যে-বছর চের্নোবিল – কুশাণ গুপ্ত ( পর্ব ৯ )

শেয়ার করুন

এত কাক কোথায় যায়?

‘এই শহরের এত কাক দিনের শেষে কোথায় যায়? জানিস?’

আবিদুর একদিন হাসুকে এই প্রশ্ন করিয়াছিল।

আবিদুরের এইরূপ এক্সট্রা-কারিকুলার প্রশ্নগুলি খাপছাড়া ধরনের হইত। একথা মানিতে হইবে যে হাসু, নব ও টোটন, আবিদুর, এক দলে থাকিলেও যে যার ন্যায় বিশিষ্ট ছিল। তন্মধ্যে, আবিদুর ছিল সকলের তুলনায় বিশেষ পৃথক। সে ছিল প্রকৃতই ছন্নছাড়া, কিন্তু আশ্চর্য সকল তথ্য তাহার কাছেই থাকিত। এইডস রোগ সম্পর্কে সকলের আগে সে-ই বাকিদের অবহিত করিয়াছিল। আগের একদিন সে ক্লাসে বলিয়াছিল, দক্ষিণ ভারতের কোথায় নাকি এইডস রোগী পাওয়া গিয়াছে, অচিরেই এইডস ভারতেও ছড়াইয়া পড়িবে। গ্রীষ্মাবকাশের প্রাক্কালে চের্নোবিলের সংবাদও সে আনিয়াছিল। ইহার পরে রিয়্যাক্টর হইতে তাপবিদ্যুৎ সম্পর্কে অগভীর আলাপ-আলোচনা সহপাঠীদের মধ্যে চলিতে থাকে। সব শুনিয়া টোটন রায় দিয়াছিল―যা বোঝা গেল, চের্নোবিল আসলে হিরোশিমা নাগাসাকির পরমাণু-তুতো ভাই।

প্রিয় পাঠক, ছিয়াশি সনের মফস্‌সলের যে আখ্যান লিপিবদ্ধ করিতেছি, তাহার একটি বিকল্প নামকরণও হইতে পারিত। তাহা হইল―‘কীরূপে হাসু একটি মেডেল জিতিয়াছিল’। প্রথমেই বলিয়াছি, যাহাদের টপার বলা হয় হাসু সেই গোত্রের ছাত্র ছিল না, তথাপি এই অসম্ভব সম্ভব হইয়াছিল। সেই প্রসঙ্গে যথা সময়ে আসিব।

সেই বৎসর, মে মাস হইতেই, স্মরণ করিয়া দেখুন, পৃথিবী ডুবিয়া গেল ধুম জ্বরে; বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হইবার কালে চের্নোবিল ইত্যাকার প্রসঙ্গ জনমানস হইতে ধামাচাপা পড়িয়া গেল। তখন বিশ্ব জুড়ে কলরব উঠিতেছে, সেই ছিয়াশি সনে সুদূর মেক্সিকোয় ছিয়াশি মানাইতেছে সাদা নীল জার্সির এক জাদুগর, কেউ কেউ যাহাকে নির্দ্বিধায় ঈশ্বর মনে করিতে শুরু করিয়াছে। দশ নম্বর জার্সির সেই অলৌকিক দৌড় ও এক একটি ল্যাটিন ড্রিবলে ধরাশায়ী হইয়া গেল সমগ্র ইউরোপ। এসকল প্রত্যক্ষ করিতেছে গোটা বিশ্ব, মধ্যরাত্রির রাতজাগা ভারতবর্ষ।

এসকল কলরবের অন্তরালে বিশে মে হইতে চের্নোবিলের চার নম্বর রিয়্যাক্টরের চতুর্দিকে একটি অতিকায় স্ট্রাকচারের নির্মাণ-আয়োজন শুরু হইয়াছিল। ইহার নাম সার্কোফ্যাগাস। অবশিষ্ট গলিত কোর ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য যাহাতে অতঃপর ‘ডিকে-হিট’-জনিত বিকিরণ বাতাসে না ছড়াইতে পারে, ইহা ছিল তজ্জনিত সোভিয়েত-উদ্যম।

আটটি পর্যায়ে সার্কোফ্যাগাস নামক দৈত্য নির্মিত হয়। দুর্ঘটনাকবলিত সকল গলিত রিয়্যাক্টর লাভা ও ধূলিবর্জ্যের চারিদিকে একটি রেইনফোর্সড কংক্রিটের মজবুত স্ট্রাকচার, তাহার সম্পূর্ণ আইসোলেশন, এছাড়াও পর্যাপ্ত সাপোর্ট স্ট্রাকচার তৈরি করা এবং ভূস্তরের নীচে যথাযথ কুলিং-এর ব্যবস্থা ইত্যাদির আয়োজন হইয়াছিল। কোল মাইনসের প্রায় চারশত শ্রমিকের লাগাতার মেহনতে মাটির তলায় ১৬৮ মিটার দীর্ঘ টানেল তৈরি হয়। এ ব্যতীত রেডিয়েশন-অধ্যুষিত স্থানে ওয়েল্ডিং ও অন্যান্য জয়েন্টের নির্মাণের জন্য বিশেষ রোবট ব্যবহার করা হয়। সাতহাজার টনের মেটাল ফ্রেমওয়ার্কের এই অতিকায় নির্মাণকার্য সম্পন্ন হইতে হইতে নভেম্বর হইয়া যাইবে।

হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা সবে হইয়াছিল। এক দুপুরে হাসু ও আবিদুর স্কুলের অ্যাজবেস্টস-শেডের পাশে অবস্থিত ট্যাপ কলে জল খাইতে গিয়া দেখিল একটি কাক কলের পাইপে বসিয়া ট্যাপটি খুলিবার উপক্রম করিতেছে। টিপ টিপ করিয়া যেটুকু জল পড়িতেছে তা কাকটি গ্রীবা বেঁকাইয়া চঞ্চু বাড়াইয়া পান করিতেছে। অবশেষে কাকটি উড়িয়া গেল। হাসু বলিল, কাকটার বুদ্ধি দ্যাখ।

আবিদুর বলিল, কাক ওমনিভোরাস, এককথায় শ্রেষ্ঠ পাখি। ওদের নিজেদের সোসাইটি আছে, জানিস? হযবরল কিন্তু মিথ্যা নয়।

কাক লইয়া কথা হইতে হইতে অকস্মাৎ এই জরুরি প্রশ্নটি সহচরের নিকট আবিদুর রাখিল, এই যে এত হাজার হাজার কাক, কোথায় থাকে জানিস?

হাসু কহিল, গাছেই থাকে নিশ্চয়।

—হ্যাঁ, কিন্তু, প্রশ্নটা হল, কোন্ গাছে থাকে?

—শহরে কি গাছের অভাব?

—উত্তর জানিস না, উলটে বেঁকা প্রশ্ন করছিস।

—বেশ, তবে তুই-ই বল।

এতক্ষণ হাসু ও আবিদুরের ভিতর বাদানুবাদ চলিতেছিল। ইহার পরে তাহা ধামাচাপা পড়িয়া যায়। কিন্তু, পরে একদিন কাঁসাই বাস ব্রিজের সংলগ্ন জীনশহরের নিকটবর্তী আনিকেট ব্যারাজের বাঁধানো পাড়ে বসিয়া পুনরায় হাসুর নিকট আবিদুর প্রসঙ্গটা একান্তে ফিরাইয়া আনিল: কাকের প্রশ্নটার ফয়সালা হল, কী রে হাসু?

―কোন্ প্রশ্ন?

—এই শহরের এত কাক কোথায় থাকে?

―গাছে।

―কোন্ গাছে?

―শহরের এখানে-ওখানে তো প্রচুর গাছ।

—আনসার মাস্ট বি ব্রিফ অ্যান্ড টু দ্যা পয়েন্ট। কোন্ গাছ?

—তুই জানিস?

—অবশ্যই জানি।

—বেশ, তবে তুই উত্তর দে।

—শোন তবে। এই প্রশ্নটা আমার অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল। এত কাক, অলিতে গলিতে, মাঠে, নর্দমার পাশে, কোথায় থাকে এরা সব?

আবিদুর একটু থামিল। তাহার পরে আবার মুখ খুলিল:

আমি বেশ কিছুদিন ধরে ফলো করেছি ওদের। একদিন কলেজ মাঠে সূর্যাস্তের সময় দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে দেখলাম সব কাক একটা নির্দিষ্ট দিকে উড়ে যাচ্ছে।

―কোন্ দিকে?

―সব কাক স্টেশনের দিকে উড়ে যাচ্ছিল। আমি সাইকেলে স্পিড তুলে ওদের ফলো করতে শুরু করলাম।

―ফলো করলি? বলিস কী?

―আরে শোন না। কেরানিতলার মোড়ে পৌঁছে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখি সমস্ত কাক একটা স্পেসিফিক ডিরেকশনে যাচ্ছে।

―তারপর?

―কাকগুলো সব স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল।

―সব কাক স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল?

―হ্যাঁ, তারপর শোন। সাইকেল নিয়ে ধাওয়া করে করে শেষে পৌঁছে দেখি সব কাক স্টেশনের কাছে এসে বড়ো বড়ো গাছগুলোর কাছে এসে চেঁচামেচি করতে লাগল। ওখানে, দেখেছিস তো, পরপর বড়ো বট আর অশ্বত্থ গাছ আছে? একে একে সব কাক সেখানে গাছগুলোয় বসতে লাগল।

―সব কাক ওখানেই বসল?

― দাঁড়া। এখনও গল্প বাকি আছে। একে একে কাকেরা গাছে বসছে, আবার কিছু উড়ছে…কিন্তু, সব কাক ওই গাছগুলোয় জায়গা পেল না।

―তাহলে?

―তখন বাকি কাকেরা আবার উড়তে শুরু করল। এবার দেখলাম ওরা অন্য ডিরেকশনে উড়ছে।

―তাই? হাসু সবিস্ময়ে শুধাইল।

―একদম। এর পরেই কাকগুলো বাসস্ট্যান্ডের ডিরেকশনে উড়তে শুরু করল। আমি আবার সাইকেল নিয়ে ফলো করতে লাগলাম।

হাসু কল্পনা করিতে লাগিল, আকাশে এক ঝাঁক কাক উড়িয়া যাইতেছে, নীচে ন্যাড়ামাথা আবিদুর সাইকেল লইয়া আপ্রাণ অনুসরণরত।

―তুই কাকগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলি?

―হ্যাঁ। আমি স্টেশন থেকে মিত্র কম্পাউন্ডকে ডান হাতে রেখে বাঁদিকের রাস্তায় সাইকেল চালাতে লাগলাম।

―তারপর?

―কাকগুলোকে স্পিড তুলে ফলো করতে করতে পৌঁছে গেলাম পুলিশ লাইন।

―পুলিশ লাইন?

―হ্যাঁ। তারপর শোন না! পুলিশ লাইনের মাঠে এসে দেখি বড়ো তেঁতুল গাছগুলোর চারিদিকে কাকেরা হট্টগোল করছে। সে কী ঠেলাঠেলি রে!

―সত্যি বলছিস?

―এই তোর গা ছুঁয়ে বলছি।

―তারপর?

―মজার ব্যাপার হলো ওখানে সব গাছেও সব কাকেদের জায়গা হল না। কিছু কাক রয়ে গেল। বাকিরা উড়তে শুরু করল আবার।

―ধুর!

―সিরিয়াসলি। দেখতে হলে একদিন আমার সঙ্গে কলেজ মাঠে সূর্যাস্তের পরে চ।

―বাকি কাক উড়ে গেল কোথায়?

―আরে এরপরে কাকগুলো অন্য একটা ডিরেকশনে উড়তে শুরু করল।

―কোন্ দিকে?

―দেখলাম ওরা সিপাইবাজারের দিকে যাচ্ছে। আমিও সাইকেল চালাতে শুরু করলাম।

―আচ্ছা।

―এরপরে কাকগুলো আবাস পেরিয়ে ভাদুতলার জঙ্গলের দিকে গেল।

―ভাদুতলা অবধি কাক দেখতে সাইকেল করলি? সে তো অনেক দূর!

―হ্যাঁ রে। যখন ভাদুতলা পৌঁছলাম দেখলাম সব কাক বড়ো বড়ো শালগাছে সেটল করে গেছে। তখন প্রায় সন্ধে।

এই গল্পটি পাঠকের নিকট তুলিয়া ধরিলাম আবিদুরের অনুসন্ধিৎসু-মননের সহিত পরিচয় করাইবার জন্যই। তাহার আরও কিছু একান্ত স্বভাব ছিল। সে কেসিনাগের এক্সট্রা ও পিকেদে সরকারের গ্রামার ও ট্রান্সলেশন করিতে ভালোবাসিত। সে অঙ্ক বলিতে কেবল জ্যামিতির এক্সট্রা বুঝিত। ইংরিজি বলিতে পিকেদে সরকার ও ন্যারেশন চেঞ্জ। এ ব্যাতীত তাহার পড়াশুনায় অপর কোনো আসক্তি ছিল না। কিন্তু তাহার তীব্র আসক্তির অন্য দুইজন ছিল। ইহাদের মধ্যে একজন হইল ক্লাস সেভেনের ওই বয়েজ স্কুলেরই পাপান। পাপানের প্রসঙ্গ উঠিলে সে বলিত, বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু তাহার অপর আকর্ষণের নাম এক বালিকা বিদ্যালয়ের বছর তিনেকের সিনিয়র তনুদি। তনুদি সম্পর্কে কেবলমাত্র টোটন, হাসু ও নব অবহিত ছিল। ইহা বস্তুত এক জটিল সম্পর্ক। কখনও দুর্মর আকর্ষণ, কখনও তীব্র ঘৃণার দোলাচলে আবিদুর নিজেও কনফিউজড থাকিত। সেই সম্পর্কের অন্তর্নিহিত মর্ম তাহার তিন সহচরও কখনও টের পায় নাই। তবুও আবিদুরের আচরণে সেই তীব্রতার কিছু কিছু প্রকাশ পাইত।

এই সময়কালীন ক্লাসে একদিন তিনটি ঘটনা ঘটিল উপর্যুপরি। টিফিন পিরিয়ডে সকলে বাহির হইয়া গিয়াছিল। হাসু চতুর্থ বেঞ্চে বসিয়া একটি দুর্গা আঁকিতেছিল। সেই দুর্গা, বলাই বাহুল্য, লক্ষ্মী ট্যারা, এবং নোলক-পরা, এক হাতে মহিষাসুরের চুল ধরিতে উদ্যত এবং ভেংচি কাটিতেছে। মহিষাসুর নীল ডাউন হইয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া আছে। হাসু আঁকায় নিমগ্ন ছিল।

টিফিন পিরিয়ড অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছিল, যদিও আঁকায় মগ্ন হাসুর খেয়াল ছিল না। অকস্মাৎ একটা জোর শব্দ হইল। হাসু দেখিল পেছনের বেঞ্চে টোটন আবিদুরের হাত দুইটি ধরিয়া আছে এবং উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি হইতেছে। সে ছুটিয়া গিয়া দেখিল আবিদুরের বাঁ-হাত হইতে রক্ত ঝরিতেছে। এক হাতে ব্লেড ধরা। ব্লেডটি টোটন কাড়িয়া লইবার উপক্রম করিতেছে, কিন্তু আবিদুর ছাড়িতেছে না।

নব ক্লাস হইতে দ্রুত ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। হাসু দ্রুত আবিদুর ও টোটনের নিকট উপস্থিত হইল। আরও দুই সহপাঠী আবিদুরকে প্রতিহত করিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু, সে ব্লেড হাত হইতে ছাড়িতেছে না।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই নবর সঙ্গে নবেন্দু স্যার ক্লাসে হন্তদন্ত হইয়া ঢুকিলেন। হাতে একটি ফার্স্ট এইড বক্স। নবেন্দু স্যার ঢুকিতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসিল। তিনি আসিয়াই আবিদুরকে ব্লেড ফেলিতে বলিলেন। তারপর ব্লেডটা হাতে ধরিয়া বলিলেন, এই ব্লেড তো মরচে ধরা। হতভাগা! হাত কেটেছিস কেন?

ইহার পরেই তিনি আবিদুরের হাত ধুইয়া তুলোসহ ডেটল লাগাইলেন। তারপরেই বলিলেন, চল আমার সঙ্গে। এক্ষুনি টিটেনাস দিতে হবে।

আবিদুর নবেন্দু স্যারের পিছন পিছন চলিল।

পরে কোনো একদিন হাসু দেখিতে পাইবে, আবিদুরের বাম বাহুতে ব্লেডের ক্ষতচিহ্ন শুকাইয়া ইংরেজি ব্লক ক্যাপিটালে আঁকাবাঁকা TANUDI লেখাটি স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

সেদিনের প্রসঙ্গেই ফিরিয়া আসি। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ওই একদিন স্কুলে ছাত্রদের ইউনিফর্ম বিষয়ে ছাড় ছিল। টিফিনের অব্যবহিত পরেই অকস্মাৎ সরখেল স্যার ক্লাসে ঢুকিলেন। তাঁহার কোনো ক্লাস নবম(ক)-তে থাকিত না। তাঁহাকে দেখিয়া ছাত্ররা সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। ইহার সঙ্গত কারণও ছিল। সরখেল ছাত্রদের পবিত্রতা রক্ষায় ছিলেন অবিচল এবং তাঁহার কিছু কিছু গুপ্তচর ক্লাসে ক্লাসে ছড়াইয়া ছিল। এছাড়া বিশেষ বিশেষ দিনে তিনি ক্লাসে ক্লাসে রেইড করিতেন।

সরখেল, শ্রেণীশিক্ষক গোপাল খাঁড়া সহ, ক্লাসে ঢুকিয়াই প্রথম বেঞ্চ হইতে একে একে ছাত্রদের দাঁড়াইয়া নিজ নিজ নাম ও রোল নম্বর বলিতে বলিলেন। ছাত্ররা একে একে দাঁড়াইয়া নির্দেশ পালন করিল। এদিকে গোপাল-স্যার অ্যাটেন্ডেন্স খাতাটি লইয়া প্রথম পিরিয়ডের অ্যাটেন্ডেন্স-এর সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন। দেখা গেল, শেষ বেঞ্চের তিন কিশোর প্রথম পিরিয়ডে অনুপস্থিত ছিল। ইহার পর ওই তিন কিশোরকে লইয়া সরখেল ক্লাস হইতে গোপাল খাঁড়া সমেত দ্রুত বাহির হইয়া গেলেন।

ছাত্ররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল। কেউ কেউ ঘটনার তাৎপর্য বুঝিয়াও গেল। বিষয়টি হইল, শহরের মহুয়া সিনেমা হলে বেলা এগারোটা হইতে একটা অবধি একটি নুন শো চলে। এই শো-তে মূলত বিদেশি ছবির প্রদর্শনী হয়, উপরন্তু এসব ছবি কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত। প্রসঙ্গত, একটি সিনেমা টোটন দেখিয়া আসিয়া হাসু ও নবকে গল্প বলিয়াছিল। চিত্তাকর্ষক ছবিটির নাম―ব্লু লেগুন। কিছু কিছু অত্যুৎসাহী কিশোর স্কুলে না আসিয়া এগারোটার নুন শো-য় সিনেমা দেখিতে যাইত। অতঃপর টিফিনের সময় আবার সোনামুখ করিয়া স্কুলে ফিরিয়া আসিত। বিষয়টি এক পর্যায়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের মাথাব্যথার কারণ হইয়া দাঁড়ায়। স্কুল হইতে মহুয়া সিনেমা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়, স্কুলের ছাত্রদের সিনেমাহলে এন্ট্রি না দিতে, বিশেষত তাহারা সাবালক হয় নাই। অগত্যা মহুয়া হলে স্কুল ইউনিফর্মে কেউ আসিলে তাহাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হইল।

কিন্তু, ছাত্রদের মধ্যে বিচক্ষণতার অভাব ছিল না। বৃহস্পতিবার ইউনিফর্মের বিধি ছিল না। অর্থাৎ, যে যা খুশি পোশাক পরিয়া আসিতে পারে। সুতরাং চঞ্চল ও সুদূরের পিয়াসী কিশোরদল ওই দিনটিকে নুন শোর উপযুক্ত হিসাবে নির্বাচন করিয়া লইল। এই সংবাদ সরখেল বিশ্বস্ত সূত্রে পাইয়াছিলেন। সরখেল ছিলেন এক হানাদার, স্কুলের অতন্দ্র প্রহরী, তিনি সামার ভেকেশনের পূর্বে আরেকদিন নবম(ক) ক্লাসে অকস্মাৎ হানা দেন। অতঃপর নিকুঞ্জ খামরই নামক এক কিশোরের ব্যাগ হইতে একটি আশ্চর্য কিতাব উদ্ধারপূর্বক বাজেয়াপ্ত করেন। হলুদ মলাটের গ্রন্থটির নাম: দেহে এল যৌবন।

এদিনও অপরাধী ছাত্রদের লইয়া সরখেল চলিয়া গেলেন। অর্থাৎ ইহার পর জেরা এবং ময়না, তোতা ও অপরাপর তদন্ত চলিবে। এসকল বিচারাধীন বিষয়ের ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির চেয়ারম্যান এবং অতঃপর কোর্টে জাজের ভূমিকাও সরখেলই পালন করিবেন। সকলের সম্মতিক্রমে সরখেলের নিকনেম হইয়াছিল―ঝানু। তাঁহার প্ৰকৃত নাম সকলে ভুলিয়া যায়, ঝানু সরখেল হিসাবেই তিনি সর্বজনে বিদিত হন।

ইতিপূর্বে আবিদুরকে বাড়ি অবধি ছাড়িয়া আসিতে নব চলিয়া যায়। নবেন্দু স্যারই এই নির্দেশ দিয়াছিলেন। পঞ্চম পিরিয়ডে বিদেশ বিভুঁই স্যার ভূগোল ক্লাস লইতেছিলেন। হাসু তৃতীয় বেঞ্চে টোটনের পাশে বসিয়া ছিল। বিদেশ স্যার হাসুকে ডাকিয়া বোর্ডে ভারতবর্ষের ম্যাপ আঁকিতে বলিলেন। হাসু চক লইয়া দ্রুততার সহিত আঁকিয়া দিল। ইহার পর বিদেশ-স্যার ভারতের ভৌগোলিক বিভাজন ব্যাখ্যা করিতে শুরু করিলেন। এই সময়ে টোটন ক্ষীণ কণ্ঠে উঠিয়া বলিল, স্যার, বাইরে যাব। বিদেশ মঞ্জুর করিলেন, পড়াইতে লাগিলেন। টোটন মিনিট পাঁচেক পরে ফিরিয়া আসিল। হাসু দেখিল, টোটন ফিরিয়াই বেঞ্চে দুই হাত রাখিয়া মাথা গুঁজিয়া দিল। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরে আবার টোটন উঠিয়া বলিল, স্যার, বাইরে যাব।

―কী হল তোর? এই তো গেলি। শরীর খারাপ নাকি? বিদেশ বলিলেন।

―বমি পাচ্ছে স্যার। একবার বমি হয়েছে।

—যা যা। চোখেমুখে জল দে।

টোটন বাহির হইয়া গেল। বিদেশ স্যার পড়াইতে লাগিলেন। মিনিট দশেক পর বলিলেন, হ্যাঁ রে ছেলেটা ফিরল না তো। একটু কেউ গিয়ে দ্যাখ।

কেউ কিছু বলিবার পূর্বেই হাসু দ্রুত বাহির হইয়া গেল। টয়লেটের কাছাকাছি গিয়া সে দেখিল স্পোর্টস রুমের পাশের বেঞ্চিতে টোটন শায়িত। কাছে গিয়া হাসু বলিল, কী রে, শরীর খারাপ?

টোটন একবার মাথা নাড়িল।

―আবার বমি হয়েছে?

টোটন আবার ইতিবাচক মাথা নাড়িল।

ইহার পরে টোটন বেঞ্চে উঠিল। তাহার মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছিল।

হাসু বলিল, তুই একটু বোস। আমি দেখছি।

হাসু প্রথমে বিদেশ স্যারকে ঘটনার রিপোর্ট দিল। ইহার পরে অনুমতি লইয়া টিচার্স রুমে নবেন্দু স্যারের নিকট উপস্থিত হইল। নবেন্দু স্যার হাসুর সঙ্গে টোটনের কাছে আসিলেন। ইহার পরে বলিলেন:

তোদের ব্যাপার কী বল তো? একটা তো ব্লেডে হাত কেটে ফেলল। তুই কী বাধালি, টোটন? উলটোপালটা খেয়েছিস? হংস, ওকে বাড়ি পৌঁছে দে। আর বিকেলেই ডাক্তার দেখাস।

অতঃপর হাসু নবেন্দু স্যারের নির্দেশে একটি রিকশা লইয়া টোটনকে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিল।

সপ্তাহ দুয়েক অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছিল। টোটনের বাড়িতে হাসু ও নব বসিয়া ছিল। পাশে, বিছানায় টোটন শায়িত ছিল। তাহার চেহারা ভাঙিয়া গিয়াছে। উপর্যুপরি দুজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলিবার পর তৃতীয় মেডিসিন স্পেশালিস্ট বলিয়াছেন, টোটনের থ্রোট আলসার হইয়াছে। এই সংক্রমণ, তাঁহার মতে, সুইমিং পুল হইতে আসিয়াছে। এক্ষণে বলা প্রয়োজন কেরানিতলায় অবস্থিত শহরের একমাত্র সুইমিং পুলে টোটন ও আবিদুর নিয়মিত যাইত।

ইহার দুদিন পরে বিকালে হাসু, আবিদুর ও নব আবার টোটনের বাড়ি গেল। কিন্তু, তাহাদের বাড়ির বাইরের দরজা তালাবন্ধ ছিল। তাহাদের দেখিয়া পাশের বাড়ির এক পরিচিত কিশোর বলিল, কীসব ওষুধ খাইয়া টোটনের গতরাতে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। গা চাকড়া চাকড়া হইয়া ফুলিয়া যায়। আজ সকালেই তাহাকে কলকাতায় লইয়া যাওয়া হইয়াছে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

  1. Kak ra kothay thake? Age thaktam. vebe dekhini.Chena shohor er achena kahini porte besh valo lage.porer sankhyar apekhay thaklam.

  2. খুবই মনোগ্রাহী। কিশোর মনস্তত্ত্ব চমৎকার ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পটভূমিতে সেই সময়কার রাজনৈতিক হালচাল।
    চলুক!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২