ভোজ কয় যাহারে (ঢেঁকি শাক) : দশম পর্ব – সত্যম ভট্টাচার্য
সেই যে সত্যজিৎ রায়ের খাতায় কবিগুরু লিখে দিয়েছিলেন—
“বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।”
প্রকৃতিও ঠিক যেন এমনটাই। আমাদের মন ভালো করে দেবার মতো যাবতীয় উপাদান সব আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে। শুধু দেখে শুনে বুঝে সময়মতো সেটিকে তুলে নিতে হবে।
এই যে আমরা কেন্দ্র থেকে এতদূরে বাস করি, সেটা শিক্ষা-সংস্কৃতি সবটুকু মিলেই, তাই কখনও মন খারাপ হলেও পরক্ষণেই যখন ভাবি প্রকৃতি কিন্তু আমাদের এখানে দুহাত ভরে দিয়েছে, তখন সে মনখারাপ আর থাকে না। তখন শশী কাপুরের মতো কাঁপা কাঁপা গলায় ওমন ব্যারিটোনের সামনে দাঁড়িয়েও যেন বুক চিতিয়ে বলে দেওয়া যায় যা যা আছে আমাদের।
কবি শ্যামল সিংহ তার প্রিয় খাদ্য তালিকায় লিখেছিলেন লাল শাক দিয়ে মাখা ভাত। লাল শাক মোটামুটি পশিমবঙ্গের সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। যা পাওয়া যায় না তা হচ্ছে ঢেঁকি শাক। ফার্ণ জাতীয় এই শাকটি গ্রামেগঞ্জে এত প্রচুর পরিমাণে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে যে তা নিয়ে বাস্তবিকই বেশ গর্ব বোধ হয়। আর যখন শুনি যে রাজধানীর দিকে এই বস্তুটি সহজে মেলে না তখন বেশ শ্লাঘা বোধ হয় ভেতরে।
যাই হোক, তখন ছোটো। সে সময় আমাদের এই মফঃস্বল শহর থেকে কেউ ট্রেনে কলকাতা গেলে তাকে ছাড়তে তার পরিবারের, নিকট সম্পর্কের বা দূর সম্পর্কের বা পাড়াতুতো কত লোক যে স্টেশনে যেত তার ইয়ত্তা নেই। ট্রেন ছেড়ে চলে যাবার পর বাইরে আসা জনস্রোত দেখে তা টের পাওয়া যেত। সেরকমই এক আত্মীয়কে ছাড়তে মায়ের সাথে স্টেশনে গিয়েছি, দেখি মালপত্রের সাথে একটা ভেজা গামছা ঢাকা দেওয়া ঝুড়িও তোলা হল ট্রেনে। কী আছে ওতে? কী আছে এমন যা লোকচক্ষুর আড়ালে ট্রেনে করে এতদূর যাচ্ছে?
জিজ্ঞেস করাতে জানা গেল যে সেই আত্মীয়র স্ত্রীকে মহানগরের এক নামকরা ডাক্তার কোন্ জটিল ব্যাধি থেকে উদ্ধার করেছেন। তার পর সেই আত্মীয় ডাক্তারবাবুকে নাকি জিজ্ঞেস করেন যে কী এমন আছে যা দিলে আপনি খুশি হবেন। ডাক্তারবাবু নাকি এই শাকটির কথা বলেছিলেন।
গ্রাম-মফঃস্বল ছেড়ে চলে এসেছি বহুদিন হয়ে গেল। এখনও কখনও সেরকম রাস্তায় চলতে চলতে যদি কাউকে দেখি রাস্তার আশপাশের ঝোপঝাড়ের থেকে কিছু তুলছে, ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়। সে সময় দুপুর নাগাদ প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম কেউ না কেউ, মহিলা, ঢেঁকিশাক তুলছে ফাঁকা জমি বা রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় থেকে। তারপর সেটা তোলা হয়ে গেলে তা নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে মায়ের সাথে চলত একপ্রস্থ আড্ডা, চা-পান ইত্যাদি সহযোগে। তারপর সেই ঢেঁকিশাক থেকে খানিক মাকে দিয়ে তিনি বাড়ি যেতেন। একটু নিম্নবিত্ত পরিবার। ওই শাক আর বাড়ির কর্তা দুপুরে যা নিয়ে আসবেন তাই হবে। তাই ওই শাকটি যেন প্রকৃতির দান, মানবজাতির প্রতি।
আর পরদিন বা সকাল সকাল কেউ দিলে মা যখন ওই ঢেঁকি শাক রান্না করতেন, গন্ধেই মন ভালো হয়ে যেত। আর খেতে বসলে তো কথাই নেই। মনে হয় একথালা ভাতই সেই শাক দিয়ে খেয়ে নিই।
এখনও বাজারে যাই। ঢেঁকি শাক কিনি শাকওয়ালি মাসিদের কাছ থেকে, বলে আজ সকালেই তুলে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই স্বাদ বা ছোটোবেলার নস্টালজিয়ার গন্ধ আর ফেরত আসে না। তবু যা পাওয়া যায় তাকেই দুহাত বাড়িয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে রাখার চেষ্টা করি। কারণ এ সব তো ভালোবাসার বন্ধন। ছিঁড়ে গেলে মানুষ বাঁচবে কী নিয়ে?
সেই যে কথায় বলে না—
কপালে না থাকলে ঘি
ঠকঠকালে হবে কি?
তাই মহানগরের সব থাকলেও ঢেঁকিশাক কিন্তু নেই। শুনেছি যদিও যে ট্রেনে করে যায় আজকাল, কিন্তু সেই স্বাদ কি পাওয়া যাবে? এটুকুই ভেবে সান্ত্বনা পাই।
আর খাওয়া? সাধারণত শাক ভেজে যেভাবে খাওয়া হয় তাই এর নিয়ম। তবে কখনও-সখনও সর্ষে দিয়ে চচ্চড়ি মতোও খেয়েছি, ভালোই লেগেছে। আবার আরেকভাবে খেয়েছি, ভাজাই, তবে কাঁঠালের বিচি, আলু ইত্যাদি দিয়ে, চমৎকার। আসলে যে বা যা ভালো সে তো সবখানেই ভালো।