|

ভাষা, জগৎ, কবিতা – শৌভ চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

বিশ শতকের শুরুতে, মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক এডোয়ার্ড স্যাপির এবং বেঞ্জামিন লী হোর্ফ সাব্যস্ত করতে চেয়েছিলেন যে, একজন মানুষের বিশ্বদৃষ্টি, অর্থাৎ জগৎ-সম্পর্কে তার ধ্যানধারণা, পুরোপুরি নির্ভর করে তার মাতৃভাষার গঠনের ওপর। হোপি ইন্ডিয়ানদের নিয়ে কাজ করার সময়ে, তাদের ভাষা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হোর্ফ দেখেছিলেন, সে-ভাষায় সময়ের কোনো নির্দিষ্ট একক নেই, নেই ‘সময়’-এর হুবহু-সমার্থক কোনো শব্দও; এমনকী, ক্রিয়ার কাল-সংক্রান্ত ধারণাটিও তাতে অনুপস্থিত। এর ফলে, সময়ের ধারাবাহিক প্রবাহটিকে, অতীত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানে ভাগ করে দেখার ব্যাপারটাই হোপিদের কাছে অবান্তর, এই ছিল হোর্ফের মত। হোর্ফের এই তত্ত্ব, পরবর্তীকালে, এক দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের জন্ম দেয়। ভাষাতাত্ত্বিকরা নানান দলে ভাগ হয়ে, ভাষা ও চিন্তার পারস্পরিক সম্পর্ক-বিষয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের প্রস্তাবনা করতে থাকেন। কেউ কেউ বলেন, ভাষা আর চিন্তার মধ্যে আদপেই কোনো যোগাযোগ নেই; বস্তুত, মানুষ যখন চিন্তা করে, তখন ‘mentalese’-নামক এক ভাষাতীত মেটা-ল্যাঙ্গোয়েজই তার চিন্তার বাহন। কেউ বলেন, সমস্ত ভাষার অন্তর্লীন গঠনটি প্রকৃতপ্রস্তাবে এক ও অভিন্ন। কেউ বলেন, ভাষা আমাদের বিশ্বদৃষ্টিকে প্রভাবিত করে বটে, কিন্তু তা-ই একমাত্র নিয়ামক নয়। সত্যি বলতে কি, এ-বিতর্কের আজও কোনো সন্তোষজনক সমাধান হয়নি।

আমি ভাষাতাত্ত্বিক নই। ফলে, ভাষা ও মানুষের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে নতুনতর কোনো সন্দর্ভের প্রস্তাবনা, আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, ভাষাকে এড়াতে চাইলেও তো আর এড়ানো যায় না। সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক-হিসেবে, এবং নিজের সামান্য লেখালিখির সুবাদেও, ভাষা নিয়ে মাঝেমধ্যেই ভাবনায় পড়তে হয়। বিশেষ করে কবিতায়, যেখানে শব্দের সামান্য হেরফেরে, বদলে যায় গোটা একটা লাইনের অর্থ, অথবা নতুন-নতুন অর্থ আবিষ্কৃত হয় প্রত্যেক পুনঃপাঠে, তখন ভাষা নিয়ে, শব্দ নিয়ে, তার অর্থ-অনর্থ নিয়ে না-ভেবে উপায় কী?

কবিতা অনুবাদ-যোগ্য নয়, এ-কথা আমরা বহু নমস্য ব্যক্তির মুখেই শুনেছি। কবিতা অনুবাদ-যোগ্য নয়, কারণ কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলি, তাদের আভিধানিক অর্থ ছাপিয়ে, ছুঁয়ে থাকে আরো বহু সম্ভাব্য অর্থের বা ব্যঞ্জনার স্তর। অনুবাদক যদি শব্দের আক্ষরিক অর্থের দিকে বেশি মনোযোগী হন, তাহলে বাদ পড়ে যেতে পারে ব্যঞ্জনার ব্যাপ্তি; আবার, যদি তাঁর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে ব্যঞ্জনার দিকেই, তাহলে আক্ষরিক অর্থের প্রতি ঘোর অবিচার ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়। ফলে, অনুবাদকের কাজটা কতকটা ‘ক্ষুরস্য ধারা’-র ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো, পা কাটবেই। ধরুন, জীবনানন্দের সেই বহু-ব্যবহৃত লাইন–‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’। এখানে ‘নীড়’ শব্দের বদলে ‘বাসা’ ব্যবহার করলেই, কী আশ্চর্যভাবে বদলে যায় পুরো আবহটাই! দুটো শব্দের মধ্যে অর্থের তারতম্য খুব বেশি নয়, কিন্তু ধ্বনিস্পন্দ, অনুষঙ্গ, ব্যঞ্জনা-মিলিয়ে যে সামগ্রিক অভিঘাত, তা একেবারেই আলাদা। এই লাইনটিই যখন ক্লিন্টন বি সীলি-র অনুবাদের পড়ি–“And raised her bird’s-nest-like eyes—Banalata Sen from Natore”, তখন ভাবি, একজন ইংরিজি-ভাষাভাষী মানুষ ‘bird’s nest’-এর মধ্যেও কি খুঁজে পাবেন ‘পাখির নীড়ের’ সমতুল্য কোনো ম্যাজিক? পেতেই পারেন, কিন্তু যেহেতু ইংরিজি আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষা নয়, বা জন্ম থেকে সেই ভাষার ছায়ায় বেড়ে উঠিনি, ফলে আমার কাছে ‘bird’s nest’ শব্দটির ব্যঞ্জনা, কিছুতেই, ‘পাখির নীড়’-এর তুল্যমূল্য হয়ে ওঠে না।

বিদেশি কবিতাও তো কম পড়ি না। কত কবির কবিতা পড়েই মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই। ইয়েটস, এলিয়ট, র‍্যাঁবো, পেসোয়া, ভাস্কো পোপা,সেলান, হুইটম্যান, ট্রান্সট্রোমার, নেরুদা, রিলকে, মিউশ, এমন আরো কত! কিন্তু কোনো একটি বিশেষ বিদেশি কবিতার বিষয়ে আমার মুগ্ধতা ও বিস্ময়, একটি উৎকৃষ্ট বাংলা কবিতার অভিঘাতের থেকে, খানিকটা হলেও আলাদা। এখন, কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ঠিক কোথায় বাকীভাবে তারা আলাদা, এবং কেন, তবে তার স্পষ্ট কোনো সদুত্তর আমি দিতে পারব না। শুধু, এইটুকু মনে হয় যে, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভাষিক প্রকাশেরই একটা মানসিক প্রতিরূপ রয়েছে, যা আমাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত। একটি শব্দ শুনলে, ততক্ষণাৎ, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানসিক প্রতিরূপটি আমাদের মনে ফুটে ওঠে। যেহেতু, ছোট থেকে বাংলাভাষার আবহে বেড়ে উঠেছি, বেড়ে উঠেছি পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে, ফলে আমার মানসিক ছবিগুলি মূলত বাংলাভাষার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। বাংলা শব্দে, বাংলা ডাকে তারা যতোটা স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়, বিদেশিভাষার ক্ষেত্রে ততোখানি নয়। ধরুন, আমি পড়লাম বিখ্যাত ইতালিয়ান কবি ইউজেনিও মন্তালে-র এই লাইনগুলি—

“Listen to me, the poets laureate
walk only among plants
with rare names: boxwood, privet and acanthus.
But I like roads that lead to grassy
ditches where boys
scoop up a few starved
eels out of half-dry puddles:
paths that run along the banks,
come down among the tufted canes
and end in orchards, among the lemon trees.”

আমি অনুভব করতে পারি এই কবিতার রস, এর সৌন্দর্য। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, ‘starved eel’, ‘tufted canes’, ‘orchard’, এমনকী ‘lemon trees’—এই ভাষিক রূপগুলো, চট করে, আমার মাথার মধ্যে আঁকা খালবিল, বাগান, ঝোপঝাড়ের পরিচিত ছবিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয় না।ফিরিয়ে দেয় না অবচেতনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো হারানো স্মৃতি বা অনুষঙ্গ। আর সেটা সম্ভবও নয়, কেননা মন্তালের দেশ, তার ভূপ্রকৃতি, তার আবহাওয়া, আমাদের বাংলার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। বরং, এর তুলনায়, জীবনানন্দ, উৎপল বা বিনয়ের কবিতায়প্রাকৃতিক রূপের স্বাভাবিক উদ্ভাসগুলো, আমার কাছে বিনা-আয়াসে অনুভববেদ্য হয়ে ওঠে। কেননা, আমার কাছে, ওই ভাষা আর ওই প্রতিবেশ, অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।শুধু প্রকৃতি নয়, সামাজিক বা পারিবারিক প্রতিবেশের ক্ষেত্রেও এ-কথা সত্য, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। ‘বিদেশি ভাষায় কথা বলার মতোন সাবধানে তোমার প্রসঙ্গে আসি’—বিনয়ের এই অমোঘ লাইন, আমার আর বিদেশি কবিতার ক্ষেত্রে বস্তুতই সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়!

এই দিক থেকে দেখলে, মানুষের চিন্তা-ভাবনা, এবংকল্পনাও, ভাষার ওপর নির্ভরশীলবলেই মনে হয় আমার। ‘বাগান’ শব্দটি শুনলে, আমাদের মনে যে-চিত্রকল্প ফুটে ওঠে, ‘উদ্যান’ শুনলে তা ফোটে না। ‘Garden’-এর ক্ষেত্রে আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রতিবেশ রচিত হয়। এমনকী, ‘পাহাড়’ শব্দ শুনলে আমাদের মনে তার যে-রূপ ফুটে ওঠে (হয়তো-বা হিমালয়ের), একজন ইয়োরোপীয়ের কাছে ‘mountain’-এর ব্যঞ্জনা নিশ্চিতভাবেই তার থেকে আলাদা। কবিতায়, যেহেতু শব্দের আক্ষরিক অর্থের চেয়ে, তার ব্যঞ্জনার গুরুত্ব অধিক, তাই শব্দের সামান্য হেরফেরে পালটে যায় কবিতার অভিঘাত, অর্থ বা দুটোই।

নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়, যেহেতু বাংলা কবিতার ভুবনটিকে তার স্বকীয় মহিমায় অনুধাবন করতে পেরেছি। আবার কখনও দুঃখ হয় এই ভেবে যে, আরো কত ভাষা আছে পৃথিবীতে, ফরাসী, এস্পানিওল, আলেমান, কত অসামান্য কবিতা রয়েছে এইসব ভাষার ভাঁড়ারে। তাদের সঙ্গে একটা আলগা অপরিচয়ের দূরত্ব বোধহয় এ-জন্মে ঘোচার নয়!

ভাবি, পৃথিবীর সমস্ত ভাষাই যদি আমার মাতৃভাষা হত, পৃথিবীর সমস্ত দেশ আমার স্বদেশ—সে এক আশ্চর্য কাণ্ড হত তাহলে!

শৌভ চট্টোপাধ্যায়
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *