|

গভীর অরণ্যের হরিণ  – নীলকমল ব্রহ্ম অনুবাদ: তপন মহন্ত

শেয়ার করুন

[নীলকমল ব্রহ্ম (১৯৪৪-১৯৯৯) বোড়ো সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক ছোটোগল্প রচয়িতা নীল কমল ব্রহ্ম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একজন শক্তিমান কবিও। বোড়ো সমাজে তিনি সাহিত্য সম্রাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর বাস্তবধর্মী ছোটোগল্পের চরিত্রগুলি চিন্তায় চেতনায় নতুন যুগের প্রতিনিধি। সহজ সরল গ্রাম্য মহিলা থেকে শুরু করে সুশিক্ষিত অত্যাধুনিক মহিলা, নারী শরীরের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অতি অহংকারী মহিলা-সমাজের সব ধরনের নারীর বহুমুখী চরিত্র চিত্রণে পারদর্শী সাহিত্য সম্রাট। নারীবাদী ভাবনার নির্যাসে রচিত ‘হাগ্রা গুদুনি মই’ (গভীর অরণ্যের মৃগ) গল্প সংকলনটি তাঁর উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের নিদর্শন। গল্পটির বিভিন্ন চরিত্রের চিন্তা চেতনায় ফুটে উঠেছে আধুনিকতা। ‘সিরিনায় মান্দার’ (ঝরা মাদার ফুল)। গল্পের নারী চরিত্র বালেঙ্গশ্রী বর্তমান সমাজের শহুরে আবহাওয়ায় প্রতিপালিত লোভী মেয়ে বৈবাহিক জীবনেও অবৈধ সম্পর্ক রেখে শেষে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে তুলনা করেছে ঝড়ে পড়া মাদার ফুলের সাথে। সামাজিক গল্প ছাড়াও নীলকমল ব্রহ্ম রাজনৈতিক গল্পও লিখেছেন। ‘সিলিংখার’ (নিঃশেষিত) পুস্তকের ‘বুলি’ গল্পে লেখক বোড়োদের রাজনৈতিক সংকটকে তুলে ধরেছেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র চিত্রণ, শব্দ চয়নে নীলকমল ব্রহ্ম সুদক্ষ। তাঁর গল্পে গতানুগতিক রক্ষণশীল বোড়ো সমাজের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে এক মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল আধুনিক বোড়ো সমাজ। শহরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে প্রাচীন মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য বোড়ো সমাজ থেকে ক্রমশ অপসৃত হয়ে এক শিক্ষিত ভোগবাদী  সমাজ ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে, এই চরম সত্যটি লেখকের শক্তিশালী কলমে উঠে এসেছে। ১৯৮৬ সালে রজত কমল পুরস্কারে সম্মানিত বোড়ো চলচ্চিত্র “আলয়ারন”-এর তিনি চিত্রনাট্যকার।] 


“এতক্ষণে নিশ্চয় গল্পটা পড়ে শেষ করেছে শর্মিলা। ম্যাগাজিন খুব পছন্দ করে সে! নতুন ম্যাগাজিন হাতে পেলেই খাওয়া ঘুম সব ভুলে যায়! আমি ভেবে কূল পাই না, আসলে ওর মনে কী আছে?”
ওর কথা ভেবে এইমাত্র ইস্ত্রি করা কুর্তাটা পরে সত্যপ্রিয়। ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য সামনে পেছনে তাকায়। কুর্তা পরার সময় তার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবার চুল আঁচড়ায় আর মুখটা ভালো ভাবে দেখে নেয়। জামাকাপড় পরে, সে তার রুমালে সম্প্রতি কেনা ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ সেন্টটি স্প্রে করে রুমালটি তার স্বচ্ছ কুর্তার পকেটে রাখে।
এখন সত্যপ্রিয় ভাবে, “আমি কি কিছু ভুলে গেছি?” সে গতকাল পাওয়া ‘ওরোর্নি লাইজাম’ পত্রিকার পাতা ওলটায়। “শর্মিলা কি পত্রিকার বিষয়বস্তু বুঝতে পেরেছে? না বুঝে থাকলে  আজ আমাকেই বোঝাতে হবে।”
“সত্যপ্রিয়র গল্পগুলি বোড়ো সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন পথ খুলে দিয়েছে৷ সত্যপ্রিয় দেখিয়েছেন কীভাবে বোড়ো ভাষার মাধ্যমেও বোড়ো সম্প্রদায়ের ওপর ভালো গল্প লেখা যায় এবং কীভাবে এই গল্পগুলি অন্যান্য সাহিত্যের সেরা গল্পগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই৷”
“সত্যপ্রিয়র গল্প পড়ে আমরা অনুভব করি যে আমরাও সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছি। আমরা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।”
“সত্যপ্রিয়র গল্পে আমরা প্লট, চরিত্র চিত্রায়ন, উপস্থাপনার নতুন শৈলী এবং কৌশল খুঁজে পাই যা আজ পর্যন্ত আমরা বোড়ো সাহিত্যের কোনো লেখকের লেখায় পাইনি। তাকে বোড়ো সাহিত্যের মপাসাঁ বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।”
“শর্মিলা কি এই মন্তব্যগুলো পড়েছে?” সত্যপ্রিয় ভাবে। 
“আমি ভাবছি, শর্মিলার মন্তব্যটি কী হবে? তার কিছু বলার তো থাকবেই। আপনার গল্পে আপনি কেবল মহিলাদেরই মূর্খ এবং অনুগত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং অন্য উপজাতির পুরুষের সাথে বিয়ে করিয়েছেন। আপনি বোড়ো মহিলাদের ইংরেজি বলতে শোনেননি বা তাদের স্লিভলেস ব্লাউজে দেখেননি। অথবা আপনি হয়তো দেখেও উদাসীন থেকেছেন।”
সত্যপ্রিয়র একটু ভালো লাগতে শুরু করে। শর্মিলা ভাবে সবাই তার মতো। একটি শহরে বড়ো হয়ে ওঠায় সে নিজেকে জ্ঞানী বলে মনে করে এবং গ্রামের লোকদেরও একই রকম ভাবে। শর্মিলা কল্পনাও করতে পারে না যে গ্রামে এখনও এমন মহিলা আছেন যাদের পায়ে চপ্পল নেই। আমাদের গ্রামের মহিলারা এখনও বস্তায় পা মোছে, ব্লাউজ পরলে সুড়সুড়ি লাগে। গ্রামগুলিত এখনও অনেক মহিলা পাবেন যারা লিপস্টিক এবং ক্রিম ব্যবহার করেন না।
এসব সত্যপ্রিয়র ভাবনা। সত্যপ্রিয় এই পথেই এগোবে। শর্মিলা তর্ক করলে, সত্যপ্রিয় এইসব কথাই বলবে।সত্যপ্রিয় শর্মিলাকে একটু ভয় পায়। ঝগড়া হলে মাঝে মাঝে শর্মিলার মুখ থেকে অপ্রীতিকর কথা বেরোয়। শর্মিলা যখন রেগে যায়, তখন সে স্থান-কাল মানে না।
দেখুন শর্মিলা পরশু কী করল? সত্যপ্রিয় এটা ভাবতেও লজ্জা পায়।
ওদের কথোপকথনের মাঝখানে সত্যপ্রিয় বলেছিল, “যখন আপনি স্লিভলেস ব্লাউজ আর মিনি স্কার্ট পরেন তখন আমার মনে হয় আমরা আদম এবং ইভের যুগে ফিরে যাচ্ছি। আমরা যত বেশি সভ্য হচ্ছি আমরা তত বেশি বর্বর হয়ে যাচ্ছি।”
সত্যপ্রিয়র এই কথাগুলো শোনামাত্রই শর্মিলা প্রতিবাদ করে, “আমরা যা পরি বা যা পছন্দ করি না কেন, তা আপনাকে কেন বিরক্ত করবে? আপনি যদি আমাদের স্লিভলেস ব্লাউজ আর টপসে দেখতে পছন্দ না করেন তবে আপনি আপনার চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন… আপনি…”
শর্মিলার আরও কিছু বলার ছিল কিন্তু তখনই ঊর্মিলা চা পরিবেশন করতে আসে। সত্যপ্রিয় এখন ভাবে, শর্মিলা আরও যেন কী বলতে চেয়েছিল! সেদিন সত্যপ্রিয় যেন মৌচাকে ঢিল মেরেছিল। আর শর্মিলা তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল, সত্যপ্রিয় শর্মিলার সামনে আর কখনও এ জাতীয় প্রসঙ্গ তোলেনি। সেদিন শর্মিলার নিশ্চয়ই কিছু একটা নিয়ে মনখারাপ হয়েছিল, সত্যপ্রিয় তা জানত না। শর্মিলা চা খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত ফিল্ম দেখতে। শর্মিলার সবসময় সন্ধ্যায় কোনো না কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকেই। যদি কেউ তাড়াতাড়ি না যায় তবে তার সাথে দেখা করা কঠিন।
সত্যপ্রিয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বাইরে বেরোয়। উদ্দেশ্য ছিল শর্মিলার বাসায় যাওয়া। সে অনেকদিন তাদের বাসায় যায়নি। সম্ভবত, দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে। এর মধ্যে উর্মিলা ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পরশু পথে তার সাথে দেখা হলে সে তাদের সাথে দেখা না করার জন্য তাকে মৃদু অভিযোগ করেছিল।সত্যপ্রিয় ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে। সে অবাক হয়, শর্মিলার সাথে কখন তার এত বন্ধুত্ব হল যে সে তার সাথে ঝগড়াও করতে পারে! তার বাবা, ঠিকাদার খাঁথাল মহাজন সত্যপ্রিয়র সাথে তার ছোটোবোন ঊর্মিলার শিক্ষকতার জন্য যোগাযোগ করেছিলেন। সত্যপ্রিয় ঊর্মিলার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এভাবেই সে শর্মিলার সাথে তার পরিচয় হয়।
শর্মিলা বিএ পাশ করে আর কিছুই করেনি। সে শুধু বাড়িতেই বসে থাকে। যদিও তার বাবা খুব ধনী ছিলেন কিন্তু শর্মিলার এমএ করার ইচ্ছে ছিল না। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, “কেউ বিএ পাশ করা কাউকে বিয়ে করার সাহস করে না! আর আপনি এমএ করার কথা বলছেন! আমি যদি এমএ করতে যাই লোকে আমাকে ‘মা’ বলে ডাকবে!”“বিয়েই কি একটি নারীর চূড়ান্ত লক্ষ্য?”
“আমাদের সমাজে সেটাই হয়।”“মানে?”“মানে, আপনার সমাজে, আপনার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এমন কাউকে খুঁজছেন যে ধান বুনতে পারে, মাছ ধরতে পারে, গোবর ফেলতে পারে এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করতে পারে। তারা নবম বা দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত কাউকে বিএ বা এমএ পাশ করার চেয়ে বেশি পছন্দ করে। তাই মেয়েরা চাইলেও লেখাপড়া করে না।”“না, আমি তা বলছি না। আমি যা বলেছিলাম তা হল মেয়েরা কি বিয়ে না করে থাকতে পারে না?”“মেয়েরা যদি আজ সংসদে একটি রেগুলেশন পাশ করে যে তারা বিয়ে করতে চায় না, তাহলে পুরুষেরা আপত্তি করবে, নাকি করবে না?”“না, তাঁরা পারবেন না যদি তাঁদের শর্মিলার সাথে তর্ক করতে হয়।” সেদিন সত্যপ্রিয়কে চুপ থাকতে হয়েছিল। অপ্রয়োজনীয় কথা বলে তর্ক করতে গিয়ে তাকে হেয় করা শর্মিলার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই তার সাথে তর্ক করার সময় তাকে দু’বার ভাবতে হয়। কেউ জানে না পরমুহূর্তে সে কী বলে ফেলবে।
কেউ তৃষ্ণার্ত না হলেও বিশুদ্ধ জল দেখলেই পান করতে ইচ্ছে হয়। এটা ঠিক নয় যে সত্যপ্রিয় তৃষ্ণার্ত ছিল না। সে ছিল। কিন্তু সে কখনও শর্মিলার সামনে তা স্বীকার করতে সক্ষম হয়নি। শর্মিলা তাকে কখনও কথা বলার সুযোগ দেয়নি। সত্যপ্রিয় মনে মনে একটু ভয় পেয়ে যায়। বয়সে সে তার থেকে বড়ো হলেও সে শর্মিলার চেয়ে বেশি জানে এমনটা তার মনে হয়নি। তবুও, সত্যপ্রিয় আশা রাখে শর্মিলাকে পাবার, তার ভালোবাসা এবং সংস্পর্শ লাভ করার।
তার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য সে ‘ওরোর্নি লাইজাম’ পত্রিকায়, যে পত্রিকাটি শর্মিলা পড়তে পছন্দ করে, একটি গল্প লিখেছিল। এমনকি শর্নিলাকে ইম্প্রেস করার জন্য সে তার বন্ধুদের দিয়ে ‘ওরোর্নি লাইজাম-এ তার গল্প সম্পর্কে একটি সপ্রশংস রিভিউ ছাপিয়েছিল।এটা বিজ্ঞাপনের যুগ। কেউ যদি নিজের বিজ্ঞাপন নিজে না করে, কেউ তার দিকে তাকাবে না। সত্যপ্রিয় বলত, “যদি কেউ প্রকাশ্যে কোন্‌টি ভালো তা নিয়ে বিজ্ঞাপন না দেয় তবে কেউ তাকে জানবে না। তার সমস্ত প্রতিভা, উপহার এবং জ্ঞান নষ্ট হয়ে যাবে—কেউ তাকে জানবে না, তার মূল্য দেবে না বা তার কথা শুনবে না।” এই কারণেই সত্যপ্রিয় তার গল্পের মন্তব্যগুলি নিজেই লিখে তার বন্ধুদের নামে ছাপতে দিয়েছিল যা গতকালের ‘ওরোর্নি লাইজাম’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। “এই পৃথিবীতে সবাই যদি অসৎ উপায়ে বেঁচে থাকে তবে আমি কেন ব্যতিক্রম হব?”
সত্যপ্রিয় আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি শর্মিলা আসলে কী চায়। সে জানত না যে এমন কেউ আছে কিনা যাকে শর্মিলা গোপনে ভালোবাসে। তার জানার কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ শর্মিলা তাকে এসব কথা বলবে না।
কিন্তু এ কথা মানতেই হবে, শর্মিলার মনে কোনো কুটিল চিন্তা ছিল না। সে কাউকে অপছন্দ করতে পারে না। সে বেশ উদার এবং মানানসই। সে যাকে বিয়ে করবে তার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে। তাই শর্মিলাকে নিয়েই আশা পোষণ করে সত্যপ্রিয়। শর্মিলা এমন কেউ নয় যে সত্যপ্রিয়র জন্য লজ্জিত হবে শুধুমাত্র সে হাইস্কুলের একজন দরিদ্র শিক্ষক হওয়ার জন্য। যদিও শর্মিলা নিজেও সুশিক্ষিত তবু সে ভাগ্যে বিশ্বাস করে। শর্মিলা নিজেই একদিন বলেছিল, “যে নিজের ভাগ্যকে মেনে নেয় সে একজন মানুষ। কেউ যদি এমন কিছু পেতে চায় যা কেউ পেতে পারে না তবে তার দুঃখ আছে। আসলে কেউ কখনও দুঃখ পেতে চায় না এমনকি আমিও চাই না।” শর্মিলার যা ইচ্ছে তাই সে বলুক, আজ সত্যপ্রিয় বলার চেষ্টা করবে যে সে শর্মিলাকে ভালোবাসে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়।
হয়তো শর্মিলা তাকে মনে মনে ভালোবাসে? সে হয়তো বলতে পারেনি! সে কীভাবে বলবে? এটা কি সম্ভব নয় যে সে-ও এই বিষয়ে লাজুক হতে পারে? এর সাথে সাথে সম্মানের প্রশ্নটিও জড়িত। সে আর ছোটো মেয়েটি নেই যে অন্যদের সুরে সুর মেলাবে। কিন্তু কেন যে তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি সত্ত্বেও আজ অবধি সে তার প্রতি সত্যপ্রিয়র ভালোবাসার বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি, তাকে এত ভালো করে জানার পরেও, এটি সত্যপ্রিয় বুঝতে পারে না। এমনও হতে পারে যে সে সবই জানে? হতেই পারে। কিন্তু শর্মিলা এসব মুখ ফুটে বলার মতো কেউ নয়।“আমার ধারণা আমাকে বিষয়টা তুলে ধরতে হবে”, ভাবে সত্যপ্রিয়। সে ভাবে, কিছু না বলে আফসোস করার চেয়ে বলে ফেলে বিব্রত হওয়া ভালো। সে শুধু একবার বিব্রত হবে। কিন্তু তার মনটা কি হালকা হয়ে যাবে না?
এইরকম পরস্পর বিরোধী চিন্তা মাথায় নিয়ে সত্যপ্রিয় পৌঁছে গেল শর্মিলাদের উঠোনে। সেখানে ঊর্মিলার সাথে দেখা।“কী করছ ঊর্মিলা?”“আমি কিছু করছি না, স্যার।”“সবাই ভালো আছে তো?”“হ্যাঁ স্যার, সবাই ভালো আছেন। আপনি কেমন আছেন, স্যার?”“আমি ভালো আছি। তোমার বোন ধারেকাছে নেই?”“হ্যাঁ, সে আছে, ভেতরে।”ঊর্মিলা সত্যপ্রিয়কে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে বসতে বলে। সোফায় বসে সত্যপ্রিয় ঊর্মিলাকে তার বোন শর্মিলার সাথে তুলনা করতে থাকে। দুজনেই ফর্সা, দেখতে ভালো। কিন্তু তাদের চরিত্রে অনেক ফারাক। ঊর্মিলা নরম, শর্মিলার মতো শাণিত জিভ নেই তার। সে খুব নির্বোধ, সে ভালো-মন্দের পার্থক্য ধরতে পারে না। মাঝে মাঝে, সে এতই লজ্জা পায় যে খুব কম কথাই বেরোয় তার মুখ দিয়ে। কিন্তু শর্মিলা? সে বজ্র আর বিদ্যুৎ  উভয়েরই সংমিশ্রণ। সে যা অনুভব করে বিনা দ্বিধায় তা বলে ফেলে। সে লজ্জার মতো বিষয়গুলি নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে সবকিছুরই কারণ খোঁজে। তার কাছে ভালোটাও খারাপ হতে পারে আর খারাপটাও ভালো। সে কখনও কিছুতেই কারো কাছে কোনো বিষয়েই পরাজয় স্বীকার করবে না।
সত্যপ্রিয় যখন এই কথাগুলো ভাবছিল তখন শর্মিলা এসে বলে, “কী, মাস্টারবাবু, আজ আপনি এখানে কী মনে করে?”শর্মিলার গলা শুনে চমকে ওঠে সত্যপ্রিয়। কী বলবে ভাবতে ভাবতেই শর্মিলা আবার বলে, “আমি ভেবেছিলাম, মাস্টারবাবু আমাদের ভুলে গেছেন?”“ওহ, এটা কী আবার বলার কথা হল? আমরা মানুষ, একে অপরকে ভুলে গেলে আমাদের কে মানুষ বলে মনে রাখবে?”
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আপনি আমাদের মতো হতভাগাদের ভুলে যাননি!”“এটা কি আমার জন্য কিছু ইঙ্গিত করা হল?”“আপনি যদি তাই মনে করেন তাহলে এগোনো যাবে না। ঠিক আছে, আমি এটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। তাহলে কি কোনো প্রয়োজন?”“আমি কি কোথাও কোনো সাইনবোর্ড দেখছি যে তাতে লেখা আছে কোনো কাজ ছাড়া কেউ এই বাড়িতে আসতে পারে না?”“ওহ, বুঝলাম। ঊর্মিলা আমাকে বোকা বানিয়েছে। আপনি কি ঊর্মিলাকে জিজ্ঞেস করেননি, আমি কাছাকাছি আছি কিনা?”“হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞেস করেছি।”“তাই আমি কিছু জরুরি কথা আছে ভেবে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।”সত্যপ্রিয় ভেবেছিল বলবে, “হ্যাঁ, আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম, শর্মিলা। কিন্তু কীভাবে বলব! আপনি আমাকে কখনোই কিছু বলার সুযোগ দেন না।” কিন্তু, সে শুধু শর্মিলার দিকে তাকিয়েই থাকে। সত্যপ্রিয়র অনুভূতি তাকে দিশাহারা করে ফেলে। আসার পথে সে যা যা বলবে বলে ভেবে রেখেছিল তা এখন হঠাৎ শর্মিলার সামনে এসে খেই হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর শর্মিলা আবার বেরিয়ে যায়। হয়তো শর্মিলা তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকটা পছন্দ করেনি? ওহ সে চলে গেল! আবার কি সে ফিরে আসবে?
কিছুক্ষণ পর ঊর্মিলা সত্যপ্রিয়কে চা দিল। চা খাওয়ার সময় সত্যপ্রিয় ঊর্মিলাকে জিজ্ঞেস করে কলেজ কেমন চলছে, সে কোন্ বিষয় নিয়েছে ইত্যাদি। তারা যখন কথা বলছিল, তখন সত্যপ্রিয়র চোখ শেলফের ওপরে রাখা ‘ওরোর্নি লাইজাম’ পত্রিকায় পড়ে। একরাশ ভয় তাকে ঘিরে ফেলে। 
একসময় ঊর্মিলা কাপ-প্লেট নিয়ে চলে যায়। সত্যপ্রিয় নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ‘ওরোর্নি লাইজাম’ পত্রিকাটি পরখ করার জন্য সেল্ফের দিকে এগিয়ে যায়। সেটা দেখে তার মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। সে উৎকণ্ঠায় ভোগে। তার ভীষণ কান্না পায়। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
‘ওরোর্নি লাইজাম’ কেউ পড়েনি। পত্রিকাটি যেখানে যেমন রাখা ছিল ঠিক তেমনই সেখানে পড়ে আছে। এখনও পিন করা অবস্থায়। সত্যপ্রিয় ভাবে, “যদি এমইটাই হয় তবে এটা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়াই ভালো।”
রাগান্বিত, বিষণ্ণ ও লাজুক সত্যপ্রিয় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। ঠিক তখনই শর্মিলা সাজগোজ করে ড্রয়িংরুমে আসে। সত্যপ্রিয় অবাক হয় খুশিতে উদ্ভাসিত তার মুখ দেখে। হতবুদ্ধি সত্যপ্রিয় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
“মাস্টার বাবু, আপনি চলে যাচ্ছেন? আজ আমরা খুব কমই কথা বলতে পেরেছি। আমার এখন একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমাকে যেতে হবে। সময় এবং সুযোগ পেলে আমরা অন্য সময় কথা বলব।”
সত্যপ্রিয় চুপ করে ভাবে “কেন সে বলে দেয় না যে আজ থেকে আমার এখানে আসা উচিত নয়?” তখন ঊর্মিলা যদি না আসত তাহলে সে নিজেই বলে ফেলত। আসার সাথে সাথে ঊর্মিলা বলে, “স্যার, আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে—চিফ এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে, পিকে ল্যাংথাসার সাথে। পরশু রিং সেরিমনি। সময় পেলে, দয়া করে আসবেন, স্যার।”
এর মধ্যে শর্মিলা বলে ওঠে, “ওহ হ্যাঁ, সেকথা জানাতে আমি ভুলে গেছি। আর আমি এখনও ‘ওরোর্নি লাইজাম’ পড়িনি। যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানেই পড়ে আছে। আপনার কি নতুন কোনো নিবন্ধ আছে ওখানে?”
রাগান্বিত ও আহত সত্যপ্রিয় একবার ভাবে, বলবে, “না, আমার কোনো লেখা নেই, হে নির্বোধ!” অবশ্য সে তা বলতে পারে না, বরং বলে, “থাকতে পারে।” আর কিছু না বলে সত্যপ্রিয় বেরিয়ে আসে।
সোজা রাস্তাও আজ তার কাছে আঁকাবাঁকা মনে হচ্ছে। সে তার ছায়াকে শর্মিলার বলে ভুল করে আর তার নিজের বেকুবিতে নিজেই হতবাক হয়ে যায়। তার মনে হয় সে নিজে আর নিজের মধ্যে নেই। সত্যপ্রিয় বাড়িতে পৌঁছোনোর সময় তার সুগন্ধি ছিটানো রুমালটি ঘামে আর চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল।
সেই সময় শর্মিলা হয়তো ল্যাংথাসার কাঁধে মাথা রেখে হাসিতে ফেটে পড়ছিল সিনেমা হলে। সেটা সত্যপ্রিয়ও জানত না, আমরাও জানি না।

[ড. অঞ্জলি দৈমারি এবং ড. প্রণব জ্যোতি নার্জারি অনুদিত “A deer in a big forest”, গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন তপন মহন্ত।]

শেয়ার করুন

Similar Posts

One Comment

  1. খুব ভালো লাগল। এত সরল ভঙ্গি, এত বুদ্ধিদীপ্ত পরিবেশন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *