এক এবং অনেক – শৌর্য চৌধুরী
“পূর্ণিমার রাত। কী কাকতালীয়! পুরনো দিল্লীর সেই অদ্ভুত রাতটাতেও চাঁদ আকাশে স্বমহিমায় ছিল। তবে তাকে দেখার অবকাশ আমার ছিল না। ভিড়ের মধ্যে লোকটাকে তাড়া করতে সমস্যা হচ্ছিল খুবই। কিন্তু সব পরিস্থিতির জন্যেই আমরা ট্রেনিং পাই। আমরা কারা? সেটা এখানে লেখা যাবে না্। মানে এই ডাইরিতে।
কাজার একটা ভাঙ্গাচোরা রেস্টুরেন্টের কোণে বসে লিখছি এসব। ও, ওপরে ডেট দেওয়া হয়নি, দেব না ভাবছি। কী লিখতে পারি আর কী পারি না সেটা নিয়েই যে ধন্দে আছি। এই ডাইরিটা যদি কারুর হাতে পড়ে বিপদ হবে। মারাত্মক বিপদ। এসব লিখে আমাদের অনেকগুলো সার্ভিস রুল যে আমি ভাঙছি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে, না লিখলেও যে পাগল হয়ে যাব। ওই দেখ, কোথায় ছিলাম, কোথায় চলে গেছি। এসব করার অভ্যাস নেই আসলে। কলেজ লাইফে কবিতা-টবিতা লিখেছি ক’টা…তাও মেয়ে পটাতে… ইশ এই শব্দটা কতদিন পর ব্যবহার করলাম। নাহ, আবার বাজে বকছি। কোথায় চলে গেলাম রে বাবা? সেদিন থেকেই আমার মাথাটা… মানে সেই রাতের পর থেকেই…
দিল্লীর সেই রাত… ভুলতে পারব না, ইন্টেলিজেন্স-এর খবরটা পাকা ছিল। কালো আঁচিল, মোটা কালো গোঁফ, নীল স্কুটার—সব মিলে গেছিল। বম্ব স্কোয়াড এর পেছনেই ছিলাম আমি, আমাদের দেখেই স্কুটার ফেলে পালাল লোকটা, তাড়া করতে বাধ্য হলাম। ঈদের রাত। ঠাসা লোক, আলো-ঝলমল চাঁদনী চক। হাতের পিস্তলটা বার করেও বুঝছিলাম আজ ওটা একটা প্রপ ছাড়া কিছু না।এই সিভিলিয়ানদের মাঝে গুলি করা সম্ভব হবে না। অদ্ভুত গতি লোকটার—বাড়ে-কমে না। মেট্রো স্টেশন-এর সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ও তাঁর মুভমেন্ট-এর কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। হাঁপাতে-হাঁপাতে পেছন-পেছন আমিও নামছিলাম। চাভরি বাজার, দিল্লীর সবচেয়ে গভীর মেট্রো স্টেশন… আশ্চর্য, লোকটা কি ক্লান্ত-টান্ত হয় না? রোজ সকালে ৫ কিলোমিটার দৌড়ই আমি। নিজের ফিটনেস নিয়ে বেশ গর্ব আছে। তবে এর কাছে আমি কিছুই না। ইতিমধ্যে মেট্রো সিকিউরিটি আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছিল।
বৃথা চেষ্টা। চারজনকে একসঙ্গে কুপোকাত করে লোকটা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেছিল। ক্রাভ মাগার প্যাঁচ। নিখুঁত। পেছন-পেছন আমিও পৌঁছে গেছিলাম। ঠিক ৩০ সেকেন্ড পর। এবার পিস্তলটা বার করা যেত। বেশ অনেক যাত্রী ছিল সেদিন রাতের স্টেশনে। “ক্লিয়ার…” বাজখাই গলায় চিৎকার করেছিলাম। বিশ্বাস করুন, এককালে RAW-এর এগজ্যাম দিয়েছিলাম এসব করব বলেই। মানে খুব একটা না ভেবেই দিয়েছিলাম আর কী। তখন কী আর জানতাম…
যাই হোক…লোকটা ঘুরে তাকিয়েছিল আমার দিকে…আঁচিলটা কেমন চকচকে ছিল। কেমন অপার্থিব। ঘামে নাকি? চোখগুলো এতটাই কোটরে যে এক্সপ্রেশনটাই বোঝা যাচ্ছিল না। মনে হয় না কোনো এক্সপ্রেশন আদৌ ছিল বলে। “হ্যান্ডস আপ, সারেন্ডার রাইট নাউ,” মুখস্ত বুলি আউড়েছিলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে রাজীভ চকের দিকে যাওয়া ট্রেনটা বিশাল আওয়াজ করতে-করতে স্টেশন ঢুকতে শুরু করেছিল… হঠাৎ, আমি কিছু বোঝার আগেই, লোকটা বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপ দিয়েছিল লাইনে। সবাই চিৎকার করে উঠেছিল। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছিল ততক্ষণে…মৃতদেহের ভগ্নাবশেষ কালেক্ট করে ফিরেছিলাম সে রাতে। বোমাটা অবশ্য ডিফিউজ করা গেছিল। তাই আমরা সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। তবে আসল আতঙ্কের শুরু হল তারপর।”
এত অব্দি লিখে প্লাবনের ক্লান্ত লাগতে শুরু করল। মারাত্মক ঠান্ডা। কাজার চারপাশের সাদা পাহাড়ের চূড়াগুলো অবশ্য চাঁদের আলোয় স্বর্গীয় লাগছিল। বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে। দু-তিন ফুট দূরে একদল কলেজের ছেলেমেয়ে এই ঠান্ডায় বসে তাস খেলছে। একটা রাম এর বোতল তাদের গরম থাকতে সাহায্য করছে। টুরিস্ট তুলনামূলকভাবে কম। যদিও এটা সিজন। কালকেই বরফ পড়েছে স্পিতির বিস্তীর্ণ এলাকায়। বোধহয় আচমকা তুষারপাতে মানুষজন আটকা পড়ে গেছে মানালি কিম্বা কিন্নর-এ। পৌঁছতে পারেনি স্পিতিতে।
নাহ, ডাইরিতে না লিখে বরং ফোন রেকর্ডার-এ ভয়েস রেকর্ড করবে সে। সুবিধে হবে।
তার ডিনারের বিল দেওয়া হয়ে গেছিল, রাস্তায় বেরিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্লাবন ফোনটা বার করল। তারপর রেকর্ডার অন করে বলতে শুরু করল,
“পরের সপ্তাহে দেশে ৪টে সিমুল্টেনিয়াস ব্লাস্ট হল। সবচেয়ে আশ্চর্যের, দু জায়গায়, মানে হায়দ্রাবাদ এবং ব্যাঙ্গালোরে, ব্লাস্ট এরিয়ায় একটা সন্দেহজনক লোককে দেখতে পাওয়ার রিপোর্ট এল আমাদের দফতরে। গালে আঁচিল, মোটা কালো গোঁফ, চোখ-দুটো কোটরে ঢোকা।
প্রথমে উড়িয়ে দিয়েছিলাম শত্র পক্ষ ভুয়ো খবর রটিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করছে ভেবে। তদন্তে নেমেছিলাম সেভাবেই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবার পাগল-পাগল লাগতে শুরু করল যখন কেরালার এক এনকাউন্টারে তিনজন জঙ্গি মারা গেল। তাদের মধ্যে একজনের গালে আঁচিল… ইত্যাদি।
বাকিটা বুঝতেই পারছেন। এরা কারা? যমজ ভাই? প্ল্যাস্টিক সার্জারি করা সৈন্যদল? ভূত? কাদের নামিয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে বিদেশি শত্রুরা?”
আকাশপাতাল ভাবতে-ভাবতে প্লাবন হেঁটে যাচ্ছিল কাজার চড়াই-উতরাই-এ ভরা অলিগলি দিয়ে। একটা ক্যাফে থেকে স্পষ্ট গাঁজার গন্ধ ভেসে এল। অদ্ভুত মাদকতা ছিল এই নিঃসঙ্গতায়… অন্য সময় হলে সে মজে যেতে পারত চারপাশের মুগ্ধতায়, কিন্তু সে যে এতদূর এসেছে একটা রহস্যের কিনারা করতে।
রাত ১০টা বেজে গেছে, রাস্তায় প্রায় কেউ নেই। দুটো ইজরায়েলি ছেলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে এবং টলতে-টলতে প্রায় প্লাবনকে ধাক্কা মেরে সামনের বাঁকে ঢুকে গেল।
“Watch it, man”-প্লাবন বেশ রাগত গলায় বলল। মাতাল ছেলে দুটি উত্তরে কেবল হাহা করে হেসে উঠল।
ওদিকে একটা হোস্টেল আছে, মূলত বিদেশিরাই থাকে। এরাও নিঃসন্দেহে ওখানে উঠেছে।
হঠাৎ প্লাবনের খেয়াল হল যে সে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে।
যে গেস্ট হাউসে তার অফিসের এজেন্টরা কাজায় এলে থাকে সেটা অদ্ভুত একটা ঘুঁজির মধ্যে। অন্যমনস্ক হলে মিস করে যাওয়া স্বাভাবিক।
আবার ফিরতি পথে উঠতে হবে। একটা ধোঁওয়া-যুক্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্কার্ফটা আরেকটু আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে নিয়ে প্লাবন ঘুরে উলটো দিকে হাঁটতে থাকল। কিছুদূর গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে হঠাৎ সে টের পেল কেউ একটা তার পেছন-পেছন পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠছে। এমনিতে ব্যপারটা অস্বাভাবিক কিছু না, কিন্তু প্লাবনদের ট্রেনিংয়ে instinct-ও একটা বড়ো রোল প্লে করে।
সেটার ওপর ভর করেই ও বুঝতে পারল পেছনের মানুষটি তাকেই অনুসরণ করছে। স্পীড বাড়িয়ে, কমিয়ে, একবার থেমে জুতোর ফিতে বাঁধার ভান করে শিওর হয়ে নিল প্লাবন। পায়ের আওয়াজ নিজের ছন্দ মেনে শুরু হয়ে গেল যেই সে আবার উঠে দাঁড়িয়ে গেস্ট হাউস-এর দিকে হাঁটতে শুরু করল।
জনশূন্য রাস্তায় প্লাবনের বেশ অসহায় লাগছিল। না ঘুরে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ক্যামেরা অন করে পেছনটা দেখার জন্য সে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল, একটু পরেই কালো জ্যাকেট পরা একটা মানুষ পাহাড়ের বাঁকে উদয় হল। মোটা কালো গোঁফ, গালের আঁচিলটা পূর্ণিমার আলোয় যেন চকচক করছে, চোখদুটো বড্ড বেশি গভীরে ঢোকা… রুদ্ধশ্বাসে দৌড় লাগাল প্লাবন।
“সার, রিপোর্ট-টা একদম ঠিক…আমি আজকেই কাজার রাস্তায় লোকটাকে দেখেছি…
“হ্যাঁ, ভুল নেই কোনো… একদম এক… ইয়েস, আই উইল গেট টু দ্য বটম্ অফ দিস।”
ফোনটা কেটে প্লাবন আবার ভাবতে বসল। সে দৌড়লেও লোকটা কিন্তু তার স্পীড বাড়ায়নি, তার কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল না বোধহয়।
তবে যে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টের ভিত্তিতে ও এখানে এসেছে তা ঠিক এটা প্রমাণিত হল। শেষ কয়েক মাস NIA, RAW, IB এবং তাদের এজেন্সি যে রহস্যের কিনারা করতে উঠে পড়ে লেগেছে, তার একমাত্র সূত্র এতদিন পর তারা পেয়েছে। এর শেষ দেখার দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর। নাহ…কোনো ভুল করলে চলবে না।
যেদিন তাদের নিজস্ব ইনপুট জানাল কাজায় সেই বর্ণনার একজনকে দেখা গেছে তখন আর দেরি না করে প্লাবনকে দিল্লি থেকে এক রাতের মধ্যে স্পিতি পাঠানোর ব্যবস্থা হল।
গভীর রাতে বিশেষ গাড়িতে স্পিতি ডিসট্রিক্ট পৌঁছেছিল প্লাবন, চারপাশের কোল্ড ডেসার্টের শোভা দেখা সম্ভব ছিল না। বরং প্রতি বাঁকে ভয় ছিল গভীর খাদে পিছলে পড়ার। RAW-এর সুনীথ অসাধারণ দক্ষতায় হেডলাইট এবং চাঁদের আলোয় ভর করে আজ ভোরে কাজায় তাকে নামিয়ে দিয়েই আবার কিন্নর ফিরে যায়। সারা রাস্তায় বোধহয় দুতিনটি কথা বলেছিল সুনীথ, এই মিশনটা কী তা তাকেও জানানো হয়নি। সে জানতেও চায়নি।
বিয়ে করেনি প্লাবন। একা থাকাটা অভ্যাস হয়ে গেছে আজকাল। কাজের বাইরে জীবন নেই বলবে না, তবে সে জীবনের প্রতি খুব একটা টানও নেই। এর ফলেই সে একজন টপ এজেন্ট হয়ে উঠতে পেরেছে বোধহয়। ভয়-ডর, ফ্যামিলি, ইত্যাদি যেসব জিনিস অফিসের বাকিদের আটকে রাখে, সেগুলো তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এই মিশনটা বড্ড অদ্ভুত, পদে-পদে ভয় চেপে বসছে তার ওপর।
গেস্ট হাউসের ঘরটা ছোটো হলেও সুন্দর। হিটার চলছে, বেশ comfortable লাগছিল তার। সামনে প্রিয় সিঙ্গেল মল্ট-এর গ্লাসে একটা চুমুক দিতে গিয়েও একটু থমকে গেল সে, হঠাৎ চোখের সামনে সেই আঁচিলওলা লোকটার মুখটা ভেসে উঠল, মরেও যে ফিরে এসেছে, এবং একলা নয়, অনেক হয়ে ফিরে এসেছে, কোথা থেকে এক ঝলক পাহাড়ের ঠান্ডা হাওয়া ভেসে এল, প্লাবন শিউরে উঠল।
রাতটা প্রায় না ঘুমিয়েই কাটল তার। ভোরের দিকে আবার ফোন রেকর্ডার অন করে ও বলতে থাকল।
“একই দেখতে, হুবহু এক, ও মুখ আমি ভুলব না। কিন্তু এটা সম্ভব কী করে? দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, কেরালা, হিমাচল। একজন মৃত ব্যক্তি এতগুলো জায়গায় একসঙ্গে কী করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে? এত জায়গা থাকতে এখানেই বা কেন সে?”
পর দিন সকালে কাজার রাস্তায় আবার ঢুঁ মারতে লাগল প্লাবন। স্পেসিফিক ইনপুট ছাড়া বেশ অসহায় লাগছিল তার। ক’জন ট্রেকার গাড়ির সঙ্গে দরদাম করছে, বোধহয় কাছের কোনো গ্রাম থেকে শুরু তাদের ট্রেক, সেই অব্দি গাড়িতে যাবে।
এককালে সেও একবার চন্দ্রতালের কাছে ট্রেক করতে এসেছিল কলেজ লাইফে। অন্য একটা জীবন সেটা। এখনও মনে আছে চন্দ্রতালের অপার্থিব সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় সত্যি মনে হয়েছিল পৃথিবী নয়, কোনো দেবলোকে পৌঁছে গেছে সে। ঠিক তখনই বরফ পড়তে শুরু করেছিল।
আজ সেই একই সব জায়গা দিয়ে যাতায়াত করলেও জীবন-মৃত্যুর অদ্ভুত লুকোচুরি খেলায় আটকে গেছে সে, সময় নেই চারপাশ দেখার। কতকটা না বুঝেই এই জীবন বেছেছিল এক সময়ে, কিন্তু আজ প্লাবনের ফিরে যাওয়ার সময় নেই, কারণ শুধু তার নয়, অন্য অনেকের জীবন নির্ভর করে আছে তার এই মিশন-এর ওপর।
এক মুহূর্তে যেন কাল রাতের ভয়টা কেটে গেল, মানুষ জীবটার প্রতি মারাত্মক কোনও ভালবাসা তার নেই, বরং অনেক সময়ই বেশ রাগ হয় মানবজাতির স্বার্থপরতার জন্য, ঠিক misanthrope না হলেও সে খুব একটা মানবপ্রেমী নয়। কিন্তু প্লাবন জানে যে যে শত্রুদের সঙ্গে সে লড়ছে তারা শুধু অনেক নিরপরাধ মানুষ মারতে বদ্ধপরিকর তা নয়, তারা এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর বাকি রয়েছে, সেটাও ধ্বংস করতে চায়, নইলে এরকম একটা জায়গায় তারা কী করছে? তাই এই মিশনে প্লাবনের ফেল করলে হবে না।
ঠিক তখনই শিবার ফোনটা এল… শিবা এই রিজিওনের অনেক পুরনো ইনফরমার। সিজন-এ ট্রেক গাইড-এর কাজ করে, লাংযা গ্রামে থাকে, কিন্তু স্পিতি থেকে লাদাখ-এর মানচিত্র ওর নখদর্পণে। অনেক সময়ে শিবাকে তারা হিমাচলের অন্য এলাকাতেও কাজে পাঠিয়েছে। ও কখনও নিরাশ করেনি।
শিবা নিজে এই মুহূর্তে সিমলায় কাজে গিয়ে থাকলেও পুরো হিমাচলে ওর অক্টোপাসের মতো হাতগুলি ছড়িয়ে আছে।
“কিব্বার-এ? শিওর তুমি?”-প্লাবন জিজ্ঞেস করল।
শিবা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হল বোধহয়।– “আজ তক কভি গলত ইনফরমেশন মিলা কেয়া আপ লোগো কো?”
কিন্তু কিব্বার-এর মতো ছোট্ট একটা গ্রামে ও কী করছে? মানে ওই লোকটা… আর এতদিন কাজাতেই বা কী করছিল সে। যার লক্ষ্য এতদিন ছিল ভারতের মূল শহরগুলি, যে নিজে রহস্যময় হলেও পরিচিত মোডাস অপারেন্ডিতে কাজ করে এসেছে, সে হঠাৎ হিমাচলের এই দুর্গম কোণে কী মতলবে এসে জুটেছে? ঘুরতে নিশ্চয় নয়।
প্লাবন তক্ষুনি কিব্বার গেল না। কারণ, ইতিমধ্যে সে এক অবাক করা দৃশ্য দেখে ফেলেছে, কিছুটা দূরে একটা দোকানে একজন লোক কিছু একটা জিজ্ঞাসাবাদ করছিল।
সবে সে মুখটা এদিকে ঘুরিয়েছে, লোকটার চোখগুলো কোটরে ঢোকা, তার একটা মোটা কালো গোঁফ আছে, গালে চকচকে আঁচিল… প্লাবন তাকে দেখেই ধাওয়া করা শুরু করল, কিন্তু আবার সে তার অদ্ভুত গতির পরিচয় পেল, খুব একটা চেষ্টা না করেই লোকটা হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। প্লাবন কোনোভাবেই তাকে ধরতে পারল না।
ফিরতে হল সেই দোকানে। দোকান নয়, আসলে বেশ বড়ো একটা অফিস। বাইরে সাইনবোর্ড-এ শুধু লেখা ‘টুরস, ট্র্যাভেলস, ট্রেক্স’। কাচের দরজা ঠেলে প্লাবন ভেতরে গেল। দাড়িওয়ালা ফর্সা এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন কাউন্টারে।
“এক্ষুনি একজন লোক এখানে কিছু একটা খবর নিতে ঢুকেছিল, কী নিয়ে আমাকে বলতে পারবেন?”- প্লাবন হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল।
“কেন, আপনাকে বলব কেন, কে আপনি?”
প্রশ্নটা স্বাভাবিক, তাই প্লাবনকে তার Raw-এর আইডি কার্ডটা বার করতে হল। তার নিজের এজেন্সির কোনো আইডি নেই, কারণ তারা পাব্লিকলি এক্সিস্ট করে না। অন্য সময় হলে লোকাল পুলিশ-এর সাহায্য নেয় তারা, কিন্তু এবার তারও সময় নেই।
কিছুক্ষণ পর প্লাবন দোকানটি থেকে বেরিয়ে এসে দিল্লিতে ফোন করল।
“স্যার, এরিক ব্লোম বলে একজন টুরিস্ট জার্মানি থেকে ৪ দিন আগে ভারত এসেছে, কিব্বার থেকে লাদাখ ট্রেক-এর জন্য বেরিয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে কাজা থেকে। বয়েস ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। এর ব্যপারে ডিটেলস চাই। দিল্লি থেকে এসেছে… প্লিজ জলদি জানাবেন একটু।
কারণ আমাদের টার্গেট এর খোঁজ নিচ্ছিল এক্ষুনি। আমার ধারণা ওর জন্যেই এখানে এসেছে লোকটা। আজ মার্কেট-এ ঘুরতে-ঘুরতে লোকটাকে দেখতে পেয়ে যাই, তবে ধরতে পারিনি। আমি এখন কিব্বার যাচ্ছি… আমার স্যাট ফোনে কল করবেন যদি নেটওয়ার্ক না থাকে…”
প্লাবন ফোনটা কেটে দিল। একটা কথা সে ইচ্ছে করেই তার দিল্লির reporting officerকে বলেনি। কিন্তু ধাঁধাটা সেই এক জায়গাতেই ঘুরে-ফিরে আটকে যাচ্ছে। যদি শিবার সোর্স কিব্বার-এ লোকটাকে দেখে থাকে তাহলে কাজায় যাকে সে এক্ষুনি তাড়া করল সে কে?
ছবির মতো সুন্দর গ্রাম কিব্বার। একটা ছোটো হোস্টেলের ছাদে বসে দূরে পাহাড়ের ওপর সাজানো বাড়িগুলো দেখছিল প্লাবন। আর কফি খাচ্ছিল। আর ভাবছিল কী করবে এবার। অনেক খুঁজেও এরিক ব্লোম-এর টিম কোথায় সে খবর প্লাবন পায়নি। তার গাইডের নাম্বার কাজাতেই নিয়েছিল, কিন্তু ফোনে অনেকবার চেষ্টা করেও তার নাগাল পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভবত লাদাখ-এর ট্রেক-এ ব্লোম-এর দল অলরেডি বেরিয়ে গেছে। সে সোলো ট্রেক করছে, অর্থাৎ পোর্টার আর গাইড ছাড়া আর কোনো মানুষ তার সঙ্গে থাকবে না।
কে এই ব্লোম? সব ছেড়ে এই প্রত্যন্ত এলাকায় এর পেছনে দৌড়তে-দৌড়তে কেন পৌঁছে গেছে লোকটা? প্লাবন বুঝতে পারছিল এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে ওকেও কিব্বার ছেড়ে উঠতে হবে, পাহাড় বেয়ে যেতে হবে লাদাখ-এর দিকে। সময় বেশি নেই হাতে।
—
হাঁপাতে-হাঁপাতে প্লাবন উঠছিল চড়াই, নীচে দেখলেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে, তাই আর তাকাচ্ছে না সে। জঙ্গুলে পথ, এই প্রশস্ত, এই সরু ফালির মতো। কোথাও কোথাও ফ্রস্টিং হয়ে বিপজ্জনক হয়ে আছে। ট্রেকিং শুস সে আনেনি, সময়ও ছিল না, এই ট্রেক শেষ করতে গেলে সে মারা যাবে, তাই আগেই ধরতে হবে তার লক্ষ্যকে।
অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শিবার পরিচিত একটি গ্রামের ছেলেকে গাইড হিসেবে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে। না আছে টেন্ট, খাবার বা রাত কাটানোর অন্য সরঞ্জাম, তাই সন্ধে নামার আগেই তাকে নেমে আসতে হবে, ব্লোমকে ধরতে পারুক বা না পারুক। নইলে এটা তার জন্য সুইসাইড মিশন হয়ে যাবে।
ঠিক এই সময়ে প্লাবনের স্যাটেলাইট ফোনটা বেজে উঠল।
“হ্যালো স্যার, কিছু জানতে পারলেন?”
“সব্বনাশ হয়ে গেছে রয়, ব্লোম ইন্ডিয়ার জার্মান আম্ব্যাসেডর হেরল্ড ব্লোম-এর একমাত্র ছেলে, কাউকে কিছু না জানিয়ে ফ্র্যাঙ্কফার্ট থেকে দিল্লি এসেছে ভারত দেখবে বলে। ওর বাবাও কিছু জানে না। আই থিঙ্ক, দে ওয়ান্ট টু কিডন্যাপ হিম… মনে আছে কাশ্মীর-এ বিদেশি ট্যুরিস্টদের কীভাবে টেররিস্টরা কিডন্যাপ করেছিল? রিমেম্বার হাউ ইট এন্ডেড? দিস উইল বি এ ডিসাস্টার…”
প্লাবন প্রায় জগ করতে শুরু করেছিল ফোন কাটার আগেই, তার রহস্যময় প্রতিপক্ষের প্ল্যানটা এবার ওর কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছিল, কিন্তু যেখানে ভারতের কেউ কোনো খবর পেল না, সেখানে শত্রুরা এত নিখুঁত ইনফরমেশন কী করে পেল?
—
“হ্যান্ডস আপ, ড্রপ ইওর ওয়েপন,” প্লাবন তার অটোম্যাটিক পিস্তলটা তাক করে বলল। দ্বিতীয়বার সেই লোকটার মুখোমুখি সে। সেই কোটরে ঢোকা চোখ, মোটা কালো গোঁফ, পড়ন্ত আলোতেও গালের আঁচিলটা চকচক করছে। তফাৎ কয়েকটা ছিল বটে। ভীত-সন্ত্রস্ত ব্লোম ছিল তার কবলে, আর লোকটার মুখের কোণে যেন এক চিলতে একটা হাসি খেলা করছিল।
এরকম দৌড়ে এই রুটে বোধহয় আগে কেউ আসেনি। প্লাবনের গাইড এত রিস্ক নিয়ে আর আসতে চায়নি, গ্রামে ফেরার পথ ধরেছিল, তখনই সে পিস্তলটা বার করে তাকে বাধ্য করে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে আসতে।
এক কিলোমিটার আসার পর প্রথম একটা লাশ দেখতে পায়, তখনই গতি বাড়ায়, কারণ মৃত ব্যক্তিটি ব্লোম-এর গাইড, কাজাতেই তার ছবি দেখে এসেছিল। স্পিড আরও বাড়িয়ে প্রায় মৃত্যুকে আহ্বান জানিয়ে পাহাড়ে চড়েছিল সে, হঠাৎ একটা ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়, পাশের খাদে গাছে জড়িয়ে ছিল একটা দেহ। না, ব্লোম নয়, বোধহয় তার পোর্টার। ঝর্ণার ওপারে দুটো ছায়ামূর্তি দেখতে পাওয়ার পরেই সে আর দ্বিধা করেনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওপারে।
“ছেড়ে দাও ওকে,” কোনো উত্তর না পেয়ে প্লাবন আবার বলে উঠল।
আলতো হাসিটা রয়ে গেল, কিন্তু লোকটা সত্যিই ব্লোমকে ছেড়ে দিল… ছেলেটি দৌড়ে প্লাবনের কাছে চলে এল। লোকটার মধ্যে যদিও কোনো বিকার দেখা গেল না, সে পালানোরও কোনো চেষ্টা করল না।
যে প্রশ্নটা এত দিন ধরে সে করতে চাইছিল, সেটা এবার করল প্লাবন।
“তুমি কে?”
প্রথমবার লোকটার গলা শুনতে পেল সে। যেন কোনো গভীর খাদ থেকে উঠে আসা একটা কণ্ঠস্বর, ঠিক মানুষের মতো হলেও যেন কোথাও একটু আলাদা…
“আমি একজন নই, একটা individual নই, তোমার মতো কোনো স্পেসিফিক আইডেন্টিটি নেই আমার এবং তাই ক্যানসারের মতো আমি তোমাদের গ্রাস করে ফেলব…”
“কী যা-তা বলছ? দিল্লি তে আমি নিজে তোমার ডেড বডি autopsy-তে নিয়ে গেছিলাম, তার পরেও কী করে সব জায়গায় তুমি হাজির হচ্ছ? হোয়াট আর ইউ?”
এর উত্তরে লোকটা হেসে উঠল… ঠিক তখনই গুলির আওয়াজটা প্লাবন শুনতে পেল, তার গাইড, যে ভয়ে এক কোণে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। আর তখনই চারপাশটা দেখে প্লাবনের রক্ত হিম হয়ে গেল। পাঁচ জন লোক তাদের আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে, দুজনের হাতে automatic machine gun, বোধহয় AK 47, যদিও ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সে শিওর হতে পারল না। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত তাদের চেহারাগুলো, যেন একই ছাঁচে বানানো, যমজ ভাইদেরও এত মিল হয় না হয়তো, প্রত্যেকেরই চোখ কোটরে ঢোকা, মোটা গোঁফ, গালের আঁচিলটা চকচকে।
“রান, রান টু দ্য ভিলেজে, ডোন্ট লুক ব্যাক,” প্লাবন ব্লোমকে বলে যুদ্ধের জন্য তৈরি হল। ছেলেটিকে দুবার বলতে হল না। তীর বেগে সে নীচের দিকে হারিয়ে গেল। তাকে গার্ড করে দাঁড়াল প্লাবন। বন্দুক এর খেলা হোক বা ক্রাভ মাগা, আজ তাকে এ যুদ্ধে টিকে থাকতেই হবে যতক্ষণ সম্ভব।
…
কিছুদিন পর প্লাবনের বস-এর ফোনে একটা ভয়েস মেসেজ এল, একটা অচেনা নম্বর থেকে।
“They are clones! সামহাউ, আমাদের শত্রুরা হাজার-হাজার মানুষের ক্লোন বানানোর প্রযুক্তি হাতে পেয়ে গেছে। এটা কেবলমাত্র first wave ছিল। একটাই মানুষ অনেক হয়ে গেলে যা হয় আমরা তার মুখোমুখি এখন, expect an army of clones soon। আমি সেদিন কীভাবে বেঁচেছি, কীভাবে তাদের একজনকে পাকড়াও করেছি সে কথা পরে জানাব, তবে মানুষের মতো হলেও এদের অনেকটাই লিমিটেড প্রগ্র্যামিংয়ে চলে, বলতে পারেন মানুষ-রোবট হাইব্রিড। তাই একটু বুদ্ধি খাটালেই এদের হারানো যায় এখনও। আমি আকসাই চীন-এর দিকে যাচ্ছি এখন। There are international forces behind this। কারা সেটা বার করবই আমি। Will talk soon…