যে-বছর চের্নোবিল – কুশাণ গুপ্ত ( পর্ব ৮ )

শেয়ার করুন

সব কটি পর্ব পড়তে উপরের যে-বছর চের্নোবিল ট্যাগে ক্লিক করুন।

শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর

আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা-উলঙ্ঘন বলিয়া একটি খুচরা ফ্যাচাং ফি-বৎসর লাগিয়া থাকে। ছিয়াশি সনই বা কীরূপে ব্যতিক্রম হইবে? অতএব অপয়া ১৩ই মার্চ দুইটি মার্কিন রণতরী কাকপক্ষীর অগোচরে সোভিয়েত সমুদ্রভাগে ঢুকিয়া পড়িল।

উপরের ঘটনাটি ‘ব্ল্যাক সি ইনসিডেন্ট’-মর্মে সংবাদপত্রের শিরোনাম হইয়াছিল। সংক্ষেপে ঘটনা এইরূপ: ইউএসএস ইয়র্কটাউন এবং ইউএসএস ক্যানন নামের দুই সুসজ্জিত মার্কিন রণতরী ক্রিমিয়ান পেনিনসুলার সোভিয়েত উপকূলের ছয় মাইল দূরে চুপিসাড়ে ঢুকিয়া পড়ে। কিন্তু অবিলম্বেই ল্যাডনি নামক সোভিয়েত সমরতরী হইতে চেতাবনি প্রেরিত হয়: ভালোয় ভালোয় এক্ষণে আমাদিগ জলখন্ড পরিত্যাগ করো, অন্যথায় ফল ভুগিতে হইবে। মার্কিন-পক্ষ উদাসীন থাকিলে সোভিয়েত আপন নৌসেনা ও বায়ুসেনা পাঠাইতে উদ্যত হয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মার্কিন রণতরী ফিরিয়া যায়। উপরোক্ত ক্যাচাল এইরূপে মিটিয়া গেলেও ইহা লইয়া কূটনৈতিক সংঘাত কিছুকাল চলিতে থাকে।

এ সংবাদ কট্টর সোভিয়েত-প্রেমী উমাপদও জানিতেন না। নবেন্দুই এই সংবাদ আনিয়াছিল।

সত্যমাধব লক্ষ করিয়াছেন, বিবিধ স্থানীয় বা জাতীয় সংবাদগুলি উমাপদ আনিয়া থাকে, কিন্তু বিশেষ আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা সেক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় নবেন্দু। এ ব্যতীত, কোনো সাম্প্রতিক বিষয়ে তাহার বস্তুত উৎসাহের ঘাটতি নাই। গেল বৎসর হ্যালির ধুমকেতু লইয়া সে এমন হুজুগে মাতিয়াছিল যে স্কুলের দর্শনার্থী ছাত্রদের আইআইটি খড়গপুর বাস ভাড়া করিয়া লইয়া যায়।

তদ্ব‍্যতীত, উদ্বেগজনক সকল সংবাদ কোথা হইতে সে পায় সে-ই জানে। জানুয়ারিতে টিচার্স রুমে সে সংবাদ আনিল, নাসার চ্যালেঞ্জার ভাঙিয়া পড়িয়াছে। ইহাতে মারা গিয়াছে আট-দশ জন।

আদ্যোপান্ত বিজ্ঞানমনস্ক তাহার মুখে একটি স্মিত হাসি সতত বিরাজমান। হাতে ধরা হাবিজাবি নানাবিধ পত্রপত্রিকা। ইহার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইল ‘উৎস মানুষ’ নামের একটি বিচিত্র পত্রিকা। একদিন কৌতূহলবশত পত্রিকাটি নাড়িয়া-চাড়িয়া সত্য চমকিত হন। পৃথিবীব্যাপী তথা দেশ ও দশের এত প্রকার সমস্যা রহিয়াছে এবং তাহার অনুপুঙ্খ লইয়া বিজ্ঞান ও এত মানুষ চিন্তিত ও নিবন্ধ লিখিতেছে ভাবিলেও বিস্ময় অপেক্ষা আশঙ্কাই হয় অধিক। এ একপ্রকার ঘরের খাইয়া বনের মোষ তাড়ানোর নামান্তর।

এই বৎসর, সত্য অনুভব করিতেছিলেন, তাঁহার ব্যক্তিগত উদ্বেগ ক্রমশ বাড়িতেছে। দীর্ঘ পঁচিশ বৎসরকাল শিক্ষকতা করিতেছেন, সংযমী হিসাবে তাঁহার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। অথচ সহসা একদিন ক্লাসে তার ব্যত‍্যয় ঘটিল। ধৈর্য হারাইয়া এক ছাত্রের গায়ে হাত তুলিয়া ফেলিলেন। ঘটনাটি মনে পড়িলেই এক ধরনের মর্মপীড়া আসিয়া উপস্থিত হয়।

অতঃপর, মার্চ ও এপ্রিল অতিক্রান্ত হইয়া শেষের সেদিন অকস্মাৎ আসিয়া পড়িল। পূর্বেই উল্লিখিত, ২৭শে এপ্রিল দুঃস্বপ্ন দেখিয়া সারারাত্রি জাগরণের পর সত্যটিয়া সকালে বারান্দায় আসিয়া মৃত টিয়ার খাঁচা-অভ্যন্তর অবশিষ্ট ধড় আবিষ্কার করেন এবং শিহরিয়া উঠেন। এক লহমা এই অসহ্য দৃশ্যের নিকট স্তম্ভিত থাকিয়া তিনি গৃহ অভ্যন্তরে ধাবিত হন, ‘সর্বনাশ হয়ে গেল’― বলিয়া স্বগতোক্তি করিয়া উঠেন। অতঃপর কিছুক্ষণ নিজ রুদ্ধকক্ষে একাকী উদ্বেগে কাটান। সেদিন রবিবার। মর্নিং ওয়াক এবং বাজার যাওয়া বাতিল হইয়া যায়।

তাঁহার পত্নী ততক্ষণে জাগিয়া গিয়াছেন, যদিও দুই কন্যা ও পুত্রের ঘন্টাখানেক পর ঘুম ভাঙে। পরে কাজের মেয়ে সুধা আসিয়া মেঝের রক্ত ডেটল জল দিয়া ধুইয়া দেয়। খাঁচার টিয়ার শবদেহ বাহিরে গৃহের অনতিদূরে রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির ভ্যাটে ফেলিয়া দেওয়া হয়। খাঁচাটি পরিষ্কার করা হয়। শূন্য খাঁচাটি বারান্দায় পুনরায় এক জিজ্ঞাসা চিহ্নের ন্যায় অনাবশ্যক ঝুলিতে থাকে।

সারা দিন কার্যত সত্যমাধব একাকী রুদ্ধকক্ষে অতিবাহিত করিতে থাকেন। সামনে খোলা পড়িয়া থাকে গোপন ডায়ারি। কানে বাজিতে থাকে প্রায় এক দশক আগের আসান ফকিরের সাবধানবাণী, ‘যতদিন এই টিয়া জিন্দা থাকবে, কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

সুতরাং, ‘ক্রাইসিস’ শব্দটি ডায়ারিতে গোটা ইংরাজি ব্লক ক্যাপিটালে ২৭ এপ্রিল নামাঙ্কিত পাতায় লাল কালিতে আন্ডারলাইনপূর্বক আনুমানিক আট বৎসর পরে পুনর্লিখিত হয়।

পরের দিন সত্যর উদ্বেগ আরও বাড়িয়া যায় স্কুলে যাইবার পরে। লক্ষ করিলেন, নবেন্দু এবং কেমিস্ট্রির বিকাশের মধ্যে তর্ক লাগিয়াছে, কোথাকার কী এক দুর্ঘটনা লইয়া। মাঝখানে উমাপদ বলিতেছেন, এসকল পুঁজিবাদী দেশের চক্রান্ত। তিলকে তাল করিয়া দেখানো হইতেছে।

নবেন্দু বলিল, উমাদা, আপনার সো-কল্ড সোশ্যালিস্ট কান্ট্রির রিয়্যাক্টরে কোনো কন্টেইনমেন্ট ভেসেল ছিল না। সেফটি বেরিয়ার নেই, এ কোনো কাজের কথা?

— পুঁজিবাদী মিডিয়ার স্রোতে গা ভাসিও না নবেন্দু। ওরা বাড়িয়ে বলে। উমাপদ বলিলেন।

― ইউএসএসআর আর কেজিবিও নিজের প্রোপাগান্ডা চালায়। চের্নোবিল এই দশকের বড়ো ক্রাইম উমাদা। ইতিহাস একে ক্ষমা করবে না।

মধ্যিখানে বিকাশ ফোড়ন কাটিল, বলিল ইহার এফেক্ট ক্ষণস্থায়ী, কী আর এমন হইবে? তখন নবেন্দু পুনরায় মুখ খুলিল। রেডিওএক্টিভিটির হাফ লাইফের তত্ত্ব আনিয়া বলিল, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের দরুন আগামী হাজার হাজার বছর অবধি ইহার প্রভাব থাকিয়া যাইবে। তাহার পরে সে বলিল, উমাদা, আপনার সঙ্গে দ্বিমত থাকবে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক নয়, সোশ্যালিস্ট ইম্পেরিয়ালিস্ট।

উমাপদ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বলিলেন, সোশ্যালিজমের লড়াই তো ইম্পেরিয়ালিজমের বিরুদ্ধে। সোশ্যালিস্ট কীভাবে ইম্পেরিয়ালিস্ট হয়? এরকম কোনো টারমিনোলজি আমার জানা নেই। তোমার রাজনৈতিক ভাবনায় গন্ডগোল আছে নবেন্দু।

নবেন্দু চুপ করিয়া গেল। তথাপি, রিয়্যাক্টর সংক্রান্ত আলোচনা চলিতে লাগিল। ক্রমে সত্যমাধব চের্নোবিলের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য কিছুটা নিজের মতন বুঝিলেন। তারপরে, নবেন্দুকে চুপিসাড়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, নবেন্দু, কবে অ্যাটম বোম ফাটল রাশিয়ায়?

―বোম নয় তো! রিয়্যাক্টর।

― তাই হবে। কবেকার ঘটনা ?

― শনিবার মাঝরাতে।

সত্য স্কুল হইতে ফিরিবার পরে সেই রাতের স্বপ্ন ও চের্নোবিলের সময় মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন। অবশ্যই টাইমজোনের ফারাকের কথা তিনি বিস্মৃত হইলেন। অতঃপর নিজকক্ষে ডায়ারি লইয়া উদ্দিষ্ট পাতায় লাল কালির ‘ক্রাইসিস’ শব্দটির নীচে সবুজ কালিতে লিখিলেন ‘চের্নোবিল’ শব্দটি। ইহা বাংলায় লিখিত হইল। ইহার পূর্বেই টিয়া, ঠাকুমা ও আসান ফকির শব্দগুলি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় লিখিত ছিল। পরে দেরাজ খুলিয়া একটি বাউন্ড ফাইল টানিলেন। ফাইল অভ্যন্তর হইতে কয়েকটি খাম বাহির হইল। পরপর কয়েকটি পত্র রাখা ছিল। পত্রগুলি তিনি নাড়াচাড়া করিয়া দেখিতে লাগিলেন।

প্রথম পত্রের তারিখ ৫ই মার্চ, যাহা সত্যর বাড়ির ঠিকানায় ৭ তারিখ আসিয়া পৌঁছায়। পত্রটি এইরূপ:

ওঁ নমো নারায়ণায়

যে নারায়ণ ভক্ত এই পত্র পাইবে তাহাকে সম্বোধন ব্যতীত লিখিতেছি। সম্প্রতি কংসাবতী তীরস্থ পাথরা গ্রাম-সন্নিহিত একটি প্রাচীন মন্দিরে এক পূজারি ব্রাহ্মণ সকালে পূজা নিমিত্তে পৌঁছাইয়া দেখেন একটি অতিকায় সর্প ফণা তুলিয়া মূর্তির গাত্রে বিদ্যমান। ব্রাহ্মণ তাহা দেখিয়া ভয় পাইলে উক্ত সর্পটি অবিকল মনুষ্য কণ্ঠস্বরে বলিল, ‘ওহে পূজারি, ঘাবড়াইও না। আমি সর্প নহি। আমি সর্পরূপী নারায়ণ। তোমাকে এই মর্মে নির্দেশ দিতেছি, তুমি আমার পূজা ও প্রচার করো। আমার মাহাত্ম্য প্রচার করিলে আমি তোমাকে উপযুক্ত পুরস্কার দিব। যদি আমার বাণী প্রচারে অন্যথা করো, তাহা হইলে তোমার সর্বনাশ করিব।’ এই বলিয়া সর্পরূপী নারায়ণ অন্তর্হিত হইলেন।

উক্ত ব্রাহ্মণ নারায়ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া মন্দির নির্মাণের তিনদিন পরেই মৃত্তিকা-অভ্যন্তর হইতে তিন ঘড়া স্বর্ণমোহর পাইলেন। অকুস্থলে এক পুষ্করিণী নির্মিত হইতেছিল।

এই পত্র পাইয়া অবিলম্বে পঁচিশজন ব্যক্তিকে যদি স্বহস্তে অনুরূপ পত্র লেখা হয় তাহলে নারায়ণের অসীম কৃপাবলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করিবে। এক ব্যক্তি অনুরূপ পত্র পঁচিশজনকে বিলি করিবার পরে নারায়ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। করাতিপাড়া এলাকার ওই ব্যক্তি বঙ্গশ্রী লটারির প্রথম পুরস্কার জিতেন। আবাস সংলগ্ন এক ব্যক্তি এই পত্র পাইয়া ছিঁড়িয়া ফ্যালেন। দুইদিনের মধ্যে তাঁহার স্ত্রী বাগানে সর্প-দংশনে মারা যান। নারায়ণের লীলায় এই সকল অলৌকিক ঘটনাবলী শহরে ও পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে নিয়ত ঘটিতেছে।

এই পত্র পাইয়া অবিলম্বে পঁচিশজনকে অনুরূপ পত্র বিলি করিয়া নারায়ণের অসীম কৃপা লাভ করুন। অন্যথায় সর্বনাশ হইবে।

জনৈক নারায়ণের পূজারি

বিঃ দ্রঃ ঠিকানা পাইতে অসুবিধা হইলে বিজ্ঞান মনীষা পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় আজীবন সদস্যদের নাম ও ঠিকানা দেখা যাইতে পারে। এ ব্যতীত একুশ নম্বর নারায়ণ-ভক্ত ঠিকানার উদ্দেশে পত্র প্রেরণ করা আবশ্যক।

পরের পত্রটি মার্চের শেষ সপ্তাহে সত্য পান। এই পত্রের হস্তাক্ষর পূর্বের পত্র হইতে ভিন্ন। ইহাতে তাঁহাকে সরাসরি সম্বোধন করা হইয়াছে। পত্রটি এইপ্ৰকার:

সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ বাবু-সত্যমাধব সমীপে,

নারায়ণ সর্বজনবিদিত, এক্ষণে জ্ঞাত হউন, তাঁহার নির্দেশ অমান্য করিবার ফল ভুগিতে হইবে। পৃথিবীর সমগ্র পাপে আপনার অংশও রহিল।

অহো দুরাচারী ব্রাহ্মণ, শনৈ, শনৈ! সকল তথ্যই কি ভাবিলেন ভূয়া? করাতিপাড়ার বুধু দোলই নারায়ণ-কৃপায় এক লক্ষ টাকা কি জিতে নাই? কুইকোটায় সামান্য টালির গৃহে বসবাসকারী সুকুমার মাইতির পুত্র কি জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ৪৫ র‍্যাঙ্ক করে নাই? আবাস অঞ্চলের নিরাপদ মন্ডলের স্ত্রী কি সর্প দংশনে প্রাণ হারায় নাই? জানিবেন, এসকল কর্ম নারায়ণের অমোঘ নির্দেশে অনুষ্ঠিত হইতেছে।

এ-ব্যাতীত নিজ গৃহে আপনার দুই কন্যা বিদ্যমান। কনিষ্ঠ যে এসএফআইয়ের সিআর হইয়া উচ্ছন্নে যাইতেছে খবর রাখেন? অধিকন্তু, অতিশয় উদ্বিগ্নকর সংবাদ আপনার জন্য অপেক্ষারত। সাবধান, ব্রাহ্মণ।

সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এক্ষণে পূর্বের পত্রের একশত কপি স্বহস্তে লিখিয়া পোস্টাপিসে সত্ত্বর দিয়া আসুন। নারায়ণ নমোহ।

কার্যত দুইটি পত্রই সত্যমাধব উপেক্ষা করেন। তথাপি, তিনি পত্রদুটি ফাইলে তুলিয়া রাখিয়া দেন। অতি সাবধানি ও হিসাবি সত্য কোনো কাগজই ফেলিতেন না। এমনকি সকল প্রকার রসিদ, বাজারের ফর্দ ইত্যাদি আলাদা আলাদা ফাইলে রক্ষিত হইত।

এপ্রিল মাসে তিনি শেষ পত্রটি আরও দুইবার পান। একই বয়ান। ভিন্ন হস্তাক্ষর। শুধু, প্রথমবার দুশো পত্র লিখিতে ও দ্বিতীয়বার চারশো পত্র লিখিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।

সত্যমাধব পত্রগুলি অগ্রাহ্য করিতেছিলেন। তথাপি, ভিতরে ভিতরে একধরনের উদ্বেগ কাজ করিতেছিল। একদিন থাকিতে না পারিয়া পত্নীর নিকট অপালার এসএফআই প্রসঙ্গ লইয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। কিন্তু, পত্নী এই প্রসঙ্গকে খুব একটা আমল দেন নাই। অগত্যা কনিষ্ঠ কন্যা অপালাকে ডাকিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, এসএফআই-এর সিআর সংক্রান্ত তথ্যটি সঠিক কিনা। তাঁহাকে অবাক করিয়া অপালা নির্দ্বিধায় স্বীকারোক্তি দিল। এই লইয়া টানা ঘণ্টাখানেক তাঁহার সহিত প্রবল বাগ্‌বিতণ্ডা চলিতে চলিতে অপালা বলিল, সামনের বৎসর সে কলেজে ভিপি ক্যান্ডিডেট হইতে পারে। উপরন্তু বলিল, সে এসএফআই-এর কর্মী হিসেবে এবং কমরেডদের জন্য গর্বিত। ইহা ব্যতীত, কথাপ্রসঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো, এমনকি প্লেখানভ-লেনিন বিতর্ক এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি হইতে কিছু কিছু উদ্ধৃতি দিয়া আপন পিতাকে বিস্মিত ও হতবাক করিল। বস্তুত, এসকল বিষয়ের তুলনায় আপন কন্যার রাজনৈতিক বক্তব্য রাখিবার বদ্ধপরিকর ভঙ্গিমা ও দ্বিধাহীন শরীরী ভাষা সত্যকে কার্যত স্তম্ভিত করিয়া দিল। পুঁজিবাদী মিডিয়া বামফ্রন্টের পিছনে ফেউয়ের ন্যায় পড়িয়া আছে এবং তাহার আশু লক্ষ্য এখন সংগ্রামপূর্বক বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করা, এই কথা বলিয়া অপালা তাহার উচ্চকিত বক্তব্যের উপসংহার টানিল।

কনিষ্ঠ অপালা আশৈশব উদ্ধত, কিন্তু এই ঘটনা সত্যকে একান্ত উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিল। তিনি রাজনীতি হইতে আজীবন শতহস্ত দূরে থাকিয়াছেন, সিপিএমকে আপ্রাণ ঘৃণা করিয়াছেন। তাঁহার কনিষ্ঠ কন্যা শেষে সিপিএমের খপ্পরে পড়িয়া গেল? সে এমনকি সিপিএমের প্রচারসভায়, নিয়মিত, সগর্বে যাইতেছে, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলিয়া মিছিলে স্লোগান দিতেছে, রগ ফুলাইয়া গণসঙ্গীতও পরিবেশন করিতেছে! সিপিএম কি আজ বঙ্গে এইরূপ সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিল? কিন্তু, পত্নীর নিকট এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে নির্বিকার পত্নী জবাবে বলিলেন, এসব কলেজের হুজুগ। দু-দিনে কেটে যাবে।

এপ্রিল মাসে শেষ চিঠিটি একই বয়ানসমেত বার তিনেক সত্যের ঠিকানায় আসিয়া পড়িল। চিঠিগুলির, সত্য বাড়ি আসিয়া আবিষ্কার করিতেন, একই বয়ান। তথাপি, প্রতিটি হস্তাক্ষর স্বতন্ত্র।

একদিন সত্য টিচার্স রুমে উমাকে ডাকিয়া একথা-ওকথার ফাঁকে শুধাইলেন, উমা, করাতিপাড়ায় কোন্ রিকশাওয়ালা নাকি লটারি পেয়েছে?

–আরে, আপনিও খবর পেয়েছেন? হ্যাঁ, বুধু, বুধু দোলই। এখন তো ও বিখ্যাত। বুধু আমাদের কনফার্মড ভোটার বললে কম বলা হয়। পার্টি সিমপ্যাথাইজার। পার্টিকে এক হাজার টাকা ডোনেট অবধি করেছে।

সত্য স্তম্ভিত হইলেন। ইহার পরে তিনি উমাকে বলিলেন, সে কি কোনো নারায়ণের মূর্তি বানিয়েছে?

―তা বলতে পারব না। তবে, বুধু খুব ভালো, উদ্যোগী ছেলে। শুনেছি, এক ভাইকে একটা স্টেশনারি দোকান করে দিয়েছে। এছাড়া কয়েকটা রিকশা কিনে ভাড়া খাটাচ্ছে। কিন্তু, নিজে এখনও রিকশা চালায়।

―আচ্ছা, উমা, এবছর জয়েন্টে ভালো র‍্যাঙ্ক করেছে, একটা ছেলে, কুইকোটায় বাড়ি। ওর সম্পর্কে জানো?

উমাপদ আগের প্রশ্ন ও পরের প্রশ্নের যোগাযোগ ও পরম্পরা ধরিতে পারিলেন না। শুধু বলিলেন―

―ও, দীনবন্ধু মাইতি? ব্রাইট ছেলে তো। আমাদের স্কুলের লাস্ট ইয়ার পাস আউট।

–এই লটারি, জয়েন্টে র‍্যাঙ্ক, এগুলো কি এমনি এমনি মনে করো?

উমাপদর মুখে একটা অর্থবহ হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন:
আমি জীবন সম্পর্কে এই ভাববাদী অ্যাপ্রোচ মানি না সত্যদা। মানুষের সমস্ত অর্জনই শ্রমনির্ভর। অবশ্যই, যোগ্যতা বলে একটা কথাও আছে।

কথাবার্তা এখানেই থামিয়া গেল।

বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে অবশ্য সত্য, পূর্বেই আলোচিত, কেবল শীতলবাবুকেই ভরসা করিতেন। টিচার্স রুমের দীর্ঘ টেবিলের এক প্রান্তে নিরালায় শীতলবাবুর সঙ্গে জটিল ও সমস্যাসংকুল প্রসঙ্গসমূহ আলোচনা করিলে সুরাহা না মিলুক, কিছু ভরসা আসিয়া যায়। বিশেষত, শীতলবাবুর অকাট্য যুক্তি কয়জনেই বা খণ্ডন করিতে পারে? অলুক্ষুণে প্রসঙ্গসকল আসিল। শীতলবাবু ধীরকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন:

―এই বিজ্ঞান নিয়ে মানুষের ঔদ্ধত্য আর বড়াই অসহ্য হয়ে উঠছে সত্যবাবু। আজ অবধি বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্য ভেদ হল? পিরামিডের নির্মাণ নিয়ে জানতে পারা গেছে আদৌ?

―আপনি কী বলেন? চারদিকে এতকিছু ঘটছে। এর কার্যকারণ তাহলে কী? সত্য জিজ্ঞাসা করিলেন।

―আমার ব্যক্তিগত ধারণা যদি জানতে চান, তবে বলি, কল্কি অবতার অবতীর্ণ হয়েছেন। মহাপ্রলয় ঘটতে চলেছে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে।

সত্যমাধব প্রমাদ গনিলেন। তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল। তিনি বলিলেন, সব ধ্বংস হয়ে যাবে? স…অঅ ব?

―আমার কথা বিশ্বাস না হয় নিউজ পেপার দেখুন। কাগজেই বলছে, পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। এছাড়া নস্টারডামুস পড়লেও এমন ধারণাই হয়।

―এর থেকে বাঁচার উপায়?

―উপায় নেই সত্যবাবু। এ হল ডিভাইন ইন্টারভেনশন। মনে রাখবেন, তাঁর নির্দেশে গাছের প্রতিটি পাতা পর্যন্ত নড়ে। এখন দিনরাত গীতা পড়ুন। আমি তো রোজ রাতে গীতাই পড়ি। বেশ উচ্চারণ করে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একাকী পড়বেন। সব অ্যাংজাইটি দূর হয়ে যাবে।

শীতলবাবুর অদ্ভুত কিছু পাঠগ্রন্থ প্রিয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হইল নস্টারডামুস, বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলের রহস্য, দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ এবং মরণের পারে। মেটাফিজিক্সের ও কন্সপিরেসি থিওরির প্রতি তাঁহার অসীম আগ্রহ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং নেতাজি প্রসঙ্গ আলোচিত হইলেই তিনি ‘আমি সুভাষ বলছি’ অপেক্ষা ‘শৌলমারির সন্ন্যাসী কি নেতাজি?’ রেফার করিতেই পছন্দ করিয়া থাকেন। কিন্তু সকলপ্রকার উদ্বেগের প্রতিষেধক হিসাবেও তিনি কিছুকিছু রেমেডি-পুস্তক রেফার করিয়া থাকেন। মাঝখানে সরখেলের ইনসমনিয়া রোগ ধরিল। উমাপদ ডাক্তারের কাছে যাইতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু শীতলবাবু দুইটি গ্রন্থ প্রস্তাব করিলেন। প্রথমটি যদি ডেল কার্নেগী হয়, তাহলে দ্বিতীয়টি অবশ্যম্ভাবী গীতা।

ইহা শুনিবার পর সত্য গীতা খুলিয়া রাত্রিতে বসিতেছেন। প্রত্যহ। কিন্তু কৃষ্ণের বাণী পড়িতে পড়িতে কল্কি স্মৃত হয়, গভীর রাতে মনে হইতে থাকে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়া অশ্বারোহী কল্কি ছুটিতেছে। অতঃপর অবধারিত মনে হইতে থাকে পত্রগুলির কথা। সকল অমঙ্গলচিন্তা আসিয়া পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাসের ন্যায় দুয়ার চাপিয়া ধরে। সত্য কেবল ঘটনাপরম্পরা ভাবিতে থাকেন। একাকী জাগিয়া থাকে উদ্বেগ।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে, চের্নোবিলের দিন সত্যমাধব অপর একটি সংক্ষিপ্ত পত্র পান। একই হস্তাক্ষরের। ইহা নিম্নরূপ।

দুরাচারী ব্রাহ্মণ,

স্মরণে রাখিও, শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর।

নারায়ণ নমোহস্তুতে।

এই পত্র পাইবার তারিখ ও চের্নোবিল ঘটনাক্রম, দুঃস্বপ্ন এবং টিয়ার মৃত্যু, সত্যমাধব দেখিলেন, মিলিয়া যায়। কিন্তু, উপর্যুপরি বিপর্যয় ঘটিল আরও কয়েকদিন পর। মে মাস পড়িয়া গিয়াছিল। পরের দিন সামার ভ্যাকেশন হইবে। মর্নিং স্কুল হইতে ফিরিয়া তিনি জগন্নাথ মন্দির চকের বাজারে সামান্য কিছু কেনাকাটা করিতে হাঁটিতে গিয়া একটা জটলা লক্ষ করিলেন। লোকজনকে দেখিয়া মনে হইল বিশেষ উত্তেজিত। দেখিলেন ভিড়ের এক প্রান্তে মোড়ের রিকশাওয়ালা নিবারণ দাঁড়াইয়া আছে। নিবারণকে ডাকিয়া সত্য এই কোলাহলের কারণ শুধাইলেন।

নিবারণ বলিল, শোনেননি বাবু? আমতলার ঘাটে তিনটে ছেলে ডুবে গেছে।

―বলো কী! কী করে?

―চান করতে গিয়ে। এপাড়ার সুখেন মান্নার ছেলেটাও গেল।

―সুখেনবাবুর ওই ছেলেটা, তার তো দারুণ স্বাস্থ্য! অমন জলজ্যান্ত ছেলেটা নদীতে ডুবে গেল!

―আর বলবেন না বাবু। দুই বোনের মাঝে একটা মাত্র ছেলে। মায়ের সে কী বুকফাটা আর্তনাদ!

সত্যর অস্বস্তি হইতে লাগিল। উকিল সুখেন মান্না এপাড়ার পরিচিত নাম। বস্তুত, প্রাতর্ভ্রমণের কালে তিনি সুখেনবাবুর বাড়ির পাশের লাল মোরামের রাস্তা দিয়া পালবাড়ির মাঠে যান। সেই সময়ে, তিনি লক্ষ করিয়াছেন সুখেনবাবুর সুগঠিত স্বাস্থ্যের কিশোর ছেলেটি খোলা ছাতে দাঁড়াইয়া বারবেল ভাঁজিত।

ইহার পরে নিবারণ বলিল, হাসপাতাল থেকে বডি আসবে। রিপোট হবে। তারপর।

―কিন্তু, এই গ্রীষ্মে কাঁসাইতে এত অল্প জলে কী করে ওরা ডুবে গেল?

নিবারণের বয়ান অনুযায়ী, কাঁসাইয়ের আমতলার ঘাটের খানিক পশ্চিমে একটি দ আছে। ইহা বস্তুত এক ঘূর্ণাবর্ত এবং অতীতে কিছু দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু অকুস্থলে ঘটিয়াছে। সেই স্থলে স্নান বা সন্তরণ সাধারণে নিষিদ্ধ। স্থানীয় একটি স্কুলের পাঁচ ছয়জন কিশোর স্নানার্থে নদীতে নামিবার পরে স্থানীয় এক মাঝি তাহাদের সাবধান করিয়াছিল। কিন্তু, উহারা জলের মধ্যে ক্রীড়া করিতে করিতে একটি ডাবের খোলা লইয়া দূরবর্তী জলে ছুঁড়িয়া দেয়। ক্রমশ একে একে তাহারা দ-য়ের নিকটে চলিয়া যায়। এক কিশোরকে বাঁচাইতে গিয়া দ্বিতীয় কিশোর তলাইয়া যায়। দুইজন কোনোক্রমে দ-য়ের মুখ হইতে ফিরিয়া বাঁচিয়া গেছে।

কিন্তু, ইহাতেও সত্য আশ্বস্ত হইতে পারিলেন না। কীরূপে এই প্রখর গ্রীষ্মের কাঁসাইতে তিন জলজ্যান্ত কিশোর ডুবিয়া গেল?

সেইদিনই অনেক দোলাচল কাটাইয়া হেড পোস্টাপিস হইতে সত্য পঞ্চাশটি খাম কিনিলেন। অরোরা সিনেমা হলের বিপরীতে পণ্ডিত বুক স্টল হইতে বিজ্ঞান মনীষা পত্রিকাটি কিনিয়া দেখিলেন শেষ দুই পাতায় আজীবন সদস্যদের নাম ঠিকানা রহিয়াছে। গোটা পাঁচেক পরিচিত নামও পাইলেন।

রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসিয়া সত্যমাধব এক এক করিয়া প্রথম পত্রের বয়ান কপি করিতে লাগিলেন। গোটা পনেরো পত্র কপি করিতে করিতে ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। পরের দিন ঠিকানা লিখিয়া হেড পোস্টাপিসে সন্তর্পণে গিয়া পনেরো কপি পোস্ট করিয়া আসিলেন।

গ্রীষ্মাবকাশ হইয়া গিয়াছিল। বিকালে বারান্দার সামনে শূন্য খাঁচাটির দিকে সত্যমাধব চাহিয়া ছিলেন। খাঁচাটি তিনি ফেলিতে পারেন নাই। শূন্যতা যেন তাঁহার কাছে কৈফিয়ৎ চাহিতেছিল। কেহ জানে না, গোপনে তিনি টিয়াটিকে ‘শৈবা’ বলিয়া ডাকিতেন। এই শৈবা, তাঁহার একান্ত শৈশবের ডাক, পিতামহীর প্রতি। টিয়াটি তাঁহাকে, সম্ভবত, আলাদা করিয়া চিনিত। তাঁহার আঙুলে সামান্য দংশন করিলেও সত্য কখনও সেভাবে আঘাত পান নাই। বরং প্রতি দংশনের পর পিতামহীর আদর স্মরণে আসিত। শৈবা কীভাবে তাহাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল?

অকস্মাৎ এক যুবক আসিয়া গেট খুলিয়া তাঁহার দিকে আগুয়ান হইল। কিছু বুঝিবার পূর্বেই যুবক ঝুঁকিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। সত্য জিজ্ঞাসু নয়নে তাকাইলেন।

যুবকের বয়েস, দেখিয়া মনে হয়, তিরিশের আশেপাশে। শ্যামলবর্ণ, দোহারা চেহারার।

যুবক মুখ খুলিল, আমার নাম নিমাই জানা। হবিবপুরে থাকি। আপনার কাছে একটা দরকারে এসেছি।

সত্য দুই চোখ, সপ্রশ্ন, তুলিলেন। কিন্তু, তিনি কিছু বলিবার পূর্বেই যুবক বলিল,

আপনার মেয়ে মৈত্রেয়ীকে আমি বিয়ে করতে চাই।

সত্য এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিছুক্ষণ বক্তব্য ও পরিপ্রেক্ষিত বুঝিতেই সময় লাগিল। কিন্তু, পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরিল। তিনি চোয়াল শক্ত করিয়া বলিলেন,

―বিয়ের বিষয় তো এত সহজ নয়। এছাড়াও এ ব্যাপারে তোমার বাবার আমার কাছে আসা উচিত ছিল। তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।

―আমার বাবা মারা গেছেন। মা ছোটোবেলাতেই মারা গেছেন।

―সেক্ষেত্রেও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকেই বিয়ের কথা বলাটা আবশ্যক। আমি তোমার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।

―কিন্তু, অসুবিধেটা কোথায়? আমি নিজের যোগ্যতায় স্কুলে পড়াই। এছাড়া মৈত্রেয়ীর এই বিয়েতে সম্মতি আছে।

সত্যর মনে সংশয় আসিল। তথাপি, তাঁহার ধারণারও অগম্য যে কেউ আসিয়া এইভাবে সরাসরি নিজের বিয়ের তদবির করিতে পারে। এসকল তো হালের চলচ্চিত্রে দেখানো হইয়া থাকে। এইরূপ কি বাস্তবে হয়? এক লহমা তিনি চুপ থাকিলেন। কিন্তু, জোর দিয়া বলিলেন:

―আমি অসবর্ণ বিয়ে মানি না। তুমি আসতে পারো।

―হ্যাঁ যাচ্ছি। কিন্তু জেনে রাখুন, হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট এবং স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, কোথাও অসবর্ণ বিয়ে আইনত আটকায় না। এছাড়া মৈত্রেয়ীর কনসেন্ট এ বিয়েতে আছে।

ইহার জবাবে সত্য কিছু একটা বলিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, সহসাই বাড়ির ভিতর হইতে বারান্দায় অপালা আসিয়া পড়িল। আসিয়াই বলিয়া উঠিল―

আরে নিমুদা, কতক্ষণ এসেছেন? বাইরে কেন, ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন।

সামান্য সৌজন্যের হাসি মুখে আনিয়া যুবক বলিল, না অপা, একটু ব্যস্ততা আছে।

তারপর সে সত্যর দিকে একবার চাহিয়া বলিল, আপনার অনুমতি চাই। নাহলে আমরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করতে বাধ্য হব। একথা বলিয়াই দ্রুত পিছু ফিরিয়া গেটের দিকে এগাইয়া রাস্তায় চলিল।

সত্যমাধব গৃহের অভ্যন্তরে ঢুকিতে উদ্যত হইলেন। দেখিলেন অপালা তাঁহার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে। এই দৃষ্টি তাঁহার পরিচিত। তাহাকে পাশ কাটাইয়া তিনি নিজ কক্ষে ধাবিত হইলেন। অতঃপর খাটে খানিক শায়িত অবস্থায় কিংকর্তব্য ভাবিতে লাগিলেন। যেরূপ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুবক কথা বলিয়া গেল, যেরূপ সাদর অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে অপালা তাহাকে সম্ভাষণ করিল তাহাতে পরিস্থিতি যে জটিল হইয়া উঠিয়াছে তাহা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষণে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে কথা বলিবার পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। কীরূপে তাঁহার অগোচরে এসকল ঘোঁট পাকাইয়া উঠিল?

সত্য ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। ঘুম ভাঙিয়া দেখিলেন পৌনে নটা বাজিয়া গেছে। হাত মুখ ধুইয়া ভিতরের রান্নাঘর লাগোয়া দাওয়ার দিকে এগাইতে গিয়া চোখে পড়িল সিঁড়ির নিকটে দাঁড়াইয়া মৈত্রেয়ী ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। অপালা বলিতেছে, কাঁদিস না, আমরা আছি তো। সত্যকে কাছে আসিতে দেখিয়া অপালা গলা চড়াইল― এই বিয়ে হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।

স্ত্রী বেণুও রান্নাঘরের দিক হইতে আসিল। আসিয়া মৈত্রেয়ীকে বলিল, খেতে আয়। অমন করিস না। আজ দুপুরেও তুই কিছু খাসনি তেমন।

সত্যমাধব বলিলেন, কী হয়েছে?

―তোমার যা আক্কেল! ছেলেটা এলো। ভেতরে ডাকা উচিত ছিল। স্ত্রী বলিলেন

―একটা বাইরের ছেলেকে বাড়ির ভেতরে ডাকব? কথা বলতে এসেছে। কথা তো হয়ে গেছে।

―বাবা, তুমি নিমুদাকে অপমান করেছ ইন্টেনশনালি। অন্যকে অপমান করার অধিকার তোমার নেই। অপালা ঝাঁঝের সহিত বলিল।

সত্য কী বলিবেন ভাবিতেছিলেন। কিন্তু মৈত্রেয়ী কান্নার মাত্রা কিছু বাড়াইয়া দিল। এই সময়ে বেণু আরেকবার তাহাকে খাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। অপালা যেন ইহারই অপেক্ষায় ছিল। সে জ্বালাময়ী ভাষায় নারীমুক্তি ও মার্ক্সবাদ বিষয়ে তাহার সুচিন্তিত বক্তব্য উচ্চৈঃস্বরে রাখিতে লাগিল। তাহার বক্তব্য মোতাবেক, এইভাবে পরিবারের নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে পিতৃতন্ত্র দ্বারা যুগ যুগ ধরিয়া শোষিত হইতেছে। এক্ষণে মৈত্রেয়ীর পক্ষ লইয়া সে ইহার বৈপ্লবিক নিষ্পত্তি করিবার এমন সুযোগ ছাড়িতে চায় না।

সত্য লক্ষ করিলেন, অপালা বামপন্থী ধারায় তাহার মুষ্টিবদ্ধ প্রতিবাদ উগরাইয়া দিতেছে। অপরপক্ষে ক্রন্দনরত মৈত্রেয়ী অসহযোগ আন্দোলনের অনুসারী। শত পীড়াপীড়িতেও সে খাইবে না। আসন পাতা হইয়া গিয়াছে। বেণু রাজ্যের বিরক্তি মুখে লইয়া খাবার বাড়িবার উপক্রম করিতেছে। কেবল তাহার সাত বৎসরের পুত্র দীপু আসনে বসিয়া পড়িয়াছে। তাহাকে কোনো কিছুই স্পর্শ করিতেছে না।

অপালা তাহার জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখিয়া ছোড়দিকে খাইতে অনুরোধ করিল। কিন্তু মৈত্রেয়ী কান্না মুছিয়া তাহা প্রত্যাখ্যান করিল। উপায়হীন সত্য মৈত্রেয়ীকে একবার ম্লান স্বরে খাইতে ডাকিতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু, মৈত্রেয়ী মুখে যথোপযুক্ত ঘৃণা ঢালিয়া মুখ ঘুরাইয়া লইল।

বেণু খাবারের থালা লইয়া আসিতেছে। আজ মোড়ের মাথায় জ্যান্ত পাকা শোল পাইয়াছিলেন, সত্য আনিয়াছেন। গন্ধ হইতে অনুমান হয়, আলুপোস্ত, ও সম্ভবত, শোলের অম্বল হইয়াছে। অপালা গিয়া দীপুর পাশে বসিল। অকস্মাৎ সত্যকে তাঁহার ঔচিত্যবোধ কহিল, তাঁহারও এমতাবস্থায় না খাওয়াই সমীচীন। বেণু দ্বিতীয়বার থালা আনিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন― আমি খাব না আজ। খিদে নেই। বলিয়াই তিনি নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হইলেন। পেছন হইতে স্ত্রীর বাঁকা কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল― বুড়ো বয়সে এই ন্যাকামির মানে কী? আমারই হয়েছে যত মরণ!

মধ্যরাত। সত্য নিজ কক্ষে বসিয়া ছিলেন। মহতাবপুরের শ্মশান হইতে মড়া পোড়াইবার গন্ধ আসিতেছে। আজ আর সহজে ঘুম আসিবে না। গীতা খুলিতেও ইচ্ছা করিতেছে না। এরূপ নিঃসঙ্গতা তিনি পূর্বে কখনও বোধ করেন নাই।

সত্য ফাইল খুলিলেন। একটি খাম বাহির করিলেন। পেনের ঢাকনা খুলিয়া খামের উপর একটি ঠিকানা পত্রিকা হইতে কপি করিলেন। তারপর পাশের পত্রে চোখ রাখিয়া সাদা কাগজের ওপরে ধীরে ধীরে লিখিতে লাগিলেন:

ওঁ নমো নারায়ণায়…

শেয়ার করুন

Similar Posts

8 Comments

  1. এই পর্বটি খুব উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। মানুষের অসহায়তা ফুটেছে চমৎকার ভাবে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রচলিত বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব সেই অসহায়তাকে আরো বিশ্বাস্য করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে শুরু করে বঙ্গীয় রাজনীতির খুঁটিনাটি প্রেক্ষাপট হিসেবে চমৎকার।

    1. প্রতিভাদি, আপনার কমেন্ট আমার কাছে মূল্যবান। কৃতজ্ঞতা।

  2. দুরাচারী ব্রাহ্মণ, স্মরণে রাখিও, শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর।

    ওঁ নমো নারায়ণায়…

    শেয়ার করুন

    1. লেখার সঙ্গে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা রইল, বাদশা।

  3. Chomotkar lekha. Besh upovogyo. Kintu porer porbo ta porar aage, aager sob porbo gulo ekbar pore felte hobe mone hocche.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *