যত্ন – শুভ্র মৈত্র

শেয়ার করুন

একটা শান্ত নিরিবিলিমুখ। আর সেটা নিয়েই কথা বলে মানুষটি। মুখের চামড়ায় যতগুলি ভাঁজ আছে, তার সংখ্যাও বাড়ে না। যেন বারের পুজোর পাঁচালি পড়ছে। ওই মুখেই বলে যায়, রাধানগরের যদুমাধবের ঘরে আর কিছু না থাকলেও যত্ন আছে। এই যেমন পুকুরে ডুব দিতে যাওয়ার আগে তেলচিটে গামছাটা হাতের কাছেই পায়, সদাই হাটে বোষ্টুমীর কাছ থেকে নিয়ে আসা পালং শাক ভাতের পাতে গড়িয়ে পড়ার আগে সাথে করে বড়ি আর বেগুন’কে জুটিয়ে নেয়, সন্ধ্যা লাগলে ঘরে শাঁখ বাজে, ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরলে জলের মালসাটাও। তা এই যত্নটুকুই তো, নইলে যদু বাঁচে কী নিয়ে।

মানুষটি বলে চলে। মুখের চামড়ায় একটুও ভাঁজ পরে না। সে না বললে কে আর জানতো যদু’র ঘরে অমন ধুলো পড়া আমগাছের মতো একটা বউ আছে, যত বয়সের ঘসা খায় তত ভেতরের সবুজটা বেরিয়ে আসে। যদুর যৌবনে সে বউয়েরও যৌবন ছিল, সে তখনও কালো’র মা হয় নি। সোহাগ করে ছ্যাকরা গলায় যদু ‘শুনছো’ ডাকলেই ঘোমটা নামাতো সরলা। তারপর সে ঘোমটা সরে গেল, রাতে শোয়ার পরে হুজ্জোতি বন্ধ হলো, মাজার ব্যাথাটা বাড়লে খোঁজ নিতে হয় আজ পুর্ণিমা কটায় ছাড়বে; কিন্তু যত্নটা রয়ে গেল।

কালো যখন গায়ে গতরে পুরো দস্তুর কাজল হয়ে ওঠে, তখন যদুমাধব তাকে মাঠেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ধুলো মাটিতে জল পরে কাদা হলে গন্ধ ওঠে গরম ভাতের। তা কাজলের থ্যাবড়া নাক পেলই না সেসব বাস, সে উঠলো গিয়ে দিল্লীর ট্রেনে। যদু’র দৌড় সদাই হাটের গা চুঁইয়ে বড় রাস্তায় জয়তারা বাসধরে টাউন যাওয়া পর্যন্ত। বউয়ের পেটের ছবি করতে গেছিল সেবার। দিল্লী’র মানে বুঝলো কবে। তাই কাজল যেদিন দুপুর দুপুর লাল রঙের ব্যাগের ভিতর জামা আর সরলার বানানো মুড়ির মোয়া ঢুকিয়ে নিয়ে টাউনের বাস ধরতে গেল, আর সরলা ওই রোগা পানা তুলসী গাছের নিচেই গড় করলো, যদু বলতেও পারে নি কিছু, আসলে কী বলতে হয় তাই জানত না ও। শুধু কালো ওর হাতে যে টাকা কয়টা তুলে দিয়েছিল তা দেখে ভেবেছিল এবারের হাটে একটা সবুজ শাড়ি কিনে আনবে সরলার জন্য। ওই বিয়ের পর যেমন পরতো। দফাদার নাকি অ্যাডভান্স দিয়েছে, কাজে যাওয়ার আগে তেমন দেওয়াই নাকি রীতি। যদু খানিক তাকিয়েছিল। ওদের জমির দিনের কাজ শেষ না হলে তো মল্লিক বাড়ির কর্তা কখনও পয়সা ছোঁয়ায় না। যদু মনে মনে গড় করে নতুন মালিককে। নাহ, যত্ন আছে মানতেই হয়। সেই রাতেও সরলা ওর জন্য কাওন সিদ্ধর সাথে একটা লঙ্কা দিয়েছিল বটে!

শুনেছিল দিল্লী, লোকটা বলে চলে। ওখানে নাকি মেলাই লোক, অনেক কাঁইকিচির। আর কাজও আছে বটে। বড় বড় দালান, মেলাই চওড়া রাস্তা, সেই আকাশ ছোঁয়া টাওয়ার—-সবেই নাকি কাজ। যদু শুনেছিল। আর কাজে হাত দিলেই মল্লিকবাড়ির বলদের শিঙের মতো তেল চুকচুক পয়সা। কালো বাড়ি ফেরার নাম করে না, মানে যদু যেমন রোজ বিহানে বাড়ি ফেরে তেমন না। সেসব জানলো যদু, শুধু জানতে পারে না, শচীন ঠাকুর যে বলেছিল উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শোয়া বারণ, কালো’র মনে আছে তো?

মানুষটির কথা শোনার জন্য ভীড় তেমন নেই। যারা আছে তারাও নেহাৎ সদাই হাটে সবজির ঝুরি নামিয়ে খানিক জিরেন চায় বলেই এই গাছের নীচে বসা। পাইকার হাঁক পাড়লেই উঠে যেতে হবে পাছার ধুলা ঝেড়ে। তাই মানুষটি বলে চলে খানিক ঘোরের মতো। ঠোঁটের দুই পাশে জমা কষ মোছার কোনও তাগিদও নেই। সে বলে চলে, এই রাধানগরের দোআঁশলা মাটির বাইরে যদু’র শুধু আরেকটা জগতের নাম জানা হলো। দিল্লী। এই দিল্লী নামটাই ঢের। কালোর ঠিকানা কেরালা না রাজস্থান নাকি হিমাচলের পাহাড়—-সেসব কথা যদু’র ঘাম সপসপ মাথা থেকে পিছলে যায় মহিষের পিঠ থেকে শ্রাবণের জলের মতো। যদু জানে ট্রেন, ট্রেন মানে দিল্লী। ওখানে মেলাই লোক। পতাকাও ওঠে। সে স্বাধীন হয় নিয়ম করে।

রোজ সকালে যদু’র ঘুম ভাঙে আগের মতোই। সেকেন্দারপুরের মসজিদের আজানের ডাকে। গেলবার পঞ্চায়েত থেকে করে দিয়েছে পায়খানা। সরলা যায় সেখানে। যদুর অবশ্য মাঠঘাটই ভালো। তা সেসব সেরে এসে রোজকার মতো গরুর জাবনা দেয়, তারপর মল্লিক বাড়ির ফটকে দাঁড়ায়। সরলা তার মধ্যেই অ্যালুমিনিয়াম বাটিতে পান্তা দেয়, সাথে মরিচ ভাজা। মাঝে একবার ঝালাই করে নেয়, মল্লিকদের কাছে একবার খোঁজ নেয় যেন, কালো’র কোনও সংবাদ এলো কিনা।সরলা সেই সবুজ শাড়িটা পরেছে। রাতেই পরেছে, বা হয়তো কাল। এই শাড়িটা পরেই গড় করেছে মঙ্গলচন্ডীর কাছে, কালো’র জন্য। যদু’র মনে পড়ে এই আঁচলেই ঘোমটা দিত। দিনের বেলার হাঘরে তাপে তো সব কিছু উবে যায়, এই সকালে রোদ এখনও নরম কিনা, তাই সরলাকে দেখে ভারী আহ্লাদ হয় যদুর।

কী এক ব্যারামের কথা বলাবলি করছিল হাটে, যদু’র কানেও এসেছে। ব্যারাম বলতে যদু তো পরান ডাক্তারকেই বোঝে, সে কিছু হদিশ করতে না পারলে টাউনে যেতে বলে। এ অবশ্য অন্য ব্যারাম। এ অসুখে ট্রেন বন্ধ হয়। কাজ কাম থাকে না। রাস্তায় নাকি লোকজনের দেখা মেলে না। মানে দেখা হলে ওদিকের হাটে মিনিকিটের দাম জিজ্ঞেস করা যায় না। রাধানগরে অবশ্য এ অসুখ নাই, সদাই হাটেও নাই। এখানে হাজা-খোস-পাঁচড়া’র ওষুধ বিক্রি হয়, ঘায়ের মলম মেলে, ইদুর মারার বিষ আর গেঁটে বাতের তেল। যদু’র কানে আসে, নতুন ব্যারামে মুখ ঢাকা লাগে। নাক-মুখ সব। সব কিছু ঢেকে রাখলে মানুষ খায় কীভাবে? বউ যখন কলাই ডালে কালো জিরা ফোঁড়ন দেয়, তারসুবাস এসে ধাক্কা দেবে না পরানটায়? সরলার কালোপানা মুখটাতে না’হয় মেচেতার দাগই পড়েছে, তা বলে ঢেকে রাখতে হবে? কী জানি বাপু। এমন অসুখ ওই রোডের ধারেই থাক!

লোকটির একটা নিরিবিলি মুখ আছে। সেই মুখে যা কিছু বলে তাতে কেউ প্রশ্ন করে না।সে বলে চলে, যদু সেদিনমালিকের বাড়িতে শুনে এসেছে, এ ব্যারাম রাধানগরে নাই বটে, তবে দিল্লীতে আছে। কালোও পড়েছে এই ব্যারামে। মানে ওই ট্রেণ বন্ধের ব্যারাম। কাজ কাম বন্ধের ব্যারাম। খুব গম্ভীর ছিল সেদিন বাবু, এসব খবর দেবার সময় নাকি গম্ভীর থাকাই নিয়ম। যদু তো ব্যারামে ভয় পায় নি পেয়েছিল বাবু’র গম্ভীর মুখেই। তাই জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় নি কিছু। নইলে যদু’র তো প্রথমেই মনে এসেছিল, কালো’র ছোটবেলায় নাক দিয়ে সিকনি গড়াতো, আর ওর মা ন্যাকড়া দিয়ে মুছিয়ে দিত। ভারি যত্ন ছিল সে মোছানোয়। এখন নিশ্চয়ই গড়ায় না, নাক-মুখ ঢাকা থাকলে তো মহা হাঙ্গামা।

মল্লিক বাড়ির ছোট ছেলে, যাকে ছোট মালিক বলার নিয়ম, তার বাপ-দাদার মতো চাষবাসে মন নেই। তা দোষের কী? কালোরও তো নেই। সেই ছোট মালিকের ফোনে নাকি মেলা নম্বর। দেশ বিদেশ, সব জায়গায় নাকি ফোন করে। আর লোক পাঠায়। বড় মালিক যেমন নিজেই মুনিষ খাটায়, তেমন না, ছোট্মালিক পাঠায় অন্যের কাছে। দিল্লীতে। দিল্লী নাকি কে জানে! কিন্তু ওই যে যদু’র কাছে সবই দিল্লী। যদু জেনেছিল সেদিন, যেদিন কালো বলেছিল দিল্লী যাওয়ার কথা। সে রাতে অবশ্য কাঁকড়ার ঝোল রেঁধেছিল সরলা, সানকি খালি করে বাপ-ব্যাটা দুজনেই চোরা চোখে তাকিয়েছিল হাঁড়ির দিকে।

লোকটির ওই পাঁচালি পরা মুখ থেকেই সামনে বসে থাকা মানুষগুলি জানতে পারে, ট্রেনের ব্যারাম নাকি সেরে গেছে। এখন আবার ছুটছে এদিক সেদিক। দিল্লীতেও। কিন্তু কালো যে আসার নাম করে না। যদু’র মাথায় ঢোকে না, ট্রে্ন কী বেছে বেছে লোক নিয়ে আসে! রাধানগরের মানুষকে চাপতে দেয় না? নাকি কালোর খেয়াল নেই, এই সামনের অমাবস্যার পরেই ভাদ্র এসে দাওয়ায় দাঁড়াবে? তখন তো চলাফেরা বারণ।

যদু অবশ্য মনে করে রেখেছিল সেদিন। তারপরেও কয়েকদিন। শুধাতে হবে ছোট মালিককে। কালোর হালচাল ছোটবাবুই জানে। সরলা জিজ্ঞেস করে কবে আসবে, মানতও করে থানে। অবশ্য সেসব কথা বলা চলে না ছোটবাবুকে। ওর যা দাপট! শুধু সুযোগ পেলে একবার মনে করে দিতে হবে, মনসার পরে ঝুলন আর তারপরেই ভাদ্র।

তা সুযোগ পাওয়াই দিগদারি। সকাল সকাল যদু যখন মল্লিক বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়ায়, ছোটবাবু নাকি ঘুম থেকেই ওঠে না। যদু ভাবে একবার বলে দেখবে, পশ্চিমের জানালা খুলে রাখলেই আজানের শব্দ কানে আসে, ঘুম ভেঙ্গে যাবে। বলার সুযোগ পায় না। সুযোগ পেলে অবশ্য কালোর সংবাদই জানতে হবে আগে, সরলার মুখটা মনে থাকে।

লোকটার কাহিনীতে সবার মন থাকে না। থাকবেই বা কেন? শ্রাবণের আকাশে কোনও ভরসা আছে? যখন তখন ঝাঁপ মেরে আসে বৃষ্টি, তখন সব্জির ডালি না মাথা কোনটা আগে বাঁচাবে, সে চিন্তা করবে না পাছায় কাদা মেখে কিস্যা শুনবে! তবু সে বলেই চলে, যেন গল্পের ভর উঠেছে তার, পাখির পায়ের দাগ ওর মুখে যে মানচিত্র এঁকেছে,তার সীমান্ত রেখা বেয়েই উঠে আসে যদুমাধবের কাহিনী।

যদু শেষমেশ দেখা পেল ছোটবাবুর। দেখা কী আর পেত? সেদিন ছোটবাবু নিজেই দেখা দিলেন জমির ধারে। সে বছর বর্ষা মুখ তুলেছে, তাই জমিতে কাজের ফাঁকে ফুরসৎ মেলে না। তার মাঝেই যদু’র চোখে পড়ল ছোটবাবু তার শিউলি ফুলের মতো বেটিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। হাতের কাজ ফেলে রেখেই ছুট লাগিয়েছিল যদু। হাতেরা কাদা লুঙ্গিতে ঘসে ঘসে ওঠে না, দাঁড়ায় গিয়ে বাবু’র কাছে।

—পেন্নাম কত্তা, তা বাবু হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন? তা ভালো তা ভালো, বেটিরানির গায়ে খানিক বাতাস লাগবে। মা মনসার আশীর্বাদ। শ্রাবণ মাস তো দয়ার মাস… কী যে বলে যাচ্ছিল যদু’র নিজেরও খেয়াল নেই। ছোটবাবুর কুঁচকে যাওয়া চোখ দেখেই ঠাহর হয়, অন্য কিছু বলার ছিল
—তা বাবু, কালোর কোনও সংবাদ…
এতক্ষনে বুঝি ছোটবাবুও বোঝে, যদু কী বলতে চায়। বড় বড় মানুষরা সব বুঝে নেয় ওদের মনের কথা। যদু জানে।
—কালোর খবর আবার কী? আছে দিল্লীতে। এখন কাজ নেই। হবে।
—-না মানে, ওর মা বলছিল ভাদ্র মাস এসে গেল…
—-আরে বাবা, টাকা শোধ না হলে কী করে আসবে?
—-টাকা?
—-কেন? অ্যাডভান্স নেয় নি কাজল? কাজ করেই তো শুধতে হবে, নাকি? —ছোটবাবু এগিয়ে চলে, বেটিকে দেখায়, ‘ওই দ্যাখো বক, ইংরাজীতে কী বলে…?’

যদু দাঁড়িয়ে থাকে আলে।ঠিকই তো, গতরে খেটে শুধতে হয় টাকা। হাতে পায়ে খাটতে হয়। গতর’তো কবেই মল্লিক বাড়িতে বাঁধা দেওয়া। ওর, কালোর, সবার। টাকা না শুধে বাড়ি ফিরলে হয়? নাহ, সরলাকে বলা যাবে না। মেয়েছেলের বুদ্ধি! অ্যাডভান্স এর কথা মাথাতেই নেই। ওই টাকাতেই তো সরলার সবুজ শাড়িটা। কী সুন্দর মানায় ওকে!
লোকটির মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। যেন যদুমাধবের কাহিনীর শেষটা লেখাই হয় নি, এ শুধু চলার গল্প, খুঁড়িয়ে, ঠোক্কর খেয়ে, টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েও আবার ধুলো ঝেড়ে চলা। সামনে বসে থাকা মানুষগুলির মধ্যেও কোনও উসখুস ভাব নেই। ওরা শোনে সেদিন যদু’র অ্যালুমিনিয়াম বাটিতে পান্তার সাথে সরলা দুই ফোঁটা কাসুন্দি ঢেলেছিল। আহ। যে গতরটা ওর না, মল্লিকের দুয়ারে বাঁধা— তাকেও কত যত্ন করে যদু’র বউ!

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *