একটি লম্বা লাইন – জিললুর রহমান
একটি লম্বা লাইনে প্রভাতফেরিতে
দাঁড়িয়ে রয়েছি মধ্যরাতে একুশের অপেক্ষায়—
হাতে ফুল — নগ্ন পদ — শাদা পাঞ্জাবির সাথে ঢলঢলে পাজামা
একটি দীর্ঘ লাইন এক সুরে গুঞ্জন করছে
শীতল বাতাসে রোমকূপে শীতকাঁটা উঠে আছে
আমরা অপেক্ষমান সেই বায়ান্নোর ফেব্রুয়ারি থেকে
ওরা বলেছিল যাহা বাহান্ন তাহা তেপ্পান্ন
আমরা প্রতিবাদ করি
আমাদের মাতৃভূমে বায়ান্ন জুড়েই আছে
মাথা নত না করার দৃপ্ত স্বর
আছে শহিদের রক্তাক্ত শার্টের ’পরে বুলেটের পোড়া দাগ
আমরা সেই রক্তের স্রোতের থেকে ভেসে ওঠা ভাষার সন্তান
আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রভাতফেরির জন্যে অজস্র বছর ধরে
ফেব্রুয়ারি আমাদের সালাম বরকত জব্বারের রক্তে রাঙা মাস
আমরা যূথবদ্ধ হই এই বিষণ্ন মৌসুমে
কণ্ঠে তুলে নিই একটিমাত্র গান — ‘আমি কি ভুলিতে পারি’
ওরা বলেছিল ভুলে যেতে
বলেছিল প্রভুর ভাষায় লেখো গান,
বলেছে লিখতে কবিতা সেই বিজাতীয় ভাষার হরফে — এমনকি রবীন্দ্র
সঙ্গীত — বলেছে আমরা যেন নতুন করেই লিখে নিই
আমরা লিখিনি — আমরা বলিনি কথা প্রভুর ভাষায়
আমরা মৌন দাঁড়িয়ে বলি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’
পৃথিবীর প্রতি জনপদে সকলে মাতৃভাষায় যেন কথা কয়
এই যে বারোটা এক মিনিটের সাথে এসে যাচ্ছে নতুন দিবস
এর নাম ‘অমর একুশে’ — আমাদের দৃপ্ত পদচারণার
মিছিলের কোনো শুরু নেই
মিছিলের কোনো শেষ নেই
মানব মুক্তির এই মিছিলের আদি-অন্ত কখনও থাকে না
আমাদের নগ্ন পদযাত্রা আজ শহিদ মিনারে ধাবমান
হাতে ফুল, কণ্ঠে গান — ‘আমার ভায়ের রক্তে…’
মিছিল চলেছে সারা বিশ্বময় — ভাষা কিংবা মুক্তি—
মানুষের অধিকার আদায়ের এই নম্র নীরব মিছিল—
আমার শরীরে শীত — আমার হৃদয়ে রক্তপাত
আমাদের ঠোঁটে শব্দ — প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ—
ওরা বলেছিল থেমে যেতে
বলেছিল শহিদ মিনারে ফুল দেয়া গর্হিত ভীষণ
ওরা পূজা ও স্মরণ একাকার করে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে
আমরা কবিতা কণ্ঠে তুলে যূথবদ্ধ হই
অনন্ত আলোকবর্ষ আমাদের মিছিলের ফুল
নগ্ন পায়ের লাইন হেঁটে চলে
হাঁটতে থাকে একুশের সূর্যোদয় থেকে
কৃষকের সংগ্রামের পথে — মুক্তির ও মানুষের পথে
ব্ল্যাক হোল থেকে ফোটনের উজ্জ্বল উৎসারণে