যে-বছর চের্নোবিল – কুশান গুপ্ত (পর্ব ১)
১
টিয়া টিয়া….
১৯৮৬ সনের ২৬ এপ্রিল গভীর রাতে ইউক্রেনের কিয়েভ হইতে আনুমানিক ১৩০ কিমি উত্তরে, চের্নোবিল পাওয়ার প্ল্যান্টে, রাত আনুমানিক একটা তেইশে চার নম্বর চুল্লির ভেসেল স্টিম-এক্সপ্লোশনে উড়িয়া গেল।
ইহার আগের দিন হইতেই চার নম্বর চুল্লিতে এক্সপেরিমেন্ট চলিতেছিল। রাত একটা ছয় অবধি প্ল্যান্ট অপারেটর এবং কন্ট্রোল রুমের কর্মরত সকলেই নিশ্চিন্ত ছিল। স্বাভাবিক অবস্থার ১০০০ মেগা ওয়াটের চুল্লি তখন নামমাত্র ২০০ মেগাওয়াটে দিব্যি চলিতেছে। কিন্তু অতিদ্রুত ঘুমন্ত দৈত্য জাগিয়া উঠিল। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে তীব্র স্টিমচাপে ভেসেল ফাটিয়া গেল। অতঃপর রিয়্যাক্টর-কোর হইতে চারিপাশের আকাশে ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল অবাধ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। সকল ঘুমন্ত কাকপক্ষীর অগোচরে রেডিয়েশন ক্রমশ ধাবিত হইতে থাকিল সোভিয়েত হইতে ইউরোপের অন্য অন্য দেশে।
অকুস্থল হইতে আনুমানিক পাঁচ হাজার আটশো কিমি দূরে দক্ষিণবাংলার শহর ও গ্রাম তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু পরেই হইবে ভোর। চুল্লি-ভেসেল ফাটিবার সময় দক্ষিণবঙ্গের এক জেলাশহরে নিদ্রাচ্ছন্ন সত্যটিয়া নামক এক প্রৌঢ়ের নাক সম্ভবত রোজকার মতো ডাকিবার কথা। কিন্তু, স্থানীয় সময়, আনুমানিক, রাত একটায় সত্যমাধব ব্যানার্জি ওরফে সত্যটিয়া একটি বিচিত্র স্বপ্ন দেখিয়া ধড়ফড় করিয়া, শয্যাত্যাগ করিতে, মশারির মধ্যে উঠিয়া বসিলেন। এমনিতেই অসহ্য গরম পড়িয়াছিল। ঘুম ভাঙ্গিবার পর সত্যটিয়া সারারাত আর ঘুমাইতে পারিলেন না। কেবল ছটফট করিতে লাগিলেন।
চের্নোবিলের সঙ্গে জনৈক মধ্যবয়সি বাঙালি ব্যক্তির নাক ডাকা, স্বপ্ন দেখা, ঘুম ভাঙার সম্পর্ক কী? প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আদৌ থাকিতে পারে কি? না থাকিবারই ষোল আনা সম্ভাবনা। তাহলে কি ১৯৮৬ র প্রেক্ষাপট প্রতিষ্ঠা করিতেই হঠাৎ এই প্ৰক্ষিপ্ত, বেখাপ্পা কৌশল? দ্বিতীয় অভিযোগের সারবত্তা আপাতত মানিয়া লইলাম, প্রিয় পাঠক। শুধু বলি, ইহা অধুনাবিলুপ্ত যে আটানা, সেই সুদূর, বিস্মৃত, সচল আটানা যুগের আখ্যানসমূহের একটি। তবু, যে কোনো জায়গা হইতেই আখ্যান শুরু হইতে পারিত। ইহাতে, কাহিনি শেষ করার পর দেখিবেন, কিছুই যায় আসে না।
তথাপি, পরে চের্নোবিল জাতীয় অপ্রসঙ্গ আসিতেও পারে। নাও পারে। মূল কাহিনিতে ফিরি।
কীরূপে সত্যটিয়ার নাম সত্যটিয়া হইয়াছিল তাহা ময়না, তোতা ও অপরাপর তদন্তসাপেক্ষ এবং ইহা লইয়া সেকালের উঠতি স্বঘোষিত পণ্ডিতদের মধ্যে স্বাভাবিক মতবিরোধ ছিল। কিন্তু, পণ্ডিত তো লোকে এমনি এমনি হয় না, থানইঁটের ন্যায় কিলো দরের পুঁথি পড়িয়া, নিয়মিত শক্তি সংঘে মেপে ছোলা খাইয়া, লাগাতার মগজের এক্সারসাইজ করিতে হয়। কেন-না, জোর যার মুলুক তার। একদিন মগজের ছাতি কনফি-তে আপনি আপ ফুলিয়া ইঞ্চিতে ছাপান্ন হইয়া উঠে, সমূহ বাইসেপস, ট্রাইসেপস আয়নায় পরখিয়া রণে, জলে, জঙ্গলে হুহুঙ্কারে অবতীর্ণ হয় পণ্ডিতসকল। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও তখন হুক্কা ডাকে, বক দ্যাখায়; সেই যে আটানাযুগের সেকাল, তৎকালে কেহ কেহ এমতই মারিত মুখে জগৎ। উপরন্তু, খোরাকপ্রিয় কে যে কখন কাহার পক্ষ লইত বুঝিবার বিলকুল জো নাই। এই নীপ-নিধুবনে ছায়াবীথিতল ততটা আবশ্যিক নয়। যে কোনো স্থানে, বিবিধ ছুতায়, ক্রীড়াব্যাকুল, ইঙ্গিতপ্রিয় তালেবর দর্শককুল মধ্যে মধ্যে জিভের নীচে দু-আঙুল পুরিয়া অব্যর্থ সিটি দেয়, এ উহাকে তাতায়, ও ইহাকে কানে কুমন্তর ফুঁকে। রগড় জমিয়া উঠে। এ খেলায় কে যে কাহার প্রতিপক্ষ বোঝা ভার, বস্তুত সকলেই যেন এক একটি মূর্তিমান নারদ।
তথাপি এসকল অল্পধৈর্য পণ্ড-ইঁট হাঘরের দল বস্তুত জ্ঞানকিতাব বা তর্কশাস্ত্র সেকালে কতটা পড়িত সন্দেহ আছে। কেহ কেহ যাহা গিলিত তাহা বস্তুত ছাইপাঁশ প্রকৃতির। জ্ঞান অপেক্ষা সেসকল কিতাব ছিল লাও ঠেলা টাইপস বিচিত্র কিমাকার তথ্য ও ভ্যানতারা প্রযুক্তিতে ভরপুর ঠাসা। সে-যুগে যদিচ তদবধি তথ্যপ্রযুক্তির লাজবাব কারবার আসে নাই। সে ছিল নিদারুণ চারানা আটানার দরদামের যুগ। বাজারে হৈ হৈ করিয়া ব্রয়লার মুরগি ঢুকিয়া পড়িতেছে। আধখানা সেদ্ধ ডিম নিখুঁত দুই ভাগে ভাগ করিবার দিন চলিয়া গেল। সেই সোনা-যুগ রৌপ্যযুগ আসলে ছিল দুদ্দাড় ছাতে দৌড়াইয়া অহরহ অ্যান্টেনা ঘুরাইবার বিড়ম্বিত যুগ, সাড়ে তেত্রিশ আরপিএমে ঘূর্ণায়মান এইচ এম ভির ফিয়েস্তা-পপুলারযুগ, ফিল্টারবিহীন চার্মিনার তথা ক্যাপস্টান-সুখটান-যুগ, স্বপনকুমার ও ডায়না পামার যুগ, নাজিয়া হাসান তথা রুনা লায়লা যুগ। তখন বম্বের নাম ছিল না মুম্বই, সেহেতু, আর ডি বনশল ও ধ্যাবড়া ইস্টম্যান কালার সম্বলিত বাংলা ছবি সগৌরবে চলিত, কাস্টিং ও পোস্টারে দ্যাখা যাইত জয়শ্রী টি (বম্বে), প্রেমানারায়ণ (বম্বে)। বম্বে এইরূপে বঙ্গের অনুষঙ্গে প্রথম ব্র্যাকেটে বিরাজ করিত ও গুচ্ছের দর্শক টানিত। ‘শত্রু’ করিয়া অঞ্জন চৌধুরী মাইলস্টোন পুঁতিয়াছেন, তা তা থৈ তাথৈ নাচিয়া শ্রীমতী বম্বে লিপস্টিক-সিক্ত ওষ্ঠে লিপ দিতেছেন: নকশা কোরো না, সোজা কথায় প্রেম করে যাও, নকশা কোরো না। স্থানীয় এমএলএ বেশী মনোজ মিত্র পেয়ালায় দিতেছেন আয়েশি চুমুক। টালিগঞ্জে উত্তম-শূন্যতা। ফাঁকা মাঠে অবিরত গোল দিতেছেন পানতুয়া মার্কা তাপস পাল ও ফাটুস চিরঞ্জিত। বুম্বার স্ট্রাগল চলিতেছে। তখনও বুম্বা মানে ইন্ডাস্ট্রি একথা বলার সময় আদৌ আসে নাই।
যুগের হুজুগ-নজরুল নিতান্ত ক্যাওড়া প্রকৃতির সেই সকল আলালের ঘরের দুলালের তালমিছরি, প্রকৃত প্রস্তাবে, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল গোছের অকালপক্ক গোঠরাখাল; কেবল বাঁশিটি হাতে নাই। আসলে কূট মেধা চর্চা নয়, তাহারা কুমীর তোর জলকে নেমেছি খেলিত। মাঝেমধ্যে বড়োজোর আব্বুলিশ মারিত। তাদের ধারণা তাহারা ইমরান খানের ন্যায় ক্যালিবার ধরে। এই সকল ইনকরিজিবল বাওয়ালবাজ দণ্ডবায়স আসলে নিছক অবান্তর কাকতাড়ুয়া বৈ কিছু নয়। তাহারা জেলাশহরের মাঠে ঘাটে ধেনু চড়ায়, অহেতুক দুদম্বা ফাটায়, অকারণ কোমর হেলায়। সকলের একটি করিয়া বাহন, হিরো বা হারকিউলিস, অভাবে এভন, তাই দিয়া লাগু থাকে শহরটহল। কিন্তু, বারণ, কাহারও কেউ শুনে না। এসকল দেখিয়া শুনিয়া অনেকেরই গা-পিত্তি জ্বলে। এই অনেকের প্রকৃত নাম পুরাতনপন্থী। সনাতন ধ্যানধারণায় দুরারোগ্য বাউন্সারজখম লইয়া তাঁহারা বাউন্ডারি লাইনের বাইরে আহত ও অবসৃত হইয়া চোখ পিট পিট করিতেন; বিষণ্ন তাঁহারা কী আর করিবেন, গাভীর ন্যায় অলস অপরাহ্ণবেলায় জাবর কাটেন: আমাদের সময় কী ছিল সব, আর দ্যাখো এখন, সকলই গোল্লায় গেল। যত্ত সব! অতঃপর হাই তোলেন। বিকাল ফুরাইয়া যায়; সব পাখি, সব নদী, এমনকি সব হাতি, সব তিমি…সকল কিসিমের হাঁসজারু নীড়ে ফেরে। মুখোমুখি বসিবার, হায়রে, না আছে বনলতা, না আছে মুনমুন; আছে শুধু ধু-ধু অন্ধকার।
(ক্রমশ)
খানিক রম্য । পরের ইস্যু র জন্য opekkha ।
Khub bhalo hoyeche
পরেরটার অপেক্ষায় রইলাম।
সবে তো শুরু! দ্যাখা যাক খেলা কেমন জমে। ভাষাটা অন্যরকম স্বাদ আনছে।
অতঃপ…..
Darun👌
আকর্ষণীয়