মা – রিয়া মিত্র
দত্তবাড়ির দুর্গাপুজো এই অঞ্চলের নামকরা। দুর্গাপুজোর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। প্রতিমা তৈরির কাজ অনেক দিন আগেই আরম্ভ হয়েছে। দত্তবাড়ির বর্তমান শরিক প্রিয়নাথ, বসুনাথ, রমানাথ ও শ্যামানাথ। চার ভাইয়ের উদ্যোগেই বাড়ির পুজো জমজমাট। তাদের বোনেরাও জামাই-সন্তানসহ চলে এসেছে পুজোর চারদিন এই বাড়িতেই আনন্দে সামিল হওয়ার জন্য। সবথেকে ছোট ভাই শ্যামানাথের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হল। তার স্ত্রী রেবতী শুধু এই পুজো থেকে ব্রাত্য।”আসতে পারি, বৌদি?”– ননদ, পাখি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। রেবতী হাতের কাজ করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, এসো এসো, পাখি। কখন এলে? জামাই আর ঋভু এসেছে?”
— হ্যাঁ, বৌদি, এসেছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে এসেছি। দ্যাখো তো, এই শাড়িটা এনেছি, পছন্দ হয়েছে?রেবতী হেসে বলল, “এত দামি শাড়ি কেন আনতে গেলে, পাখি? আমি তো পুজোর ক’দিন ঘরেই থাকি। পুজোমণ্ডপে তো আমি ব্রাত্য। আমি তো পুজোর কোনো কাজে হাত দিতে পারব না।” পাখি মুখটা নীচু করে বলল, “তোমার সন্তান হয়নি, সেটা তোমার দোষ নয়, বৌদি আর আমি ওসব মানিও না। তুমি এই শাড়িটা পরে অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিও। মন খারাপ কোরো না। মা চাইলে তোমার কোল ভরিয়ে দেবেন।”– আচ্ছা, খুব পাকা কথা শিখেছ। পুজোর ক’দিন বিশ্রাম নাও আর আনন্দ করো।নীচে চণ্ডীমণ্ডপে রমানাথ বসুনাথকে ডেকে বলল, “দাদা, গ্ৰাম থেকে যে ঢাকিদের আসার কথা ছিল, তারা কী এসেছে?”
— হ্যাঁ, ওরা বাইরে বসে আছে। ভিতরে নিয়ে এসে ওদের সমস্তটা দেখিয়ে, শুনিয়ে, বুঝিয়ে দাও।রমানাথ বাইরে বেরিয়ে দেখল, একজন বৃদ্ধ, একজন মাঝবয়সী লোক ও একজন বাচ্চা তিনজনে তিনটে ঢাক কাঁধে করে বসে আছে। রমানাথকে এগিয়ে আসতে দেখে বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, “নমস্কার, বাবু। আমি আবদুল, আমার ছেলে করিম আর আমার নাতি বছির।” রমানাথ বছিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কত বয়স ওর?” আবদুল বলল, “আজ্ঞে বাবু, দশ বছর।”– ও এত ছোট, ঢাক বাজাতে পারবে?– খুব পারবে, বাবু। আমি নিজে ওকে তালিম দিয়েছি। আর মা-মরা এইটুকু ছেলেকে ঘরে কোথায় রেখে আসব, বাবু? তাই সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম।রমানাথ ওদের নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে প্রবেশ করতে করতে বলল, “তা, বেশ করেছ। শোনো, ও’দিকের ঘরটায় তোমরা থাকবে। ভোরবেলা থেকে বাজানো শুরু করতে হবে। মায়ের পুজোর সময়ে বিভিন্ন তালে বাজাবে। কোনো ত্রুটি যেন না হয়। আগের বছর পর্যন্তও যারা আসতেন, তারা খুবই ভালো বাজাতেন।”– হ্যাঁ, বাবু, এ’বছর বন্যায় তাদের খুব ক্ষতি হওয়ায় তারা আর আসতে পারেনি। তাই, আমাদেরই পাঠালো। আমাদের দিক থেকে কোনো ত্রুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, বাবু।ভোরবেলা ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো রেবতীর। বেশ ভালো বাজাচ্ছে তো! শ্যামানাথকে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ গো, এরা কী সেই পুরনো ঢাকিরই দল?!”– না, দাদারা এ’বার নতুন ঢাকি এনেছে। বেশ ভালো বাজাচ্ছে, বলো?রেবতী মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে রান্নাঘরে যায়। পুজোর কাজে ব্রাত্য। তাই, বাড়ির লোকের খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব পুরো তার ওপরেই। রান্নাঘরে একমনে লুচি-আলুরদম বানাচ্ছে রেবতী। বাড়ির কাজের লোকেরাও হাতে হাতে সাহায্য করছে। বাইরে থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। হঠাৎ রেবতীর রান্নাঘরের দরজার দিকে চোখ পড়ল। কে যেন দরজার কাছ থেকে সরে গেল। রেবতী উঠে গিয়ে দেখল, একটি বাচ্চা ছেলে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে। বড় মায়াবী মুখটা। রেবতী জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কে, বাবা?” বাচ্চাটি ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি বছির, আপনাদের বাড়ি ঢাক বাজাতে এসেছি।”– এখানে কী করছ?– আমি ভোরবেলা ঢাক বাজাচ্ছিলাম। এখন বাবা ঢাক বাজাচ্ছে। তাই, এখন আমি বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।রেবতী হেসে বলল, “ভারী সুন্দর ঢাক বাজাও তুমি, বছির। এসো, আমার সাথে।” বছিরকে একটি প্লেটে লুচি-আলুরদম দিয়ে রেবতী বলল, “খিদে পেয়েছে তো? খেয়ে নাও।” বছির ভয়ে ভয়ে বলল, “না, দাদু বকা দেবে।” রেবতী হেসে বলল, “দাদু কিছু বলবে না। আমি বলে দেব দাদুকে।” বছির একটু মুখে দিয়েই বলল, “খুব সুন্দর রান্না হয়েছে, মা, তোমার রান্না?” রেবতী বছিরের মুখে ‘মা’ ডাকটা শুনে চমকে গিয়ে বলল, “তুমি কী আমাকে ‘মা’ বলে ডাকলে, বছির?” বছির খেতে খেতে বলল, “হ্যাঁ, আমার তো মা নেই। তোমাকে ডাকতে ইচ্ছে হলো হঠাৎ, তাই ডাকলাম। দাদুও বলে দিয়েছিল যে, বাড়ির ছেলেদের ‘বাবাঠাকুর’ আর মেয়েদের ‘মা ঠাকরুণ’ বলতে।” রেবতী ভেজা-চোখে বলল, “তোমার মা নেই? আজ থেকে তুমি আমাকেই ‘মা’ বলে ডেকো।”দুপুরে খেতে বসে রেবতী শ্যামানাথকে বলল, “বছিররা খেয়েছে?”– পুজোর প্রসাদ ও ভোগ খেয়ে নেবে ওরা।সকলের খাওয়ার পর রেবতী জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, বছির ঢাকের ওপর মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছে। পাখিকে দিয়ে রেবতী বছিরকে ডেকে পাঠাল। বছির ঘরে আসতেই রেবতী জিজ্ঞাসা করল, “খেয়েছিস্, বছির?”– না, এখনও খেতে দেয়নি।রেবতী বছিরকে আদর করে পাখিকে বলল, “পাখি, ওর জন্য একটু খাবার এনে দাও না।” পাখি বছিরকে খেতে দিয়ে রেবতীকে বলল, “বড় মায়াবী না মুখটা?” রেবতী বলল, “বড় ভালো ছেলে। ওকে আদর করলে আমার মনে হয় যেন আমি আমার নিজের ছেলেকে আদর করছি, আমার অপূর্ণ মাতৃত্ব তৃপ্ত হয়।” পাখি বলল, “ওকে তোমার কাছেই রেখে দাও, বৌদি।” রেবতীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রাতে শুয়ে শ্যামানাথকে রেবতী বলল, “বছিরকে আমি নিজের ছেলের মতো স্নেহ করি। ও থাকলে কখনো আমি সন্তানের অভাব বুঝতে পারি না।” শ্যামানাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, “ওর বাড়ির লোকই বা ওকে রাখবে কেন?”– ওর তো মা নেই। আমি ওকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করব।– কাল দশমী। মায়ের বিসর্জনের পর ওরা চলে যাবে। কাল একবার ওদের বলে দেখব।
সকাল থেকেই মাকে বরণ করার জন্য বাইরে থেকে অনেকেই আসছেন। রেবতী বছিরকে ডেকে বলল, “বছির, তুই আমার কাছে থাকবি?” বছির রেবতীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমারও খুব তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে, মা কিন্তু বাবা বোধহয় রাজি হবে না। আমি ছাড়া তো বাবারও আর কেউ নেই।” বাইরে তখন মা বিসর্জনের পথে বেরোচ্ছেন। রেবতী ঘর থেকে বেরিয়ে সকলের সামনে করিমকে বলল, “ভাই, আপনার ছেলেকে আমার কাছে রাখবেন? আমার নিজের কোনো সন্তান নেই। আপনার ছেলেকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করব।” করিম হাতজোড় করে বলল, “মা ঠাকরুণ, আমার ঐ একটিই ছেলে। ওকে আমি কারো হাতে দিতে পারব না। আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন। প্রতি বছর আমি আপনার কাছে ওকে নিয়ে আসব, আপনাকে এই কথা আমি দিলাম।”বাইরে মা তখন ছলছল নেত্রে বিসর্জনের পথে চলেছেন, মর্ত্যের সন্তানদের ছেড়ে স্বর্গলোকের পথে পাড়ি দিতে। একবছর পর আবার তিনি সন্তানদের দেখতে পাবেন। রেবতীর চোখও জলে ভরে ওঠে, মনটা কষ্টে ভরে যায়, বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়, বছিরকেও যে সে আবার একবছর পর দেখতে পাবে। বছিরের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে চোখটা ঝাপসা হয়ে ওঠে রেবতীর…