একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ১ )

একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ১ )

শেয়ার করুন

 

এক

তোমার শিকড়ে তো গান্ধি-পরিবার ঢুকে আছে হে! তোমার মজ্জায় মজ্জায় কংগ্রেসি সুবাস। তুমি কেন মেহনতি মানুষের কথা জানতে চাইছ, হে ছোকরা?

ভোলাইয়ের কাছে গিয়ে যখন দাঁড়াল শুভাশিস তখনও আলো আছে আকাশে। এই যে সে এখানে এল, তার আগে বিস্তর ভেবেছে সে তার আসা না-আসার বিষয় নিয়ে। কেন যাবে, কিসের জন্যই বা যাবে। শুভাশিস জীবনে কোনোদিন পার্টি করেনি। তাদের বাড়িতে একমাত্র ব্যতিক্রম তার সেজোকাকা। সে ছাড়া তাদের বাড়ির আর কেউ তেমনভাবে সক্রিয়ভাবে পার্টি করেনি।  ছোটোবেলা থেকেই সে দেখে আসছে, সেজোকাকা পার্টিঅন্ত প্রাণ। পার্টির প্রতি এইভাবে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেবার জন্য পার্টি যে কাকার জন্য কিছু করেনি, তা নয়। তাকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় হাইস্কুলের কেরানির পোস্টে। কাকা নেয়নি। বলেছিল, আমার থেকেও এই চাকরি এই মুহূর্তে যার বেশি দরকার সে হল শরৎ। চাকরিটা তাকে দাও। পরের লটের চাকরি আমি নেব।

সেই লট আর আসেনি। কাকার আর চাকরিও হয়নি।  পরে, যখন কাকা মধ্য তিরিশ তখন চাকরির দরকার পড়ল। কিন্তু সেটা আর সরকারি চাকরি হল না। এই রাজ্যেও হল না। কাকার প্রথম চাকরি হল বিহারে। বিহারি মালিকের অধীনে কাজ। মালিকের প্রাসাদসম বাড়ির কম্পাউন্ডের একদিকের একচালা ছোটো ছোটো এককামরা ঘর বরাদ্দ স্টাফদের জন্য। পাঁচ ইঞ্চির গাঁথুনি, মাথায়  অ্যাসবেস্টস। শুভাশিস গেছিল একবার। সেখানে বিকেলে কম্পাউন্ডের ঘাসের উপর বসে কাকা বললে, জীবনটা এমনিই জানিস, এমনিই। বয়ে যাচ্ছে। তুই আর পড়াশুনোর চেষ্টা করিসনি, গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছিস—এনাফ! এবার কোথাও ঢুকে পড়। তুই যদি রাজি থাকিস, আমাদের এই কোম্পানিতেই তোকে ঢুকিয়ে দিতে পারি।

শুভাশিস রাজি হয়নি। সে মাথা নেড়েছিল। বলেছিল, চাকরি আমি ঠিক একটা না-একটা জোগাড় করে নেব কাকা, ও তুমি ভেবো না।   

তবে সেই পরিবেশে, অচেনা-অজানা একটি জায়গায় সদ্য কলেজ পাশ বয়েসে তখন ভারি অদ্ভুত লেগেছিল কথাগুলো। মনে হয়, এই যে জীবনটা সে সত্যিই বয়ে যাচ্ছে, বয়েই যাচ্ছে। সে যেন অনুভব করেছিল, জীবন চলে যাচ্ছে। কোনো কার্যকারণ ছাড়াই চলে যাচ্ছে। না, জীবনের নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য নেই। অথচ সকল মানুষ ভাবে, তার গন্তব্য আছে। কিন্তু ব্যাপারটা যে সেরকম নয়, শুভাশিস এক লহমায় সেই সত্যিটা আবিষ্কার করেছিল। বুঝেছিল, চাঁদ-সূর্য যেমন উদিত হয় ও অস্ত যায়, জীবন তেমনি আপনাআপনি বয়ে চলে—এক সময় থেমে যায়। তাতে কারও কিছু যায় আসে না।

তার মনে পড়ছিল কাকার সেই চাকরিটির কথা। যে সেই চাকরিটি করছে এখন, মাটির ভাঙা বাড়ি ভেঙে দোতলা বাড়ি করেছে সে। যে গরু বা গোয়াল ছিল তাদের গ্রাসাচ্ছাদনের উৎস তাদের বিদায় দিয়েছে অনেকদিন। মাটির বাড়ি ও গোয়ালের উৎস—পুরো জায়গা জুড়ে বাড়িটি বানিয়েছে সে। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা হলে, কাকার কথা জিজ্ঞাসা করে। সেদিন তার মনে হয়েছিল, সেজোকাকা কি হেরে গেল? নাকি চাকরি ছাড়াটাই তার জিত?

শুভাশিস কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সেদিন।   

ভুলাই-এর কথাটি শুনে শুভাশিস বলল, আমার কাকা কি বামপন্থী ছিল না?

হা-হা! তাহলে আমরা কে?

বলেই আবার আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠল ভুলাই। শুভাশিস হাসল না। ব্যাপারটা তার ভালো লাগল না। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বলল, তোমরাও তাই—কমিউনিস্ট।

এবার তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ভুলাই বলে, তাহলে তোমার কাকা কে?

চেয়ারটায় নড়েচড়ে বসল শুভাশিস। এটা কোনো ঘর নয়, একটা চালা। কিন্তু দেখায় যেন ঘর। বাইরে থেকে এই ঘরের কোনো অস্তিত্ব বোঝা যায় না। যদিও রাস্তার ধারেই এই বাড়ি। কিন্তু লম্বা টানা একটি দেওয়াল আছে, তার এধারে এইসব।

কী হে ছোকরা, বলো…  

ভুলাই বসে বসে দুলে যাচ্ছে। আর বিড়বিড় করে বলছে, কমিউনিস্ট হওয়া অত সোজা নয়। একজন গরিবের জন্য একটা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেই সেটা গরিবের সেবা করা হয় না। সেটার মধ্যে অনেক দয়াদাক্ষিণ্য থাকে। তাতে আর যাই হোক, একজন কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। সেটা তোমার কাকাকে বলে দিও।

চুপ করে বসে আছে শুভাশিস। আর দেখছে ভুলাইকে। তাকে দেখে, তার কথায় ও প্রশ্নে কি মনের মধ্যে জোর পাচ্ছে সে? ফলত, এইভাবে, গলায় একটা ঝাঁঝ নিয়ে সে কথা বলছে?

কী, বলো…?

আমি তাই মনে করি।

কী? কাকা একজন কমিউনিস্ট?

হ্যাঁ।

আর করত হাত পার্টি— এই তো?

হ্যাঁ।

হা হা হা—এমন কখনও শুনিনি ভাই!  

হাত করলে বুঝি কমিউনিস্ট হওয়া যায় না? আর বাম হলেই বুঝি কমিউনিস্ট হয়? এই যে চারিদিকে এত বাম মানুষ দেখি— তারা কী জীবনাচরণে কমিউনিস্ট? তোমার কী মনে হয়?

মোক্ষম এই প্রশ্নে শুভাশিস দেখল ভুলাই পাল তার দুলুনি থামিয়ে দিয়েছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে তার হাসিটা এক লহমায় কে যেন শুষে নিয়েছে। ভুলাই তার দিকে তাকাচ্ছে না। দেখছে অন্যদিকে। কিন্তু দুলছে না। শক্ত হয়ে ধরে রেখেছে নিজেকে।   

কী করলে  একজন মানুষ কমিউনিস্ট হতে পারে, তা নিয়ে কোনো ধারণা আছে তোমার?

শুভাশিস চুপ করে রইলো। এই চালার তিনদিক খোলা। এর পিছনদিকে ঘর আছে। সেটা অন্য লোকের। পাশে একটি মুদিখানা। ছিল। মালিক মারা যেতে দোকানটা বন্ধ পড়ে আছে। তার ছেলেরা বাইরে কলকারখানায় কাজ করে। একটি ম্যাদামারা মুদিখানা চালাতে তারা উৎসাহী নয়। এর ফলে দোকানসদা করতে তার কিছু অসুবিধে হয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাতে ব্যাগ দুলিয়ে যেতে হয়। ভুলাইয়ের পায়ে গুঁফো। এই কারণে জমিতে যেতেও তার অসুবিধে হয়। এক সময় ফাটিয়ে চাষ করেছে সে। সাইকেলের পিছনে পটলের বস্তা টিউ দিয়ে বেঁধে, জ্বলে-ভিজে সে নিয়ে গেছে ব্যাপারীর কাছে। নেতা বলে আলাদা কোনো খাতির সে দাবি করেনি কোনোদিন। 

সে বলল, কোন যুক্তিতে তুমি এইকথা বলছ?

এবার মুখ খুলল শুভাশিস। বলল, কাকার লেখা পড়ে।

আর?   

কাকার জীবনদর্শন।

আর?

আমার মনে হয়…

হ্যাঁ?

কাকার জীবনাচরণের মধ্যে এমনকিছু ছিল, যা তাঁকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে।

কীরকম?   

কাকার মধ্যে, আমি যেটা এখন বেশ বুঝতে পারি— একটা বাম দর্শন ছিল, যেটা তাঁকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে।

বাম দর্শন কী জিনিস?

বলে উৎসুক মুখে শুভাশিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ভুলাই। শরীরের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল শুভাশিসের। কাকার বিষয়ে খোঁজ নিতে এসে যে এমনই প্যাঁচে পড়ে যাবে সে, ভাবতে পারেনি। বাম দর্শন নিয়ে প্রচুর কথা সে শুনেছে। পড়েছেও কিছু। কিছু ধারণাও করে নিয়েছে মনে মনে। কিন্তু এমন কঠিন প্রশ্নের সামনে পড়ে একটু যেন গুটিয়েই গেল শুভাশিস। সে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। সে দেখছিল ভুলাইকে। দাপুটে এই নেতার দলের অবস্থার কথা কারও অজানা নয়। সেখানে এই লোকটা এভাবে তেজ নিয়ে বসে থাকে কীকরে?  অমন অশক্ত শরীরে?     

শুভাশিস সেই ছেলেবেলার কথা ভাবছিল। ভাবছিল ভুলাইয়ের দাপটের কথা। এখন আর তার শরীরের তেজ নেই, পাশের মুদিদোকান বন্ধ। এর ফলে একটা অসুবিধে হয়েছে ভুলাই পালের। মুদিখানা সারতে হলে নিজেকে কষ্ট করে পাশের পাড়ায় যেতে হয়। সেখানে অরবিন্দর মুদিখানা। চলে ভালো। ঘরের পিছনে দোকান হলে তাকে আর কষ্ট করতে হত না। চাইলেই পাওয়া যেত। যত দিন যাচ্ছে, সে আরও অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আরও বয়স হলে— সেটা আর  বেশিদূরে নেই যখন বয়স একমাস হলেও মনে হয় একবছর এগিয়ে গেছে সময়। এই সময়টাকেই মনে মনে খুব ভয় পায় সে। যখন একা বসে থাকে এই চালার ভেতর পাতা ছোট্ট চৌকিতে, ভাবনাটা ঘিরে ধরে তাকে। এটাই কি সেই মৃত্যুভয়— যা প্রতি মানুষই পেয়ে এসেছে পরিণত বয়সে এসে? এই ভয় থেকে মুক্তির উপায় কী? না, সেটা জানা নেই তার।

শুভাশিস বলল, বাকিটা জানার জন্যই তোমার কাছে এসেছি।  আর নিতে চাই সেই দর্শনের খবর, যা আমি বুঝলেও বলতে পারছি না।

সে ফিরে তাকাল শুভাশিসের দিকে। বলল, তোমার কাকার খবর কী?

খবর ভালো।

এখন কোথায় আছে যেন?

রৌরকেল্লা।

ঘুরে ঘুরে কাজ, তাই না? বাজার ধরার?

ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। এক-একটি কোম্পানির হয়ে কাজ। প্রোজেক্টের কাজ তো, প্রোজেক্ট শেষ তো কাজ শেষ। আবার নতুন কোম্পানি, নতুন জায়গা— এই করেই চলছে।

তার মানে বসে থাকতে হয় না?

না। একটি কাজ শেষ হবার আগেই অন্য কোম্পানির অফার চলে আসে।

হুম! ভালোই ব্যাপার।

আসলে কী হয় বলো দেখি, যারা যে লাইনে কাজ করে, সব খবরাখবর রাখে। কে কখন কোন্ কাজের টেন্ডার পাচ্ছে না পাচ্ছে। পুরোনো কলিগ হয়েও খবর আসে। কাজ চলতেই থাকে।

আচ্ছা! তার মানে সারা দেশ ঘোরা হয়ে গেল সোনার?

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

4 Comments

  1. অনিরুদ্ধ র গল্প যত পড়ি তত একটা ঘোরের জগৎ তৈরি হয়। শেষ জানিনা। তবে অন্যরকম কিছুর আশা রইলো

Leave a Reply to Teesta Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২