সমার্থক শব্দকোষ – অনির্বাণ ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

বাংলাভাষার দেয়াল। কয়েকদিন পরপর খোলনলচে পাল্টে যায়। কী ভাষায় প্রথম কথা বলেছিলাম? কিছু কি বলেছিলাম? কোনও স্মৃতি থাকলে ভাল হত। অন্ধকার ঘরের ভেতর আরেকটা অন্ধকার ঘর। শূন্যতা। গর্ভ। জীবন। জ্যোতি বসুর বাংলায় লোডশেডিং। আমাদের মফস্বলে বুকে হেঁটে শুয়ে থাকা একের পর এক রোয়াকের শ্বাস নেওয়া। শীতঘুম না। বড় বেশিই জ্যান্ত। আমার বাংলা ভাষায় সেই রোয়াকের আরেক নাম আশ্রয়। সমার্থক। লোডশেডিং হলে গোটা পাড়াকে তেরি ক্যাহেকে লুঙ্গা বলা একেকজন ষাটোর্ধ প্রজ্ঞা। ‘মরণ’। সে এমন এক সময়, যখন শাস্তি শিখে এসেছিলাম, পড়িনি। বাড়ির ভেতর এক লুকোনো বাগানবাড়িতে একানড়েদের সঙ্গে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া আমাকে, আমাদের। পড়াশুনোয় অমনোযোগ বা স্ল্যাং। শাস্তি দেখেছিলাম বড় বেশি, পড়িনি। চন্দরা, ছিদাম, রাধা…। চিনতাম না। তবে লোডশেডিং হলে ঠাকুমার লিপ সিঙ্ক ধরতে পারতাম। মরণ। আমার বাংলা ভাষায় ‘মরণ’ মানে লোডশেডিং। অন্ধকার চলত। দুঘণ্টা গড়ে। যাকে উসুল করার জন্য থাকত এক একটা উঠোন। গোল হয়ে খুব বেশি হলে একদিন অন্তক্ষরী। আর হপ্তাটা যেহেতু সাত দিনের, ল অফ আভারেজ মেনে সাহস করে একটা দিন কারেন্টটা যেত না। বাকি পাঁচটা দিন মৃত্যুচেতনা। পরিবার বা বন্ধুবৃত্তের নিদেনপক্ষে পাড়ার চৌহদ্দিতে কে কিভাবে চলে গেল, কার কখন কিভাবে ডাক এসেও যাওয়া হল না, আর কে কখন দুর্বল সময়ে মরণোত্তর কোন না-মানুষের দেখা পেল ছাদের অন্ধকারে, উঠোনে গোল হয়ে বসে সেসব গল্প চলত। আমাদের সেভাবে কোনও বারান্দা ছিল না। ওই উঠোনটাই সব। বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে তাতে জ্যোৎস্নার লেগে থাকতে দেখা যেত কোনও কোনও সন্ধেয়। আমাদের সেই উঠোনটা ভাগ হয়ে গেল, ছোট হয়ে গেল বহুদিন পর। অবশ্য তদ্দিনে আমার বাংলা ভাষায় উঠোনের নাম দিয়ে রেখেছিলাম মৃত্যুবোধ, রেখেছিলাম স্মরণসভা আরও কত কী …। স্মৃতি বলতে, ভাষা বলতে শুধু যৌথতা না। একদম একা কিছু বেবাক দৃশ্যকল্পের নেশাও লেগে আছে এগল্পে। অন্তত খান দশেক বাড়ির পর পাড়া আলো করা যে অশ্বত্থ গাছটা আলো দিত, দিত কি, বালাই ষাট, সনাতন সেই পাড়াটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও সেই এখনো দিব্যি বেঁচে বর্তে আছে, তার শাখা-পল্লব চুমু খেতে আসত আমাদের বাড়ির ছাদটায়। একদিন ভুল করে আঙ্গুল ছোঁয়াতে গিয়ে বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে দূরত্ব বুঝতে। আমার ওপরে বাবা-কাকারা, তার ওপরে পিতামহ, যৌথ বাড়িগুলোর ক্ষেত্রে সেসবও একাধিক। উঠোনের লাগোয়া দেয়ালে ঘুঁটে লাগানো সারাক্ষণ কাঁপা এক মৃতবৎ বৃদ্ধা, ক্রিকেট বল চলে গেলে শাপ শাপান্ত করে তার ঠিক পরেই টিভি দেখতে গিয়ে অনুরোধের চোখে তাকানো পিতামহীরা সবাই তো আসলে একই বাড়ির। প্লুরাল। শুধু নামগুলো আলাদা। ঘরগুলোও। ছোট বাক্স। একটা বড় বাক্সের ভেতর। এসবের মাঝে সেই অশ্বত্থ গাছটা একজনই। অজস্র শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে থাকলেও তার নিজস্ব অস্তিত্বের কোনও শাখা নেই। ওই একটাই গুঁড়ি, আর সেটাই অবস্থান। আমার যৌথ পরিবারের বাংলা ভাষার শব্দকোষে অশ্বত্থ মানে অভিভাবক। পিতামহ। সুনীল গাঙ্গুলী তখনো অব্দি সেরকম না পড়া এক কিশোর। তার সামনে এক বৃক্ষ। ‘প্রতিনিধি বৃক্ষ’। ‘যার কাছে সমস্ত কৃতজ্ঞতা সমীপেষু করা যায়’। ধন্যবাদ দেওয়া যায়। মালবেরি জানি না। আমাদের ছিল অক্ষয় অশ্বত্থ। ‘বর্ষায়, শরতে, হেমন্তে, শীতে আমাদের কত প্রাচুর্য’! মাসের শুরুতে অপেক্ষার নাম দিয়েছিলাম শুকতারা। খাট, দেয়ালের চাঙ্গর, আলমারি – এখন প্রায় সমস্তই ভেঙে পড়া আমার সেই ঘরটায় অফিসফেরত শুকতারা ছুঁড়ে দিয়ে ছোটকাকা তখন ওসীমানায় থাকত না। অবশ্য মায়ের কাছে উল্টোরথ, নবকল্লোল কালে ভদ্রে কোনোকোনো বার। জানিনা, মায়ের আলাদা কোনও শব্দকোষ ছিল কিনা। মায়েদের নিজস্ব কোনও মাতৃভাষা হয় কি? জানি না। ওই যে বললাম, অপেক্ষা। একটা শব্দের একাধিক প্রয়োগ হয়, মানেও। যেমন অপেক্ষা মানে তো শুকতারা না, বাবার সপ্তায় একদিন করে বাড়ি আসার নামও তো তাই। প্রায় সেভাবে কিছুই কাজ না পাওয়া ভাইদের আর্থিক সাহারা, কাঁধে হাত, খোঁজখবর, ঠাকুমার ধোঁকার ডালনা, দাদুর রক্তস্রোত ফিরে পাওয়ার উচ্ছ্বাস, আমার শব্দছক, মায়ের অভিযোগ-অনটন আর নমাসে ছমাসে একবার কোথাও বেরনো। অপেক্ষার ভেতর প্রোথিত থাকে এসবও। পরিবারের সবচেয়ে বয়স্কদের জন্য যে ঘরখানা ছিল, তার জানলাগুলো বেয়ে আমাদের কত বেড়ে ওঠা। রাস্তার কুকুরদের রুটি খাওয়াতাম। পোড়া রুটি। আঃ, আঃ। আমার বাংলা ভাষার ক্ষুদ্রতম উচ্চারণ। মাটি ছোঁয়ার আগেই দাঁতের ভেতর অন্ধকার হিংস্র গুহার ভেতর সেসব সম্বল ঢুকিয়ে নিত ওরা। আমি জানলা থেকে রুটি ছোঁড়ার সময় মনে হত ম্যাজিক শোয়ে টিকিট কাটতে এসছি। আর ওরা ম্যাজিশিয়ান। দিদির সঙ্গে জানলায় খেতে বসে সাইকেল গুনতাম। একটা ডিভাইডারে ভাগ করা দুটো জানলা। ওপাশেরটা দিদি, এপাশেরটা আমি। কার জানলায় কটা সাইকেল। কখনো গোনাগুনতিতে ভুল হয়ে যেত। আর ঠাকুমার জন্য পড়ে থাকত অমলের রোলটা। রাজা। দইওলা। মোড়ল। সব ওই জানলা। কী গো? কে গেল আজ? ওমা, ওইটুকু বয়স! হরিধ্বনি। খইয়ের গন্ধ। দাদুর সেরিব্রাল এবং তার পরেও দুবছর টিকে যাওয়ার আরও বছর চারেক পরে শেষমেশ রাজার চিঠি পেয়েছিল ঠাকুমা। তখন অবশ্য শরিকি বিবাদে ঘরটা বদলে গেছে, মানে ঠাকুমার অবস্থান্টা পাশের একটা ছোট প্রায়ান্ধকার ঘরে এসে পড়েছে। যাই হোক, আমার বাংলা ভাষায় ওই জানলাগুলোর নাম