তারা দীর্ঘদিন পুরুষের সঙ্গে থেকে যায় স্ত্রী হিসাবে,পুরুষ বুঝতেও পারেনা সে আসলে ভিক্সেন। তারপর একদিন সে চলে যায় পুরুষকে ছেড়ে। যখন পুরুষ তাকে আর শারীরিক তৃপ্তি দিতে পারেনা, সন্তানের জন্য জোর করে,তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে,ভিক্সেন চলে যায়। ভিক্সেনরা পুরুষ রূপ ধরেও আসতে পারে,তখন তাদের লক্ষ্য হয় নারীশরীর ভোগ করা। সে প্রেমিক বা স্বামীর রূপ ধরে আসে,কিন্তু তার যৌনক্ষিদে অনেক বেশি হয়। নারীর প্রবল যন্ত্রণা হয় তারসঙ্গে সঙ্গম করতে।
পূর্ব ইউরোপে একরকম ভূত হয় জানেন,তাদের বলে পেরেলিস্কনায়েক। তারা একাকী দুঃখী বিধবা নারীদের কাছে আসে,কখনো তাদের স্বামীর রূপ ধরে,কখনো অন্য কোন চেহারা নিয়ে। সেই নারীদের সঙ্গ দেয়, যৌনতা দেয়,তাদের সঙ্গে থেকে যায় বছরের পর বছর।তাদের সঙ্গে সন্তানও হয় নারীদের। পরিবারের লোকজনেরা বেশিরভাগ সময় মেনে নেয় এদের। যদি কখনো কোন পরিবার সেই ভূতকে তাড়াতে চেষ্টা করে,নানারকম উৎপাত হয় বাড়িতে।

কী মনে হচ্ছে? এই গল্পগুলো কারা বানিয়েছিল? আমার কেমন যেন মনে হয় এগুলো আসলে নারীর ইচ্ছেপূরন আর ভয়ের গল্প। বাস্তবে যে জিনিসগুলো পাওয়া যায়না,গল্পে তার স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষরাও হয়ত স্বাধীন নারীকে ভয় পেত বলেই তাকে নেকড়ে বানিয়েছে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *