কেঁচো — সুধীর নাউরোইবম অনুবাদ: এল. বীরমঙ্গল সিংহ
১
ফটক থেকে কুমার চিৎকার করে বলল, “অ বউদি কেঁচো নেবে নাকি?”
কুমারের ডাক শুনে অহনবী ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল, “হ্যাঁ, দিয়ে যাও। তখন থেকে তোমারই অপেক্ষা করছি। এসো এসো।”
কুমার এসে তার কেঁচো মাপার ছোট্ট কৌটোটাতে মাপার জন্য কেঁচোগুলো ঢোকাল।
—বেশি বড়ো কেঁচো দেবে না, মাছে খেতে চায় না। এই সাইজের দেবে।
—নাও তোমার পছন্দমতো বেছে নাও। আগের দশ টাকা আর আজকেরটা মিলে হল গিয়ে পনেরো টাকা।
—নগদ টাকা চাইছ নাকি। নগদে না দিয়ে কুঁচে মাছ দিতে বলেছিলে না সেদিন?
—কুঁচে মাছই দিও। মোট কত হল শুধু তা মনে করিয়ে দিয়েছি মাত্র।
—যেদিন তুমি কুঁচে মাছের কথা বলেছ না, সেদিন থেকে একটিও ধরা পড়েনি।
কাছেই বারান্দায় মাদুর পেতে য়াইমা শুয়ে রয়েছে। সে লক্ষ করছে, কুঁচে মাছ দেখলেই যে কিনা আঁতকে উঠত তার সেই স্ত্রীই নিজে হাতে ধরে কেঁচো বাছাই করছে। উঠোনে আবার তাদের বছর দুয়েকের ছেলেটা অনাদরে আদুড় গায়ে নোংরা মেখে খেলা করছে।
কুমার চলে যাবার পর য়াইমা জিজ্ঞেস করল, “গতকালই তো তুমি দুটো কুঁচে ধরে এনেছ?”
—তাই বলে কি চট করে দিয়ে দেওয়া যায়? ও দুটো বেচে নগদ কুড়ি টাকা পেয়েছি। য়াইমা আর কথা বাড়াল না।
—আমাদের জলা জমিতে লোকেরা জাল আর বড়শি পেতে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে জলাটা শুধু শুধুই অন্যের দখলে চলে যাওয়ার চেয়ে বরং ঘরে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা বড়শিগুলো পেতে দিয়ে আসি।
য়াইমা হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। অহনবী একজন নারী। তাই য়াইমার নীরব থাকার কারণ সে বুঝতে পারে। বড়শি পেতে আসলে পরদিন ভোরে উঠে তাকেই যেতে হবে বড়শিতে গাঁথা মাছ তুলে নিয়ে আসার জন্য। না হলে যে কেউ তুলে নিয়ে যাবে। আর যেতে হবে তাকে সেই নির্জন জলাতে।
অহনবী কোনো ইতস্তত না করে বলল, পুব পাড়ার তোম্বী বউদিও তো যাচ্ছে। তাদের জলাও আমাদের জলার পাশেই। তার সঙ্গে গেলেই তো হয়। প্রতিদিন ভোরে উঠে জলাতে গিয়ে বড়শিতে গাঁথা প্রচুর মাছ সে তুলে নিয়ে আসে। তাদের চেয়ে আমাদের জলাতেই বেশি মাছ আছে। তাই তো লোকেরা আমাদের জলা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। কতদিন হল আমরা জলাটার খবর রাখিনি।
য়াইমা নীরবই থাকে। তার নীরব থাকার অর্থ অহনবী নিজের মতো ব্যাখ্যা করে। অহনবী জলাতে বড়শি পাততে চলে যায়। তবুও য়াইমা ভালো মন্দ কিছুই বলে না।
একদিন য়াইমা অবাক স্বরে বলে উঠল, “প্রচুর মাছ ধরে এনেছ দেখছি।” তার কাজে স্বামী আগ্রহী হয়ে উঠেছে ভেবে অহনবী খুব খুশি। তৃপ্তির হাসি হেসে সে বলল, “তবুও তো তোম্বী বউদি ঠাট্টা করে বলেছে, ‘তুই যেভাবে আধার গেঁথে বড়শি পাতিস তাতেই দেখছি মাছগুলো দলবেঁধে স্বেচ্ছায় এসে ধরা দিচ্ছে।’ সত্যিই, নিপুণ হাতে আধার গেঁথে ঠিক মতো বড়শি পাততে পারলে প্রচুর মাছ ধরা পড়ত।”
সেদিন থেকে য়াইমাও বড়শিতে কেঁচো গাঁথতে অহনবীকে সাহায্য করে। কোন্ মাছের জন্য বড়শিতে কীভাবে আধার গাঁথতে হয় তা শিখিয়ে দেয় সে।
—আমাদের জলাটার অবস্থা কেমন?
—শাপলার বন হয়ে রয়েছে। গত পরশু আমি যে চারটা শাপলা ফুল এনেছিলাম সেগুলো আমাদের জলারই। কলমি শাকও প্রচুর জন্মেছে। প্রথমদিন তো একে দেখেই আবেগে কেঁদে ফেলেছি আমি। আগামী বছর মজুরি দিয়ে জলাটা সাফ করিয়ে ‘থাংজিং’ লাগাব, কেমন? আমাদের অভাবে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ছেলেটিও তো আর বাচ্চাটি থাকবে না।
—অহনবী। তোমার কত কষ্টই না হচ্ছে।
—তা তোমার জন্যেই তো।
য়াইমা হেসে উঠল। নীচু গলায় বলল-“কতদিন হল তোমার চুলে হাত বুলাইনি।”
অহনবী মুখ নীচু করল, আর কথা বাড়াল না।
সেদিন সকালে অহনবী খালি হাতে ভিজে কাপড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুত পায়ে জলা থেকে ফিরে এল। তাকে বেশ ভীত ও সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। য়াইমা জিজ্ঞেস করল, “অহনবী! কি হয়েছে তোমার?”
ঘরের ভেতর থেকে অনেকটা কাঁপা গলায় জবাব এল, “কিছু হয়নি।”
—বড়শিগুলো?
অহনবী কোনো জবাব দিল না। কী যে হয়েছে য়াইমা ভেবে পায় না। সন্ধ্যায় নীরবতা ভেঙে অহনবী মুখ ফুটে বলল, “আমার চুলগুলো এবার কেটে ফেলি গিয়ে।”
অহনবী কী বলতে চাইছে য়াইমা কিছুই আঁচ করতে পারল না। ভিজে কাপড়ে জলা থেকে ফিরে আসার কারণ জানায় অহনবী। চোখের জলে ঘটনার বিবরণ দিতে থাকে সে। বিবরণ শুনতে শুনতে য়াইমার চোখে জল আসে। দাঁত তার কড়মড় করে ওঠে। মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে চুল সুদ্ধ শক্ত করে মুঠো করে। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে চালে গুঁজে রাখা কাস্তেটা শক্ত করে ধরার ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু পা দুটো নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। য়াইমার দু’চোখ বেয়ে জলধারা নেমে আসে। চোখে ভেসে ওঠে জলজ কলমি শাকগুলো, সেদিনের ভোরের আলো-আঁধারি দৃশ্য। মহিষের পিঠে চড়ে য়াইমা নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছে জলার দিকে। কিন্তু ভোরের আঁধারে কলমি শাকগুলো কী যেন হয়ে গেল। অহনবী প্রাণপণে ছুটে চলেছে জলের ভেতর। ‘চেঙহী’-র গন্ধ মাখা এক রাশ কালো লম্বা চুল খোঁপা খসে ছড়িয়ে পড়েছে ভোরবেলায় অন্ধকারের স্তূপ হয়ে। পেছনে এক লোলুপ হাত ধাওয়া করছে কালো চুলের গোছা স্পর্শ করার জন্য। ভোরের আঁধারে কী যেন হয়ে গেল কালো চুলগুলো।
ক্ষীণ স্বরে য়াইমা স্ত্রীকে বলল, “তুমি কেন এ সব কথা আমাকে বলছ! আমি কি করতে পারি বলো।” অহনবী চমকে ওঠে। তবু সে নিশ্চল বসে থাকে। হঠাৎ দুজনই নিশ্চুপ হয়ে গেল। কিছুদিন পর সেদিন ভোরে অহনবীর চুল স্পর্শ করতে ব্যর্থ পুরুষটি পরাজিত ও চরম অপমানিত হয়ে লজ্জায় মুখ কালো করে য়াইমার কাছে ছুটে এল ও নিজের অপরাধ স্বীকার করল সে। তার বাঁচা-মরার বিষয়টা ঝুলে রয়েছে বলে জানাল সে। লোকটির কথায় য়াইমা অবাক না হয়ে পারল না। তাদের এমন কী প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে যার কারণে অপরাধী নিজে থেকে এসে তার অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে য়াইমা কিছুই বুঝতে পারে না। পরে জানতে পেরেছে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখা কিছু চরমপন্থী যুবক তাদের জলা পার হয়ে গোপন পথে প্রায়ই আসা যাওয়া করে। য়াইমার হাসিও পেল–বাঁচার জন্য মানুষ কতই না আকুল হয়ে ওঠে!
২.
কুমারের টাকাটা কি দিয়ে দিয়েছ?
—দিইনি।
—কত হল।
—ত্রিশ।
—দিয়ে দিতে পার না।
—দেব’ খন।
―বেশি জমে গেলে দিতে কষ্ট হবে বলে সতর্ক করছি।
অহনবী আর কথা বাড়াল না। য়াইমা আপন মনে বিড়বিড় করে বলল, “কেঁচো পর্যন্ত জোগাড় করে দিতে পারি না আমি!”
অহনবী বলল, “ভাবছি কুমারের সঙ্গে কেঁচো খুড়তে যাব। এবার কেঁচো বিক্রি করে কত টাকাই না পেল সে! অন্য কেউ না পেলেও সে কিন্তু ঠিকই কেঁচো জোগাড় করে নিয়ে আসে। সত্যিই, কী যে দিনকাল পড়ল, আজকাল মানুষে কেঁচোও কেনে! কিছুদিন পর তো মনে হয় এটি আর পাওয়াও যাবে না।”
“সত্যিই, আমি কোনো কাজেই আসি না”, এ কথা বলে য়াইমা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শরীর ভারী হওয়া গাভি মহিষটা ধীর পায়ে হেলতে দুলতে য়াইমার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছিল। পথে কারও সঙ্গে দেখা হল না। অহনবী অবশ্য বলেছিল, ভোরে হাল চালাবে বলে কি কেউ মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে জমিতে যায় নাকি। আকাশের দিকে তাকিয়ে য়াইমা আঁচ করতে পারল ভোর হতে তখনও অনেক বাকি। ভাবল সকাল সকাল চলে আসাটা একদিকে ভালোই হয়েছে, রোদ মাথায় নিয়ে হাল চালাতে হবে না। তাছাড়া মহিষটার শরীরের যা অবস্থা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় হাল চাষের কাজটা সেরে নিতেই হবে।
শক্ত মাটির হাঁটা পথ শেষ করে যখন তাকে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়া কাদা জমির উপর দিয়ে যেতে হল তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও য়াইমা গর্ভবতী মহিষটার পিঠে চড়ে বসল যাতে তাড়াতাড়ি চাষের জমিটিতে পৌঁছে যায়। জমিটার অবস্থা না জমি না জলা। হালের গরুতে চাষ করার উপায় নেই, পাওয়ারটিলার নিয়ে যাওয়ার রাস্তাও নেই। নিজের মহিষ না থাকলে জমিটা চাষ করা সম্ভব হত না।
মাথার সমান উঁচু কলমি শাকগুলো কালো স্তূপের মতো য়াইমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীর পায়ে মহিষটা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কলমি শাকগুলো ক্রমেই কাছে আসছে। কালো স্তূপটা আসছে কাছে। হঠাৎই মহিষটা দাঁড়িয়ে পড়ে। য়াইমার মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে। চোখ বড়ো বড়ো করে কলমি শাকের বনের ভেতর তাকায় সে। ধীরে ধীরে তার সারা শরীর অবস হয়ে আসে। চোখ দুটো আপনিই বুজে এল।
য়াইমা যখন চোখ মেলে তাকাল তখন ভোরের অন্ধকার কেটে গেছে। মুখের অংশটুকু ছাড়া সারা শরীর জলে ডুবে রয়েছে। এই অবস্থায় পড়ে থাকায় সে অবাক হল। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও কিন্তু চট করে উঠতে পারল না। সারা শরীর ক্লান্ত ও অবসন্ন। য়াইমার মনে পড়ল, ভোরের ঝাপসা আলোয় সে দেখেছে কলমি শাকের জঙ্গলের মধ্যে থেকে সাদা কুয়াশার মানুষের মতো একটা অবয়ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তার দিকে ধীর গতিতে উড়ে আসছে। দৃশ্যটা মনে পড়তেই তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মুখ ফিরে তাকাল কলমি শাকের জঙ্গলের দিকে। ঝলমলে সূর্যের আলোয় শাকগুলো আগের মতোই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে উঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীর পায়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। কাদায় পা আটকে যাওয়া ছাড়াও পা দুটো অবশ হয়ে আসায় হাঁটতেই পারছিল না সে। তার সারা শরীর কাদা মাথা, দেখতে মনে হয় যেন কাদা দিয়ে তৈরি এক মানুষ।
মাটির রাস্তায় উঠেই য়াইমা পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলমি শাকগুলোর দিকে তাকাল। তারপর চোখ বুজে কিছুক্ষণ থাকার পর চারদিকে তাকিয়ে তার মহিষটার খোঁজ নিল। কিন্তু ধারে কাছে কোথাও মহিষটাকে দেখতে না পেয়ে কলমি শাকগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তির্যকভাবে পড়া ভোরের নরম রোদে তার দীর্ঘছায়া পড়েছে। নিজের ছায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নীচু করল সে। দেখতে পেল দুটো জোঁক পায়ে কামড় দিয়ে পেট ভরে রক্ত চুষে খাচ্ছে। সে জোঁক দুটোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে আবার তাকিয়ে রইল।
“মাঠে একা বসে কী করছ?”
য়াইমা চমকে উঠল। ফিরে তাকাতেই অহনবীকে দেখতে পেল। পাড়ার এক যুবকও তার সঙ্গে এসেছে।
“মহিষটা কি ঘরে ফিরেছে?”, রাইমা জিজ্ঞেস করল।
“অনেক আগেই ফিরেছে। তুমি ঘরে ফিরে না আসায় দুশ্চিন্তায় খুঁজতে এসেছি। কী হল, গায়ে এত কাদা মাখা কেন? ওমা! পায়ে জোঁক। জোঁকের কামড়ও কি টের পাচ্ছ না? একটু খুলে দাও, বাবা। তোর দাদার কী যেন হয়েছে।”
ছেলেটা য়াইমার পা থেকে জোঁক দুটোকে খুলে ফেলে দিল। সেও জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে দাদাবাবু?”
কলমি শাকগুলোর দিকে য়াইমা আবার ভালো করে তাকাল আর বলল, “বাড়িতে গিয়ে বলব৷ তোমরা দুজনে আমাকে ধরো আমার পা দুটো কেমন যেন ভারী লাগছে।”
“অপদেবতার কুনজর পড়েছে”, সব ঘটনা শোনার পর পাড়ার বরিষ্ঠ মাইবা (ওঝা) কথাটা বলল। উপস্থিত সবাই মাইবার কথায় বিশ্বাস করল। কিন্তু জমির মালিক তা মানতে রাজি না।
“আজকাল কি ভূত পেত্নী আছে বলে বিশ্বাস হয় না কি? য়াইমা! তুমিও কি এসব বিশ্বাস করো?”, জমির মালিক বলল।
ভূত পেত্নীতে য়াইমার তেমন বিশ্বাস নেই। কিন্তু সে নিজ চোখে যা দেখেছে তাও উড়িয়ে দিতে পারছে না। সে বলল, “কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। মানুষের অবয়বের মতো সাদা কুয়াশার একটা মূর্তি কলমি শাকের জঙ্গলের মধ্যে থেকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আমার দিকে আসতে দেখেছি।”
“ভূত-পেত্নী অবশ্যই আছে। এদের এক কথায় উড়িয়ে দেবে না বাপু।”—বরিষ্ঠ মাইবা জমির মালিককে বলল।
–‘পাৎথবী লৌকোল’ নামে পরিচিত জায়গাটা একসময় অপদেবতাদের আখড়া বলে সবাই জানত। আমরা যখন ছোটোবেলায় গরু চড়াতাম তখন ভয়ে সেখানে কখনও পা বাড়াতাম না। কোনো গরু ভুলে সেখানে ঘাস খেতে গেলেই পেট ফুলে দমবন্ধ হয়ে মারা যেত। খুব খারাপ জায়গা—অপদেবতার আখড়াই বটে। ইদানীং কালেই না কেবল তোরা সেখানে চাষবাস শুরু করেছিস। জায়গাটা যে জঙ্গল হয়ে পড়েছিল তা তোরাও নিশ্চয় দেখেছিস।
—তা জ্যেঠো, য়াইমার উপর অপদেবতার কুনজর আগেই পড়ার কথা। সে তো অনেকদিন ধরেই সেখানে চাষ করছে। কাল পরশু থেকে শুরু করেছে তা তো নয়।
—এটাকেই বলে মানুষের দশা। আগে কুনজর না পড়ুক আজ তো পড়ল।
অহনবী নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারল না, “এখন কি ভালো মন্দ কিছু—”
—ভালো মন্দ মানে প্রাণে যে বেঁচেছে সেটাই ভালো। মরতেও তো পারত, ঠিক কি না। যেভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, চিৎ হয়ে না পড়ে উপুড় হয়ে পড়লেই তো সর্বনাশ হয়ে যেত। বলতে হবে তার ভাগ্যের সহায় আছে। ভয়ের কিছু নেই।
—তা জ্যেঠো, উনি যে বলেছেন পা দুটো কেমন যেন ভারী লাগছে?
—অপদেবতার কুনজরে পড়লে কিছু ক্ষতি না করে এমনিই ছেড়ে দেবে ভেবেছিস। চিন্তা করবি না, আমি তো আছিই। তার পঞ্চপ্রাণ ডেকে নিই, এরপর তো ‘উশিল’ দিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমি তোদের সতর্ক করে দিচ্ছি—ঘুণাক্ষরেও তাকে ডাক্তার বদ্যি দেখাবি না। অপদেবতার সঙ্গে ডাক্তারের কিন্তু বনিবনা নেই। আমাকে দিয়ে চিকিৎসা না করালেও অন্য কোনো মণিপুরি মাইবাকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করাবি, বুঝেছিস তো।
মণিপুরি মাইবার প্রতি আস্থা, তার উপর বরিষ্ঠ মাইবার ঝাড়ফুঁকে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। ভালো হয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করলেও দিনকে দিন য়াইমার পা দুটো আরও ভারী হতে থাকে। এভাবে আর কতদিন বসে থাকা যায়। খেতে শুতে প্রতি মুহূর্তে। জমিটা ডাকছে য়াইমাকে। সে চট করে উঠে চলে যেতে চায় জমিতে চাষের কাজে। চাষি জমি চাষ না করলে কি করে বাঁচবে।
জমির মালিক প্রায়ই য়াইমার কাছে আসে, এসে জিজ্ঞেস করে, “কী করা যায়, বল তো য়াইমা?”
—এতদিন অপেক্ষা যখন করেছেন আরও দিন কতক অপেক্ষা করুন।
—আমার অপেক্ষা করতে কোনো অসুবিধে নেই। তবে আষাঢ় যে এসে গেল, তা-ই।
“হয়ে যাবে, সময় মতো সব সেরে নেব। আগেও বলেছি- জমিতে এক পল্লা হাল চাষ হয়ে গেছে। আপনার ছোটো ভাই বেশিদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার লোক নয়৷ পা-টা ঠিক হলেই, এখন অনেকটা ভালো। দিন কয়েকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠব। এই দেখুন”–য়াইমা চট করে উঠে দাঁড়াল। বানরে পা ফেলে হাঁটার মতো করে কয়েক পা এগিয়ে পড়ে গেল। তবে কাউকে তাকে টেনে তোলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই উঠে বসল। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, “মাইবা জ্যেঠো ঝড়ফুঁকটা ভালোই জানেন। তার ঝাড়ফুঁকেই কত তাড়িতাড়ি আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। আগে মাথা ঘুরত, কোমরও প্রচণ্ড ব্যথা করত। ভেবেছিলাম বুঝি আর বাঁচব না। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে, কেবল পা-টাই বাকি আছে। জ্যেঠো বলেছেন এটাও নাকি খুব শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে। দাদাবাবু জমিটা আমার কিন্তু খুব পছন্দের। হোক না অপদেবতার আখড়া, শতবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেও আমি কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নই। আমি ওসব নিয়ে ভাবিই না।”
জমির মালিক য়াইমার সামনে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না, চলে গেল।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের কারণে অনেকের সঙ্গে য়াইমার জমিও জলের তলে চলে গেছে। জমিগুলো এখন বিলে পরিণত হয়েছে। এক সময় এটি যে ধানি জমি ছিল তার আর কোনো চিহ্নই নেই। জমি হারিয়েও সে কোনো ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রকাশ করেনি, নীরবে মেনে নিয়েছে। নিজের জমি হারিয়ে ভাগ চাষের জন্য একফালি জমির খোঁজে হন্যি হয়ে ঘুরেছে। তার মতো অনেক সরলপ্রাণ চাষিরই জমি জলের তলে চলে গিয়ে তারা সবাই ভূমিহীন ভাগচাষিতে পরিণত হয়েছে। তাই ভাগ চাষের জন্য চট করে জমি খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। শেষপর্যন্ত চাষিদের অপছন্দ জলা জমিটাই পেয়েছিল সে। তাতেই য়াইমা খুশি। এতদিন সে জলা জমিতেই চাষ করে এসেছে। তাই জমিটা তৈরি করে নিতে তার তেমন বেগ পেতে হয়নি। তার হাতের যত্ন পেয়ে জলা জমিটা ধীরে ধীরে সোনার জমিতে পরিণত হয়ে ওঠে। তাই বলে কি সোনার কারিগর কখনও সোনার মালিক হয়! নিজের জমির মতো যত্ন নেয় বলে কি সে জমিটার মালিক বনে যাবে? কতদিন তার অপেক্ষায় বসে থাকবে জমির মালিক? শ্রাবণ মাসের কালো মেঘও আর কতদিন তার অপেক্ষায় থাকবে!
অপেক্ষা করেনি। য়াইমার চোখের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছে শ্রবণের বারিধারা, ভাদ্র মাসের মাঠভরা সবুজ কচি ধানের চারাগুলো স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে ভয় দেখায়। য়াইমা জমির মালিকের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে। সে যার প্রতীক্ষা করছে সেটি কি শ্রাবণের রোদ্দুর না কি পৌষের ফসল কাটা মাঠের জন্য।
কাছের ও দূরের মাইবারা তাকে সুস্থ করে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার পরই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডাক্তারি চিকিৎসা করিয়েছিল সে। সে জীবনে কোনোদিন দেখেনি এমন যন্ত্রপাতি, দামি ওষুধপত্র, ব্যস্ত ডাক্তারদের আনাগোনা। এসব দেখে সে সুস্থ হয়ে উঠবে বলে তার মনে যে আশা জেগেছিল তা ভুল বুঝতে পেরে য়াইমার মনের খুশির ভাব নিজের অজান্তেই উবে গেল। লোকবলহীন য়াইমা কতদিন আর বাড়ি ঘর ছেড়ে থাকবে। খেটে খাওয়া তার মতো ভাগচাষি আর কতদিন হাসপাতালে পড়ে থাকবে। বেশিদিন এভাবে পড়ে থাকতে পারেনি সে। ডাক্তারের ওষুধপত্র, ব্যবস্থা পত্র, নানা উপদেশ পরামর্শ নিয়ে ফিরে এসেছে বাড়িতে।
—দাদাবাবুর কাছ থেকে কত টাকা ধার নিয়েছি?
—পাঁচ হাজার।
— পাঁচ হাজার! য়াইমা চমকে ওঠে।
মহিষটা বিক্রি করে দিতে হল। গর্ভকাল পূর্ণ হয়ে এসেছিল। চোখ বুজে বাচ্চাটা জন্মের অপেক্ষায় ছিল। চিকিৎসার জন্য নেওয়া ধারের টাকা সুদ সহ মিটিয়ে দিতে গিয়ে মহিষ বিক্রির সব টাকাই হাতছাড়া হয়ে গেল। মানুষের ঋণ যে শোধ করতে পেরেছে তাতেই য়াইমা খুশি। মহিষটার জন্য এক বোঝা ঘাস কেটে আনাই তাদের পক্ষে দায় হয়ে পড়েছিল। তাই মহিষটা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে বলতে হবে। এ বাড়ির প্রতিটি প্রাণী এখান থেকে দূরে চলে গেলেই মঙ্গল। বাড়ির পুরুষ মানুষটি পড়ে যাওয়ায় কত দুর্ভোগই না ভুগতে হচ্ছে। সবকিছুই য়াইমার চোখের সামনে ঘটছে।
অহনবী জমিতে ধানের চারা রোপণের কাজে গেছে। ছোট্ট বাচ্চাটিকে স্বামীর কাছে রেখে গেছে। বাচ্চাটি একটু একটু করে য়াইমার কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল বারান্দা থেকে উঠোনে। উঠোনের কাছেই রয়েছে গভীর জলের পুকুর। ধীরে ধীরে পুকুরটির কাছে চলে গিয়েছিল বাচ্চাটা। য়াইমা শঙ্কিত হয়ে বাচ্চাটিকে কাছে ডাকে। সে নির্বিকার ভাবে হাঁটি হাঁটি পায়ে ক্রমেই এগিয়ে যেতে থাকে পুকুরের দিকে। শোয়া ও বসা ছাড়া একা একা কিছু করতে অক্ষম য়াইমা নিরুপায় হয়ে বুকে ভর দিয়ে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যেতে যেতে ডাক দেয় তাকে, অন্যরা যাতে শুনতে পায় তার জন্য গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে। গলা ফাটিয়ে ডাকাডাকির মধ্যেই বাচ্চাটা তার চোখের সামনেই জলে ডুবে গেল। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে য়াইমা। পাগলের মতো চেঁচাতে থাকে।
—কী হয়েছে, হয়েছে কী! চোখটা একবার মেলে তাকাও। য়াইমা চোখ মেলে তাকাল। অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে বাচ্চাটি। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। নীচু স্বরে বলল, “এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো।”
অহনবী য়াইমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল, “বাঁচার জন্য আমি এত কষ্ট করে লড়ে যাচ্ছি তা বুঝি তোমার চোখে পড়ে না। মরতে হলে তুমি একা মরবে কেন—মা ও ছেলেও তোমার সঙ্গী হব। য়াইমা চুপ বনে গেল।
৩.
—দাদা, বউদি কি ঘরে ফিরেছে?
—না, এখনো ফেরেনি। কুমার! তোর বউদি কি টাকাটা এখনও দেয়নি?
—টাকার জন্য না, এমনিতেই।
—কত হয়েছে?
—তেমন বেশি না।
—কত হল?
—পয়তাল্লিশ টাকা মাত্র।
—পয়তাল্লিশ! য়াইমা আপন মনে বিড় বিড় করল।
তারপর কুমারকে বলল, “এখনই ফিরে আসবে। দেখা করে যেতে চাইলে মোড়াটায় বসে অপেক্ষা কর।
—বসব না, পরে আসব।
কুমার চলে গেল।
“কুমার।” য়াইমা ডাক দিল, য়াইমা ডেকে বলল, “ফুমদি কাটার দা কেনার কেউ থাকলে পাঠিয়ে দিও। ঘরের মাচাঙে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা আমার দাটি বিক্রি করে দেব।”
কয়েক মুহূর্ত দাড়িয়ে কুমার জবাব দিয়ে গেল, “ঠিক আছে।”
য়াইমা আবার আপন মনে বিড় বিড় করে বলল–পয়তাল্লিশ। অন্ধকার রাত ও কলমি শাকগুলোর কথা তার মনে পড়ল। য়াইমা মহিষ চড়ে নির্বিকার ভাবে এগিয়ে চলেছে। এক মহিলা তার দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার কাছে এসে পৌঁছতে পারছে না। মহিলাটি অহনবী। সে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে আসছে। বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে সে। পেছন থেকে এক লোলুপ হাত তার খোঁপা খসে পড়া চুলের রাশি স্পর্শ করতে চাইছে। রাইমা রাগে ঠোঁট কামড়ে লোলুপ হাতের দিকে ছুটে যায়। সেও তাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না। উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে চলা অহনবী হঠাৎই হাসতে হাসতে যেন ছুটে চলেছে। সে যেন লোলুপ হাতটাকে ভেংচি কেটে কেটে ছুটছে। তা দেখে য়াইমা চমকে উঠল।
মাথায় এক রাশ লম্বা চুলের দুই মহিলার সঙ্গে য়াইমার পরিচয় আছে। দুই মহিলার একজন তার স্ত্রী অহনবী আর অপরজন থাবাতোন। একবার য়াইমা থাবাতোনের ধান মাড়াইয়ের কাজে সামিল হয়েছিল। কিন্তু সেই কাজের মজুরি পায়নি সে। অন্য সবাইকে দিয়ে দিলেও থাবাতোন তার মজুরি আটকে রেখেছিল। আজ দেব, কাল দেব বলে তাকে। কেবল ঘোরাচ্ছিল। কিন্তু ধান মাড়াইয়ের কাজের অপর সঙ্গীরা য়াহমাকে ভাগ্যবান বলে ঈর্ষা করছিল। সবাই তাকে ঈর্ষা করায় য়াইমা মনে মনে গর্ব করত। সঙ্গীদের হাসি মস্করায় সেও অংশ নিত। এসব অনেকদিন আগেকার কথা। য়াইমার বিয়ের আগের যৌবনকালের কথা।
থাবাতোন সবার কাছে দুভাবে পরিচিত। প্রথম পরিচয় সে পাশের গ্রামের মেয়ে। কার সঙ্গে যেন বিয়ে হয়েছিল। সন্তান হয়নি বলেই স্বামীর ঘর থেকে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর আবার এ গ্রামের বউ হয়ে এসেছে সে। দ্বিতীয় স্বামীর বয়স হয়েছে। সে ঘরের কাজকর্ম করার চেয়ে মদের প্রতি বেশি আসক্ত। শুধু আসক্তি নয়, কম বেশি মদও বিক্রি করে সে। একদিন রাতে একদল উগ্রপন্থী যুবক তাকে মদ খাওয়া ও বিক্রির অপরাধে প্রচণ্ড ভাবে মারধোর করেছিল। এ ঘটনার পর থেকেই সে হঠাৎই শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে ঘরের ও চাষের সব কাজকর্মই থাবাতোন দেখভাল করত। অকর্মা পুরুষের স্ত্রী হলে যে দুর্ভোগ ভুগতে হয় তা-ই ভুগতে হয়েছিল থাবাতোনকেও। তার সন্তান হয়নি। সত্যি, কপাল মন্দই তার।
দ্বিতীয় পরিচয় হল—থাবাতোন সুন্দরী। য়াইমা ও তার সঙ্গীসাথীরা বউদি সম্বোধন করলেও বয়স তার কমই৷ তার শরীরের গঠন দেখার মতো। চোখের চাহনিও মদিরা ভরা। খোলা মেলা পোশাক। পরিবেশ বুঝে পোশাক আরও বেশি খোলমেলা করে। য়াইমা ও তার সাথীদের কাছে থাবাতোনের দ্বিতীয় স্বরূপটিই বেশি করে পরিচিত।
কাল-পরশু দেব বলে আটকিয়ে রাখা মজুরিটা দিয়ে দেবার জন্য য়াইমা থাবাতোনকে তাগাদা দিয়েছিল।
“তোমার কি টাকার খুব দরকার?”, থাবাতোন হেসে জিজ্ঞেস করে।
—কি যে বলেন বউদি। জোয়ান ছেলে টাকা দরকার হবে না!
—ইস! বলে কি না জোয়ান ছেলে। প্রেম করতে শিখেছ? আমার চুলের খোঁপাটা খুলতে পারবে?
য়াইমা ঘাবড়ে যায়।
“মুরোদ নেই।”, থাবাতোন হাসতে থাকে। ইঙ্গিতবহ চাহনিতে তাকিয়ে বলে, “পারবে বললে কিন্তু তোমার প্রাপ্য মজুরির সমান টাকা আমাকে দিতে হবে। রাজি তো?”
য়াইমা থাবাতোনকে টাকা দেয়নি। পাপ পূণ্যের জন্য নয়, আসলে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল। অহনবীর প্রতি টানটা তার বেশিই ছিল। তবু বেশ কিছুদিন য়াইমার ভাবনার আকাশে থাবাতোনের মুখ উঁকিঝুঁকি দিত। অহনবীর কথা ভেবে তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। তবুও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না থাবাতোনকে। আবার মাঝে মাঝে থাবাতোন ও অহনবী তার ভাবনায় একাকার হয়ে যাচ্ছিল। দুজনের মিলও রয়েছে। মিল থাকলেও দুজনকে এক করতে য়াইমা রাজি নয়। একদিন রাতে মনের গোপন কথা চেপে রাখতে না পেরে অহনবীকে থাবাতোনের সব কথা বলে ফেলে। আর সে রাতেই তাকে ভাগিয়ে এনে ঘরে তুলেছিল। স্ত্রী হিসেবে অহনবীকে কাছে পাওয়ার পরও থাবাতোনকে পুরোপুরি ভুলতে পারেনি য়াইমা। তার মনে বড়ো যন্ত্রণা হত। মন কী যেন চাইত! নিজের প্রতি নিজেই সন্দিহান হয়ে উঠেছিল সে।
—থাবাতোন বউদির কাছে আমার পাওনা মজুরিটা তুমি আদায় করে নিয়ে এসো না।
—কী যে বলো! থাক, দরকার নেই।
—না হবে না। অন্য কেউ হলে আপত্তি ছিল না, তার ক্ষেত্রে হবে না। আমাকে যে সব কথা বলেছিল মনে হয় যেন এখনও কানে কানে বলে যাচ্ছে। মজুরির টাকাটা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। তা না হলে সে যে আমাকে ভীরু ও কাপুরুষ ভাবত তা-ই সত্য বলে মেনে নেবে। আমি তার খোঁপার চুল খুলতে যাব বলে হয়তো
সে এখনও আশা করছে। টাকাটা যে করেই হোক আদায় করতে হবে। আদায় করতেই হবে টাকাটা।
অহনবীও পারেনি টাকাটা আদায় করতে। পারেনি বলাটা ঠিক নয়, আদায় করার সুযোগই পায়নি সে। একদিন জলার পরিত্যক্ত নির্জন কুটিরে এক যুবকের সঙ্গে অসংলগ্ন অবস্থায় থাবাতোন ধরা পড়েছিল। গ্রাম্য বিচারে তাকে যুবকটির সঙ্গে ঘর বাঁধতে বাধ্য করা হয়েছিল। যুবকটি থাবাতোনেরই গ্রামের ছেলে। প্রায়ই সে পুবের বিলে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করতে আসত। ঘাস কাটতে গিয়ে য়াইমার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। থাবাতোনকে তার অপরাধের জন্য গ্রামছাড়া করা হলে দুর্বল স্বামীটার কথা ভেবে য়াইমা মনে দুঃখ পেল। অক্ষম স্বামীটার পক্ষে পাপের ভাগী হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। তাই মেনে নিতে পারেনি সে। তার চেয়ে বরং থাবাতোনকে ঘরছাড়া করে দেওয়াটাকে ভালো বলে মনে হয়েছে তার।
অহনবী য়াইমাকে ঠাট্টা করে বলে, “তোমার মজুরির টাকাটার কী হবে?”
য়াইমা জবাব দেয়, “সুযোগ পেলেই তাগাদা দেবে। আদায় করতে হবে।”
অনেকদিন পর আজ থাবাতোনের কথা য়াইমার মনে পড়ল। চোখ বুজে হাত দুটো বুকে রেখে সে আপন মনে বলল—আমি কোনো অপরাধ করিনি। কারও কাছে আমি অপরাধী নই।
অহনবী রাতের খাবার তৈরি করছে। য়াইমা মেঝেতে মাদুরের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে।
“থাবাতোন বউদির সঙ্গে তোমার কি একেবারেই দেখা হয় না?”—য়াইমা জিজ্ঞেস করে।
য়াইমা যে কার কথা বলছে অহনবী প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। পরে বুঝতে পেরে হেসে উঠল, “এখনো মনে রেখেছ দেখছি?”
কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকার পর আবার মুখ খুলল, “কুমার কি এখনও কুঁচে মাছ ধারার অপেক্ষায় রয়েছে?”
—নগদ টাকা দিয়ে দিয়েছি।
—কবে?
—আজ, বাজার থেকে ফেরার পথে।
য়াইমা অবাক হল, “তোমার সেই মাছগুলো কত টাকায় বিক্রি করেছিলে? চাল কেনার টাকাই বা কোথায় পেলে?”
অহনবী হেসে উঠল, “কী-যে বলো! কুমার যা চাইবে তা-ই কি দিয়ে দেব! মাত্র ত্রিশ টাকা দিয়েছি। তাও বেশিই দিয়েছি।” য়াইমা আরও অবাক হল, জিজ্ঞেস করল, “সে কি তাতেই রাজি হয়েছে?”
—কেন রাজি হবে না।
য়াইমা অহনবীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অহনবী রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। য়াইমা যে তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তা সে বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারলে হয়তো এভাবে তাকানোর কারণ জিজ্ঞেস করত।
য়াইমা ইঠাৎই বলে উঠল, “অহনবী! তোমার চুলটা কি এবার কেটে ফেলবে?”
অহনবী য়াইমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল। বড়ো কঠোর চাহনি। য়াইমা অহনবীর চোখে চোখ রাখতে পারল না। সে তাকে যে কথা বলেছে তা অন্যায় হয়েছে। নতুবা যে কথা বলা উচিত নয় সে কথাই বলে ফেলেছে বলে মনে হল।
“আমার মা বিধবা ছিলেন।” অহনবী আস্তে করে বলল, “মায়ের তিন সন্তান আমরা সবাই মেয়ে। আমি সবার বড়ো। বাবার চেহারাটা কেমন ছিল আমি এখন মনে করতে পারি না। মা তিন মেয়েকে কীভাবে লালন পালন করে বড়ো করেছেন তা আমার এখনও মনে আছে। মা অনেক কষ্ট সয়েছেন কিন্তু কোনোদিন আমাদেরকে মুখ ফুট তার কষ্টের কথা বলেননি। আমার কিন্তু একটি মাত্র সন্তান। তাও ছেলে সন্তান। তার উপর মায়ের মতো বিধবা নই।” এ কথা বলে অহনবী কিছুক্ষণ চুপ রইল। তার গলার স্বর কাঁপা। আবার সে আস্তে ধীরে প্রসঙ্গে ফিরে আসে— “পাড়ার লোকেরা মাকে প্রায়ই মিথ্যেবাদী বলে বকা দিত। মাঝেমধ্যে মা মিছে কথা বলত তা ঠিক। কেন এমন করত তখন আমরা বুঝতে পারিনি। এখন মা নেই। তবে কেউ যদি মার চরিত্র নিয়ে অপবাদ করে তাহলে আমি সহ্য করতে পারি না। অহনবী নিজেকে সংযত রাখতে পারল না, চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
য়াইমা আস্তে করে চোখ বন্ধ করল। আর একটি কথাও বলল না। অহনবীর মা কেমন ছিল তা সে ভালোই জানে।
১. থাংজিং—কাঁটাযুক্ত জলজ ফল বিশেষ। কাঁটাযুক্ত খোসার ভেতরের বিচিগুলো মণিপুরিদের প্রিয় খাদ্য।
২. চেঙহী—আতপ চালে ধোয়া জল।
৩. উশিল—মাইবা অর্থাৎ মণিপুরি ওঝারা কোনো রোগীর রোগ-সুখ ও অপদেবতার কুনজর ইত্যাদি উদ্ভিদ বা অন্য কোন ক্ষুদ্র প্রাণীতে মন্ত্র বলে চালান করে দিয়ে রোগীকে রোগমুক্ত করে তোলে বলে বিশ্বাস। এই প্রক্রিয়াকে বলে উশিল।
৪. ফুমদি—ভাসমান জলজ উদ্ভিদের মূল প্রসারিত হয়ে বেশ পুরু একটি ভাসমান আবরণী তৈরি হয়। একে বলা হয় ফুমদি।
[২০০৩ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সুধীর নাউরোইবম-এর মনিপুরি গল্পগ্রন্থ “লৈই খরা পুপ্সি খরা”-র (কিছু রেখা কিছু জীবন) অন্তর্ভুক্ত ‘তিনথ্রোক’ (‘কেঁচো’) গল্পের বাংলা অনুবাদ।]