মুসাফির বাঙালি – দময়ন্তী দাশগুপ্ত

শেয়ার করুন
গরমের ছুটি এসেই পড়ল। আর অমনি আমবাঙালি ব্যাগপত্তর গুছিয়ে পাহাড়ে-সমুদ্রে যে যেদিকে পারে বেড়াতে বেরিয়ে পড়বে। যাঁদের নিতান্ত সে সুযোগ এ যাত্রা হল না, তাঁরা ছক কষবেন আগামী পুজোর জন্য। চারমাস আগেই টিকিট কেটে রাখতে হবে যে। এখন আর উঠাও গাঁটরি, চল মুসাফির বলার দিন নেই। এতসব হলেও, বাঙালির ভ্রমণের অভ্যেস কিন্তু খুব একটা পুরোনো নয়। পায়ের তলায় সর্ষে এই প্রবাদবাক্য তৈরি হয়েছে আধুনিক বাঙালিকে ঘিরেই। প্রাচীনকালে বাণিজ্য অথবা যুদ্ধযাত্রার মত খুব প্রয়োজন না হলে বাঙালি ঘর ছেড়ে বিশেষ বেরোতো না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালি কেন ভ্রমণ করেছে বা করে? মূলতঃ তীর্থ করতে, রাজনৈতিক কারণে, ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরির সূত্রে, পড়াশোনার জন্য অথবা স্রেফ বেড়ানোর জন্যই বেড়ানো। আঠেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালি তীর্থের উদ্দেশ্যে বেরোতে শুরু করল। তবে অনেক ক্ষেত্রে সে ভ্রমণের কিছু রাজনৈতিক অনুসঙ্গও থাকত। প্রাচীনকালে ধর্মের ক্ষেত্রেই বাঙালি কিছুটা স্বাধীনতার সুযোগ পেয়েছিল তা ভ্রমণ কাহিনি পড়তে পড়তে দেখেছি। বাঙালি মেয়েরা প্রথম এই ধর্মের হাত ধরেই ভ্রমণে বেরোলেন। সেই তাঁদের কাছে ছিল ‘বিদেশ ভ্রমণ।’ বাঙালি পুরুষ অবশ্য কাশী-হরিদ্বারে আটকে না থেকে কেদার-বদরী কী অমরনাথেও পৌঁছালেন খুব তাড়াতাড়িই। তবে অতদূর না গেলেও দার্জিলিং কিম্বা নৈনিতালে গিয়ে পাহাড় দেখার সাধ মেটালেন বাঙালি মেয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে পড়াশোনা বা কর্ম সূত্রে বিদেশ যাওয়ার চল শুরু হয়েছিল। ‘বিদেশ’ বলতে প্রাথমিকভাবে বিলেত বা ইংল্যাণ্ডকে বোঝাতো। পরের দিকে যার সঙ্গে যুক্ত হয় ফ্রান্স, ইতালির মত জায়গা, এমনকী অফবিট জাপান কিম্বা আফ্রিকাও। রামমোহন মাত্র পনের বছর বয়সে অন্য প্রকার ধর্ম দেখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে দু-তিন বছর তিব্বতে গিয়ে ছিলেন। ডাঃ কার্পেন্টার এই কথা রামমোহনের মুখে শুনেছেন বলে তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রামমোহন তাঁর নিজের কোন রচনাতেই নিজমুখে তিব্বত ভ্রমণের কথা বলেন নি। তাঁর প্রথম জীবনের ভ্রমণ সম্বন্ধে, ১৮০৩-৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘তুহফাৎ-উল্-মুয়াহহিদীন’-এর আরবী ভাষায় লেখা ভূমিকাতে লিখেছেন, ‘আমি পৃথিবীর সুদুর প্রদেশগুলিতে, পার্ব্বত্য ও সমতল ভূমিতে পর্যটন করিয়াছি।’ ১৮১৫ সালে ইংরেজের দৌত্যকার্য্যে রামমোহনকে ভুটান যাত্রা করতে হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েদের বিদেশ ভ্রমণ মূলত স্বামীর সঙ্গ দিতেই। এর ব্যতিক্রম জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এবং পরবর্তীকালে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি কী তার পরেও বাঙালির ভ্রমণ যাত্রা ছিল হয় পায়ে হেঁটে বা জলপথে। সে তীর্থ হোক কী বাণিজ্য। বিলেত যেতেও তাকে মাসের পর মাস জাহাজবাসী হতে হত। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে রেল যোগাযোগ শুরু হলে শুরুর দিকে তা খুব আগ্রহের সঙ্গে নেয় নি সে। পাঁচ জাতের মানুষের সঙ্গে এক আসনে বসে যাওয়া তারপক্ষে কঠিন হয়েছিল বৈকি। তায় বাড়ির মেয়েদের নিয়ে। তীর্থ করার আগেই যদি জাত যায় তাহলে আর রইল কী? কিন্তু ক্রমশঃ এই ধারনারও বদল ঘটল। বরং রেলযাত্রায় পথ সুগম হওয়ায় বাঙালির ভ্রমণ উৎসাহ দিনদিন বেড়ে উঠল। তবে বিশ শতকে রেলযাত্রার মত বেড়েছিল পাহাড়ে পাহাড়ে পায়ে হেঁটে ঘোরার চলও। যাকে আমরা আধুনিক ভাষায় বলি ট্রেকিং। তারসঙ্গে ইংরেজঘেঁষা বাঙালির বিদেশ ভ্রমণও। এইসব যাত্রায় বারন কিম্বা বাধা সত্ত্বেও মেয়েরাও পিছিয়ে রইল না। আসলে বাড়ির বাইরে পা রাখা বাঙালি মেয়ের সত্ত্বায় একটা স্বাধীনতার আস্বাদ এনে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরের চিত্র দেখলে ক্রমশঃ দেশেবিদেশে সপরিবারে ঘোরার ব্যাপারটা যেমন বাড়তে শুরু করল, পুরুষের পাশাপাশি বাঙালি নারীর একা ভ্রমণও শুরু হয়ে গেল। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ছাপ পড়তে লাগল বাঙালির ভ্রমণচিন্তনেও। আর বিশ শতকের শেষ থেকে এখনের সময়ে এসে ভারতবর্ষের সর্বত্র এমন কী দেশে-বিদেশেও দেখা যায় পর্যটকদের একটা বড় অংশই বাঙালি। খাবার জুটলেই সে দ্বিতীয় যে কথা ভাবে তা বেড়ানো। তাই উচ্চবিত্ত শুধু নন, সাধারণ রিক্সাওলাও সারা বছর টাকা জমান, বছরে একবার অন্ততঃ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ভ্যান সফরে ভারতবর্ষ ঘুরবেন এই আশায়।

সঙ্গের ছবি – বাঙালির চিরকেলে চেনা দার্জিলিং (ম্যল), আলোকচিত্রী – রত্নদীপ দাশগুপ্ত

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *