আমার শহর – মৈনাক চক্রবর্ত্তী

শেয়ার করুন
দূর দিগন্তের অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে, অনেক অদ্বিতীয় শোভার হাত ছানিকে উপেক্ষা করে আমরা ফিরে আসি আমাদের নিজের শহরে; যে শহরে আমার বড় হয়ে ওঠা। যে শহরের ফুট পাথে একটা কাঠি আইসক্রিম খেতে খেতে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরেছি, যে শহরে মা-বাবার হাত ধরে পুজোতে ঘুরেছি প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, যে শহর আমার বড় হবার সাক্ষী, যে শহরে প্রথম সিগারেট খাবার জন্য বাবার হাতে প্রচন্ড মার খেয়েছি, যে শহরেই প্রথম প্রেমিকার হাতের স্পর্শ পেয়েছি; সেটা আমার শহর। কলকাতা। কল্লোলিনির তিলোত্তমা। এই শহরে জুড়ে আছে আমার জীবনের আর্ধাংশ।
            কলকাতা, The City Of Joy, আনন্দের নগর এই কলকাতা। দূর দুরান্তের মানুষ খাদ্যের চাহিদায় কর্মসংস্থান খুঁজে চলছে প্রতিনিয়ত। ঝাচিকচিকে আলোর বাহারে গুলিয়ে যাচছে দুপুর-রাতের ভেদাভেদ। আমার দেশে আর যত গুলো শহর আছে তাদের পাঁচটির মধ্যে আমার শহর একটি। এই শহরের কত বাহার আর কত তার রূপ। হাইওয়ে দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটছে মিনিবাস-প্রাইভেট-টেম্পো। সবাই ব্যাস্ত তার নিজস্ব কাজে, দম ফেলবার জোঁ নেই কারো। তবুও এই আনন্দ নগরীর কোনে কোনে বৃহৎ শঙ্খচিলের ডানার আচ্ছাদনে সন্ধ্যা নামে। ধীরে জমতে থাকে অন্ধকার। রাত নামে শহরের বুকে জ্বলে ওঠে নিয়ন, হ্যালোজেন। আলো-আধারী রাস্তায় অ্যপবন্দি মানব জীবন হাত বাড়িয়ে লিফ্ট চায় বাড়ির ঠিকানায়। গাঢ় হয় রাত। হ্যালোজেনের তীব্র প্রাবল্যে ফিকে হয় আকাশের তারা।
            আমার শহর, আনন্দময় হলেও কেনো জানিনা এই আনন্দ ভীষন ভাবে মেকী মনে হয়। মনে হয় এই আনন্দ এক পেশী। লাল সবুজের সিগনালে ঘেরা শহরে উড়ে চলছে টাকা। যে লাফিয়ে তাকে আগে ধরতে পারবে, টাকা তারই।  যেনো এক টাকা ঝড়া অরণ্যের শহর। শহরের বুকে হাটতে থাকা মনব সত্তা সাক্ষী থাকে বহু উত্থান পতনের। এই শহরেই এমন কিছু মানুষ কে দেখি যাদের দেখে আমরা সহানুভূতি দেখাতে পারি কিন্তু তাদের পরিচয় দিতে পারিনা সমাজের কাছে। তারা আমাদের মতই ঔরস জাত এক একটা মানুষ তবুও তারা যেনো সমাজের গন্ডি থেকে অনেক দূরে, এক নক্ষত্র খচিত অগ্নি পিন্ড তারা। কিছু মানুষ তাদের অন্ধকারময় রাত গুলোতে কাছে চায় তাদের। জৈবিক চাহিদা পুরনের পর বাঁসি ফুলের মতো ছুঁড়ে দেয় তাদের। তারা এমনই এক উদ্দীপ্ত সোনার টুকরো, যাকে সবাই চায় আড়ালে আবডালে কিন্তু প্রকাশ্যে “নৈব নৈব চঃ”।
            তারা এমন এক জগতের বাসিন্দা যাদের, প্রকাশ্য দিবালোকে ছায়া মারাতে চায় না তথাকথিত সুশীল সমাজ। কিন্তু রাত বাড়লেই শুরু হয় সুশীল সমাজের আনাগোনা তাদের চোরা কুঠুরিতে। সেই কুঠুরিতেই নেমে আসে কারো শান্তির রাত আবার কেউ জঠর যন্ত্রনায় স্বপ্ন দেখে পরের দিনের বাঁচার। তদের ভিটের মাটি ছাড়া অসমাপ্ত হয় দূর্গা মুর্তী। তবুও তাদের দেখা হয় অস্পৃশ্যের মতো।
            শুভ বুদ্ধির সমাজ তাদের পতিতা আখ্যা দিয়েছে। যৌনকর্মী তারা। এরা কেউ জন্মগত ভাবে পতিতা নন। কারো শরীরেই সৃষ্টিকর্তা পতিতা কথাটা খোদাই করেনি। সুশীল সমাজের প্রতিটি নারীর শরীরের মতই তাদের শরীর। তাদের কেউ পরিস্থিতির চাপে, কেউ অর্থের চাহিদায়, কেউ কর্মের চাহিদায় এই চোরা বাঁকে এসে পড়েছে। এটা এমন একটা জগৎ যেখানে দিন ছোট রাত বেশী, প্রতিটি বাঁকে বাঁকে জমে থাকে অন্ধকার। এই নগরের মোরে মোরে হাজার হাজার ভোল্ট রাতকে দিন করছে কিন্তু আশ্চর্য, দিনের আলোতে এখানে জমে থাকে গাঢ় অন্ধকার। এই পথে ঢোকা যায় কিন্তু বেড়ানোর সাহস নেই কারো। সামাজিকতার ভয়ে এই মানুষ গুলো থেকে যায় অন্ধ গলির বাঁকে। কেউ কি নেই? কেউ কি আছে? কোন একজন, যে তাদের একজনকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারে। শরীরের ভালোবাসা ভুলে তাদের একজনকে অন্তত মানসিক ভাবে ভালোবাসতে পারে। জানি কেউ নেই এই সমাজে। আমরা আমাদের শুভ বুদ্ধির বড়াই করি সমস্ত ক্ষেত্রে তবুও এই সুশীল সমাজ,  যখন একজন নারীকে দেখে তখন বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়
—-সে কটা ছেলের সাথে প্রেম করেছে?
—-সে কী তার সতীত্ব এখন বজায় রেখেছে?
—-সে কটি ছেলের সাথে সহবাস করেছে?
—-ইত্যাদি ইত্যাদি…
এই সব প্রশ্ন যখন হয় একটা নারীকে বিচার করার মাধ্যম, তখন আমার এই ভাবনা চুড়ান্ত নিরবুদ্ধির পরিচয় যে একজন পতিতা, গৃহবধূর সম্মান পাবে। আসলে আজ যেন সমাজে শরীরটাই সব, একজন নারী মানে, তার অক্ষত যোনি। এই শহরটাকে তখন আর আনন্দময় শহর বলতে লজ্জাবোধ হয়। কিছু মানুষের আনন্দের প্রতিফলনে একটা শহরের নাম হতে পারেনা।
        আমাদের সুশীল সমাজ! এতটাই সুশীল তারা, যে তারা কখনই একটা নারীকে শারীরিক বন্ধনের বাইরে ভাবতে পারেনা। তাই এই সমাজের কেউ অনুভব করেনা সেই সব নারীদের  মানষিক যন্ত্রনা। তাদের অন্ধগলির নোনা ধরা দেওয়ালের গন্ধ, তাদের জঠরের যন্ত্রনা, তাদের দেহে বিন্দু বিন্দু ঘাম; দেখতে চায়না প্রকাশ্য দিবালোক। প্রতিটা নারীর মতই তাদের চোখেও লাল-নীল-হলুদ স্বপ্ন চিক চিক করে দূরের তারার মতো। তবুও সেই তারাকে ধরতে পারেনা তারা। তারা পায়না একটা সুস্থ সম্পর্ক, তারা শুনতে পায়না নবজাতকের কান্না। থেকে যায় হ্যলোজেনের আলো,অর্ধনগ্ন দেহ, শরীরে সুগন্ধির গন্ধ, প্রতি মুহুর্তের খোদ্দেরের পৈশাচিক চাহিদা। জীবনের সব রঙ মুছে যায় নিভন্ত পিলসুজের কাজলে।
         আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে আমাদের মনে। আমরা আধুনিক পোশাক পরছি, তবুও মনের মধ্যে রয়ে গেছে আদিম রিপুর অভিশাপ। কোন ভাবে যদি কোন পুরুষ জানতে পারে তার স্ত্রীর আগে এক পুরুষের সাথে সহবাস করেছে তহলেই কুরুক্ষেত্র কান্ড ঘটবে। তাই সেখানে একজন পতিতা নারীর সংসারের কল্পনা নিরবুদ্ধিতা। নারী অনেকটা ঠিক নদীর মতো। নদী বহু পাহাড়, অরণ্য, শহর পেরিয়েও তার গতি চিরন্তন। তার পরেও সে সভ্যতার জন্ম দেয়। নারীও ঠিক তেমন কখন সে কিশোরী, কখনো সে প্রেমিকা,কখনো সে বিবাহিত স্ত্রী, কখন সন্তানের মা। সবার প্রথমে সে একজন নারী। প্রতি জন্মের আদিতে সে নিজে। একদিন হয়ত আসবে যেদিন ত্রিশক্তির অভ্যুদ্বয়ের মধ্যদিয়ে আসবে এক সভ্যতা, যে সভ্যতার সাহস দেখাবে সেই অবহেলিত নারীদের নিজেদের মাঝে মেনে নিতে। রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কথায় আছে “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পূণ্য কর” সমাজের অগ্নিচেখের আগুনে তারা ভস্মীভূত হয়ে যেন এক অজানা পূর্ণ্যর সন্ধানে তাদের জীবন চলেছে অসীমের পথে।
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *