বেলারানির গল্প বা শেষ বড় ম্যাচ – অর্ণব রায়
এদিকের রাইট উইং-এর থেকে বলটা একটা সোজা ফলো থ্রু তে মাঠ ক্রস করে ওদিকের পেনাল্টি বক্সের কাছাকাছি গিয়ে পড়ার আগের বেলারানি তার দৌড় শুরু করেছিল। এদিকের স্ট্রাইকার ছেলেটি একটু বেশীই ছটফটে। এর আগে বার দুয়েক অপোনেন্টের পেনাল্টি বক্সের কাছে কাছে ঘুরঘুর করছিল। ডিফেন্ডার গোলকিপার হাত নেড়ে চেঁচিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেসময় ওই এলাকায় বল ছিল না। বেলারানি ছেলেটিকে ওয়ার্ণিং দেয়। বয়স কম। রক্ত গরম। বেশী ম্যাচ খেলেনি বোধহয়। না হলে বেলারানি মাঠে থাকতে এরকম করার সাহস পেত না। বলটা গিয়ে পেনাল্টি বক্স আর মিডফিল্ডের মাঝে মাঠের বাঁ দিকে গিয়ে ল্যান্ড করার আগেই ছেলেটার পা পেয়ে যায়। আর তারও আগে বেলারানির বাঁশি ফুররর করে অব্যর্থ্য বেজে ওঠে। বেলারানি মাঠের কোনাকুনি চোখ চালিয়ে দেখে নেয়, হ্যাঁ, লাইন্সম্যান ফ্ল্যাগ তুলে দিয়েছে। অফসাইড।
গোটা মাঠ হৈ হৈ করে উঠল। মন্ডলপুর বিজলি সঙ্ঘ এক গোলে হারছে। খেলা চলছে বিরাশি মিনিট। ইন্জুরি টাইম বাদ দিয়ে। বেলারানি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল। সে জানে কী হতে চলেছে এবার। সে শ্বাস টেনে ধরল। তারপর প্রস্তুত হল দুনিয়ার মুখোমুখি হতে। সাত আটজন ছুটে আসছে তার দিকে। চোখে মুখে দুনিয়া খেয়ে নেব রাগ। বাইরে, রাস্তায়, লোকালয়ে হলে বেলারানি দেখত সাত আটজন পুরুষমানুষ তার দিকে ছুটে আসছে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হত পালানোর। কিন্তু এটা মাঠ। তার এলাকা। আর তার দিকে যারা ছুটে আসছে তারা পুরুষ বা নারী নয়, প্লেয়ার।
রেফারিদের জন্যও এরা একটা করে মেডেলের ব্যবস্থা রেখেছে। তার মানে ভালোই দাঁও মারতে পেরেছে। নয়ত ফাইনাল সেমি ফাইনাল কিচ্ছু না, নিতান্ত লিগ ম্যাচে রেফারির জন্য মেডেলের খরচা করা, কে কবে দেখেছে! সুরজিৎ দা বলেছিলেন, চলে যা, পার ম্যাচ ভালো টাকা দিচ্ছে। দূর বলে একটু কেন মেন করছিল বেলারানি। সুরজিৎ দা দাবড়ে উঠলেন, দূর তো কী হয়েছে? সারাজীবন কি বাড়ির চৌহদ্দিতে, নিজের এলাকায় খেলিয়ে যাবি না কি? নতুন মাঠ নতুন প্লেয়ার নতুন পরিবেশ নতুন পাবলক , এসব হ্যান্ডেল করতে না পারলে আর রেফারি কীসের? আর দূরই বা এমন কী? ম্যাচ শেষ হবে, সন্ধ্যের ট্রেনে বাড়ি চলে আসবি। ওরা স্টেশনে পৌঁছে দেবে বলেছে। আর তোকে তো দেবেই।
শেষ কথাটা গায়ে মাখেনি বেলারানি। হয়ত তার কান অবধি পৌঁছয়ই নি। পৌঁছলেও কোনও বিশেষ অর্থ নিয়ে তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়েনি। সে ঠিক করে ফেলে, যাবে। পার ম্যাচ টাকার অঙ্কটা একটা বড় ব্যাপার বটে। কিন্তু নতুন মাঠ নতুন দর্শক নতুন প্লেয়ারের চ্যালেঞ্জটা মিডফিল্ড থেকে অল আউট অ্যাটাকের মত ঝড়ের মত তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে হাতের গ্লাভস টাইট করে রেডি হয়ে যায়। এককালের গোলকিপার তার রক্তের ভেতর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
মেডেল গলায় পরাতে গিয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরা কালো ফ্রেমের চশমা পাকা চুলের ভদ্রলোক দুহাতে তার হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘খুব ভালো ট্যাকেল করেছো মা। খুব বুদ্ধি করে শক্ত হাতে সিচুয়েশান সামলেছো। খুব ভালো খেলিয়েছো পুরো ম্যাচ। আশির্বাদ করি, অনেক বড় হও। অনেক বড় বড় ম্যাচ খেলাও।’ এসব বলাতে তো সেই ভদ্রলোকের মুখে বাবার মুখ আরও বেশি করে বসে গেল। বেলারানির মনে হল, চট করে একটা প্রণাম করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে মনে দ্বিধা এল। সে ম্যাচের রেফারি। কোনও প্লেয়ার এই ভদ্রলোককে প্রণাম করছে না। শুধু হাত মেলাচ্ছে। সেখানে সে দুম করে প্রণাম করে বসবে। তাছাড়া এটা মাঠ, রবীন্দ্রজয়ন্তী না। এখানে এত ঢিপঢাপ প্রণাম চলে না। তার ওপর গোটা মাঠ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভদ্রলোক তার সামনে থেকে সরে গেছেন। পরে কে যেন বলল, উনি এলাকার স্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টারমশাই। তখন মনে হল, প্রণামটা করলেই হত।
ম্যাচ শেষে স্টেশানে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। সেই পৌঁছে দেওয়াটা করা হল সাইকেলের পেছনের কেরিয়ারে বসিয়ে। যাওয়ার সময় একটা রিকশা ছিল। ফেরার সময় সেটি গায়েব। যাওয়ার সময় রিকশার সিটে বসে রাস্তার ঝাঁকুনিটা ততটা মালুম পাওয়া যায়নি। এখন সাইকেলের কেরিয়ারে বসে গাঁয়ের রাস্তার মহিমাটা ভালোই টের পাচ্ছে বেলারানি। যে ছেলেটি তাকে তাকে পেছনে বসিয়ে এই চষা ক্ষেতের মত রাস্তা দিয়ে টেনে টেনে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার চেহারাটা ভালোমানুষ গোছের। ম্যাছ শেষ করে হাতমুখ ধুতে ড্রেস বদলাতে বদলাতে লোকজন সব হাওয়া হয়ে গেছিল। রেফারি পুরুষ মানুষ হলে মাঠেই গামছা জড়িয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিতে পারে। বা না চেঞ্জ করেও রেফারির জার্সিতেই যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারে। লোকে বড়জোর জিজ্ঞেস করবে, ‘কী, ম্যাচ ছিল?’, ‘কোথায় ম্যাচ ছিল?’ বা ‘খেলিয়ে ফিরলেন বুঝি? কে জিতল? বেলারানি তো আর তা করতে পারে না। গোটা জেলা জুড়ে প্রচুর লোক বেলারানিকে চিনলেও, আরও অনেক অনেক লোক চেনে না। রেফারির ড্রেসে ট্রেন বাসে উঠলে যে পরিমান লোকের তাকানো আর মন্ত্যব্য সহ্য করতে হবে, একটা গোটা ম্যাচের ধকলের পর একটা বেলারানির ইচ্ছে করে না। তাই তার জন্য মাঠের কাছাকাছি একটা বাড়ি আর সেই বাড়িতে মহিলা ও বাথরুমের ব্যবস্থা রাখতে হয়। ম্যাচের আগে একবার, পরে একবার। এতরকম ঝামেলা পুইয়ে যে টুর্নামেন্ট কমিটি তাকে ডাকে, তাদের ভালো বলতেই হবে। অবশ্যই এর পেছনে সুরজিৎ দার হাত পা মাথা কিছু না কিছু রয়েছে। তার ওপর পাশের বাড়ির মাসীমা তাকে ম্যাচের পরে বারান্দায় বসিয়ে মুগপুলি গোকুল পিঠে না খাইয়ে ছাড়লেন না। সেটা কিছুটা তারা ভালোমানুষ বলে আর বেশীটাই যে মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে মাঠভর্তি পুরুষের সামনে দুদল পুরুষকে ফুটবল খেলায়, পুরুষেরাও মাঠে যার সামনে ট্যাঁ ফোঁ করে না সেই মেয়ে কীভাবে আমাদের ঘরের মেয়ের মত চুড়িদার পরে আসনপিঁড়ি করে বসে মুগপুলি আর গোকুলপিঠে খায়, সেটা দেখার কৌতুহল থেকে করা। বাড়ির আর পাড়ার বাচ্চারা উঠোনে ভিড় করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মহিলারা বারবার সামনে দিয়ে যাতায়াত করে। বিভিন্ন আড়াল থেকে ফিসফাস ও হাসি চাপার আওয়াজ পাওয়া যেতে থাকে।
এইসব সেরে, ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ‘আবার এসো’ ইত্যাদি সামলে মাঠে আসতে আসতে সব ভোঁ ভাঁ। টুর্নামেন্ট কমিটির দু একজন তবু আছে। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বেলারানি চিন্তিত হয় না। শেষ পর্যন্ত হাঁটার ব্যবস্থা তো আছেও। কেউ একটা সঙ্গে পথ দেখানোর পেলে মিটে যায়। আলো এখন শুধু আকাশে। বেলারানি ডান হাতের কবিজির ছোট্ট ঘড়িটা একবার দেখে নেয়। ট্রেনের এখনও দেরি আছে কিছুটা। প্রায় দশমিনিট খোঁজাখুঁজি, পারস্পরিক দোষারোপ, আধখ্যাঁচরা ক্ষমা চাওয়া ইত্যাদির পর এই ছেলেটিকে ধরে নিয়ে আসা হয়। সেও বেলারানিকে ‘বসুন দিদি। ধরে বসবেন’ বলে পেছনে বসিয়ে প্যাডেল চেপে দেয়। সাইকেল ল্যাগব্যাগ করে স্টেডি হয়। বেলারানি টাল খেয়ে পড়োপড়ো হয়ে সামলে নেয়। সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে।
ছেলেটি সাইকেল চালাতে চালাতে গলগল কথা বলে। বেলারানি হুঁ হাঁ উত্তর দেয়। ছেলেটি নিজের কথা বলে। ওই সেই বিধবা মা অবিবাহিতা বোনের গল্প। বলে, ‘ জানেন দিদি, আমিও ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। ভালো খেলতাম। রাইট ব্যাক। ভাবতাম সুপার ডিভিশানে খেলব। না হলে ফার্স্ট ডিভিশান। কলকাতার প্লেয়ারদের নামই শুনেছি, খেলা দেখিনি কখনও। কলকাতা যেতে পয়সা লাগে তো! কে নিয়ে যাবে!’
বেলারানি দুই পা দুইদিকে করে বসেছিল। তাকে এরকম ভাবে সাইকেলের কেরিয়ারে বসতে দেখে দু একজন তাকিয়েছিল। বেলারানি পরোয়া করেনি। মেয়েদের মত একদিকে পা করে সাইড ফিরে বসলে নির্ঘাত পড়ে যাবে। ছেলেটাও ব্যালেন্স রাখতে পারবে না। বেলারানি খেয়াল রাখছে, ঝোঁপেঝাড়ে পা না ঘসে যায়। গা গঞ্জে অজস্র বিছুটি। তার মধ্যে ছেলেটার কথা শোনা। ছেলেটা বলে চলেছে, বাড়ির অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। একটা চাকরি বাকরি না হলে আর চলে না। চাকরিই বা কে দেবে! এইচ এস পাশ। নীলুদা বলে, অমন হাজার হাজার ছেলে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীলুদা নিজেই কলকাতা গিয়েও চাকরি পেল না। চার বছর পড়ে থাকল ওখানে। অত অত পরীক্ষা দিল। পড়াশোনায় অত ভালো! এখন কী করছ্র, না গ্রামে ফিরে ছোড় ছোট বাচ্চাদের টিউশনি পড়াচ্ছে। আর খেলে কি আর পয়সা আছে? দু বছর আগে অবধি খেপ খেলতে যেতাম। পঞ্চাশ পঁচাত্তর কিছু একটা পাওয়া যেত। একবার তো পুরো একশোর একটা নোট দিয়েছিল। আইলের ওপর ঘোষপাড়ায় খেলা ছিল। এখন আর পারি না। তবু মাঠ তো। টানে। খেলা হলে দেখতে আসি। রেগুলার।’
কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে। যেমন, ‘এখন আর পারি না’-তে বেলারানির মনে প্রশ্ন ভুড়ভুড়িয়ে ওঠে। কেন পারে না? বয়স তো এমন কিছু না। তার থেকে অনেকটাই ছোট হবে। তাহলে পারে না কে? ইনজুরি? অসুখ? কিন্তু ঝাঁকুনির চোটে কথা বলবে কী, নিজের হাত পা সামলে রাখাই বিরাট ব্যাপার। ছেলেটা পারছে কী করে কে জানে। খেপ খেলতে যাওয়ার কথায় ব্যাগের মধ্যে টুর্নামেন্ট কমিটির দেওয়া খামটা খচমচ করে ওঠে। কত দিয়েছে কে জানে! তাড়াহুড়োয় ব্যাগে ভরে নিয়েছে। দেখা হয়নি। বেলারানি ঝাঁকুনি খেতে থাকে।
ট্রেনে উঠে শরীর ছেড়ে দেয়। বসার জায়গা পাওয়ার পর আরও। ট্রেনটা পেতে শেষ দশমিনিট ছেলেটাকে কথা থামিয়ে হোঁকহোঁক করে প্যাডেল করতে হয়েছে। ওই যে শেষবেলায় মাঠে, ‘কে নিয়ে যাবে’, ‘একটা দায়িত্ব নেই রে’, এই তুই একটু যা, দিদিকে স্টেশনে দিয়ে আয়’, ‘না না, আমি কী করে যাব, আমার তো এখন…’— এইসব করতে গিয়ে যে দেরি, এ তারই মাশুল। ছেলেটার প্যাডেল করতে গিয়ে আর ট্রেন পাবে কি না, না পেলে কী হবে এইসব টেনশানে পেছনে বসে বেলারানির, দুজনেরই হার্টবিট পাঁচশো মিটার স্প্রিন্টারের লাস্ট ল্যাপের মত হয়ে গেছিল। কোনওমতে স্টেশনে ঢুকে ট্রেনে পা দিতে না দিতে ট্রেন নড়ে উঠল। আসার সময় রিটার্ন টিকিট করা ছিল। ছেলেটা ট্রেনের পাশে হাঁটতে হাঁটতে আর হাঁফাতে হাঁফাতে ভেতরে উঁকি মেরে বলল, ‘দিদি আবার আসবেন। আমার নাম আলম।’ বেলারানি জানলার ধারে সিট পায়নি।
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আলো আর মানুষবোঝাই ট্রেন ছুটতে শুরু করলে বেলারানির শরীর সেই রেলগাড়ির ছন্দের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। ট্রেনের ছুট বাড়লে মনের ছুট কমে। গায়ে আগুন ছোটা বন্ধ হয়ে ঘাম, সেই ঘামে জানলার বাতাস লেগে শরীর শীতল হয়। বেলারানি ওড়না দিয়ে ঘাড় গলার ঘাম মুছতে গিয়ে টের পায়, তাড়াহুড়োয় কানের দুলদুটো পড়তে ভুলে গেছে। ম্যাচ শুরুর আগে সে গা থেকে যেটুকু যা গয়না আছে, আসল নকল, খুলে রাখে। আছেটাই বা কী! কানের দুল খুঁজতে গিয়ে ব্যাগের মধ্যে সাদা ছোট খামটা আর একবার খচমচিয়ে ওঠে। বেলারানি একবার খামটা বের করে খুলতে যায়। তারপর রেখে দেয়। কী দরকার। অচেনা লোকভর্তি ট্রেনের কামরা। কে কী মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে! চুরি ছিনতাই যা বেড়েছে আজকাল!
চুরি ছিনতাইয়ের কথা মনে হতে বেলারানির শিথিল হয়ে আসা শরীর টানটান হয়ে যায়। মনে পড়ে, হরিসভার পর থেকে পাকুড়তলা পার হয়ে তাদের পাড়ায় ঢোকার মুখটা পর্যন্ত রাস্তা একেবারে শুনশান। সন্ধের পর একটা জনমনিষ্যির দেখা পাওয়ার জো নেই। রাস্তার আলোগুলো সব ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাঙা। যে দু একটা টিমটিম করে জ্বলে, আলোর থেকে অন্ধকার দেয় বেশি। আর প্রায় দিনই ওই রাস্তায় কিছু না কিছু লেগে আছে। এই তো সেদিন, কালু স্বর্ণকারের ছোটভাই কলকাতা থেকে ফিরছিল। তাও রাতের ট্রেন নয়। সন্ধ্যে আটটার ট্রেনে। গরমকালে আটটা আর কী এমন রাত! হরিসভা পার করে চৌধুরীদের আমবাগান পড়তে না পড়তে মনে হল কারা যেন সাইকেল নিয়ে পিছু নিয়েছে। কালু স্বর্ণকারের ভাইয়ের কাছে কিছুই ছিল না। না টাকাপয়সা না মালের স্যাম্পেল, যা তার কাছে হামেশাই থাকে। কিন্তু যারা পিছু নিয়েছে তারা তো আর তা জানে না। কিছু না কিছু নিশ্চই পাওয়া যাবে, এই ভেবে যদি মারধোর করে! বা চাকুটা ক্ষুরটা চালিয়েই দেয়! সে রিকশাওয়ালাকে জোরে জোরে প্যাডেল করতে বলে। রিকশাওয়ালা আবার ছিল আমাদের চরণ। সে বেটা গোটা দিনটা পাউচ মেরে পড়ে থাকে। সন্ধ্যে হলে রিকশাটা নিয়ে দু প্যাডেল মারল কি মারল না, তার পরের দিনের পাউচের টাকা উঠল কি উঠল না, সে গিয়ে হরিসভার কেত্তনের আসরে খঞ্জনি নিয়ে বসে গেল। নেশা করে আর না খেয়ে শরীরের যা দশা, ও কাউকে দু চড় মারতেও হবে না, সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে দুবার জোরে জোরে পা ঠুকলেই চরণ কাটা কলাগাছটার মত ধপ করে মাটিতে পড়ে যাবে। তাকে জোরে জোরে প্যাডেল করতে বলা না বলা সমান। বরং বলা মানে বিপদে পড়া। তাওয়ে পড়ে বা ভয় পেয়ে দমের বাইরে জোরে চালাতে গিয়ে সেই গোনাগাঁথা দমটুকু ফস করে বেরিয়ে গেলে শেষে মরা মেরে খুনের দায়ে পড়তে হবে। যা হোক, কেউ এসে রাস্তাটাস্তা আটকায়নি বা সেরকম কিছু, ঠাকুরের অশেষ কৃপা, হয়নি। কিন্তু বাকী রাস্তাটা যে কীভাবে এসেছিল, তা কালু স্বর্ণকারের ভাইই জানে। স্টেশানে বেলারানির সাইকেল রাখা আছে। ব্যাগে খামের মধ্যে খচমচ করছে টুর্নামেন্ট কমিটির দেওয়া টাকা। যদি তিন চারজন রাস্তা আটকে দাঁড়ায়ই, ওই চৌধুরীদের আমবাগানের কাছে বা পাকুড়তলার মোড়টায়! ভয় নয়। ভয় বেলারানি কাউকে পায় না। তাছাড়া আশেপাশের এলাকায় তার একটা পরিচিতি আছে। কিন্তু দিনকাল ক্রমে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লোকে পঞ্চাশ একশ টাকার জন্য লোকের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সে একা কতজনের সঙ্গে পারবে? এটা ফুটবল মাঠ নয়। এখানে কেউ তার কথা শুনবে না। তার হাত তোলা, থামতে বলা, বাঁশির আওয়াজ, কোনও কিছুর কোনও দাম নেই এখানে। কোথায়ই বা আছে!
পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে চারিদিকে শাঁখের আওয়াজ থেমে গিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে বাংলা সিরিয়ালের আওয়াজ আসতে শুরু করেছে। ময়নাদের বাড়ি পার হতে গিয়ে বারান্দায় কেশোবুড়ো ‘কাশিরাম’কে বসে থাকতে দেখল বেলারানি। দুই কাশির দমকের ফাঁকে বুড়ো প্রবল হাঁফাচ্ছে আর দম নিচ্ছে। পাছে ডেকে সাতসতেরো প্যাচাল পাড়তে শুরু করে, বেলারানি হুশ করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে ভাবতে ভোলে না, বেচারা লোকটা, কাশতে কাশতে আসল নামটাই হারিয়ে ‘কাশিরাম’ হয়ে বসে আছে। এরকম ভাবনা আজকাল আর চেষ্টা করে ভাবতে হয় না। হাজার একটা ভাবনা আপনিই চলে আসে। ফোকাসের তের গুষ্টি উদ্ধার হয়ে বসে আছে। সুরজিৎ দা যতই কানের দুপাশে দুহাত নিয়ে সামনে পেছনে করে ‘ফোকাস, বেলু ফোকাস’ বলে বেলারানিকে চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করুক, ও আর ফেরবার নয়। তাছাড়া বেলারানির জীবনে ফোকাস নাড়িয়ে দেবার মত এলিমেন্টের অভাব আছে!
নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা টিনের গেট খুলে একফালি উঠোনমতন বাড়ির সামনেটায় পা রাখতে না রাখতে পোষা নেড়িটার মত সেসব এলিমেন্ট তার দিকে ঝাঁপিয়ে এল। নেড়ির সঙ্গে তফাত এই যে এইসব ঝামেলা ঝগড়া অশান্তি, যা পাড়ার প্রতিটা বাড়িতেই সকাল বকেল লেগে আছে, এরা সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে কুঁইকুঁই করে না। ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি ছিঁড়ে নিতে চায়।
বেলারানি একটু থামে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে ধরে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। শ্বাসের সঙ্গে সুধাকাকীমাদের বাড়ির কামিনী ফুলের গন্ধ আর পেছনের কাঁচা ড্রেনের গন্ধ একসঙ্গে আসে। বেলারানি সেই অতিপরিচিত বাতাস বুকের ভেতর একটুখানি পাক খাইয়ে শ্বাস ছেড়ে দেয়। চোখ খোলে। হুইসিলটা মনের দুঠোঁটে কষে চেপে ধরে। যেন সবটুকু শ্বাস দিয়ে একবার জোরে বাজিয়ে ফেলতে পারলে সবকিছু থেমে যাবে। কিছু থামে না। মায়ের সঙ্গে বোনের খিটমিট, বোনের সঙ্গে বেলার খিটমিট, বিড়াল ভাতে মুখ দিল, বেলা হয়ে গেল এখনও বিছানা তুললি না গীতু, রেশন আনতে কি আমি যাব, তাহলে এই গুষ্টির হাঁড়ি ঠেলবে কে, কাপড় মেলবে কে তুলবে কে, ভাত খাওয়া হলে এঁটো মুছবে কে, বাসন মাজবে কে, আচার শুকোতে দিলে পাখপাখালি তাড়াবে কে— শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে ছোট বড় প্রশ্ন, উত্তরে ঝগড়া, অশান্তি, মনের কালো ধোঁয়া বিষ, ‘কী, আমাকে এত বড় কথা বলতে পারলি!’, ‘আমিই তবে অশান্তির কারন!’, ‘আর তুই যে সেবার…’ দিনে রাতে সকালে বিকালে এত ফাটল তৈরি হচ্ছে জোড়া লাগছে, চেরা দাগ কাটাকুটি হিজিবিজি, এসবের তলায় একটিই মূল সুর, নর্দমার মত ঘ্যানঘেনে কান্নার মত বয়ে চলে, পয়সা নেই। কেউ মুখে কিছু বলে না। এমনকি মা-ও সে সিনেমার মত, রাতে সবাই শুয়ে পড়লে পাশে বসে, লম্ফ জ্বলছে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে না, ‘তোর বাবার করা এম আই এস-এর টাকায় আর টানা যাচ্ছে না রে। জিনিসপত্রের যা দাম চারিদিকে! কিছু একটা কর বেলি। টাইপিংটাও শিখতে শিখতে ছেড়ে দিলি। ঐ মাঠে খেলিয়ে কটা টাকাই বা আসে! একটা চাকরি বাকরির চেষ্টা না করলে তো আর চলছে না।’ না, এরকম বুঝদারের স্বরে কোনও কথা এবাড়িতে কেউ বলে না। রাগারাগি চেঁচামেচি দুমদাম পা ফেলে উঠে চলে যাওয়া হয়। কথা হয় না।
শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে, চোখ খুলতে খুলতে মাঠের সেই ভদ্রলোক কানে আর একবার বলে গেলেন, খুব ভালো খেলিয়েছ মা। খুব ভালো ট্যাকেল করেছ সিচুয়েশন। উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় উঠতে উঠতে মা আর বোনের কথা কাটাকাটি, বাসনের আওয়াজ সব ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে যায়। ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে সবার আগে ব্যাগ খুলে খাম বের করে। দুখানা একশ টাকার নোট। ঘরের চাল থেকে হোল্ডারে আটকে ঝোলানো ষাট পাওয়ারের বাল্বটা একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাইরে থেকে আসা সমস্ত আওয়াজ থেমে যায়। কয়েকদিনের জন্য সমস্যা মিটল। অনেকদিন মাংস আসেনি বাড়িতে। কাল আনবে। কাল সকালে একবার মাঠের দিকে যেতে হবে। অনেকদিন যাওয়া হয় না।
সকাল সবসময় সকালের মত। মুখচোখ ধুয়ে চকচকে শিশু। ভালো কিছু হবেই হবে ভাব। মানুষই এমন সকালে উনুনে আগুন দিয়ে গলগলে ধোঁয়া বের করে। কলের লাইনে চিল চিৎকার করে ঝগড়া করে। এত বছর হয়ে গেল, তবু বেলারানি পাশ দিয়ে ট্রাকস্যুট স্পোর্টস শু পরে জগিং করতে করতে দৌড়ে গেলে সে ঝগড়া কয়েক সেকেন্ড দম নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের তাকানোর কারন বদলায়, তাকানো ফুরোয় না।
বড় ইস্কুলের মাঠ, লোকে ফিল্ডের মাঠও বলে। যুগীপাড়ার দিক থেকে মাঠে পা দিয়ে, ঘাস মাটিতে হাত ছুঁইয়ে সে হাত কপালে ঠেকিয়ে বুক ভরে একটা দম নিয়ে ফার্স্ট ল্যাপ শুরু করতে না করতে মেজাজ খিঁচরে গেল। গত সাতদিন ধরে এই মাঠে চব্বিশ প্রহর নামকীর্তন হয়েছে। সকাল বিকাল পুরো এলাকার যেকোনও কোনা থেকে কান পাতলেই বিভিন্ন সুরে ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ হরে রাম হরে রাম’ শোনা গেছে। রাত বাড়লে কান পাতার দরকার হয়নি। শেষের দিকে সয়েও গেছিল। কিন্তু এখন এই মাঠ বেলারানি সইয়ে নেয় কি করে? শালপাতা, কাহজের ঠোঙা, প্লাস্টিক থেকে শুরু করে আধপাটি চটি, বাচ্চার ঝুমঝুমির ভাঙা টুকরো, কী নেই! গোটা মাঠটা সবুজের ওপর নানা রঙের আবর্জনা ছড়িয়ে চিতাবাঘের পিঠের মত হয়ে গেছে। তার ওপর আছে গর্ত। এক হাত দু হাত যেতে না যেতে ইয়া বড় বড় সব গর্ত। কত বাঁশ পুঁতেছিল কে জানে! গোটা মাঠটার একেবারে আকুপাংচার করে রেখে গেছে। একবার কায়দামত পা টুকু পড়ার অপেক্ষা। তিনমাস বিছানা। সিজন তো যাবেই, কেরিয়ারও শেষ হয়ে যেতে পারে।
বেলারানি মাটির দিকে চোখ রেখে সাবধানে পা ফেলে ফেলে দৌড়োচ্ছিল আর নিজের মনে গজগজ করছিল। এভাবে দৌড়োলে দৌড়ের রিদম থাকে? না দৌড়ের পশ্চার ঠিক হয়? এখন আর আগের মত দম পায় না। তবু এক আধবার স্প্রিন্ট তো টানতে হবে! এই যদি মাঠের হাল হয়, সে না হয় প্লেয়ার নয়, কিন্তু যারা প্লেয়ার, ঐ তো দেখা যাচ্ছে, মাঠের ঐ দিকটায়, অলক, তাপস, ইয়াকুব, জাগৃতি সঙ্ঘের ছেলেগুলো স্ট্রেচ করছে, এবার ওয়ার্ম আপ করে প্র্যাকটিসে নামবে, তারাই বা স্প্রিন্ট টানবে কী করে? প্র্যাকটিস ম্যাচই বা খেলবে কী করে! গোটা মাঠটাকে তো চালুনি বানিয়ে রেখে দিয়েছে।
ল্যাপ নিতে নিতে মাঠের ওপাশে পৌঁছলে ছেলেগুলো ঘিরে ধরে। ‘বেলাদি আমাদের একটা ম্যাচ খেলিয়ে দাও। এতদিন পরে মাঠে এলে!’
বেলারানি দৌড় থামায় না, এগোনো থামায়। হাত পা স্ট্রেচ করতে থাকে। বলে, ‘ম্যাচ খেলবি কী করে রে? মাঠের অবস্থা দেখ!’
ওরা হৈ হৈ করে ওঠে, ‘মাঠের অবস্থা তো এরকমই থাকবে দিদি। আজ কীর্তন, কাল পার্টির মিটিং, জনসভা, এমনকি বিয়েবাড়ি পর্যন্ত মাঠে প্যান্ডেল খাটিয়ে হচ্ছে। এই তো গোয়ালপাড়ার বুল্টনের দিদির বিয়ের খাওয়াদাওয়াই তো এই মাঠে প্যান্ডেল খাটিয়ে হল। ওই যে ক্লাবঘরের দিকটায়। কেন তুমি দেখোনি?’
বেলারানির মনে পড়ে না। মাঠে কত কিছুই তো হচ্ছে। তবু তো বলে কয়ে এদিক ওদিক বিস্তর ধরাধরি করে রথের সময় সার্কাস বসাটা এই মাঠ থেকে রথবাজারের পেছনে জয়শ্রী সিনেমা হলের পাশের মাঠটায় সরানো গেছে। একবার যে মাঠে সার্কাস বসে গেছে, সার্কাস চলে গেলে সে মাঠের দিকে আর তাকানো যায় না। সে সব কী বিরাট বিরাট গর্ত রে ভাই! এক একটা গর্ত একটা করে হামা দেওয়া বাচ্চা গিলে নেবে। হবে না ই বা কেন। অত বড় বড় অত উঁচু উঁচু সব তাঁবুকে ধরে রাখতে ঐ কুতুব মিনারের মত পিলারই লাগে। শুধু কি গর্ত! মাটি খুঁড়ে উনুন, সেই উনুনের ছাই, সেই ইয়নুলে রান্না হওয়া মাছ মাংসের হাড়, সবজির খোসা, ভাতের মাড়, বাঘ সিংহর জন্য এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া কুকুরদের হাড়গোড় চামড়া, বিভিন্ন পশুর বিভিন্ন রকম মল, হাতির চিবিয়ে ফেলে দেওয়া কলাগাছের গোড়া, ঘোড়ার বালতি থেকে উপচে আসা আধচিবোনো ছোলার দানা, মানুষের উলোকোটি চৌষট্টি রকমের আবর্জনা, কত আর বলা যায়। তার ওপর সার্কাসের মূল এরিনা করার জন্য, মাঠের চাঁদিই গোল করে চেঁছে উড়িয়ে দেয়। তার ওপর বালি মাটি ফেলে রোলার চালিয়ে সমান করে দেয়। ওই জায়গাটুকুতে ঘাস গজাতে মিনিমাম একখানা পুরো বর্ষা লাগে। তাও যদি ওর ওপর দিয়ে মানুষ গরু মোষ হাঁটাচলা না করে।
বছর বছর সার্কাস আসার ব্যাপারটাকে রথবাজারের পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় সরাতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। জায়গা রাজার। বাজার কমটিকে লিজ দেওয়া আছে। তাতে হাজারটা ডিসপুট। বাজার কমিটিও কিছু করছে না। শুধু শুধু ফেলে রেখেছে। মাঝের থেকে চারদিকের বাড়িঘর দোকানপাট থেকে যে যা পারছে ফেলছে আর জায়গাটার এখানে ওখানে ময়লার ঢিপি উঁচু হচ্ছে। আর কয়েক বছর পরেই জায়গাটা একটা ভ্যাটে পরিণত হবে। ‘বাজার কমিটি, ‘রথের মেলা কমিটি’ আর ‘মাঠ বাঁচাও সমিতি’র ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের প্রথম অধিবেশনে চা শিঙাড়া খাওয়া আর পরস্পরকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না। তৃতীয় অধিবেশন থেকে ব্যাপারস্যাপার একটু ঠিকঠাক দিকে গড়ায়। চতুর্থ বা পঞ্চম বৈঠক নাগাদ সার্কাস সরানোর প্রস্তাবে সবপক্ষ সায় দেয় ও একটি ঢিলে মিনিমার দুখানা পাখি হত্যার ব্যবস্থা পাকা হয়। ফিল্ডের মাঠটাকে বাৎসরিক গনধর্ষণের হাত থেকে বাঁচানো যায়। রথবাজারের পেছনের মাঠটি ভ্যাটে পরিনত হওয়ার হাত থেকে বাঁচে। শুধু তাই নয়, বছর বছর সার্কাস পার্টির থেকে আদায় করা ভাড়া থেকে বাজার কমিটির একটা থোক ইনকামের ব্যবস্থা হয়। মূলতঃ এই পয়েন্টে এসেই বাজার কমিটির সব আপত্তি গলে যায়। এছাড়া তাদের মাথায় এটাও চলতে থাকে, রথবাজারের পেছনের মাঠে সার্কাস বসা ও পিলপিল করে লোক আসা শুধু রথবাজার বা সিনেমা হলের জন্য না, গোটা বাজারের ব্যবসার জন্য ভালো। সেরকমই সিদ্ধান্ত হয়। অবশ্যই দুই প্লাস হাফ আড়াইখানা পার্টিই যে যার নিজের মত করে ব্যাপারটা থেকে সর খেতে এসেছিল। কিন্তু খুব রেয়ার হলেও, কখনও কখনও মানুষ নিজের ভালোটা বুঝতে পারে। মাঝাখানে অবশ্য দু একটা ছোটোখাটো বাধা এসেছিল। যেমন, জায়গাটা যে নোংরা হয়ে পড়ে আছে, সেটা পরিস্কার করাবে কে? বা সার্কাস চলে গেলে সেই মাঠ আগের অবস্থায় ফেরাবে কে। সারাবছর জায়গা দেখভাল করবে কে। তা সেসব ঝামেলা পার করে আসা গেছে। কখনও আলোচনা করে, কখনও কথাকাটাকাটি করে। বলে রাখা ভালো, এই পুরো পদ্ধতিতে বেলারানি, কাঠবিড়ালির হলেও একটা ভূমিকা নিয়েছিল। জেলার একমাত্র মহিলা রেফারি বলে কথা। এলাকার খেলাধুলা বিষয়ক কোনও ব্যাপার হলে তাকে নিতেই হয়। তারও যেতে আগ্রহের অভাব দেখা যায়নি কখনও।
জাগৃতি সঙ্ঘের ছেলেরা বলে, ‘ঐ গর্তের মধ্যেই তো খেলে যাচ্ছি। ও আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমাদের কিছু হবে না। তুমি একটু দেখেশুনে পা ফেলো, ব্যাস্। তাহলেই হবে।’
বেলারানি শেষ একবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, যদিও বাধা দেওয়ার ইচ্ছে বা কারন কোনওটাই জোরালো নয়। ‘হুইসিল টুইসিল কিছুই আনিনি যে রে!’
ওরা আবার হৈ হৈ করে ওঠে। এটা কোনও সমস্যা হল! আমাদের সঙ্গে কি হুইসিল নেই! আর প্র্যাকটিস ম্যাচে কে আর অত দেখে!
তারপর আর কী, মাঠ আর ম্যাচ। বলের ছুটোছুটি। সাত সাত চোদ্দজন প্লেয়ারের সেটাকে দখল করার লড়াই। ঘাম। উত্তেজনা। হাসি। অ্যাড্রিনালিন। সকালের খিচিবিচি ভাবটা কেটে যায়।
সেই দিনও নাই, সেই দাপটও নাই। তবু সুরজিৎ দা ডাকলে যেতেই হয়। না ডাকলেও বাড়িটা ডাকে। টাউনের ওদিকটা সব বাটি দোতলা তিনতলা হয়ে গেল। একবার ছেড়ে দুবার করে রঙের কোট খেয়ে ঝাঁ চকচকে। মোজাইক মার্বেলের মেঝে, বাহারি আলো, গ্রিলের গেট। এই স্নো পাওডার টানা পাড়ার মধ্যে মুর্তিমান আঁচিলের মত এই একটাই বাড়ি। লোহার গেট ঠেলে ঢুকলে পাশের বাড়ির বাচ্চা ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠবে। তারপর গুনে গুনে চল্লিশ পা গেলে দুধাপ সিঁড়ি ভেঙে রেলিং দেওয়া লাল বারান্দা। সেই বারান্দার প্রতিটি ফাটলের ইতিহাস ভূগোল বেলারানির মত আরও অনেকের এককালে মুখস্ত ছিল। তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানাদিকে ছিটকে গেছে। বেলারানি যায়নি। এখনও মাঝে মাঝে আসে।
গেট থেকে বারান্দা যেতে যে চল্লিশ পা, তাতে ভদ্রপাড়ার ভদ্রলোকেদের চল্লশবার ভ্রু কপালে উঠে যাবে। তারা অযত্ন দেখবে, আগাছার বাড়বাড়ন্ত দেখবে, সাপের উৎপাত কল্পনা করে বকের মত পা ফেলবে, এতখানি জায়গা এভাবে পড়ে আছে দেখে আফশোষ করবে, বিক্রিবাট্টার প্রস্তাব, দালালি, জমির আকাশে হেঁটে বেড়ানো দাম, এসবও তাদের মাথায় এক লহমায় খেলে যাবে। যাদের চোখে এসব কিছুই পড়ে না, যাদের মাথায় এসব কিছুই খেলে না, যেমন বেলারানি, যারা গেটের ভেতরে পা দিয়ে এই চল্লিশ পা মনে মনে গোনে, কখন পার হবে, আর বারান্দার পরে দরজা ঠেলে ঘরটায় বাঁ দিকে খাটের ওপর লুঙ্গী আর ফতুয়া পরে লোকটা বসে আছে আর গোটা ঘরটায় আলো, গোটা ঘরটায় লোকটার লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরা হাসি ভেসে বেড়াচ্ছে। লোকটা ‘আয় বোস’ বলে ডেকে হাত চাপড়ে চৌকির একপাশটা দেখিয়ে দিচ্ছে। ইনজুরির জায়গায় ফস করে পেনকিলারের স্প্রে পড়ছে।
সেই গোটা ঘরে থৈ থৈ করা আলো একটু একটু করে কমতে দেখেছে বেলারানি। আশেপাশের বাড়িগুলো উঁচু হয়ে গেছে। না কি এই বাড়িটা দিনে দিনে আরও নিচু ঝুঁকে পড়া কোলকুঁজো মতন হয়ে গেছে! এই ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়ানো আলোর প্রজাপতি হাসিগুলো বেশীরভাগই মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। রোগের চাপড় খেয়ে, অভাবের চাপড় খেয়ে, শোকের অপমানের চাপড় খেয়ে ডানা ছটফট করেছে। তারপর নিভে গিয়ে মরে গেছে। কেউ সেসব এত বছর ধরে খেয়াল করে দেখেনি। বেলারানিও দেখেনি। তবে ঐ আলো কমে আসা, হাসি আবঙ্কু কমে আসা টের পেয়েছে। আর পাঁচটা লোক যেমন পায়। আর পাঁচটা লোক যেমন মাথা নেড়ে আফশোষের সুরে বলে, পুরোনো দিন কত ভালো ছিল, সেরকম কিছু কথা সেরকম ভঙ্গীতে বেলারানিও বলে থাকে সময়ে সময়ে।
যেমন আজ দেখল, সুরজিৎ দা-র হাত কাঁপছে। কথা বললে বোঝা গেল, গলাও কাঁপছে। এই গলা একসময় মাঠের একপ্রান্ত থেকে বাতাস চিরে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। ঐ হাতের চড়চাপড় খায়নি, এককালে এলাকায় এরকম ইয়ং ছেলেমেয়ে খুঁজে পাওয়া যেত না। বৌদি চা দেবার নাম করে রান্নাঘরে ডেকে বললেন, সুরজিৎ দা আজকাল কিছু কিছু কথাও ভুলে যাচ্ছেন। সাধারণ কথা সব। অনেকেই ভোলে। বৌদির মনে হচ্ছে এটা ভালো লক্ষণ নয়। ‘আচ্ছা মানুষটা যদি সব ভুলে যায়! আমাকেও যদি আর চিনতে না পারে! আমার যে আর কেউ নাই!’ সাতমাস পেটে থাকার পর শিশুটি পৃথিবীতে শ্বাস নিতে অস্বীকার করে। বৌদি দুবছর পাগলের মত ছিল। মাঝে মাঝে সারা শরীরে খিঁচুনি দিত। মাসের পর মাস কথা বলত না। মাঝরাতে উঠে স্নান করত। সেসব দিন বেলারানি দেখেনি। সুরজিৎ দা- কাছে শুনেছে। সেসব দিনের কথা বলতে গেলে সুরজিৎ দা-র চোখ একটু মরে আসত। তার বেশী কিছু নয়। স্বাভাবিক ভাবে বলে যেত সেইসব কঠিন দিনগুলো পার করার গল্প।
আজও বলছেন, ‘তোকে আমি বারবার বলছি বেলু, কলকাতা যা। ডি এস এ-এর একমাত্র মহিলা রেফারি তুই। গোটা বাংলায় আর দুজন মাত্র আছে। তারা সব চুটিয়ে লিগের ম্যাচ খেলাচ্ছে। আর তুই এই মফঃস্বলে পড়ে আছিস! এখানে লোকে মেয়েদের খেলাধুলো বলতে বোঝে কিতকিত, স্পুন রেস আর মিউজিক্যাল চেয়ার। নিজের খেলাধুলাটা শেষ করেও কি কথাটা বুঝতে পারিসনি? কলকাতায় যা। একটা বড় ম্যাচ অন্ততঃ খেলা। না হলে এত কষ্ট করে, এত ছুটোছুটি করে রেফারি হয়ে কী লাভ হল?’
আগে হলে বলা যেত, আগুন পাহাড়ের মাথা উড়ে গেল। এখন বড় জোর বলা যায়, জলফোস্কার ওপরের নুনছাল একটু গেলে গেল। দুদিন পরে হয়ত তাও মনে হবে না। না, সেরকমভাবে ফেটে পড়া, আগুন পাহাড়ের মাথা উড়ে যাওয়া, কোনওদিনই হয়নি। ‘তোর খেলা হবে না’, ‘আমি খেলবই’— জাতীয় দড়ি টানাটানি, বাসন ছোঁড়াছুঁড়ি বা দুম করে দরজা লাগানো, কিছুই হয়নি। প্র্যাকটিস সেরে ফিরলে নিজের জলটা নিজে গড়িয়ে নিতে হত। সকালের জন্য ছোলা বাদাম নিজেকে ভিজিয়ে রাখতে হতো রাতে। ডিস্ট্রিক্ট ট্রায়াল এ একবারের জায়গায় দুবার ফেল অনেকেই করে। গোপন বা বুঝতে না পারা ইনজুরি থাকে। ওই দশ মিনিটের ট্রায়াল ম্যাচে কি ই বা বোঝা যায়! কাকেই বা স্পট করা যায়! তবু বেলা রানী গোলকিপার বলে আলাদা করে চোখে পড়ে। বাকীদের কথা কে কাকে কী বলবে! ওই হাফ প্যান্ট পড়ে মটরদানার মত মাঠের একপাশে, ছেলেদের খেলার জায়গা ছেড়ে রাখতেই হয়, তারা খেলুক বা না খেলুক, ঐ মটর দানার মত মাঠের একপাশে ছুটোছুটি করছে। সেখান থেকে বেছে নেওয়া সহজ কাজ নয়। প্লাস ভীড়। এ দৃশ্য কোন পুরুষ মানুষ মিস করবে! এমনি করে নানা রকম গোলমালের মাঝে পড়ে একবারের জায়গায় দু’বার বাদ পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তা বলে সেবার, সেই থার্ড টাইম! বেলারানি পিক ফর্মে। সকাল সন্ধ্যা প্র্যাকটিস। সুরজিৎ দা ওর দিকে মন প্রাণ ঢেলে দিচ্ছে। বেলারানিও শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুকে ঘামে পরিণত করছে। বাড়ি যাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই। মাঠ মাঠ মাঠ। কিন্তু কী হল! ভাতৃসঙ্ঘের মাঠে ট্রায়াল। সুরিজিত দা নিজে নিয়ে গেলেন সে বার। মেয়েদের সিলেকশন ম্যাচ কিছু রোজ রোজ হয় না। অত প্লেয়ারই বা পাবে কোথায়! বেলারানি, অন্ততঃ তার নিজের মতে খুব খারাপ খেলেনি। একটা হাফ চান্স কে গোলে পরিবর্তন হতে দেয়নি। বাকি যা বাঁচানো সম্ভব নয় তাকে কে বাঁচাবে। সুরজিৎ দা, ওই মানুষ সহজে কারোর প্রশংসা করে না, ম্যাচ শেষে কাছে এসে চাপা গলায় কানের কাছে বলে গেল, ‘ব্রাভো’ । সিলেকশন কমিটির লোকজনও পিঠ চাপড়ে গেল। সাত দিন পর লিস্ট বেরোলে দেখা গেল, নাম নেই। কেন নাম নেই আর কার কার নাম আছে, কেন তাদের নাম আছে— এসব চিন্তায় বেলারানি প্রচুর রাত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভোর করে দিয়েছে। প্রশ্ন সোজা, উত্তরও সকলেরই জানা। সুরজিৎ দা প্র্যাকটিস শেষে পাশে বসে বললেন, কোনও ব্যাপার না। নেক্সট টাইম। সেই নেক্সট টাইম আর এলো না। বাবা কাশতে কাশতে আর হাঁফ টানতে টানতে একেবারে সিনেমার মত বিছানার সঙ্গে মিশে হারিয়ে গেল। তারপর চুপচাপ একদিন সেই বিছানা শুদ্ধু শ্মশানের দিকে রওনা দেওয়ার আগে তিনটে বছর কেটে গেছে। ডাক্তার বদ্যি ওষুধপত্র করে করে সংসারের সব রক্ত বয়ে গিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে। দু একটা ফিক্সড ডিপোজিট, মায়ের ছিঁটেফোঁটা গয়না, মামার দেওয়া কিছু টাকা সব গরম তাওয়ায় জলের ফোটার মত হুশ করে উবে গেল। তারপর থেকে বাকি দিনগুলো কী করে চলছিল, সত্যি বলতে কি ভগবানই জানেন, অন্তত এরা জানে না।
এই অবস্থায় মনের জেদে খেলাধুলো চালিয়ে যাওয়া যায়। কাগজে এরকম মানুষদের কথা মাঝে মাঝেই পড়তে পাওয়া যায়। বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে, মা লোকের বাড়ি বাসন মাজে, ছেলে যাচ্ছে স্পেনে ট্রায়াল দিতে। সুতো কলের মিস্ত্রির ছেলে রঞ্জি খেলছে। ন্যাশনালে চান্স পেল বলে। লড়াই করে লড়াই করে, কেউ জানতে পারে না, একটা বড় ম্যাচ, সেখানে জ্বলে ওঠে, তখন সবার নজর গিয়ে পড়ে। বেলারানি সেই বড় ম্যাচ পেল কই! প্লেয়ার থেকে ব্যর্থ প্লেয়ারের খাদে সংসার আর ভাগ্য তাকে পা ধরে টেনে নামাচ্ছিল। সুরজিৎ দা হাত ধরে টেনে তুলে রেফারি বানিয়ে দিল। সে হতেও কম লড়াই নেই। বাইরে, ঘরে, নিজের ভেতরে। সে গল্প আর একদিন। রেফারি হয়েই বা কী হলো? এদিক ওদিক ছুটকো ছাটকা ম্যাচ খেলিয়ে বেড়াচ্ছে। গলায় ঝোলানোর মেডেল পেলেই খুশি হয়ে যাচ্ছে। খামের ভেতর দুটো কি তিনটে একশ টাকার নোট পেলে ঘরের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। একটা বড় ম্যাচ এলো না। এত বছর হয়ে গেল।
ইদানিং একটা গোটা হাফও টানা ছুটে খেলাতে পারে না। চোরা বিশ্রাম নিতে হয়। হাঁটতে হয়। আর হয়ত এক দুটো সিজন। সাইড লাইন থেকে প্লেয়ার চেঞ্জের ইশারা আসবে। মাঠ ছেড়ে উঠে পড়তে হবে। রেলের চাকরি, জলার ধারে ফ্ল্যাট, কিছুই হল না। সাইড লাইনের ধারে বসে, যতদিন শ্বাস চলে, হাঁফাতে হাঁফাতে জীবনের এই সব ছোটখাটো ম্যাচ দেখে যেতে হবে। যেমন সুরজিৎদা দেখছেন, যেমন তাদের মত শয়ে শয়ে হতে চেয়ে হতে না পারা স্পোর্টসম্যান, ওই সাইকেল চালিয়ে তাকে স্টেশনে নিয়ে আসা ছেলেটির মতো, হাজারে হাজারে ছেলে মেয়ে নিঃশব্দে সাইড লাইনের ধারে সরে যায়। টিভিতে রেডিওতে কোথাও আসে না। তাদের কথা কেউ জানতে পারে না। একটা বড় ম্যাচ, খেলতে না হয় পারেনি, খেলাতেও যদি পারত, তাহলে হয়তো নিঃশ্বাস নিতে আর ছাড়তে এত খচখচ করে লাগত না।
ম্যাচ শুরুর আগে বা ম্যাচ চলাকালীন মাঠের বাইরের কোন কথা কানে ঢোকে না। একবার রেফারির কালো ড্রেস পরে, বুট কষে বেঁধে, হোস মজা হাঁটুর উপর পর্যন্ত তুলে, পকেটে লাল হলুদ কার্ড, ছোট প্যাড, পেন, গলায় বাঁশি— বেলারানি আর এই দুনিয়ার কেউ নয়। হলেও তার কানে কিছু পৌঁছতো কিনা সন্দেহ। কেননা এদিকে সেরকম ভাবে কোনও খবরই পৌঁছয়নি। খবর পাওয়া গেল স্টেশানে এসে। ততক্ষণে রিক্সাওয়ালা হাওয়া। বেলারানী স্টেশনে এত লোকের মধ্যে একা। খবর, নসীপুরের আগে, মানে ট্রেন যেখানে নসীপুরে ঢোকে, সেখানে মহরমের তাজিয়া বের করা নিয়ে ঝামেলা বেধেছে। যা হয় আর কি। রুট ঠিক করা থাকে। বছর বছর হয়। তবু ঝামেলা লাগে। বক্স বাজানো নিয়ে, থুতু ফেলা নিয়ে, মেয়েদের দিকে তাকানো, টোন কাটা নিয়ে। ঝামেলা পাড়ায় পাড়ায় বাঁধে। হিন্দু-মুসলমান হতে সময় নেয় না। পুলিশ প্রথমে একটু ঢিল দিয়ে নজর রাখে। তারপর আগুন লকলকিয়ে উঠলে লাফিয়ে পড়ে। কখনও সামলাতে পারে, কখনও পারে না।
গোটা স্টেশনের মুখ থমথম করছে। পরিষ্কার খবর কিছু নেই। গুজব পিঁপড়ের মত ঝাড়ে বংশে ছড়াচ্ছে। এই গঙ্গা দিয়ে তিনশ মুসলমান ‘নারায়ে তকদীর’ ‘আল্লাহু আকবর’ বলে কোথা থেকে নৌকা করে এসে লাফিয়ে পড়েছে। হাতে খোলা তলোয়ার আর টাঙ্গি। ওই এলাকার ঘোষ আর হালদাররা কাটারি নিয়ে মসজিদ আক্রমণ করে বসেছে। বেটাইমে আজান পড়ে গেল। মসজিদের মাইকে বারবার বলা হচ্ছে ‘মুসল্লী ভাই সব, আমরা আক্রান্ত। মসজিদ আক্রান্ত। আপনারা যদি প্রকৃত নামাজী হন, সব ফেলে ছুটে আসেন। আপনাদের এই মসজিদকে বাঁচান’। বারবার নাকি এইসব বলা হচ্ছে। সঙ্গে ঘন ঘন আজান। হোক না তা বিশ মাইল দূরে। একটু নিজেদের গোলমাল থামিয়ে এই স্টেশন থেকে কান পাতলেই শোনা যাবে। ট্রেনকে ওই জায়গার ওপর দিয়েই যেতে হবে। লোকজনের মুখ তাই দুশ্চিন্তায় কালো হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলল, আরে ওসব কিছু নয়। পাড়ায় পাড়ায় ঝামেলা বেঁধেছিল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই থেমে গেছে। লোকজন এদের কথা বিশ্বাস করতে চায়, ভরসা করতে পারে না। একশ লোক হলে তাদের একশ রকম মতামত। তারা এদিক ওদিক বোকার মত তাকায়। ছুটোছুটি করে। যাদের আজ না গেলেও চলবে, তারা ফিরে গেছে। যাদের উপায় নেই, তারাই আছে। বেলারানি কোথায় ফিরে যাবে! কার কাছে ফিরে যাবে!
টিকিট কাউন্টারের মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে মাংসের দোকানের সামনে বাধা এক ছাগল বাকি ছাগলদের দেখছে। বাড়িতে একটা খবর দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে দেবে? এখানে স্টেশনে কোনও বুথ নেই। ওদিকে পাড়ায় একটাই টেলিফোন। ঘুটুদাদের বাড়ি। তাও আবার পুকুরের ওপারে। ফোন করে খবর দিলে ওরা বাড়ি গিয়ে খবর দেয়। বা আধঘন্টা পরে ফোন করবো বললে বাড়ি থেকে ডেকে আনে। ঘুটুদা বাড়িতে না থাকলে এগুলোর কোনটাই হয় না। আর কীই বা খবর দেবে! একে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না কি হয়েছে। আর যদি সত্যিই এখান থেকে বাড়ি যাবার পথে রাস্তায় দাঙ্গা লেগে থাকে, আর সে খবর বেলারানি ফোন করে বাড়িতে দেয়, তাহলে বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে যাবে। আর দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল হিসেবে তার বাইরে খেলাতে যাওয়া, বরাবরের মতো না হলেও, বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। সঙ্গে নানা রকম কথার খোঁচা তো রয়েইছে। এরকম সাত পাঁচ নানা রকম কথা ভেবে বাড়িতে খবর দেওয়ার ব্যাপারটা বাতিল করে দেয় বেলারানি। যা হবে দেখা যাবে ভেবে, বুকের ওড়না মনে মনে কোমরে কষে বাঁধল সে। এতগুলো লোক স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। এত লোক আসছে ট্রেনটায় চেপে। সবাই মিলে রুখে দাঁড়ালে কে কী করতে পারবে! ঠিক কী করতে পারবে তা নিয়ে বিভিন্ন লোকের ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিভিন্ন রকম। সকলের মনেই নোয়াখালী থেকে শুরু করে কাটরা মসজিদ বাবরি মসজিদ উত্তর প্রদেশ গোরখপুর নানা রকম মাথায় আসছে। কিন্তু ট্রেনের অপেক্ষায় বা হয়তো আরো ভয়ংকর কিছুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুইই থাকায় কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। সবাই সবাইকে আড় চোখে দেখছে। এরই মধ্যে লেট করলেও, কি আশ্চর্য, ট্রেন এসে পড়ল।
অন্ধকারের মধ্যে থেকে এক চোখ জ্বেলে ধ্বক ধ্বক করতে করতে স্টেশনে ঢুকলো। আজ সেটাকে সকলের দানো বলে বলে মনে হচ্ছে। সব জানলা দরজা বন্ধ। ফাঁক দিয়ে কেউ উঁকিও মারছে না। ট্রেন থামবে এক মিনিট। শুরু হলো ডাকাডাকি গালাগালি দরজা ঠেলাঠেলি দমাদম লাথি চিৎকার চেঁচামেচি বাচ্চাদের কান্নাকাটি মহিলা কন্ঠে হাহাকার। একটা দুটো করে জানলা একটু ফাঁক হল। সেই ফাঁক দিয়ে চেঁচামেচি গালাগালির মধ্য দিয়ে পারস্পরিক পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া গেলে, দরজা খুললো ও হুড়মুড় স্রোত ভেতরে ঢুকলো। তখন আরেক প্রস্থ গালাগালি হাতাহাতি ভয়ানক ঝগড়া কোলাহল। ট্রেন এক মিনিটের জায়গায় চার মিনিট থেমে দুলে দুলে রওনা দিল। স্টেশনের লোকেরা স্টেশনে কিছু কিছু শুনেছে, ট্রেনের লোকেরা শুনেছে হকারদের কাছ থেকে। কী হয়েছে সঠিক কেউ জানে না।
প্রথম পাথরটা ট্রেনের গায়ে এসে পড়ার আগে পর্যন্ত ভেতরের বহুপাক্ষিক ঝগড়া থামেনি। পড়ার পরও থামেনি। এক দুই তিন চার করে যখন ধপাধপ শিলাবৃষ্টির মত ট্রেনের গায়ে আওয়াজ হতে লাগল, তখন ভেতরে সব চুপ করে গেল। খেয়াল পড়ল, ট্রেন থেমে গেছে। কামরায় মহিলাদের আঁচলচাপা কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। পুরুষেরা বারবার উঠে দরজা চেক করছে, ঠিকমতো লাগানো আছে কি না। জি আর পি, আর পি এফকে গালাগাল করছে। একটা পুলিশেরও দেখা পাওয়া যায়নি গোটা ট্রেনে। গালাগাল করছে ড্রাইভারকে। শালা ইচ্ছে করে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ড্রাইভারের ধর্মীয় পরিচয়, এমনকি যারা ট্রেনের দিকে এগিয়ে আসছে, তাদের ধর্মীয় পরিচয় না জানা থাকার কারণে ওই লাইনে প্রকাশ্যে কিছু বলা যাচ্ছে না। পাশের লোকের ধর্মীয় পরিচয় এক হলে তাকে ফিসফিস করে বলা যাচ্ছে অবশ্য।
কামরাভর্তি আতঙ্কের মধ্যে বেলারানি জড়োসড়ো বসে আছে। বিরাট বড় ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে। বেলারানি বুঝতে পারছে, বাঁশি তার হাতে নেই। সে অন্য কোথাও অন্য কারো হাতে রয়েছে। আর সে বা তারা খেলা শুরুর ফুরররর বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। খানিক বল নিয়ে এদিক-ওদিক করার পর ওদের ফার্স্ট অ্যাটাক এগিয়ে আসছে। যারা এগিয়ে আসছে তারা হয় ‘আল্লাহু আকবর’ বলে নয় ‘জয় শ্রী রাম’ বলে। হয় তাকে কাটবে নয় আর তার পাশের প্লেয়ার কে কাটবে। দু ক্ষেত্রেই তার টিম গোল খাবে। তাকে গোল বাঁচাতে হবে। সে রেফারি নয়। এই ম্যাচে সে প্লেয়ার। এত বছর ধরে এত প্র্যাকটিস, বাড়িতে অশান্তি, ঘাম রক্ত ক্লান্তি, মাঠের টান, সুরজিৎদার শিক্ষা, স্নেহ, তার পাড়া, দশদিকে সম্মান, পরিচিতি, এমন কি সেই সাইকেল করে তাকে বসিয়ে নিয়ে আসা আলম, যে বলেছিল, আমিও ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম দিদি— এত মানুষকে স্মৃতিকে, এত আনন্দ-বেদনাকে কিছুতেই হারতে দেওয়া যাবে না। এ ম্যাচ যারা খেলায়, তাদের হাত থেকে টিমকে বাঁচাতেই হবে। বেলারানি মনে মনে কিডব্যাগ পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া গোলকিপারের গ্লাভস খানা দুহাতে পরে নেয়।
গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগল। গল্প বলার অসামান্য দক্ষতা আছে লেখকের। শুভেচ্ছা রইল।