আদিম হিংস্র মানবতার আমি – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

আদিম হিংস্র মানবতার আমি – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

আদিম হিংস্র মানবতার আমি যদি কেউ হই… স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই…

সেদিন মারা যেতে পারতাম আমিও। জ্ঞানহীন অচেতন দশা থেকে সাংবাদিক বন্ধু খুঁজে না বার করলে আমারও দশা হতে পারত মইদুল অথবা আর কারোর মতোই। ‘আমি আর বাঁচবুনি’ স্লোগানটাই সত্য হয়ে গেল। রাস্তায় পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিল মইদুল। সেই মইদুল অথবা তার মতো আরো অনেকেই। মিছিলে এসে আর ঘরে ফিরে যায়নি পাঁশকুড়ার দীপক পাঁজা অথবা মাথা দিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত বেরোচ্ছিল যে ছেলেটির অথবা যে মেয়েটিকে কব্জির কাছ থেকে টানছিলো উর্দিধারী পুলিশ এদের সকলের জন্যই একটাই প্রশ্ন — এগুলো ঠিক কোন পুলিশি আইনের পথ ধরে চলে? নবান্ন অভিযানে অংশ নেওয়া ডিওয়াইএফআই কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যু নিয়ে রাজ্য জুড়ে তীব্র ক্ষোভ শুরু হয়েছে। বামেদের অভিযোগ পুলিশ খুন করেছে। তাদের লাঠির ঘায়েই মৃত্যু হয়েছে জখম মইদুলের। যদিও রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ পেয়েছেন বলে জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, প্রয়োজনে মৃত বাম কর্মী মইদুলের পরিবারের যে কোনও সদস্যকে চাকরি ও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। ডিওয়াইএফআই কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যু নিয়ে এদিন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘ যেকোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। আমারও দুঃখ হয়েছে। চাইলে সরকারি চাকরি, আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে গরিব ছেলেটির পরিবারকে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন দুই মেয়ের বাপ মইদুল আদৌ যুব করার বয়সে আছেনকিনা। ডিওয়াইএফআই থেকে বলেছে মইদুল এর বয়স ৩২, পেশায় অটোচালক হলেও মইদুল মিদ্যা শিক্ষাগত যোগ্যতা গ্রাজুয়েট। এই আলাপচারিতা থেকে একটাই প্রশ্ন উঠে আসে একটি ছেলে বা একটি মেয়ে চাকরি চাইতে গেলে তাকে পুলিশ অথবা শাসকের পোষা গুন্ডাদের আক্রমণের মুখে পড়তে হবে কেন? প্রসঙ্গটি উঠে আসে ১১ ফেব্রুয়ারির একাধিক ছবিতে দেখা গেছে উর্দিহীন বাহিনীকে। আর রাষ্ট্রের পোষা রক্ষক বাহিনী কি সকলের জন্য শিক্ষা ও কাজের দাবিতে মিছিলে হাঁটা ছাত্র যুবদের মাথায় এমন মারতে পারে যাতে মাথার চারপাশ দিয়ে ঝরঝরিয়ে রক্ত ঝরে? বারবার মনে হচ্ছে শুধু মইদুল অথবা দীপক কেন আমি অথবা আমার মতো অনেকেই হাজার হাজার মিছিলে হাঁটা মানুষের একই দশা হতে পারত। মনে পড়ছে কলেজ স্কোয়ারে মিছিলের জমায়েতে দাঁড়িয়ে বলা ডলের কথাগুলো। ছোট্ট মেয়ে ডল, লড়িয়ে মায়ের একমাত্র কন্যা ডল বলছিল দেখবে মার খাবো আমরাই। অনেকেই বসে বসে টিভিতে বাইট দেবে। বাকিটা ডল জানতো না, এরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, এম এল এ, এম পি হবেন, তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মারবেন, দলবদলের রাজনীতি শুরু করবেন। প্রশ্ন ওঠে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও। একটা চুয়াত্তর বছরের স্বাধীনতা পাওয়া দেশে এখনও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরোনো একজন ছাত্র অথবা ছাত্রী বেকার থাকে কি করে? এই বেকার দের দিয়ে রাজনীতির সুবিধাবাদ গ্রহণ করা যাবে বলে? যে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের বলি হলো আজকের মইদুল মিদ্যা অথবা আরো অনেকেই। অথচ নির্বাচনের সময়ে দেখতে পাই রং বেরঙের সেলেবদের প্রার্থী করে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ চলে যাচ্ছে মসনদে। শুরু হলো মিছিল। রাজনীতির মারপ্যাঁচ, বিভিন্ন দলের ভালমন্দ এ সব বোঝেন না সুদীপ্তের দিদি। তবে এটা বোঝেন, ২০২১-এ দাঁড়িয়ে রাজনীতি ঢের জটিল হয়েছে। সুমিতা বলেন, “ভাইটা চলে যেতে সব দলের লোকই এসেছিল। অনেকে তো খুবই আসতেন! কে জানে, বিজেপি-র কেউ এসেছিল কি না! তখন তো ওরা প্রায় ছিল না।” ভাইয়ের মৃত্যুতে ‘বিচার’ না-পাওয়ার ক্ষত আর খোঁচাতে চান না সুমিতার দিদি। আর একটি পরিবার ধসিয়ে দেওয়া মৃত্যুর যন্ত্রণা তবু সেই জ্বালাই উসকে দেয়। মনে পড়ে যাচ্ছে কমরেড সৌতিক দাশের ফেসবুক ওয়াল এ পোস্ট করা সেই কবিতার লাইনগুলো —

আজ কৌশিক সেন কোনো দুর্দান্ত স্ক্রিপ্টের বক্তব্য রাখেনি,
আজ শ্রীজাত কোনো কবিতা লেখেনি
আজ অনির্বাণ ‘শাসক’ এর বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি
আজ সায়নি ঘোষ মইদুলকে নিয়ে কোনো টুইট বা ফেসবুকে পোস্ট করেনি,
আজ দেবলীনা রেগে যায়নি…
যদিও এগুলোর আশাও করিনা,
তবুও বলবো।…সাথী চিনুন ,কমরেড চিনুন।
এ লড়াই কোনো সেলেব্রিটির দুই লাইনের বাইটের
ওপর নির্ভর করেনা, নির্ভর করে এখনও দীনেশ
মজুমদার ভবনের সামনে, মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ওপরে।

আর একটু পর দেহ যাবে। গার্ড অফ অনার দেবে কমরেডরা। এই লড়াই চলবে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই কমরেডদের চিনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হলো মইদুলের শহীদ হওয়ার মধ্যে দিয়ে। এই আহ্বান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় বধির হয়ে যাওয়া কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে তবেই এ লেখার শিরোনাম যথার্থ হবে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২