খাইরুল ও খোদা – আলিউজ্জামান

শেয়ার করুন

এই গাঁয়ের নাম দুর্গাপুর। দশ পা পিছনে ফেললে মরিয়মদের বাড়ি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঢালাই রাস্তার প্রকল্প যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই এই ঘাটের শুরু, বাম দিকে চক্রবর্তীদের বাড়ি আর ডানে নবকৃষ্ণ হালদারের গান….

পালাইয়া পালাইয়া মরি
ও মন বিরাগ জানো না
চাঁদের গায়ে সিঁধকেটে
তোর কলঙ্ক ঘুচল না।

গানের রেশ বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই যখন গুম হয়ে যায় এ দিলকি গুজারিশ, তখন খাইরুল সেখ রংচটা গামছা কাঁধে শক্ত অশথ গাছের ফাঁকে ফাঁকে এমনভাবে নড়ে ওঠে, যেন মনে হয় দাঁতন করার ওই সুন্নত ফেলে, সে এখনই খুঁজে নেবে কাশী, মথুরা—গুপ্ত হেরাগুহার ভেতর। নবুয়াত একদিন সফর হবে বলে হয়তো ওই গাঁয়ের ওই সাত ছিনালের এক ছিনাল হয়ে পেরিয়ে যাবে হাওড়াগামী ট্রেন, হয়তো পাখির মুখে সুতানুটি ভাসিয়ে শোভাবাজারে খুঁজে নেবে একা একটা টালির ঘর কিংবা নিজস্ব জানলার বাঁকানো শিক বেয়ে ঝুলে থাকা শুকনো শাড়ির তলে লুকিয়ে রাখবে গোপনীয় বৈঠক। তারপর অস্ত্রের গিঁট খুলে সে খুঁজে নেবে সফেদ জঙ্গলমহল।

অথচ খাইরুল চেনেনি কিছুই। ধর্ম, মানুষকে খুচরো করার সার্থক রাজনীতি, বিড়ির ইউনিয়নের লিডার, দালালচক্রে ফেঁসে যাওয়া যুবতীর মাই সহ শুকনো জ্বালাতনে ফুঁপিয়ে ওঠা দুধের সর, তার ফুসফুসের ওই আজন্ম বয়ে চলা বাতাসের বিনিময়ে, সে কিছুই ফোলাতে পারেনি। তবু যে কৃষ্ণ বারে বারে তাকে গান শোনায়, মুখ দিয়ে বুকের ফেনা তুলতে শেখায়, তাকে সে কী করে বোঝাবে, ঢেউ তুলে নদী হারায় বালির সরেজমিনে। জীবনের এই সকল লেনাদেনা শেষে একটা আস্ত নৌকার তাগদে, খোঁড়া গর্তের সমান্তরাল আরেকটা ডোবা বোজাতে পেরিয়ে যায় তার হাফজনম। মনে হয়, কথা যত বলবার থাকে, তার বেশিরভাগ শ্রাবণের অস্ফুট গোঙানির মতো বর্ষার জলের সঙ্গে রাস্তা ভাসিয়ে চলে যায় ওই নদীটির দিকে। জন্মসূত্রে পাওয়া এই একখানি নদী ছাড়া তার কিছুই নেই জীবনে। তবু এই সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে, কোরবানির শেষ জান কবুল করে নিজের কাছে উবু হয়ে বসে থাকে আর বুকের ভেতর চুঁইয়ে পড়া রক্তের মতো থেকে থেকে বলে ওঠে—

মরিয়মের মা তুমিও কি ভেতরে আগুন পুষে
শুকতারা হয়ে আছো চাঁদের অন্ধকারে?

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

এসব ভাবতে ভাবতে লোকালয়ের ট্রেন ছুটে যায় দক্ষিণ কোণে। তবু জীবনের এরকম অসামান্য বোঝা ভেন্ডার কামরায় ভুলে, সে কখনও যায়নি মফঃস্বলের কোনো রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। যেখানে হরিতকী ও ভেরেন্ডার সংমিশ্রণে প্রস্তুত ব্যথার ওষুধ আর পাঁচরকম মলম সহ ক্লান্ত বিক্রেতার মতো স্থির গতিতে সুখী ট্রাকগুলো থামায় জিটি রোড। যেখানে জলের অভাবে ধ্বক ধ্বক করা রেডিয়েটর থামিয়ে রাখে সাদা মারুতি, সেখানে জীবনের এপাশ ওপাশ ভুলে খাইরুল নিশ্চিন্তে হতে পারত একটা তরুণ জীবনের একমাত্র সাক্ষী।

সেই তরুণ, যার কথা মনে পড়লে প্রথমে মাথায় আসে, একটি নিখোঁজ ছেলের হদিশ জানতে চাওয়া রঙিন বিজ্ঞাপন। হারানোর সময় যার গায়ে হলুদ জামার সঙ্গে পরনে ছিল হলুদরঙা হাফপ্যান্ট, আর মনে পড়ে… তার দেহে ছিল অস্বাভাবিক নীল রং। সে যেন অমনই নিখোঁজ হওয়া তরুণ। যার মনের ভেতর হাজারো কোলাহলে সকালে প্রথম কাচের গ্লাস টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। তখন সে মনে মনে চলে যায় চতুর্থ বান্ধবীটির দিকে, বান্ধবীটির বুক খুলে দেখে সেখানে শিবের মতো শুয়ে আছে সে তার একপায়ের নীচে আর তার আশেপাশে শীতের পাতার মতো ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছরের মমি।

এখন নিজেরই নিজেকে চিনতে তার ভয় হয়। ভয়ে মাঝে মাঝে বাতাবিবন কেঁপে ওঠে, কেঁপে ওঠে তার জিওল মাছের কাঁটা আটকে যাওয়া গলার স্বর। এমন অবস্থায় অমন রুক্ষ নদী পারাপারে আশ্চর্য জলপতনের শব্দগুলি একেকটা গার্লস হোস্টেল হয়ে দেখা দেয় চোখের সামনে। যেন এরকম হোস্টেলের মেয়েদের মতো তার বান্ধবীটি ছিল ওয়ার্ডেনের হুকুম পালন করা একনিষ্ঠ তরুণী যার জেরে তার পিঠে ভেঙে যায় মোজেসের আজ্ঞাবহ লাঠির প্রত্যেকটা আঘাত। এইভাবে সমস্ত আঘাত সয়েছে যেন নীলনদ নিজেকে সঁপেছে তার দেহের কাছে। যেন এখনই সেই নদে অনুপ্রবেশকারী ঢেউ, সমান্তরাল ভৌগলিক দূরত্ব টেনে ভুলিয়ে দেবে ক্লাসরুম থেকে সদ্য মুখস্থ হওয়া ষোড়শ মহাজনপদ। অথচ, কিছুই ভোলেনি সে। কাঁটাকম্পাস গেঁথে থাকা ইরেজারে সমস্ত ভুল মুছে, পুনরায় সে মনে রাখে সকালের প্রার্থনাসংগীতের স্বর—

‘যে অসীম প্রেমময় তাকে
অনন্তের কাছে বাকি রেখো না,
উতলা করে করুক, পাগল করে করুক
তার লেনাদেনা ভুলো না’

শুধু এইটুকু সারমর্ম নিয়ে সে ছুটে যায় উচ্চতর ভৌতবিজ্ঞানের দিকে। তারপর বইয়ের সমস্ত পাতা ওলটাতে গিয়ে তার সম্পূর্ণ আকাশকে শূন্য মনে হয়। অথচ সমপরিমাণ ঝালমুড়ির একটাকা থেকে পাঁচটাকার যুগে, তখন একলা ঘরের দেশে তার নিষ্ফল দরজার একটি পাল্লা তাকে ক্রমশ গ্রাস করে, বায়বীয় আকাশ অস্থায়ী সূর্যোদয় ঘটায় আদিগন্ত ঘরের কোণে। তখন সত্যিই মনে হয়—

তোমার দেহের কাছে এই দেহে
ছত্রাক বাসা বাঁধে যেটুকু বর্ষার জলে
তার সামান্য অক্সিজেন শুষে
কচুরিপানা নিজেকে বিস্তার করে
ফুলের দৃষ্টির বিনিময়ে।

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

যে ফুল এতদিন তাকে অবশ করেছিল, সেই ফুল শোক হয়ে ঝরে যায় ফণীমনসার ঝোপে। সেখানে ফুলের ওই দৃষ্টির বিনিময়ে অর্ধেক পিঠখোলা আর সচেতন ঊরু দেখতে দেখতে, সন্দেহজনক ভাবে যখন ফুরিয়ে যায় মাধ্যমিকের দুপুর তখন চোখের ভেতর গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা বরফ গলে নিমেষে বয়ে যায় অনির্দিষ্ট জল। এতদিন যে মানুষ বাগানের ভেতর ফুলে আর পাপে বিকল করে রেখেছে তাকে, সেই মানুষের প্রত্যেক শাখাপ্রশাখার ছায়ায় গা-কেমন করা শীতে, শরীর ও মনের উভচর ডাকে তার ঘটে যায় অকেজো বীর্যপাত।

এখন পশ্চিম দিকে হেলেপড়া নাক বরাবর অস্থির বাতাস, খানিক থেমে থেমে, পৃথিবীর সমস্ত নোঙর চলে যায় ঢেউয়ের সমান্তরালে। ফুরিয়ে যাওয়ার থেকেও ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় চন্দনকাঠ পুড়তে থাকে লাশের চিতায়—আর সংঘবদ্ধ ধোঁয়ার কুণ্ডলী মাথার উপর রেখে যখন আমি পেরচ্ছি শীতের এক একটা বিল তখন মাথার ভেতর ফুরফুরে হাওয়া বয়ে আনে পচা যকৃতের খবর। যারা মানুষ কামড়াকামড়ির সাইকেল ব্রেক করে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি করেছিল এই লোকালয়ে, তারা এই কাম্য পৃথিবীর গতিজাড্যের নিরিখে বাসের সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। আমি তাদের আর পাই না দেখতে। যেমন পারি না, রুনুর টিউশন টিচারের সামনে মাগিস্বরূপ কোনো মহিলার নমুনা পেশ করতে। অথচ কিছুই থামেনি এই জাহানে, আমাদের সমূহ লাঠালাঠি, একা একা সন্তান ছুঁড়ে গঙ্গাসাগরের মেলা, প্রতিস্থাপিত জ্ঞান এবং নির্জ্ঞানের অন্তর্বর্তী সেতু ভেঙে মাথার ভেতর একশো পাখির গমন, কিছুতেই থামেনি সেলাইকলের ওই একটি চাকার ঘূর্ণন। তবুও জলের রঙিন বোতল ঝাঁকিয়ে কুসুম তুমি বলো, মানুষের ফলিত মেধার ভেতর কতদিন লুকিয়ে থাকবে প্রাণের ওই ক্ষুদ্র সংস্করণ? অথবা বলো, জানের এই জাকাত দিয়ে আর কতদিন আমি চলে যাব ইফতারহীন ওই সন্ধ্যাটির দিকে?

এবারে রোদে ঝিলমিল করে ওঠে পুকুরের পাড়। মায়ের সমস্ত বিকেল দিয়ে সেলাই করা, দারুণ নকশার কাঁথা ঠেলে আমার ঘুম ভাঙে। ঘরের সদর দরজার বাইরে তখন ওড়ার ক্ষমতাহীন পাখিগুলি পরীক্ষকের মতো খুঁটে খুঁটে ধান খায়, সজনে ও নিম গাছের মিলিত ছায়ায় অর্ধেক কালো হয়ে আসে পুকুরের জল। আর বাকি অর্ধেক জলে সামাজিক দূরত্ব ভেঙে ফেলার অপরাধে ব্যাঙের আয়তন চলে যায় সাপের পেটে। এসব কথা আমি যখন মিছামিছি শুনি তখন ভোর হয় হয়। জাহানারার হাত দিয়ে মাজাঘষা করা সমস্ত বাসন শুকিয়ে আসে ভোরবেলার রোদে। আমি তখন নিজের কাছে ঝিম মেরে বসে থাকি আর দেখি, এরকম একা একা শুয়ে থাকা জাহান্নামের রং ও আত্মার প্রতিলিপি গঠনে, যেসব মুখ মুখরিত হয়ে ওঠে মনে, যাদের কৈশোরে এঁটে ওঠা ডানা ছিঁড়ে গেছে গতরাতে, তাদের ওই বিন্দুমাত্র সিথানের কথা মনে রেখে, আমি চলে যাই পুনরায় ওই সেলাইকলের কাছে।

উৎসর্গ- ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
কৃতজ্ঞতা- শাশ্বতী সরকার, অতনু চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

Similar Posts

One Comment

  1. শোনা যায়, সেজানের ছবি দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে রাইনার মারিয়া রিলকে ‘বুক অব ইমেজেস’ সহ একাধিক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। জিনিয়াস ভাস্করপ্রসাদের আঁকা ছবি প্রিয় আলিউজ্জামানের থেকে এই লেখা বের করে আনল। অভিনন্দন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *