দেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় – আফরোজা খাতুন
তখন শিক্ষকতা করছি মুর্শিদাবাদের এক স্কুলে। থাকতাম ইসলামপুরে। বাস রাস্তার পাসেই। একদিকে নেতাজি পার্ক। মুসলিম সম্প্রদায় সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাস রাস্তার ওপর পারে চক। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসস্থান। সকাল থেকে বাসস্ট্যান্ডে বিভিন্ন পেশার মানুষের জমজমাট জমায়েত চলে। নিত্যদিনের চেহারাটা পালটিয়ে গেল ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ এর সেই দিন এবং তার পরের কটি দিনেও। ’সঙ্ঘ পরিবার’ ও রাজনৈতিক নেতাদের আঁতাতে সেদিন ধুলোয় মিশে গেল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ। সাময়িকভাবে অনেকের মনেই আত্মীয়তা-বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হল ‘আল্লাহ আকবর’ আর ‘জয় শ্রীরাম’-এর করুণ আর্তিতে। রাজনৈতিক দাবার ছকে আক্রান্ত মানুষ। দাঙ্গা-মৃত্যু, অবিশ্বাস, উসকে দিল অস্তিত্বের সংকট, নিরাপত্তাহীনতা। দিন মজুরের ঘরে হাড়ি চড়ল না। দোকানদার দোকানের ঝাঁপ খুলল না, স্কুল-কলেজ, অফিস বন্ধ। বাসস্ট্যান্ড দখল নিল পুলিশ। দুই পারের দুই সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন রাখতে চলল তাদের নজরদারি। তখন মোবাইল নেই। চকে আমার সহকর্মী নিত্যানন্দবাবু, অজন্তাদি কেমন আছেন, কি ভাবছেন জানতে পারিনি। তাঁরাও আমার খোঁজ নিতে পারেননি। বাবরি মসজিদ আর রামমন্দিরের লড়াইয়ে দুই সম্প্রদায় দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেলাম। নিরাপত্তাহীনতায়, সন্দেহ করার একরকম বাতিক যেন চোখে পড়ল সেই উত্তালতায়। শীতের সকালে তিলের খাজা বিক্রি করেন লিয়াকত চাচা। অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতেও খাজার ঝুড়ি মাথায় হাঁক ছেড়ে বিক্রিতে বেরিয়েছিলেন। বড় রাস্তায় তার পথ আটকে দিল পুলিশ। ফিরতে হল লিয়াকত চাচাকে। বিড়বিড় করে বকছেন। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ডেকে বললাম, বাবরি মসজিদ ভেঙেছে হিন্দু উগ্রপন্থীরা, দেশে দাঙ্গা চলছে, আপনি জানেন না? ওসব খবরে বাড়িতে ভাতের হাড়ি চড়বে মা?-লিয়াকত চাচার সহজ স্বীকারোক্তি। কর্মকেই জীবনের ধর্ম বলে মেনে চলা শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে ধর্মীয় রাজনীতি বিভেদ গড়তে এগিয়ে আসে। বিপন্ন মানবতার আর্ত চিৎকার নিয়েই ৬ ডিসেম্বর দেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে রয়ে গেল। ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে—এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’র (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) হৃদয়বাণীকে মূলসমেত উচ্ছেদ করার প্রবণতা থেকেই এই ধ্বংসযজ্ঞ।
বাবরি মসজিদ নির্মাণ হয় ১৫২৮-১৫২৯ সালে, মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের নির্দেশে। বাবরি মসজিদ নির্মিত হওয়ার কয়েক শ’ বছর পর এই মসজিদ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে। মসজিদ ঘিরে সংঘর্ষ ঘটে। তাই মসজিদের সীমানা নির্দিষ্ট করে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়। অযোধ্যায় ১৯৩৪ সালের দাঙ্গার সময় মসজিদের দেওয়াল এবং গম্বুজের ক্ষতি করে দাঙ্গাকারীরা। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারে বাবরি মসজিদ বিতর্ক চরম রূপ নিয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর । ১৯৪৯ সালে কিছু মানুষ, রাতের অন্ধকারে গোপনে মসজিদে ঢুকে রামলালার মূর্তি রেখে আসে। মসজিদ প্রাঙ্গণে অলৌকিকভাবে রামের মূর্তির আবির্ভাব ঘটেছে এ কথা প্রচার হয়। হিন্দু নর-নারী দলে দলে মুর্তি দর্শনে মসজিদে আসতে শুরু করেন। মন্দির-মসজিদ প্রসঙ্গের জোরালো বিতর্ক শুরু হলে তৎকালীন সরকার মসজিদের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের মুখে, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী হিন্দু মৌলবাদের আবেদন মেনে মসজিদের গেটের তালা খোলেন । ঝিমিয়ে পড়া বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলে সমস্যাকে উসকে দেন। হিন্দু মৌলবাদ মাথা চাড়া দেয়। শিলান্যাসের অনুমতি পেয়ে যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। ৯২ সালে ,মসজিদের জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নির্বিঘ্নে ১০ হাজার কিলোমিটার প্রচারমূলক রথযাত্রা করেন বিজেপি নেতা এল কে আদবানি। মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়। করসেবার উদ্দেশ্যে ৬ ডিসেম্বর জমায়েত হয় মসজিদের প্রাঙ্গণে এবং ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে ভেঙে ধূলিসাৎ করে অন্ধকারের পথে যাত্রা শুরু করে।
পচিঁশ বছর কেটে গেল। বাবরি মসজিদ ইস্যু এখনও জ্বলন্ত । বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জানিয়েছে ২০১৮-তেই রামমন্দির তৈরির কাজ শুরু হবে। একই সুর মোহন ভাগবতের। আর এস এস ও তার রাজনৈতিক দলের প্রধান মনোযোগ মন্দির আর গোমাতা। গেরুয়া সরকার কেন্দ্রে। বাহুবল দেখানোর প্রবণতা প্রকট । ১৯৯০-এর দশকে ‘রাম-জন্মভূমি’ ইস্যু ছিল ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টায় গো-রক্ষা নিয়ে সরব হলেন নরেন্দ্র মোদী। এখন গোমাতা রক্ষার নামে চলছে মুসলিম নিধন। ২০১৫ সালে উত্তরপ্রদেশের দাদরি গ্রামের মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে হত্যা করে গেরুয়া বাহিনী, তাঁর বাড়ির ফ্রিজে গরুর মাংস আছে সন্দেহে। একই বছর রাজস্থানের পেহলু খান খুন হন গোরক্ষকদের হাতে। হরিয়ানার জুনেইদ দিল্লি থেকে ইদের বাজার করে ফেরার সময় খুন হয়ে যান। মোদী সরকারের নীরবতায় স্ব-ঘোষিত গোরক্ষকদের তাণ্ডব অব্যাহত। বাবরি মসজিদ ও রাম-জন্মভূমি সমস্যা যেমন সর্বভারতীয় হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল, গো-রক্ষা ইস্যুও আজ সেই রূপ নিতে চলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। ইন্ধন যোগাচ্ছেন নেতারা। তেলেঙনার সাংসদ টাইগার রাজা সিং-এর এবারের রামনবমীর অনুষ্ঠানের ভাষণ-‘ইস দেশ কা হর বাচ্চা সিয়ারাম কহেগা। ইস দেবভূমি পর নেহি ইসলাম রহেগা।’ দাঙ্গার পটভূমিকে পুষ্ট করছে এই বার্তা। লাভ জেহাদের শ্লোগান তুলে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার চলছে। জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দেশের বাস্তব সমস্যাকে ঢাকা দিতে ধর্মীয় উন্মাদনার পরিবেশ তৈরি অনেক বেশি অনিবার্য হয়ে উঠছে তাদের কাছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে জিনিসের দাম। ডিমনিটাইজেসনের নামে সাধারণ মানুষের টাকা ছিনতাই হল। আদানি, আম্বানি, বিজয় মাল্যদের উদর পূরণ তাদের প্রধান উদ্দেশ্য । হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে তারা উদ্দ্যোগী। মুসলিম মা বোনেদের ইনসাফ দেওয়ার অঙ্গীকার করে উদারতার প্রদর্শন চালাচ্ছে। তালাক বন্ধের আইন করতে চেয়ে উত্থাপন করছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের প্রসঙ্গ। উদ্দেশ্য, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে ব্রাম্ভণ্য বিধি চাপানো। মহিলাদের অধিকার সংকুচিত, নিয়ন্ত্রিত করা। গেরুয়া সরকার, তার দল ও সংঘ পরিবারের ধর্ম-রাজনীতির চালে অশান্ত দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা। অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা আজ সজাগ। সম্প্রীতির পরিবেশ ফেরাতে সংগঠনগুলিও তৎপর। সচেতন নাগরিকদের মানব-বন্ধনের উদ্যম সারাদেশে। কিন্তু ২০১৮-তে কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন। ২০১৯-এ জাতীয় নির্বাচন। মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরাতে ধর্মই যে হাতিয়ার। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভোট নিশ্চিন্ত করা জরুরি। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়, স্বচ্ছ ভারতে আজ যুক্তিবাদের জায়গা নেই। মুক্ত চিন্তার কদর নেই। হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাস থেকে দেশপ্রেমিক টিপু সুলতানের নাম মুছে ফেলবে বলছে। টিপু জয়ন্তী বন্ধ করবে। রচিত হবে গোরক্ষকদের মস্তিষ্কপ্রসূত বিকৃত এক ইতিহাস। পাঠ্য বইয়ের মধ্য দিয়ে সেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ইতিহাস চারিয়ে দেওয়া হবে শিশু মনে। হিন্দু-মুসলমান ভালোবেসে বিয়ে করতে পারবে না। নিজের রান্নাঘরে পছন্দের খাবার খেতে পারবে না। নিজের রুচিতে চলতে পারবে না। গরুর মাংস আছে সন্দেহে মেরে ফেললেও প্রশাসন নীরব থাকবে। মুসলমান রক্ষার চেয়েও গোমাতা রক্ষা করা তাদের ধর্মীয় বিধান। ঐতিহাসিক মসজিদ মুছে দিয়ে, কাল্পনিক রামের প্রতিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করানোতেই তারা অধিক স্বচ্ছন্দ। হিন্দুত্ববাদীদের এই মন, এই ভাবনা থেকে জাত উদ্দ্যম, গোরক্ষার দায়িত্ব পালন আর মন্দিরের শিলাপূজার সারি দীর্ঘ করে দেশকে অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেবে। স্বচ্ছ ভাবনা, যুক্তিসিদ্ধ গবেষণা ছাড়া আলোর পথ দেখা যায় না। উন্নত দেশ গড়ার প্রকল্প থেকে যোজন দূরে অবস্থান মোদী সরকারের। ধর্মের উন্মাদনায় মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখার রাজনৈতিক কৌশল বিস্তার করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, তাদের নিয়ন্ত্রিত দল বিজেপি ও তাদের সরকার। সামনের বছর মসজিদ-মন্দির বিতর্ক কতদূর গড়ায় সেই অপেক্ষায় আমরা। গুজরাট দাঙ্গার নায়ক যখন রাষ্ট্রের প্রধান, তখন দেশকে রক্তাক্ত ধসের দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁর দল রাম মন্দির গড়ার স্বপ্ন বিলিয়ে আবার হয়ত সংঘাতের পরিবেশ জোরালো করবে। কিন্তু ‘বিবিধের মাঝে’ মিলন যে ভারতের ঐতিহ্য। সেই আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ ভারত স্বমহিমায় মাথা তুলবে, এটাও নিশ্চিত এবং নিশ্চয়।
অসাধারণ