দুই ক্যারোলাইনের গল্প – গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
অনেক মৃত্যুর মিছিলের মাঝে আরও এক মৃত্যুসংবাদ চোখে পড়ল। গত ১৩ আগস্ট, ২০২১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার ফ্ল্যাগস্টাফে প্রয়াত হয়েছেন ক্যারোলাইন শুমেকার, তাঁর বয়স হয়েছিল বিরানব্বই।
শুমেকার নামটা মনে পড়ছে? মনে করিয়ে দিই, শুমেকার-লেভি-৯ ধূমকেতু ১৯৯৪ সালে বৃহস্পতি গ্রহের বুকে আছড়ে পড়েছিল। সৌরজগতে সংঘর্ষের ইতিহাস অনেক আছে, কিন্তু আমাদের পর্যবেক্ষণে তা ধরা পড়েছিল এই প্রথম। অবশ্য সেটা আমাদের পক্ষে ভালো, শুমেকার-লেভির মতো বড়ো ধূমকেতু পৃথিবীতে ধাক্কা মারলে তা মানব সভ্যতাকে মুছে দিতে পারে। ধূমকেতুর নামকরণ সাধারণত আবিষ্কারকদের নামে হয়, এই বিশেষ ধূমকেতুটি আবিষ্কার করেছিলেন ক্যারোলাইন (১৯২৯-২০২১) ও ইউজিন (১৯২৮-১৯৯৭) শুমেকার দম্পতি ও তাঁদের সহযোগী ডেভিড লেভি। আরও সঠিকভাবে বললে এটি তাঁদের আবিষ্কৃত নবম ধূমকেতু যার সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণকাল দু’শো বছরের থেকে কম। মোট ৩২টি ধূমকেতু ও কয়েকশো গ্রহাণুর সঙ্গে ক্যারোলাইনের নাম জড়িয়ে আছে, অথচ তিনি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন না।
ক্যারোলাইন স্পেলমানের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোতে। ভাইয়ের বিয়েতে তাঁর সঙ্গে ভাইয়ের বন্ধু ইউজিন শুমেকারের আলাপ হয়, এক বছর পরে তাঁদের বিয়ে হয়। ইউজিন ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ এবং একই সঙ্গে অন্য গ্রহের গঠন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। ভূতত্ত্ববিদ হওয়ার কারণে ইউজিনকে দুর্গম জায়গায় কাজ করতে হত, প্রথমে ক্যারোলাইন, পরে গোটা পরিবার অনেক সময়েই তাঁর সঙ্গে যেতেন। ছেলেমেয়েরা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে পঞ্চাশ বছর বয়সি ক্যারোলাইন দেখলেন তাঁর হাতে অনেক সময়। তিনি তখন ঠিক করলেন যে তিনি স্বামীর কাজে সাহায্য করবেন। স্বামী জিজ্ঞাসা করলেন কী তাঁর পছন্দ, ভূবিদ্যা না জ্যোতির্বিদ্যা। ক্যারোলাইন বললেন, ‘ভূবিদ্যা অনেক করেছি, এবার তাহলে দ্বিতীয়টাই চেষ্টা করি।’
গ্রহদের ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে ইউজিনের কিছু মত ছিল, যেগুলির পক্ষে পরবর্তীকালে অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইউজিন পৃথিবীতে গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট গহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। সাধারণ ধারণা ছিল যে চাঁদের বুকে গহ্বর অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। ইউজিন বিশ্বাস করতেন যে সেগুলি হল গ্রহাণু ও ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফল। তাঁর মত ছিল পৃথিবীতে জলও এসেছে ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে। সৃষ্টির সময় পৃথিবী ছিল অত্যন্ত গরম। ঐ তাপমাত্রায় জল হাইড্রোজেন অক্সিজেনে ভেঙে যায়। হাইড্রোজেন হালকা গ্যাস, তা পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে মিলিয়ে যাবে। তাই সে সময় পৃথিবীতে জল থাকা সম্ভব নয়, পৃথিবীতে জল নিয়ে এসেছে ধূমকেতু। তাই গ্রহাণু ও ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে তিনি উৎসাহী ছিলেন। ক্যারোলাইন সেই কাজে যোগ দিলেন।
মাউন্ট পালোমার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিখ্যাত মানমন্দির, সেখানকার হেল টেলিস্কোপ দীর্ঘদিন ছিল পৃথিবীর সব থেকে বড়ো সাধারণ দূরবিন। কিন্তু বড়ো দূরবিন ধূমকেতু বা গ্রহাণু খোঁজার কাজে ব্যবহার হয় না; কার্যক্ষেত্রে তা এমনিও প্রায় অসম্ভব, কারণ বড়ো দূরবিনের দৃষ্টিক্ষেত্র, অর্থাৎ তার সাহায্যে একসঙ্গে আকাশের কতটা দেখতে পাওয়া যায়, তার পরিমাণ খুব ছোটো। জার্মানিতে দূরবিন নির্মাতা বার্নহার্ড স্মিড্ট (১৮৭৯-১৯৩৫) এক নতুন ধরনের প্রতিফলক নির্মাণ করেছিলেন। সেই প্রতিফলকের দৃষ্টিক্ষেত্র অনেক বেশি, তাই দিয়ে একসঙ্গে আকাশের অনেকটা জায়গার ছবি তোলা যায়। কিছুক্ষণ আগে পরে তোলা ছবি দুটি তুলনা করলে দেখা যায় গ্রহ, ধূমকেতু বা গ্রহাণু জায়গা পরিবর্তন করেছে, কিন্তু দূরের নক্ষত্ররা একই জায়গায় আছে। এভাবে গ্রহাণু বা ধূমকেতু খুঁজে পাওয়া যায়। শুনতে যতটা সহজ লাগছে আসলে কাজটা তার থেকে বেশি শক্ত। এক একটা ছবিতে হাজার দশেক জ্যোতিষ্কের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে। ফটোগ্রাফের মধ্যে ধুলো, দাগ, রূপার গ্রেন বা দানা ইত্যাদি থাকে, অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া তাদের থেকে জ্যোতিষ্কদের আলাদা করা শক্ত। তার মধ্যে কোন্ বিন্দুটা সরে গেছে বুঝতে হবে। উদ্দিষ্ট্ বিন্দুটি সবসময়েই খুব আবছা হবে কারণ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করা সবাই আগেই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।
মাউন্ট পালোমারে একাধিক স্মিড্ট টেলিস্কোপ আছে, তার মধ্যে সব থেকে বড়োটির ব্যাস হল ১২২ সেন্টিমিটার। কিন্তু সেটি সাধারণভাবে হেল টেলিস্কোপের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আমেরিকার প্রথম স্মিড্ট টেলিস্কোপটিও আছে পাউন্ট পালোমারে, তার ব্যাস হল ৪৬ সেণ্টিমিটার, সেটিকে ব্যবহার করছিলেন ইউজিন ও তাঁর সহযোগীরা। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর সঙ্গে ভবিষ্যতে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন গ্রহাণু ও ধূমকেতুদের খুঁজে বার করা। অনেকের মনে হতে পারে গ্রহাণুরা সবাই মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে আছে, কিন্তু তা ঠিক নয়। অনেক গ্রহাণু অন্য কক্ষপথে ভ্রমণ করে, পৃথিবীর খুব কাছে যারা আসে তাদের বলে নিয়ার আর্থ অ্যাস্টেরয়েড। এখন আমরা জানি যে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে এমনই এক ধূমকেতুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলে যে প্রলয় নেমে আসে তার ফলেই ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে যায় ও স্তন্যপায়ীদের উত্থান শুরু হয়।
ক্যারোলাইন প্রথম প্রথম ইউজিনকে অফিসের কাজে সাহায্য করছিলেন, ১৯৮০ সাল থেকে তিনি ফটোগ্রাফে গ্রহাণু খোঁজার কাজে হাত লাগান। তারপর দূরবিন ব্যবহারও শুরু করেন। ১৯৮৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ক্যারোলাইন প্রথম কোনো ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। পরের বছর আট মাসের মধ্যে তিনি পাঁচটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন, সেটা একটা রেকর্ড। ক্যারোলাইনের স্মৃতিকথা বিজ্ঞানের জার্নালে ছাপা হয়েছে। মাউন্ট পালোমার দূরবিন নিয়ে লেখা রিচার্ড প্রেস্টনের বই ‘ফার্স্ট লাইট’-এও ইউজিন ও ক্যারোলাইনের মাউন্ট পালোমারের জীবন নিয়ে অনেক কাহিনি পাওয়া যায়। আগে ক্যারোলাইন জীবনে কখনও সারা রাত জাগেননি। কিন্তু জ্যোতির্বিদদের কাজ তো রাত্রিবেলা, সেই রুটিনে তাঁকে অভ্যস্ত হতে হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একজন যখন দূরবিনকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, অন্যজন তখন আগের ফটোগ্রাফিক প্লেট ডেভেলপ করতেন, সেটিকে পরীক্ষা করে দেখতেন কোনো বিশেষ আলোর বিন্দুর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা।
ক্যারোলাইনদের প্রচারের আলোতে এনেছিল শুমেকার-লেভি-৯; নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতা ও টাইম ম্যাগাজিনের কভারে তাঁদের ছবি জায়গা পেয়েছিল। ১৯৯৩ সালের ২৪ মার্চ স্মিড্ট টেলিস্কোপে তোলা এক ফটোগ্রাফে তাঁরা এই ধূমকেতুটি আবিষ্কার করেছিলেন, তার কক্ষপথ থেকে বোঝা যায় যে গ্রহরাজ বৃহস্পতির টানে সেটি বাঁধা পড়ে গেছে এবং শিগগিরই সে বৃহস্পতিকে ধাক্কা মারতে চলেছে। খবর পেয়ে ইউজিনের মাথায় প্রথম এল যে জীবনে তিনি প্রথম কোনো মহাজাগতিক সংঘর্ষের ঘটনা দেখতে চলেছেন। ক্যারোলাইন ভাবলেন, ‘আমার একটা ধূমকেতু হারিয়ে যাবে!’
সংঘর্ষ ঘটে পরের বছর জুলাই মাসে। তার আগেই বৃহস্পতির আকর্ষণ ধূমকেতুটিকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। এক সপ্তাহব্যপী সেই সংঘর্ষ টেলিভিশন ও খবরের কাগজে জায়গা করে নিয়েছিল। বিশাল বিশাল আগুনের গোলা, হিমালয়ের থেকে দীর্ঘ অগ্নিশিখা, বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে পৃথিবীর দ্বিগুণ পর্যন্ত বড়ো কালো কালো ছোপ—সৌরজগতে এত আকর্ষণীয় দৃশ্য আগে কখনও দেখা যায়নি। সব থেকে বড়ো খণ্ডটির ধাক্কাতে যে পরিমাণ শক্তি বেরিয়েছিল, তা মানুষের সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারের মোট শক্তির ছ’শো গুণ। এর পরেই সৌরজগতে সংঘর্ষের সম্ভাবনা ও তার থেকে আমাদের সভ্যতার বিপদ নিয়ে সচেতনতা কল্পবিজ্ঞানের লেখক ও পাঠকদের বাইরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
শুমেকার দম্পতি এর পর অস্ট্রেলিয়াতে গ্রহাণু-সৃষ্ট গহ্বর পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ইউজিন গবেষক জীবন শুরু করেছিলেন এই ধরনের গহ্বর আবিষ্কার করে, সেই কাজই তাঁর জীবনের অবসান ঘটাল। অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগ খুবই জনবিরল, ক্যারোলাইনের ভাষায় সে অঞ্চলে সারা দিনে হয়তো দুটো গাড়ির সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় না। অথচ সেখানেই এক গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কায় ইউজিন মারা যান, ক্যারোলাইনও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ইউজিনের স্বপ্ন ছিল প্রথম ভূতত্ত্ববিদ হিসাবে চাঁদে পা দেওয়ার, তিনি মহাকাশচারী নির্বাচিতও হয়েছিলেন, কিন্তু এক অদ্ভুত রোগ ধরা পড়াতে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়নি। জীবিত ইউজিন না যেতে পারলেও তাঁর চিতাভস্ম চাঁদে পাঠানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত সে বিষয়ে তিনি একক। সুস্থ হয়ে উঠে ক্যারোলাইন আরও অনেকদিন তাঁর কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে বিজ্ঞানী মনে করতেন না, কিন্তু বিজ্ঞানী মহল তাঁর সঙ্গে সহমত নয়। বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, খুব কম বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেই তা ঘটে।
আগেই বলেছি ক্যারোলাইন শেষ পর্যন্ত বত্রিশটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেছিলেন; তার মধ্যে সাতাশটিতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইউজিন। ১৯৯৪ সালে যখন তাঁরা ধূমকেতু খোঁজা বন্ধ করেন, তখন কোনো জীবিত বিজ্ঞানী ক্যারোলাইনের রেকর্ডের কাছাকাছি ছিলেন না। ১৯৮৫ সালে তাঁর শিকারের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়, তখনই তিনি প্রেস্টনকে বলেছিলেন, ‘আমার লক্ষ্য হল ক্যারোলাইনকে অতিক্রম করা।’ এই ক্যারোলাইন কে যাঁর রেকর্ড ভাঙতে তিনি এত উৎসুক ছিলেন? সেই ক্যারোলাইনের খাতায় ছিল মাত্র আটটি ধূমকেতু, কিন্তু যে সময় এবং যে পরিস্থিতিতে তিনি এই আবিষ্কার করেছিলেন, তা ক্যারোলাইন শুমেকারের থেকে অনেক আলাদা।
দুই ক্যারোলাইনের মধ্যে মিল অনেক। দুজনেই দীর্ঘায়ু, ক্যারোলাইন শুমেকার বেঁচেছিলেন বিরানব্বই বছর, অন্যজন আটানব্বই বছর। দুজনেই ঘটনাচক্রে জ্যোতির্বিদ্যাতে এসে পড়েছিলেন; একজন স্বামী অন্যজন দাদাকে সাহায্য করতে গিয়ে ধূমকেতু আবিষ্কারের পথ ধরেন। দুজনেই যাঁদের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন, তাঁদের মৃত্যুর পরেও কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন, অথচ দুজনেই নিজেদের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখাতেন।
অমিলও কম নয়। আমাদের গল্পের এই দ্বিতীয় ক্যারোলাইন হলেন ক্যারোলাইন লুক্রেশিয়া হার্শেল, তাঁর জন্ম ১৭৫০ সালে জার্মানির হ্যানোভারে। তাঁর দাদা বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল (১৭৩৮-১৮২২)। ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কার, তারাদের সাপেক্ষে সূর্যের প্রকৃত গতি, আমাদের ছায়াপথের প্রথম মডেল, শ্বেত বামন নক্ষত্র, যুগ্ম নক্ষত্র—উইলিয়ামের আবিষ্কারের তালিকা শেষ হবে না। সমকালে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত ছিলেন। তাঁর অনেক আবিষ্কারের সময় তাঁর সহায়ক ছিলেন তাঁর ছোটোবোন ক্যারোলাইন।
পরে ব্রিটেনের রাজজ্যোতির্বিদ হলেও উইলিয়ামের প্রথম জীবন বেশ কষ্টে কেটেছিল। তিনি তরুণ বয়সে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। হার্শেল পরিবারের পুরুষরা সবাই ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ, উইলিয়ামও সঙ্গীত শিখিয়ে জীবন চালাতেন। জ্যোতির্বিদ্যা ছিল তাঁর শখ। দূরবিন কেনার পয়সা ছিল না, তাই তিনি একটা দূরবিন ভাড়া করে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি নিজেই প্রতিফলক দূরবিন বানাবেন ঠিক করেন। আধুনিক সমস্ত দূরবিনই প্রতিফলক দূরবিন, সেখানে বক্রতল আয়না ব্যবহার করা হয়। তাঁকে বাড়ির কাজে সাহায্যের জন্য হ্যানোভার থেকে ক্যারোলাইন ইংল্যান্ডে আসেন।
ক্যারোলাইন বাড়িতে পড়াশোনার বিশেষ সুযোগ পাননি। দশ বছর বয়সে টাইফাস রোগের জন্য তাঁর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর উচ্চতা ছিল মাত্র চার ফুট তিন ইঞ্চি। তাঁর বাবা মা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে সারাজীবন কুমারীই থাকতে হবে। হার্শেলের গৃহস্থালি দেখার জন্য এসেছিলেন বটে ক্যারোলাইন, কিন্তু হার্শেল তাঁকে সঙ্গীত ও গণিত দুই-ই শিখিয়ে নিজের সহকারী করে নিয়েছিলেন। এমন দিনও গেছে যে হার্শেল ষোল ঘণ্টা টানা দূরবিনের আয়না বানিয়ে গেছেন, ক্যারোলাইন হাতে করে তাঁকে খাইয়েছেন। হার্শেল একের পর এক বড়ো দূরবিন বানিয়ে চলেন, শেষ পর্যন্ত সে যুগের সেরা দূরবিনগুলি তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছিল। ইউরেনাস আবিষ্কারের পর তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে, রাজার অনুগ্রহে দূরবিন বানানোর অর্থও জোটে। একই সঙ্গে একজন সহকারী রাখার অর্থও মঞ্জুর হয়।
ক্যারোলাইন আয়না তৈরিতে হার্শেলকে সাহায্য করতেন। তখনও ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়নি, ক্যারোলাইন উইলিয়ামের পর্যবেক্ষণ লিখে রাখতেন। সেই সমস্ত পর্যবেক্ষণ সুশৃঙ্খলভাবে প্রকাশের উপযোগী করতেন। নিজে পর্যবেক্ষণ করতেন। অঙ্ক কষে জ্যোতিষ্কের অবস্থান ও কক্ষপথও নির্ণয় করতেন। সব দিক দিয়েই তিনি ছিলেন উইলিয়ামের যোগ্য সহকারী। তাই দাদা বোনকেই বেছে নেন। সেই হিসাবে ক্যারোলাইন হলেন প্রথম পেশাদার মহিলা জ্যোতির্বিদ, এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম বেতনভুক মহিলা সরকারী কর্মচারী। উইলিয়াম যখন জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণের রেকর্ড প্রকাশের উপযোগী করার সময় পাচ্ছিলেন না, তখন ক্যারোলাইন সেই কাজ করেন। ১৭৯৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির গবেষণাপত্রিকা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে সেই তালিকাতে তাঁর নামও লেখক হিসাবে আছে। তিনিই প্রথম মহিলা যাঁর গবেষণা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। তিনি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির প্রথম মহিলা স্বর্ণপদক বিজয়ী এবং তার প্রথম দুজন সাম্মানিক মহিলা সদস্যের একজন।
উইলিয়ামের ছেলে জন তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা জ্যোতির্বিদ ছিলেন, ক্যারোলাইন ও জন চিঠিপত্রে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। ক্যারোলাইন ডায়েরি লিখতেন ও চিঠিপত্র খুব যত্ন করে রাখতেন। জনের ছেলের নামও জন, তিনি ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার হিসাবে ভারতে এসেছিলেন, এবং বিখ্যাত গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভেতে অংশ নিয়েছিলেন। ভারত থেকে ১৮৬৮ সালে এক সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের সরকারি দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে তিনিও পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী মেরি কর্নওয়ালিশ হার্শেল ক্যারোলাইনের ডায়েরি ও চিঠিপত্র সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। এই বইটি হল তাঁর ও উইলিয়ামের চিঠিপত্র, ভাইবোনের জীবন সম্পর্কে সংবাদের অন্যতম সূত্র।
উইলিয়ামকে যখন সাহায্য করতে হত না, ক্যারোলাইন নিজে তখন একটি ছোটো দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। ধূমকেতু খোঁজার জন্য সেটি উইলিয়াম ক্যারোলাইনের জন্যই বানিয়েছিলেন। ১৭৮৩ সালে তিনি তিনটি নীহারিকা খুঁজে পেয়েছিলেন। নীহারিকা পর্যবেক্ষণ উইলিয়াম হার্শেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তিনি প্রথমে সঠিকভাবেই ভেবেছিলেন যে সেগুলি খুব দূরের তারকাগুচ্ছ, পরে যদিও তিনি সেই মত থেকে সরে আসেন। সম্ভবত ক্যারোলাইনের পর্যবেক্ষণ দেখেই তাঁর এই সম্পর্কে আগ্রহ জেগেছিল। ১৭৮৬ থেকে ১৭৯৭ সালের মধ্যে আটটি ধূমকেতু ক্যারোলাইন আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম আবিষ্কারের দিনটা ছিল ১ আগস্ট, ১৭৮৬। সেটি নিঃসন্দেহে পুরোপুরি ক্যারোলাইনের একার কৃতিত্ব, দাদা সেই সময় সেখানে ছিলেন না।
হার্শেলদের আকাশ পর্যবেক্ষণ নিরুপদ্রব ছিল না। উত্তর ইউরোপের শীতে সারা রাত বাইরে কাটানোর মূল্য হিসেবে নিউমোনিয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে নিউমোনিয়া ছিল প্রাণঘাতী রোগ। ক্যারোলাইনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় অন্ধকারে বরফে ঢাকা মাঠের উপর দিয়ে দৌড়োতে গিয়ে এক লোহার গজাল তাঁর পায়ে ঢুকে গিয়েছিল, কিছুটা মাংস সমেত সেটিকে বার করতে হয়েছিল। অনেক দিন তাঁকে বিছানাতে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু নিজের আঘাত নয়, ক্যারোলাইন চিন্তিত ছিলেন তাঁর দুর্ঘটনার ফলে উইলিয়ামের আকাশ পর্যবেক্ষণে কতটা অসুবিধা হবে তাই নিয়ে। তিনি সবসময়েই বিশ্বাস করতেন যে উইলিয়ামই আসল, তাঁর নিজের কাজটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।
উইলিয়ামের মৃত্যুর পরে ক্যারোলাইন জার্মানি ফিরে যান। সেখানে তিনি উইলিয়ামের রেকর্ড থেকে আড়াই হাজার নীহারিকার এক তালিকা বানিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি করা জ্যোতিষ্কের তালিকাগুলি এখনও আকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে জার্মানিতে প্রকাশিত তালিকাটির উপর ভিত্তি করে পরের নিউ গ্যালাকটিক ক্যাটালগ (NGC) তৈরি হয়েছিল। এখনও আকাশে অনেক আলোকউৎসকে NGC সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ছিয়ানব্বই বছর বয়সে প্রুশিয়ার সম্রাট তাঁকে এক স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন, সেটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফন হুমবোল্ট। সমকালে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধার স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত ধূমকেতুগুলি ছাড়াও একটি গ্রহাণু, চাঁদের বুকে একটি গহ্বর, দুটি নক্ষত্রমণ্ডল ও একটি কৃত্রিম উপগ্রহের নাম তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে।
ধূমকেতু সন্ধানী দুই ক্যারোলাইনই ঘটনাচক্রে জ্যোতির্বিদ্যাতে এসে পড়েছিলেন, কিন্তু সেই বিদ্যাকে আপন করে নিতে দেরি করেননি এবং সেখানে নিজেদের ছাপ রেখে গেছেন। দুজনের নামই শেষ পর্যন্ত আকাশে থেকে গেল। অন্য খ্যাতনামা ব্যক্তিদের স্মৃতিস্তম্ভ, মূর্তি, প্রশংসাপত্র যখন ধুলোতে মিলিয়ে যাবে, তখনও তাঁদের দুজনের নামাঙ্কিত ধূমকেতুরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে, আমাদের মনে করাবে যে আগ্রহ থাকলে সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব।
তথ্যসূত্রঃ
- Ups and Downs in Planetary Science, Carolyn Shoemaker, Annual Reviews of Earth and Planetary Science, Vol. 27, Page 1 (1999)
- First Light: The Search for the Edge of the Universe, Richard Preston (1987)
- Sir William Herschel: His Life and Works, Edward S Holden (1881)
- Memoir and Correspondence of Caroline Herschel, Mrs. John Herschel (1879)
ক্যারোলাইন হার্শেলের আবিষ্কৃত ধূমকেতুর তালিকা লিঙ্কঃ
https://gchbryant.tripod.com/Articles/Caroline0597.htm
ক্যারোলাইন শুমেকারের আবিষ্কৃত ধূমকেতু ও গ্রহাণুর আংশিক তালিকার লিঙ্কঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Category:Discoveries_by_Carolyn_S._Shoemaker