ভোজ কয় যাহারে (ত্রয়োদশ পর্ব) : ক্যাপসিকাম – সত্যম ভট্টাচার্য
‘এই সব জিনিসপত্র এখানে। চিকেন ওখানে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা আছে। ভাতটা আমরা কেউ করে ফেলছি। তুমি চিকেনটা জম্পেশ করে বানিয়ে ফেলো তো’—
যার উদ্দেশ্যে কথাটা বলা হল সে এগিয়ে এসে জিনিসপত্র সব দেখেটেখে বলল, ‘কিন্তু দাদা আমি যে ক্যাপসিকাম ছাড়া মাংস রান্না করি না। ওটা এনে দেবার ব্যবস্থা করুন।’
যখন এইসব কথাবাত্তা হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা তার বহুক্ষণ আগেই রাত বারোটা পেরিয়ে গিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই উলটোদিকের ব্যাক্তিটি বললেন, ‘এত রাতে কোথায় তোমার ক্যাপসিকাম পাব, যা আছে তা দিয়েই করে দাও আজ।’
কিন্তু উলটোদিকের ব্যক্তি কঠিন। কিছুতেই তিনি ক্যাপসিকাম ছাড়া মাংস রান্না করবেন না। আর কেউ উনি ছাড়া অন্য কারুর রান্না করা মাংস খাবেও না। অতঃপর সেই মধ্যরাতে ক্যাপসিকাম অভিযানে বেরুনো হল। রাত দেড়টা নাগাদ ঘুটঘুটে অন্ধকার বাজারে একে তাকে ডাকতে ডাকতে অবশেষে একজন দোকানের ভেতর থেকে সাড়া দিলেন। তার কাছ থেকে ক্যাপসিকাম নিয়ে ফিরলে পর মধ্যরাতে মাংস চাপল। এবং সে যে মাংস রান্না হল আজ কুড়ি বছর পেরিয়েও তার অমায়িক স্বর্গীয় স্বাদ ভুলতে পারিনি।
এই ঘটনার কাল তো বলেই দিলাম। স্থান বারাসাত চাঁপাডালির মোড়ের কাছাকাছি কোনো একটা আবাসন, আর পাত্ররা সকলেই আমার ইউনিভার্সিটি রুমমেটের দাদার প্রতিবেশীরা। কারণ দাদা সেই আবাসনে থাকতেন এবং তাদের পানভোজনের দিন ঠিক হলেই আমাদের সাদরে সেখানে ডাক পড়ত। আর আমরা তখন মেসে থাকা বুভুক্ষুর দল। বাড়ি থেকে সাতশো কিমি দূরে কোনো নেমতন্ন পাওয়া মানেই হাতে চাঁদ পাওয়া। ওদিকে আসরে আমরা তখন সদ্য কুড়ি পার আর এমন লোকও আছেন যিনি প্রায় আশির দোরগোড়ায়। এমন আসরে বসে নিজের মধ্যে বড়ো হয়ে গিয়েছি এমন একটা ফিলিংস আসে যা সেই বয়সের জন্য চমৎকার।
সেই রাত থেকে আমি বুঝেছি যে একা কোনো বস্তু বা ব্যক্তি স্বাদহীন হলেও সে যখন কোনো কিছুর মধ্যে গিয়ে পড়ে খাপে খাপ মিললে তার খেল দেখিয়ে থাকার ক্ষমতা থাকে। ব্রয়লার আসার পর মাংস বিশেষত চিকেনের সেই কুলীন স্ট্যাটাস গিয়েছে। তবু আজও এতবছর পেরিয়েও যখন কোথাও সামান্য হলেও চিকেনের স্বাদ পাই জিজ্ঞেস করে নিতে ভুলি না যে ঝোল যাকে আমরা আজকাল স্টাইল করে গ্রেভি ডাকতে শিখেছি তাতে ক্যাপসিকাম দেওয়া আছে কিনা। যদি পাচক বলেন যে হ্যাঁ আছে তাহলে মনে হয় তার জন্যই এত স্বাদ আর যদি বলেন না তাহলে মনে হয় একটু ক্যাপসিকাম পড়লে এই মাংসের স্বাদ আরও খুলে যেত।
আরেকজন খাদ্যরসিক দাদা আমাকে আরেকভাবে ক্যাপসিকামের উপকারিতা বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু সেইভাবে সোনালী সন্ধ্যায় ক্যাপসিকাম খাওয়া আমার আজও হয়ে ওঠেনি। আর যেই দাদার কাছে এই খাওয়ার গল্প শুনেছিলাম সে সেই পদটি এত খেয়েছে যে বুকে বাইপাস করিয়ে এখন শুধু লাল চা খায় আর জানালা দিয়ে দূরে দেখতে দেখতে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে।
তো কেমন সেই খাওয়াটি? বাজার থেকে বেশ পুরুষ্টু আকারের ক্যাপসিকাম কিনে এনে তাকে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে বোঁটার দিকে সামান্য নিচ থেকে কেটে ফেলতে হবে। এবারে ক্যাপসিকামের সেই ভেতরটা ভালো করে পরিষ্কার করে, দরকার মনে করলে সামান্য জল দিয়েও ধুয়ে নেওয়া যেতে পারে, তাতে বাজার থেকে কেনা চিজ ঠুসে দিতে হবে। বা চিজ না পাওয়া গেলে ভালো পনীরকে প্রিপারেশন করেও দেওয়া যেতে পারে। তারপর তাকে মাইক্রোওভেনে হালকা আঁচে রেখে গরম গরম নামিয়ে খেতে হবে। অবশ্য যিনি আমাকে এই খাবারটির কথা শুনিয়েছিলেন তার বিধিসম্মত সতর্কীকরণ অনুযায়ী এই পদটকে অবশ্যই সোনালী জলের সাথে খেতে হবে আর জিনিসপত্র সব সকালে কিনে আনলেও প্রিপারেশন শুরু করতে হবে ঠিক দেড় ঘণ্টা আগে থেকে। তবেই সেই উদ্দিষ্ট সোনালী তরলটির ঠিক প্রথম চুমুকের আগে ধোঁয়া ওঠা অনুপানটি সামনে চলে আসবে।
খাওয়া দাওয়ার গল্প তো ভালই লাগে।