একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি – জিললুর রহমান ( ভূমিকা : অমিতাভ গুপ্ত ) পর্ব ১
ভূমিকা
অমিতাভ গুপ্ত
মৌলবাদী হিংস্রতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে উদ্বোধন “আপনপাঠ” করে চলেছে তার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে রয়েছে বিভিন্ন তথাকথিত ‘ধর্ম’ ভিত্তিক চেতনার সংশ্লেষণ। এই তথাকথিত ‘ধর্ম’ থেকে উৎসারিত হয়েছে অনেক প্রত্নকথা বা মিথ এবং লোককথা।
আমাদের মনে পড়ে, কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ধর্ম চেতনায় অন্তর্নিহিত হয়ে রয়েছে যুগ যুগান্তরের সর্বহারা মানুষের দীর্ঘনিশ্বাস। মার্কস দেখিয়েছিলেন তিনটি শতাব্দী ধরে রোমান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়েছিল নির্যাতিত মানুষের ধর্মবিশ্বাস।
এই কথাটি হয়তো সবসময় আমাদের মনে থাকে না। তাই এদেশে হিন্দু পুরাণ ও প্রত্নকথার চর্চা সাহিত্যে দেখা গেলেও ইসলামের ঐতিহ্যের যথেষ্ট দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ হয় না। আমাদের কাছে তাই কবি জিললুর রহমানের এই দীর্ঘ কবিতাটি একটি সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণে দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা দিয়েছে।
হিজরি নবম মাসের ছাব্বিশ তারিখে ‘মেরাজ’ বলে যে ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল তারই কিংবদন্তীর পুনর্নির্মাণ ঘটেছে এখানে। ইসলামের পবিত্র আকর কোরান এবং হাদিস-এ মেরাজের দীর্ঘ পথের বর্ণনা, হজরতের অভিজ্ঞতাসমূহ ও প্রত্যাবর্তনের পরে প্রতিটি বিস্ময় ধৃত হয়েছে এই পুরাণে। পুনর্নির্মাণের সৃজনকৌশলে ধীরে ধীরে আমাদের পরিচিত মানব-বিশ্বই হয়ে উঠেছে স্বর্গ।
দীর্ঘ কবিতাটি পাঠ করার সময়ে পাঠকের হয়তো দান্তে রচিত “দ্য ডিভাইন কমেডি” মহাকাব্যটির কথা মনে পড়ে যেতে পারে। সেখানে দান্তের যাত্রা ছিল স্বর্গ ও নরক পেরিয়ে স্বর্গের উদ্দেশে যেখানে তার জন্যে দুয়ার খুলে অপেক্ষা করেছিলেন বিয়াত্রিসে আর দান্তে বলে উঠেছিলেন “তার ইচ্ছাই আমাদের শান্তি”।
কবি জিললুর রহমানের কাছে পরম শান্তি ধরা দিল মানুষের পৃথিবীতে। বছর পঞ্চাশ বয়সের এই কবি ঢাকার বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে অধ্যাপক, গবেষণা পরিচালক। চট্টগ্রামে তাঁর শিকড়। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে উত্তর আধুনিক চেতনার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা তিনিই। তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ “উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়” এবং একাধিক কাব্যগ্রন্থ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। আমরা আশা করব বর্তমান সাম্প্রদায়িক উগ্রতার মধ্যে তাঁর এই সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণের উদ্যোগ নন্দিত হবে।
একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি
জিললুর রহমান
আদিপর্ব
১.
কত কী ঘটে যায় মারির খপ্পরে
তোয়াফ থেমে গেল বন্ধ কাবা ঘরে
কোভিড যত বাড়ে মানুষ যত মরে
জীবন দামে বাড়ে তীর্থ থামে ধীরে
তবু তো চলে যায় ঘন্টা বেজে গেলে
কত যে আঁধারের ধাঁধাঁর শোরগোলে
কেন যে চলে যায় কেন যে লোকে মরে
২.
যেভাবে চলে গেলে সেভাবে যেতে নেই
আকাশে ভালোবাসা হারায় শুধু খেই
আকাশে কোটি তারা শুনেছি শুধু জ্বলে
অনেকে এর মাঝে নিভেও গেছে চলে
তুমি কি সে আকাশ আলোয় ভরে দেবে
তুমি কি সূর্যকে আগুন ধার দেবে
কোটি তো আছে কেন নিয়েছে তোমাকেই
৩.
শুনেছি আসমান সাতটি থরে থরে
সূর্য তারাগুলো নীরবে রাখে ভরে
মানুষ মরে গেলে আত্মা ভেসে যায়
তৃতীয় আসমানে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়
গতি কি আত্মার আলোর চেয়ে বেশি
আত্মা দেহ ছেড়ে ঘুরতে পারে নাকি
মেরাজে গেলে শুনি স্রষ্টা দেখা করে!
৪.
চাঁদের রূপে মজে কত-না জোছনায়
কবিরা লুনাটিক হৃদয়ে তড়পায়
মেকাপ ঝরে গেলে চাঁদের গর্তেই
প্রেমিক-প্রেমিকারা পড়েছে মর্তেই
তবুও কিছু আছে চাঁদের রসায়ন
তারাকে ভুলে কেন চাঁদেই মজে মন
চাঁদ তো খাদে ভরা অযথা ঝলকায়
৫.
মরেছে যত লোক সকলে তারা হবে?
কেউ কি মাঝপথে ধরায় রয়ে যাবে?
পৃথিবী যাদেরকে বিদায় জানাবে না
তাদের আত্মা কি ভূতের আনাগোনা?
এমন কোনো ভূত বন্ধু যদি থাকে
আমার চেতনার কলব্ তারে ডাকে
দু-বেলা আড্ডায় বুঝি সে কথা কবে!
৬.
এনড্রোমিডা জুড়ে শুনেছি আত্মারা
ভীষণ ভিড় করে কোভিডে মরে যারা
কে যাবে নরকেতে কে পাবে স্বর্গকে
কখন দেবদূত কাউকে নেবে ডেকে
কবে যে শিঙ্গাটা উঠবে বেজে শালা
বছর কত শত অপেক্ষার পালা
কার কী গতি হবে ভেবেই সবে সারা।
৭.
বুঝি না কোন্ পথে বেরোয় আত্মারা
শরীরে চারপাশে ঘিরেছে চামড়াটা
হৃদয় থেমে গেলে মানুষ ছুঁড়ে ফেলে
কাউকে পুঁতে রাখে কারো বা চিতা জ্বেলে
তবে সে আত্মাটা বেরোল কোন্ ফাঁকে
বুঝতে পারিনি তো মৃতের হাঁকডাকে
নাকি সে পুরুতের বাঁচার শর্করা?
৮.
পড়েছি অ্যানাটমি পড়েছি অ্যালকেমি
আত্মা খুঁজে সারা করিনি আলসেমি
মরেছে নানিজান ছিলাম হাত ধরে
মরেছে কত লোক পাশেই ঘুরে ঘুরে
কোথাও দেখিনি তো আলোর ছিটেফোঁটা
হঠাৎ ফুস করে আকাশে ভেসে ওঠা
ঠিকুজি আত্মার মেলেনি কোনোদিনই
উড্ডয়নপর্ব
৯.
একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি
হঠাৎ দেবদূত বলল, ‘ঘুরে আসি’
বুঝেছি দফা শেষ, বউকে বলে যাই
জানাল ইশারায় ‘সময় অত নাই’
নেহাত হতাশায় উড়েছি বোররাকে
দেখেছি আসমান সাতটি পাকে পাকে
ভ্রমণ শেষে ভোরে আসব ফিরে বুঝি?
১০.
নানান আসমানে কত যে খেলাধুলা
রয়েছে দেবদূত শ’তানো কতগুলা
এদিকে নরমাল ওদিকে কোভিডেরা
এদিকে চোরদল ওদিকে মহতেরা
এমনি কত শত আত্মা বোঁচকায়
ভেতরে কেউ হাসে কেউবা কেঁদে যায়
হাসর কবে হবে অপেক্ষার পালা
১১.
ওই যে বান্ডিলে আত্মা বেশ মোটা
বেরোতে চায় সে তো বলবে দুটো কথা
ডাকছে চুপিচুপি তরুণ দেবদূতে
ঘুষটা কে না খায়, হেথাও চায় দিতে
খাটছে দেবদূত কত না যুগ ধরে
সে চায় বিশ্রাম পাত্রে সুরা ভরে
আত্মা তস্কর বোতল খোলে দুটা
১২.
যাবার কালে পথে দেখেছি কত গ্রহ
শনির গলা কাটা মোটেও দেখিনি তো
চাঁদের বুড়িমাকে বলেছি সুতো কেটে
আমাকে দুটো জামা বানিয়ে এনে দিতে
কেবল ভয় ছিল কখন ব্ল্যাকহোলে
বাবাজি বোররাক আমাকে নিয়ে ফেলে
এ মহাশূন্যেতে কত যে বিগ্রহ
১৩.
একটা উল্কাকে দেখেছি পাশ কেটে
আগুন ছ্যাঁকা দিয়ে কোথায় গেল ছুটে
আসলে উল্কা তো? নাকি সে নভোযান!
বুঝি না মিথ আর সত্য কোন্ জ্ঞান
পুষ্পকরথে কে? রাবণ নাকি ধায়!
গরুড় পিঠে নাকি বিষ্ণু উড়ে যায়?
আকাশে বোঝা দায় কত যে খেলা চলে!
১৪.
ওই যে দেখা যায় পাহাড় উঁচু এক
একটু কাছে নাও, ও-ভাই বোররাক,
দেখেছি কী বিশাল ঠেলছে কে পাথর
মাংস ফুলে ওঠে, ঘামছে দরদর
একটু বাকি আছে তবেই চূড়াটায়
পাথর তোলা হলে থামতে পারা যায়;
অমনি নিপতিত, হায় রে সিসিফাস!
[ক্রমশ]
[শীর্ষচিত্র: ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ]
অমিতাভ গুপ্ত কয়েকটি শব্দ ভুল লিখেছেন, না-কি তিনি অবজ্ঞাত, না-কি সম্পাদক ভুলভাবে লিখেছে, ঠাহর করতে পারলাম না। আর হজরত শব্দটি মুহম্মদের নামও বোধকরি নয়, উপাধিও নয়, যারাই ইসলামের নবী মুহম্মদের শহর মক্কায় হিজরত করেন, হযরত বলা হয় তাকে।
কবিতাটিতে কবির একটা সাইন আছে। দীর্ঘ-দমের। আত্মজার প্রতি, শতখণ্ড’র পর এই দীর্ঘকবিতাটিও ভালো লাগল।
ধন্যবাদ প্রিয় ধ্রুব সাদিক। এ ত্রুটিগুলো সম্ভবত হাতে লেখা বক্তব্যকেও যিনি টাইপ করেছেন তাঁর বুঝতে ভুল হয়েছে। কিছু কিছু শুধরে নেতা গেল
পাঠ করে ঋদ্ধ হলাম ভোরের ট্রেন যাত্রার প্রথম ভাগে। কবি অমিতাভ গুপ্তের ভূমিকার পর, আমাদের মতো পাঠকদের বলার আর কিছু থাকে না।
ধন্যবাদ ভাই
ধন্যবাদ । আরও বাকি আছে
সবকটি অসম্ভব ভালো।❤️
ধন্যবাদ। আরও বাকি আছে।