|

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৬ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – ষোলো

১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিমোন বোলিবারের মৃত্যুর শতবর্ষ উদযাপনের সময় দাদু-দিদিমা আরেকবার বাররানকিয়ায় গেলেন আমার বোন আইদা রোসার জন্ম উপলক্ষে। বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান আইদা। কাতাকায় ফেরার সময় দাদু-দিদিমা সঙ্গে করে নিয়ে এলেন আমার আরেক বোন মার্গোতকে। তার বয়স তখন সবে এক বছর কয়েক মাস। আর বাররানকিয়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে রইল লুইস এনরিকে ও সেই সদ্যজাত বোন। এই নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল। মনে হল মার্গোত যেন এক অন্য জগত থেকে এসেছে। খুব অসুস্থ ছিল, আর ঘ্যানঘ্যানে ও পুরোপুরি দুর্বোধ্য। লুইস কারমেলো কোররেয়ার মা আবিগাইল তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কেন আমার দাদু-দিদিমা আবার এই দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। তিনি বলেই ফেললেন, ‘এ মেয়েটা তো বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না।’ অবশ্য আমার সম্বন্ধেও এই একই কথা সবাই বলত। আমি খুব কম খেতাম আর চোখ পিটপিট করতাম বলে। তাছাড়া যে সব কথা আমি বলতাম তা তাদের কাছে এতই বাড়িয়ে বলা বলে মনে হত যে তারা বিশ্বাসই করতে পারত না। অথচ এ কথাটা একবার ভেবে দেখত না যে অন্য দৃষ্টিতে দেখলে সেগুলো সবই সত্যি কথা। বহু বছর পরে জানতে পেরেছিলাম যে ডাক্তার বারবোসাই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমার পক্ষ নিয়ে একটা খুব জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছিলেন: ‘শিশুরা মিথ্যে কথা বললে তা তাদের বিরাট প্রতিভার পরিচয় দেয়।’

বেশ কিছু দিন পর তবেই মার্গোত বাড়ির নিয়ম-কানুন মানতে শুরু করল। সে তার ছোট্ট রকিং চেয়ারে বসে আঙুল চুষত, কিন্তু বাড়ির এমন একটা কোনে বসে থাকত যা কেউ ভাবতেই পারত না। ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো কিছুর প্রতি তার আসক্তি ছিল না। তাই ঘণ্টায় ঘণ্টায় সে তার বড় বড় মায়াভরা চোখ চেয়ে অপেক্ষা করত কখন ঘণ্টা বাজবে। অনেক দিন পর্যন্ত তাকে কেউ খাওয়াতে পারেনি। সে খেতে চাইত না, কিন্তু তাই নিয়ে কোনো চেঁচামেচিও করত না। মাঝে মাঝে শুধু খাবারটা ঘরের কোনায় ফেলে দিত। কেউ বুঝতে পারত না কি করে এতদিন কিছু না খেয়ে বেঁচে আছে। তারপর একদিন আবিষ্কার করা হল যে সে শুধুমাত্র বাগানের ভিজে মাটি খেতে ভালোবাসে আর ভালোবাসে চুন খেতে। নখ দিয়ে দেয়ালে আঁচড়ে চুন তুলে খায়। এই ব্যাপারটা জানার পর দিদিমা বাগানের যে জায়গার মাটি সবচেয়ে ভালো খেতে সেখানে গোবর ছড়িয়ে দিলেন আর ফুলের টবে রেখে দিলেন ঝাল লঙ্কা। একদিন ফাদার আঙ্গেরিতা তাকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দিলেন। সেই একই অনুষ্ঠানে আমারও দীক্ষাদান সম্পূর্ণ হল, কেননা আমার জন্মের সময় তাড়াহুড়োয় দীক্ষাদান করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিল। একটা চেয়ারের উপর আমি দাঁড়ালাম। ফাদার আমার জিভে নুন দিলেন ও এক জগ জল আমার মাথায় ঢেলে দিলেন। খুব সাহসের সঙ্গে আমি সবকিছু গ্রহণ করলাম। কিন্তু মার্গোত আহত পশুর মতো প্রবল চিৎকার করে এক নাগাড়ে দুজনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সারা শরীর দিয়ে সে এমন লড়াই শুরু করল যে ধর্ম-মা ও ধর্ম-বাবা কোনোমতে তার মাথায় দীক্ষার জল ঢেলে দিয়ে কাজ সম্পন্ন করলেন।

এখন বুঝতে পারি যে ছোটবেলায় আমার আর বোনের মধ্যে যে যুক্তি-বুদ্ধির সম্পর্ক ছিল তা বড়দের নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্কেও ছিল না। আমাদের মধ্যে এমন সুন্দর বোঝাপড়া ছিল যে একাধিকবার আমরা একে অন্যের চিন্তা ধরে ফেলেছিলাম। একদিন সকালবেলায় আমরা দুজন বাগানে বসে খেলা করছি এমন সময় ট্রেনের বাঁশি শোনা গেল। প্রতিদিন সকাল এগারোটায় এই বাঁশি বাজত। কিন্তু সেই দিন যেই বাঁশির শব্দ শুনতে পেলাম আমার মনের মধ্যে এক অবর্ণনীয় অনুভূতির উদ্ভাস ঘটল, আমি যেন পরিষ্কার দেখতে পেলাম কলা কোম্পানির যে ডাক্তার কয়েক মাস আগে আমাকে একটা মিক্সচার খেতে দিয়েছিল ও যেটা খেয়ে আমার খুব বমি হয়েছিল, সেই ডাক্তার ট্রেনে করে আসছেন। সারা বাড়ি দৌড়ে দৌড়ে সবাইকে সেই খবরটা দিলাম, কিন্তু কেউ-ই আমার কথা বিশ্বাস করল না, শুধু মার্গোত ছাড়া। একমাত্র সে-ই আমার সঙ্গে লুকিয়ে রইল যতক্ষণ না ডাক্তার দুপুরের খাবার খেয়ে ফেরার ট্রেনে বিদায় নিলেন। ‘জয় মা মেরী’, তাঁর বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকা আমাদের দেখতে পেয়ে দিদিমা বললেন, ‘এই সব বাচ্চারা থাকলে আর টেলিগ্রামের দরকার হবে না।’

আমি কখনো একা থাকার ভয়কে জয় করতে পারিনি, বিশেষ করে অন্ধকারে। তার প্রকৃত কারণটা অবশ্য আমার অজানা নয়। রাতের অন্ধকারেই যে দিদিমার কল্পনা আর ভবিষ্যতবাণীগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই সত্তরের কোঠায় পৌঁছেও আমি স্বপ্নে দেখতে পাই বারান্দার জুঁইফুলের সেই উচ্ছলতা ও ছায়াচ্ছন্ন শোবার ঘরের ভূতেদের। আর ঠিক তখনই সেই অনুভূতিটা হয় যা আমার শৈশবকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল – সেই রাত্রির আতঙ্ক। অনেক সময় আমার এই বিশ্বময় অনিদ্রার মধ্যে মনে একটা অস্পষ্ট বোধ জাগ্রত হয় আর ভাবি, যে বাড়িতে আমরা প্রতি রাত্রে মারা যেতাম সেই উপকথার বাড়ির অভিশাপ বোধহয় আমিও বহন করে বেড়াচ্ছি, আজও, এই আনন্দময় পৃথিবীর বুকে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হল আমার দিদিমা বাস্তবজ্ঞানবর্জিত বুদ্ধি দিয়েই গোটা সংসার পরিচালনা করতেন। ওই সামান্য উপকরণ দিয়ে কী করে অমন স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতাম আমরা? হিসাব মেলাতে পারি না। কর্নেল সোনার কাজ শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। তাঁর বাবা শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। কর্নেলের তৈরি সোনার সেই বিখ্যাত ছোট ছোট মাছ সর্বত্র কিনতে পাওয়া গেলেও সেটা আদৌ একটা লাভজনক ব্যবসা ছিল না। এমনকি ছোটবেলায় আমার মনের হত যে তিনি খুব বেশি দিন ব্যবসা করেননি। তিনি মাছ তৈরি করতেন বিয়েতে উপহার দেওয়ার জন্য। দিদিমাও সেকথা বলতেন যে দাদু শুধু উপহার দেওয়ার সময় কাজ করেন। তা সত্ত্বেও উদারপন্থীরা যখন ক্ষমতায় এল তাঁর কর্মদক্ষতার খ্যাতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং বেশ কয়েক বছরের জন্য কোষাধ্যক্ষ ও অনেক বার প্রশাসক হিসাবেও কাজ করেছেন।

আমার লেখক জীবনের জন্য ওই বদ্ধ পাগলের বাড়ির চেয়ে উন্নততর অন্য কোনো পরিবেশ থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করি না। বিশেষত যে অগণন মহিলার দল আমায় বড় করে তুলেছিলেন তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সেই বাড়িতে শুধু দুজন পুরুষ ছিল – দাদু আর আমি। দাদুই ভয়ংকর যুদ্ধের সব গল্প বলে বড়দের করুণ বাস্তবের কথা আমায় প্রথম বুঝিয়েছিলেন, পাখিরা কেমন ভাবে ওড়ে ও বিকেলের ঝড় কেন হয় তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও তিনি সবার আগে আমায় বলেছিলেন এবং আমার আঁকার প্রতি যে ঝোঁক ছিল তাতে সর্বপ্রথম তিনি-ই উৎসাহ দেন। শুরুতে আমি বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকতাম। কিন্তু মেয়েরা দারুণ শোরগোল ফেলে দিলেন, বললেন যে দেয়াল হল বদমাইশদের কাগজ। সেকথা শুনে দাদু প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং তাঁর কাজের ঘরের একটা দেয়াল সাদা রঙ করে দিলেন। তারপর আমায় কিনে দিলেন প্রথমে রঙ পেন্সিল ও কিছুদিন পরে একটা জলরঙের বাক্স যাতে তিনি যখন তাঁর বিখ্যাত সোনার মাছ তৈরি করবেন আমি আমার ইচ্ছেমতো যা-খুশি ছবি আঁকতে পারি। কখনো কখনো তাঁকে বলতে শুনেছি যে তাঁর নাতি বড় হয়ে পেন্টার হবে। কিন্তু আমি তাঁর কথায় বিশেষ পাত্তা দিইনি, কারণ আমি তখন জানতাম যারা দেয়াল রঙ করে তাদেরই শুধু পেন্টার বলে।

আমার বছর চারেক বয়সে যারা আমাকে দেখেছে তারাই বলত যে আমি খুব দুর্বল ও অন্তর্মুখী ছিলাম। আর শুধু ভুলভাল গল্প বলতাম। সেই গল্পগুলো আসলে রোজকার জীবনের গল্পই, আমি কেবল তাদের উপর কল্পনার রঙ চড়িয়ে ঘটা করে বলতাম যাতে বড়রা আমার কথা মন দিয়ে শোনে। আমার এই সব গল্পের উৎস ছিল তাদেরই কথোপকথন। তাঁরা ভাবতেন আমি ছোট, আমি কিছুই বুঝব না, তাই আমার সামনেই সব কথা বলতেন। আবার কখনো কখনো সঙ্কেতের আকারেও বলতেন যাতে আমি কিছুতেই বুঝতে না পারি। কিন্তু বাস্তবে ঘটত ঠিক তার বিপরীত: আমি স্পঞ্জের মতো সমস্ত কথা শুষে নিতাম, তারপর তাকে টুকরো টুকরো করতাম ও সেই টুকরোগুলোকে এমনভাবে সাজাতাম যাতে আসল গল্পটা পুরো অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর যখন সেগুলো যারা বলেছিল তাদেরকেই আবার শোনাতাম তারা হতভম্ব হয়ে যেত এই ভেবে যে তারা ঠিক যা যা ভেবেছিল সেগুলোই আমি বলছি কি করে।

মাঝে মাঝে আমি বুঝতে পারতাম না আমার মনের ভেতরে যা হচ্ছে তা নিয়ে কি করব আর সেই দ্বিধা ঢাকতে চোখ পিটপিট করতাম। এই প্রবণতা এত বেশি ছিল যে পরিবারের এক প্রখর যুক্তিবাদী ব্যক্তি আমাকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সেই ডাক্তারের মতে আমার চোখ পিটপিট করাটা আসলে টনসিলের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত এবং আমাকে আয়োডিনযুক্ত মুলোর একটা সিরাপ খেতে দিলেন। বাড়ির বড়দের আশ্বস্ত করতে সেই সিরাপটা খুব কাজে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই। অন্যদিকে দিদিমা তাঁর দৈবনির্ধারিত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন যে তাঁর নাতি আসলে একজন গণৎকার। এরপর থেকে তিনি-ই ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় শিকার। তবে তা বন্ধ হল সেই দিন যেদিন তিনি আমার স্বপ্নের কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমি সত্যি সত্যি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে দাদুর মুখের ভেতর থেকে একটা জীবন্ত পাখি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেদিন আমি ভয় পেয়ে গেলাম, যদি আমার জন্যই দিদিমা মরে যান। তার ফলে আমার আগল ছাড়া পাকামিতে সেই প্রথম রাশ পড়ল। এখন বুঝতে পারি যে সেগুলো একটা বাচ্চার শয়তানি বুদ্ধি ছিল না, যেমনটা অনেকে ভাবতেন। বরং তা ছিল এক অঙ্কুরিত লেখক সত্তার বাস্তবকে আরো আনন্দদায়ক ও বোধগম্য করে তোলার প্রাথমিক কলা-কৌশল।

বাস্তবের মাটিতে আমি সেই দিন প্রথম পা রেখেছিলাম যেদিন রাস্তার মাঝখানে বা প্রতিবেশী কারুর বাগানে ফুটবল খেলতে শুরু করলাম। আমার শিক্ষক ছিল লুইস কারমেলো কোররেয়া। খেলাধুলোয় এক সহজাত দক্ষতা নিয়ে সে জন্মেছিল আর অঙ্কেও ছিল তার জন্মগত প্রতিভা। আমি তার থেকে পাঁচ মাসের বড় হলেও সে আমার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি লম্বা হয়ে গিয়েছিল বলে আমাকে খুব খেপাত। আমরা খেলা শুরু করেছিলাম কাপড়ের বল বানিয়ে এবং আমি একজন বেশ দক্ষ গোলরক্ষক হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু যখন সত্যিকারের বল নিয়ে মাঠে নামলাম লুইস কারমেলো আমার পেটে এত জোরে একটা লাথি মারল যে আমার সব অহংকার সেখানেই ভূপতিত হল। বড় হয়ে যখন আমাদের দেখা হত একটা ব্যাপারই আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিত যে আমরা একে-অন্যের সঙ্গে ঠিক সেই ছোটবেলার মতোই আচরণ করতাম। সে যাই হোক, সেই সময়ে আমার সবথেকে চমক লাগানো স্মৃতি হল কলা কোম্পানির সুপারিন্টেনডেন্টের বিলাসবহুল মাথা খোলা গাড়িটার রাস্তা দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া। গাড়িতে তার পাশে বসেছিল লম্বা সোনালি চুলের এক মহিলা, বাতাসে তার চুল উড়ছিল আর একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর রাজকীয় ভঙ্গীতে বসে ছিল মাঝখানে। এ সবই ছিল আমাদের জন্য নিষিদ্ধ বহুদূরের এক অলীক জগৎ থেকে ভেসে আসা ক্ষণমুহূর্তের কিছু উদ্ভাস মাত্র।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *