মৃগশিরা আর কালপুরুষ – গৌতম চৌধুরী
১.
যে-সর্বনামকে বিদায় দেওয়া হইয়াছিল ঘোর কোনও তমসাতীরে, ঘুড়িটি ভাসিতেছে, এতই উঁচুতে, যে কাটিয়া যাওয়া টের পাওয়া যায় না। মেঘ জমিলে চিলেরাও সেইখানে। তাহাদের চোখে নদী সামান্যই দূরে। জলই সম্পর্করেখা। বন্দর বলিলেই কেন বৃষ্টির কথা মনে হয়। তাহার কত লিপ্ততা, ঘাম ও মুদ্রা বিনিময়, তবু পথে পথে ভিজিবার আমন্ত্রণ। রংবেরঙের কাপড় কাচিয়া মেলিয়া দেওয়া হইয়াছে প্রান্তরে। বাতাসে দুলিতেছে তাহাদের অহং। শব্দ উঠিতেছে। ফুলিতেছে গর্ভ। দুঃখ ও আনন্দের ভিতর দিয়া কে কোথায় ছিন্ন হইয়া যাইবে তাহাদের সন্ততিরা, বাতাস জানে না …
২.
অনেক কথা জানাইবার ছিল। মাটি ভেদ করিয়া উঠিয়া আসে পিপীলিকার সারি। কাণ্ড বাহিয়া উঠিয়া যায় গাছের শীর্ষে। মহাজনের হুঁশিয়ারি মেঘের কোণে দিপ দিপ করে। হায় রে প্রকৃতি! যাহা কিছু সংকেত, সকলই তো ভাসিয়া আসে ওই আদিম হইতে। অভিকর্ষহীন দশায় কেশরাশি যেভাবে মাথার উপরে দাঁড়াইয়া যায়, তাহাতে স্বপ্ন দেখিতে কোনও সুবিধা হয় কি? কিছু কথা আড়ালেই থাকিয়া যায়। নহিলে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা শাবল-খন্তা লইয়া খুঁজিবে কী? ভূগর্ভের যত গভীরেই যাক, একটি করিয়া কাহিনি। সকল কাহিনির নীচে ক্রন্দন। ক্রন্দনই যে প্রাণ, সহজে কি বুঝা যায়! শুনাও যায় না। তবু বাতাস কাঁপিয়া উঠে। পাল উড়াইয়া দেয় নৌকা…
৩.
কূপে উঁকি মারিতে ভয়, তাহা এত অতল। ছায়া নাই। কারণ জলের চিহ্ন মাত্র নাই। পাত্রের স্পর্শে শুধু ঠং শব্দ। কোন্ তিমিরে পুঞ্জ শিলা ও শৈবাল। কোন্ সুদূর তিমিরে! তাই ভয়।
উড়ন্ত গালিচাখানি জবুথবু আড়ষ্ট গুটানো। সকল উড়াল স্তব্ধ। বিহঙ্গচোখের ছবিগুলি ম্লান। সেই কাঁটাগাছ ও ঢেউকাটা বালি, সেখানে ধিকি ধিকি অস্থিগুলি, স্বপ্নের। তাহাদের পিপাসা জল চায়। আকাশপ্রমাণ হাঁ চন্দ্রসূর্য গিলিয়া লইতে চায়। তাই ভয়…
৪.
বোতলের ভিতরে জিন। স্তব্ধ, হিম। আরকের ভুরভুরি দেখিয়া বুঝা যায়, আছে। ছিপি গালা দিয়া আঁটা, জমপেশ। গালার ভিতর সুগন্ধ মিশাইয়াছিল, সে কি জিন নিজেই! গন্ধটি বয় মাঝে মাঝে। সামনে কেউ থাকিলে, তাহার হাত নিশপিশ। আঙুল আগায় ছিপির দিকে। পিছনের দেওয়াল হাসিয়া উঠে–হা হা।
পরম্পরা নাই। বাক্য অনর্থ মাত্র। আমন্ত্রণকেও মনে হয়, প্রত্যাখ্যান। জল ফুটিতেছে। রন্ধন আউলাইল বলিয়া। আর একা ডুবিবার জো নাই। যদু মধু চদু সব বংশই ডুবিবে। কানে আঙুল দিবার কিছু নাই। ঘড়ির কাঁটা আগাইতেছে। এইবার ছিপি খুলিলেই হয়…