বাইপাসের ধারে – পম্পা বিশ্বাস
অদ্রি আমার প্রেমিক নয়। নেহাতই সহকর্মী-বন্ধু। কিন্তু রবিদার মতো কোনো কোনো লোকের কাছে এ-কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এবং কোনোদিন এদের বিশ্বাস করানোও যাবে না। আর এমনই কপাল আমাদের যে, আমরা দু-জনে একসঙ্গে বারবারই এদের চোখে পড়ে যাই।
সময়ে-অসময়ে, মাঝেমধ্যে আমাদের একসঙ্গে দেখলেও এবার পর পর চার দিন রবিদার সঙ্গে আমাদের দেখা হল। সে-দিন অফিস ছুটির পর বাস স্টপেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দু-জনের দেখা। একসঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি। দেখি রবিদা আমাদের দেখছেন। তাকিয়ে তাকিয়ে। তারিয়ে তারিয়ে। না-ডেকে। পরদিন একসঙ্গে একটা বইয়ের খোঁজে বেরিয়েছিলাম অফিস থেকে। রবিদা হাত তুলে হাসলেন। তৃতীয় দিন আমি অফিস থেকে বেরিয়ে ব্যাঙ্কে যাচ্ছি আর অদ্রি অফিসে সেকেন্ড হাফে জয়েন করতে ঢুকছে। একদম মুখোমুখি। এক মিনিটের জন্য হাই-হ্যালো করতে-না-করতে দেখি রবিদা আড়চোখে তাকিয়ে মিচকি হাসছেন।
এরপর আজকেও আবার রবিদা দেখলেন যে, আমরা ছুটির পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভুট্টা খাচ্ছি। রবিদা এগিয়ে এসে অদ্রিকে ডেকে নীচু গলায় কী যেন বলতে লাগলেন। দেখলাম, অদ্রির বেশ একটু সময় লাগছে রবিদার কথা বুঝতে। মনে হচ্ছে, রবিদাকে এ-বিষয়ে ও কিছু প্রশ্নও করছে। বিষয়টা খানিকটা বোঝা হলে অদ্রি আমাকে বলল,
—‘বাইপাসের ধারে এক জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছেন রবিদা। তুমি যাবে??
—‘সেখানে কী আছে?
—‘অনেক কিছু। গাছপালা। পুকুর। গ্রাম-গ্রাম ব্যাপার।’
— ‘যেতে কতক্ষণ লাগবে?’
—‘একঘণ্টা মতো। তাই তো রবিদা?’
রবিদা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালেন। আমি বললাম,
— ‘বেশ তো, কাল যাওয়া যাবে। কাল তো অফিস হাফ-ডে-তে ছুটি হয়ে যাচ্ছে।’
সেই কালটাই আজ এসেছে। ছুটির পরে, ভরদুপুরে, আমি, অদ্রি আর রবিদা একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি ছুটতে লাগল বাইপাসের দিকে। মাঝে মাঝে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন কালো মেঘে আকাশ ভারী হয়ে মাটির দিকে নেমে আসছে। চারিদিকে ধাতব ধূসরতা। আমরা টুকিটাকি গল্প করছিলাম।
একসময় যাত্রা শেষ হল। একটা মাটির দেওয়ালওয়ালা চায়ের দোকানের সামনে আমরা নামলাম। তারপর খানিকটা হেঁটে একটা বাঁক ঘুরে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছোনো গেল। সেটা একটা বাড়ি। দেখলাম, আট-দশটা বর্ষা-ঠেকানো একটা নড়বড়ে কাঠামো। প্লাস্টারহীন।… নামেই পাকাবাড়ি। গতিক সুবিধের নয়। বেড়ার নামমাত্র ঠেকনা-দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে হল। তারপর কিছুটা জমি পেরিয়ে আসল দরজা। সবুজ রং-জ্বলা দরজার নীচের অংশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে এখন ঝাঁঝরা। সেটা খোলাই ছিল। প্রথমে রবিদা … তারপর অদ্রি … তারপর আমি ঢুকলাম। আমি ভেবেছিলাম, কোনো বেড়াবার জায়গা-টায়গা হবে বুঝি। তার বদলে এরকম একটা হাড়-জিরজিরে বাড়িতে এসে ঢুকতে হবে ভাবতে পারিনি। হতভম্বভাবে ওদের পিছন পিছন গুটিগুটি এগোলাম।
ভিতরের চাতালটার খানিকটা অংশে ইট বসানো, খানিকটা মাটির। ইট-বসানো অংশে ইটগুলো পাশাপাশি শোয়ানোমাত্র। একফোঁটা বালি-সিমেন্টের চিহ্ন নেই। চাতালের মাটির অংশ থেকে একটা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। সিঁড়িও ইট বের করা। নড়বড় নড়বড় করছে। লুঙ্গি পরা দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির পাশে। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রবিদা আমাদের ডেকে উপরের দিকে হাত দেখিয়ে দিলেন,
— ‘যাও, ওপরে ঘর আছে। ভালো সময় কাটবে।’
অদ্রি নিজের হতভম্বভাবটা লুকোবার জন্য স্মার্টলি ইট-নড়া সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখে অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ‘চলো ওপরটা একটু দেখে আসি।’ –
ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েক ধাপ ওপরে সিঁড়ির মধ্যে লিকলিকে দুটো সাপের ছানাকে দেখা গেল। লোকদুটো ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। কারও নড়বার এতটুকু ইচ্ছা ছিল না। রবিদা ‘আহা আহা’ করে উঠলেন। এদিকে ততক্ষণে চাতালেরর ইট-পাতা অংশের লাগোয়া ঘরের দরজায় দু-চার জন পুরুষ-মহিলা ছায়ার মতো এসে দাঁড়িয়েছে। আর ওদের পিছনে খড়র-খড়র করে একরকম অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যেন কোনো জন্তু নখ দিয়ে ইট আঁচড়াচ্ছে। আমি চমকে তাকালাম। ছায়ামূর্তিদের পিছন থেকে সেই অপার্থিব শব্দের মালিকও বেরিয়ে এল। গলায় লম্বা দড়ি লাগানো একটা কিম্ভূতকিমাকার প্রাণী। একটা বেজি। দড়িটা ছায়াদের হাতে ধরা ছিল। তারা এবার প্রাণীটাকে ছেড়ে দিল। … এটাই তাহলে ওদের সাপ মারার পদ্ধতি?!
বেজিটা নিজের চারপাশে একবার চক্কর মেরে ছুটে এল। অদ্রি, আমি, রবিদা যে যেদিকে পারলাম ছিটকে সরে গেলাম। বেজিটার মুখের ভিতরটা লাল টুকটুকে। ঠোঁটটা হাসি-হাসি। চোখের দৃষ্টি ক্রুর এবং ক্রুদ্ধ। হাসিভরা মুখে এত রাগ ওর যে, ওর নাক দিয়ে ধোঁয়া বেরোলেও আমি বিস্মিত হতাম না। কেমন যেন ড্রাগন-ড্রাগনভাব।
আমি ছিটকে সরে আসতে আসতে খেয়াল করলাম, বাড়ির পিছনে একটা বোজা ডোবা আছে। ওখানে দু-জন মহিলা মাথায় ঘোমটা আর মুখে আঁচল দিয়ে দাঁড়িয়ে। এদিকে বেজিটা তখন অসম্ভব দ্রুততায় একটা সাপের ছানাকে ছিঁড়ছে। অন্য ছানাটা সেঁধিয়ে গেছে সিমেন্ট-বালিহীন ইটের ফাটলে। সিঁড়ির কাছে দাঁড়ানো লোকগুলো একটা কঞ্চি দিয়ে ইটের ফাটল খোঁচাচ্ছে। মহা উৎসাহে অদ্রি গোটা ব্যাপারটায় পরামর্শ জোগাচ্ছে। রবিদা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। সব মিলিয়ে এক জমজমাট কাণ্ড।
আমি চলে এলাম খিড়কির ডোবার ধারে। চারিদিকে কচু গাছের জঙ্গল। হালকা বৃষ্টিতে পাতাগুলো কাঁপছে। বউ-দুটোর একেবারে বিধ্বস্ত চেহারা। আঁচল-চাপার ফাঁক থেকে একজনের অকালে পড়ে যাওয়া দাঁতের শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। বলিরেখায় বলিরেখায় মুখ-দুটো ছিন্নভিন্ন। হাজায় নষ্ট হাত-পায়ের আঙুল। আঙুলের ডগাগুলো রক্তহীন সাদা। চাতালে জমায়েত ছায়ামূর্তিদের মতো ওরাও চুপ এবং হতাশ।
—‘তোমরা এ-বাড়িতে থাক?’
— ‘হ্যাঁ দিদিমণি।’
— ‘মুখে আঁচল-চাপা কেন? কী হয়েছে?’
একজন আগাগোড়া চুপ। অন্য জন বলল,
—‘দুটো দাঁত পড়ে গেল আমার। রক্ত বার হচ্ছে। তাই আঁচল চেপেছি।’ বলে পিচ করে রক্তথুতু ফেলল ডোবায়।
— ‘উপরে ক-টা ঘর আছে?’
— ‘তিনটে।’
একটু থেমে আবার বলল,
— ‘ঘরে ঘরে টিনের দরজা আছে। জানলার পর্দা আছে। চৌকিতে বিছানা-বালিশ
আছে।’
— ‘ভাড়া কত করে? –
— ‘খুব কম দিদিমণি। তিন-শো টাকায় এক বেলা। রাতে থাকলে পাঁচ-শো। খাওয়া-দাওয়া করতে চাইলে টাকা দিলে আমরা রেঁধে দেব।’
— ‘তোমরা সব আত্মীয়স্বজন?’
— ‘হ্যাঁ গো, এটা বসতবাড়ি। একটু দূরে নদী আছে। সবাই পিকনিক করতে আসে। তখন ঘর ফাঁকা থাকে না। এখন তো সিজিন নয়। রবিবাবু মধ্যে মধ্যে লোকজন নিয়ে আসেন। এখানে ওনার “ফিরি”।”
পাশের জনকে দেখিয়ে বললাম,
— ‘ও কাঁদছে কেন?’
—‘ওর মেয়েটা কাল মরে গেছে।’
— ‘কী হয়েছিল?’
— ‘জ্বরে ভুগে ভুগে একশা। কাল হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে পথেই মরে গেল।’
এদিকে রবিদা তখন আমাদের ডাকছেন,
— ‘চলো, তোমাদের এখানকার নদীটা দেখিয়ে আনি।…সাপটাকে তো খুঁজে পেল না… আর একদিন আসা যাবে। মা-কেউটেটা কোথায় আছে কে জানে?’
তারপর সিঁড়ির কাছের লোকগুলোকে ধমকালেন,
— ‘বেজিটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখিস কেন তোরা? বোকার দল! ওকে খুলে রাখ। মা-কেউটেটাকে ও ঠিক খুঁজে বার করবে।’