ছিল পরম্পরা। একটা বিরাট আলোময় ঘর টুকরো টুকরো হয়ে এধার ওধার হওয়ার পর যেটুকু থাকে তা শুষে নেওয়ার জন্য উত্তরপুরুষের দরকার হয়। সেসবের জন্যই হয়ত আমাদের জন্ম। বড় বিকারহীন সেই আদি অকৃত্রিম ঘরটা নেই। তবু কড়িকাঠটা দেখেছিলাম। অনাথবাবুর বলে যাওয়া সেই অট্টহাসি শুনতে পেতাম। কিছু একটা আছে ওখানে, কিছু একটা…। মাথা উঁচু করার আরও অনেক কিছু ছিল। একটা ছবি। পাখি। হরিণ। পাশে লেখা – সোনার হরিণ, কোন বনেতে থাকো। কার লেখা, আঁকা? জিজ্ঞেস করতে কখনো মা কখনো ঠাকুমার নাম। সে যাই হোক, আমার অচেনা কল্পবনের বাহন ছিল সেই জীবটা। তার পাশে দাদুর যুবকবয়সের ছবি। চারজনের মাঝে অন্যতম। বহুকষ্টেও একজনের সঙ্গেও মেলাতে পারিনি এই মানুষটাকে। ছবি, কড়িকাঠ, আর বাকি এসবকিছুর ওপর বলতে ছাদ। তার নীচের চাঙ্গর। নীচের তলাটা মেরামত হলেও ওপরটা অস্বাভাবিক বিপজ্জনক আজ। যাই হোক, সেই মায়াবী ছাদটার কথা বলছিলাম। পার্টিশন দেওয়া। ডালের বড়ি। অশথের চুমু। রোদ। হারবার্ট সরকারের মতো লুকিয়ে দেখা বুল্টি। উচ্চতা। ইলেকট্রিক পোস্ট। ঘুড়ি। আমার সেই ছাদের অনেক রঙ। অনেক আকাশ। অনেক কাহিনী। তবে এক কথায় সেই ছাদটার নাম দিয়েছিলাম সাক্ষ্য। আমার বাংলা ভাষায়। আমাদের সেই টেলিভিশনটার কথা বলা হয়নি। রোববার করে পাড়া ভিড় করে আসত। বই পড়েছে, বই। সুস্বাস্থ্য। কৃষিকথা। নতুন সমস্ত সিরিয়াল। কী অদ্ভুত, সবকটা গল্পেই একজন করে ঝুলে পড়ে কড়িকাঠ থেকে। আর আমার ওই দৃশ্যে কী ভয়। লাল্টুর বাবার মতো। একদিন হঠাৎ…। কাউকে কিছু না বলে। যে কথা বলছিলাম, টিভি। দূরদর্শন। ম্যাজিক দেখতাম। কুইজ। নরোত্তম পুরি। খবর। ওই মুখগুলো। আর বিজ্ঞাপন। মিয়াদাদ, আজহার, কপিলদেব, ম্যাকডারমাট। অন্যদিকে মারাদোনা, কারেকা, ক্যানিজিয়া, স্কিলাচি, মিল্লা, ম্যাথিউজ। আমার বাংলা ভাষায় ওই টেলিভিশনটার নাম হয়ে গেছিল নব্বই। নাইন্টিজ। তখনো তো ‘বিইং জন ম্যালকোভিচ’ দেখিনি। নাহলে জানতাম, সেই নাইন্টিজেই নিজেই নিজের পোর্টালে গিয়ে নিজেদেরই অভিনীত ভূত-ভবিষ্যৎ দেখে নেওয়া হয়ে গিয়েছিল আমাদের সবার। তখন বুঝিনি। অনেক পরে ভেবে চমকে উঠেছিলাম।

 

এসব জন্ম, বেড়ে ওঠার ভেতরে আরও অনেক গল্প থাকে। আমার নিজস্ব বাংলা ভাষায় সেসব দিন, সেসব মুহূর্ত নতুন নাম নেয়। ‘উদার গৈরিক মাঠ’, ‘নিকনো উঠোন’ পেরিয়ে আমাদের সেই ব্যক্তিগত ভাষার দিকে নড়াচড়া। নমাসের লড়াই। তারপর একদিন ঠিক জন্ম নেবে আলো। যেন চোখ ফুটবে না শুরুর দিকে। কান্না। বনেদিয়ানা। শোরগোল। মিষ্টিমুখ। ‘দেখ দেখ একদম মায়ের মুখ পেয়েছে’। আমাদের ছোটবেলাগুলো মায়ের মুখ পাক …

অনির্বাণ ভট্টাচার্য
শেয়ার করুন

Similar Posts

One Comment

  1. আমাদের ছোটবেলাগুলো মায়ের মুখ পাক…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *