অখিল ভুবনে সুরের মেলা – প্রবীর মিত্র
ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে
—কবি পার্থজিত চন্দ
দশদিকে নাম ছড়িয়ে গেল তোমার গান গেয়ে
গান ফুরোল পাড়া জুড়োল ফুর্তি হোল দেশে
চোখের জলে বাঁশুরিয়ার রক্ত এসে মেশে
এসব কথা উঠলে পড়ে, উথলে ওঠে রোষ
গান কি কারও কেনা!
নাকি গোলাম?
সে সব কথা থাক। বাংলাগানে শীতলপাটি পাতা
তাতে রাজার মতো ঘুমিয়ে আছেন অখিলবন্ধু ঘোষ।
একটা সময় রেকর্ড প্লেয়ার-এ যখন বাজছে শচীনদেব বর্মন, তালাত মাহমুদ, হেমন্ত, শ্যামল, মান্না, মানবেন্দ্র–র হিট গানগুলি, তারই মধ্যে কবে একদিন বেজে উঠল ‘জাগো জাগো প্রিয় রজনী পোহায় দেখ দেখ চেয়ে বনে শেফালি দোলে ভোরের হাওয়ায়’। রেকর্ড কভারে নাম লেখা অখিলবন্ধু ঘোষ, যার কথা মনে পড়লেই আজও বাঙালির চোখ বোজা এক আত্মভোলা গায়ককে মনে পড়ে, বোজা দুটো চোখেই যেন নিবিষ্টতা নিহিত।
আদি বাড়ি নদীয়ার রানাঘাট হলেও অখিলবন্ধু ছিলেন বালির বিখ্যাত ঘোষ পরিবারের বংশধর, যে বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ। ছোটোবেলা থেকেই ভীষণ লাজুক ও কিছুটা ভাবুক, পড়াশুনায় একদম মন নেই, দিনরাত খালি গুনগুন করে গান গাইছে আর কাছেই মামার বাড়ি চাকদহে যেতে পারলে সে যেন আর কিছু চায় না। মামা কালীদাস গুহ নিজে একজন সঙ্গীতরসিক এবং সঙ্গীতজগতের বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে জানাশোনা। পড়াশোনার পাশাপাশি মামার কাছে সঙ্গীতের তালিম নেয়া শুরু হলেও কিছুদিন পরেই কর্মসূত্রে বাবাকে কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসতে হয়। অগত্যা তালিমে সাময়িক ছেদ পড়ল। অখিল ভর্তি হলেন নাসিরুদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে এবং সেখানেই তার সাথে বন্ধুত্ব হল সঙ্গীতজগতের ভবিষ্যৎ নক্ষত্র হেমন্ত নামে একটি ছেলের, যে কিনা নিজেও একটু-আধটু গান গায়। স্কুলে যাতায়াতের দরুন অখিলের মা মণিমালা ও হেমন্তর মা কিরণবালা দেবী বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠলেন এবং দুজনের মা একে অপরের পুত্রের গানের প্রতিভার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। জীবনের সব ক্ষেত্রেই একজন মাঝারি মাপের মানুষ অখিলবন্ধু কি গান কি পড়াশুনা সব ক্ষেত্রেই যেন মাঝারি থাকতে ভালোবাসতেন। কোনোমতে ম্যাট্রিক পাশ করে আর পড়াশোনার চেষ্টা করেননি। তাঁর নিজের মামার কাছে সঙ্গীতের হাতেখড়ি হলেও কয়েকবছর তিনি মামারই এক বন্ধু নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতশিক্ষা শুরু করেন। মনের মধ্যে আগে থেকেই একটা ইচ্ছে ছিল এখন সেটা তালিম নেবার সময়ই তিনি বুঝলেন গলা ও গায়কিধরন তৈরি করতে গেলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেওয়াও খুব দরকার। তাই তিনি এলেন সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন তাঁর গুরুর। যে কোনো গান তোলার যেন অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। গুরু তারাপদবাবুর পরামর্শে কিছুদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা নিলেন চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। চিন্ময় লাহিড়ী তাঁকে শিখিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন না করতে পারলে কোনো ধরনের গানই ঠিকমতো গাওয়া যায় না। গুরুর এই উপদেশ অখিলবন্ধু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভোলেননি। ছোটোবেলা থেকে তৈরি হওয়া বিভিন্ন রাগ রাগিনীর সম্পর্কে কৌতূহলের নিরসন হল এই দুই গুরুর সংস্পর্শে এসে। ভারতীয় সঙ্গীতের গর্ব কুমার শচীনদেব বর্মনের গান অখিলকে খুব প্রভাবিত করেছিল, যাকে বলে ডাই হার্ড ফ্যান ছিলেন তিনি। শচীনকর্তার যে-কোনো গান সেটা শোনামাত্র অবিকল তুলে নিতেন নিজের গলায়। একবার কলকাতায় শচীনকর্তার বাড়িতেও চলে গিয়েছিলেন গান শেখার জন্য। কিন্তু তিনি অখিলের সঙ্গে দেখা না করে ফিরিয়ে দেন কিন্তু কিছুদিন পরে একটা জলসায় শচীনকর্তার একটা গান এমন অবিকল গাইতে শুরু করলেন যে কর্তা নিজেই সেই গান শুনে একেবারে থ। অনুষ্ঠান শেষে মুগ্ধ শচীনকর্তা অখিলবন্ধুকে তাঁর নিজের একটি গান, ‘বাজে গোধূলিয়া বাঁশি’, গানটি রেকর্ড করার অনুমতি দেন। কোনো কারণে গানটি আর রেকর্ড করা হয়ে ওঠেনি তবে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় শচীনদেব বর্মনের সুরে তিনি রেকর্ড করেন ‘বধূ গো এই মধুমাস’–এই গানটি এবং বলা বাহুল্য গানটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। নিজে শচীনদেব বর্মনের কাছে তালিম না নিলেও মনে মনে তিনি আজীবন শচীনদেবকে গুরুর আসনে বসিয়েছিলেন। শচীনদেব বর্মনকে ঘিরে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল অপর এক লোকগীতিশিল্পী অমর পালের ক্ষেত্রে। তিনিও অখিলবন্ধুর মতো শচীনদেবকে নিজের গুরুর আসনে বসিয়ে পুজো করতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গভীর জ্ঞান অর্জন করলেও পরিবেশনায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়েই রইল, আলোর মুখ দেখল না আর কিন্তু ক্লাসিক্যাল ঢং-এ নিজস্ব ঘরানার আধুনিক বাংলা গানে তিনি হয়ে উঠলেন একমেবাদ্বিতীয়ম।
১৯৪৪-৪৫ সাল নাগাদ কলকাতা বেতারে গান গাওয়ার মাধ্যমে শুরু হল অখিলবন্ধু ঘোষের সাংগীতিক যাত্রা। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হল প্রথম রেকর্ড। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান দু-টি ছিল— ‘একটি কুসুম যবে’ এবং ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল’। প্রথমটির গীতিকার অখিলবন্ধু নিজেই, দ্বিতীয়টি ব্যোমকেশ লাহিড়ীর লেখা। এর পর কয়েকটি রেকর্ড পেরিয়ে ছ-নম্বর রেকর্ডে (১৯৫৩) একেবারে ঝলসে উঠলেন তিনি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গাইলেন, ‘মায়ামৃগ সম’ এবং ‘কেন প্রহর না যেতে’। সুরকার যথাক্রমে দুর্গা সেন ও দিলীপ সরকার। প্রথম গানটি যে শুদ্ধ ও কোমল ধৈবত-এর এক অন্যধরনের সংমিশ্রণে শুরু হয়, যা অখিলবন্ধুর কণ্ঠে এক অপূর্ব মায়া সৃষ্টি করল। কী অনায়াস গায়ন-ভঙ্গি! অথচ অসম্ভব জটিল পথে সুরের চলন, আবার বাণীর মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ। এই রেকর্ড থেকেই প্রতিভার জাত চেনালেন শিল্পী অখিলবন্ধু ঘোষ। তবে অখিলবন্ধুর এই আধুনিক গান গাওয়ার ব্যাপারে তাঁর গুরু সংগীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর একটু অভিমানও হয়েছিল কারণ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তাঁর যে একটা পাকা ভিত তৈরি হয়েছিল সেখানে আধুনিক গানের স্রোতে ভেসে যাওয়া সংগীতাচার্য-র কাছে হয়তো নিজেকে অপচয় মনে হয়েছিল। কিন্তু শুধু তো আধুনিক গান নয়, অখিলবন্ধু বেতারে খেয়াল, ঠুমরী, রাগপ্রধান, ভজন, এমনকি কীর্তনও পরিবেশন করেছেন অতি দক্ষতার সাথে। ইতিমধ্যে ডাক পেতে লাগলেন বিভিন্ন জলসায়। বেতারে গান গাওয়ার জন্য বাংলা সঙ্গীতজগতে বেশ নামডাকও হয়েছে কিন্তু তাসত্ত্বেও অখিলবন্ধু বিভিন্ন জলসায় বিভিন্ন আধুনিক গানের পাশাপাশি অন্য শিল্পীদের গানও গাইতেন, যেমন শচীনদেব বর্মনের গাওয়া গান, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু এবং বন্ধু সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানও গাইতেন নিজস্ব গায়নভঙ্গিতে। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় গাওয়া ‘মোর মালঞ্চে বসন্ত নাই রে নাই’ এবং গায়ত্রী বসুর গাওয়া ‘কোন দূরের বনের পাখি’ গানদুটি তিনি বহু জলসায় তাঁর অননুকরণীয় গায়নে তৎকালীন শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখতেন। ১৯৪৭ সালে অখিলবন্ধুর প্রথম রেকর্ড প্রকাশের পাশাপাশি তাঁর জীবনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দীপালী ঘোষকে নিজের স্ত্রী রূপে পাওয়া। অখিলবন্ধুর গানের সাধনা ও তাঁর সব গুনগুলিকে পরিশীলিত করে রাখার জন্য তিনি তাঁর সঙ্গীতরসিকা স্ত্রীকে সবসময় পাশে পেয়েছেন। নিঃসন্তান দীপালি দেবী সারাজীবন তাঁর পাশে থেকেছেন কী গানে, কী বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিকূলতায়। একাকী যে সাধনা, অবলম্বনবিহীন যে অবস্থিতি, সংগতবিহীন যে সংগীত, তা নিঃসন্তান দীপালি দেবীর সংস্পর্শে সার্থকতা পেয়েছিল অখিলবন্ধুর জীবনে। দীপালি দেবী ছিলেন সুগায়িকাও, তিনি নিজে যেমন গান গাইতেন তেমনি অসাধারণ সুরসৃষ্টিও করতেন। অখিল বন্ধুর গাওয়া ‘যেন কিছু মনে কোরো না’, ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম’, ‘শ্রাবণ রাতি বাদল নামে’, ‘তোমার নয়ন দুটি’, ‘কেন ডাক বারে বারে’ প্রভৃতি গানের সুরের স্রষ্টা হলেন তাঁর ছায়াসঙ্গিনী স্ত্রী। সুরের প্রেম আর প্রেমের সুরে দুজনে এমনই বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন।
গানের জন্য কখনও ১০ টা ৫ টার চাকরি করার কথা ভাবেননি এই আত্মভোলা মানুষটি, নিজে ছিলেন নিঃসন্তান তাই অনেক ছাত্রছাত্রীকে নিজের হাতে তৈরি করেছেন সন্তানস্নেহে। তার উপর সঙ্গীত শিক্ষকতায় ব্যবসায়ীসুলভ মনোভাবের অধিকারী একদমই ছিলেন না। জলসা আর রেকর্ডের আয়ও ছিল না তেমন আহামরি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সামান্য পেনশন দিত কিন্তু সেটাও ছিল অনিয়মিত। তাই আর্থিক একটা অসুবিধা তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল। কিন্তু সুরের প্রতি উৎসর্গিত এই আত্মভোলা মানুষটি তাঁর সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই পড়ে থাকতেন, খুব চেষ্টা করতেন তাঁদের ভিতর থেকে আরও প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে। গানের কান তৈরির জন্য তিনি ছাত্রছাত্রীদের পরামর্শ দিতেন গুণী শিল্পীদের গান শুনে নিজের কান তৈরি করতে। আব্দুল করিম খাঁ, পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী, পণ্ডিত জ্ঞান গোস্বামী, শচীনদেব বর্মন প্রমুখ শিল্পীদের গানের সুর আত্মস্থ করতে বলতেন ছাত্রছাত্রীদের। এমনও এক এক দিন এসেছে যে সুরের ঝলকানিতে তিনি কখনও কখনও জেগে উঠতেন মধ্যরাত্রে। তানপুরা পাশে নিয়ে বসতে বলতেন তার সুরের সাথীকে। নিজের স্বামীকে খুব ভালো চিনতেন দীপালী। তখনই সুরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তানপুরা নিয়ে বসে যেতেন স্বামীর সাথে তারপর সারাটা রাত ধরে ওই সুরেরই গুনগুন বা রেওয়াজ চলত আর এই ভাবেই জন্ম নিত তাঁর গাওয়া কত কালজয়ী গানের সুর। গানকে নিয়ে এমন নিবিড় দাম্পত্যের ছবি বাংলাগানের জগতে খুব কমই আছে এবং সেটা অখিলবন্ধুর জীবনে অন্য মাত্রাও পেয়েছিল।
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এর সঙ্গে অখিলবন্ধুর টিউনিং ছিল খুব সুন্দর। পুলকবাবু লিখেছিলেন একটি বিশেষ গান–‘ও দয়াল বিচার করো, দাও না তারে ফাঁসি’! গানটি লিখেই পুলকবাবুর মনে হয়েছিল এই গান গাওয়ার উপযুক্ত লোক হলেন শচীনদেব বর্মন। কিন্তু তখন শচীনদেব স্ত্রী মীরা দেবীর লেখা ছাড়া অন্য কারুর গান গাইবেন না ঠিক করেছেন। তাই পুলক তখনই বিকল্প হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন অখিলবন্ধুর কথা। ইতিমধ্যেই পুলক তাঁর নিজের লেখায় অখিলবন্ধুকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘কবে আছি কবে নেই গান’ গানটি (সুর অখিলবন্ধু ঘোষ)। তিনি এবার শচীনদেব-এর রিজেক্ট করা গানের জন্য ডেকে পাঠালেন অখিলবন্ধুকে, কারণ তিনি ভেবেছিলেন শচীন দেব বর্মনের পর এই গান যদি আর কেউ তাঁর মনোমতো গাইতে পারেন তিনি নিঃসন্দেহে তাঁর ভাবশিষ্য অখিলবন্ধু। এটাই পুলকবাবুর কথায় অখিলবন্ধুর গাওয়া দ্বিতীয় রেকর্ডের গান। অবশেষে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হল ‘ও দয়াল বিচার করো, দাও না তারে ফাঁসি’ গানটি। কী অনায়াস দক্ষতায় দয়ালের কাছে বিচার চাওয়ার এই আকুতি শ্রোতাদের কাছে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছিলেন অখিলবন্ধু তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই রকম আরও একটি গান ছিল ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা আমি কাঁদি সাহারায়’। এটিও পুলকবাবুর লেখা ও অখিলবন্ধুর সুর ও কণ্ঠের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন।
আরও একটি ঘটনা, একদিন পুলক অখিলবন্ধুর টার্ফ রোডের বাড়িতে এসে বললেন, ‘বউদি আপনাকে নিয়ে একটা গান লিখেছি, শুনুন’, এই বলে পাঠ করলেন তার লেখা ‘সেদিন চাঁদের আলো চেয়েছিল জানতে/ তার চেয়ে সুন্দর কেউ আছে কি?/ আমি তোমার কথা বলেছি’। গানের কথা শুনে অখিলবন্ধুর হাসি আর ধরে না। খুব খুশি হলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে গেলেন তিনি এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলকের কথায় সুর বসিয়ে অসাধারণ একটি রোম্যান্টিক গান তৈরি করে ফেললেন। আরও একটি গানের কথাও উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না, সেটিও পুলকবাবুর লেখা। ‘ওই যাঃ! আমি বলতে ভুলে গেছি সে যেন বাঁশী না বাজায়’ গানের শুরুতে, ‘ওই যাঃ!’ কথাটি কিন্তু পুলকবাবুর কথায় ছিল না। সুর করার সময় তিনি গানটিকে একটু নাটকীয় ঢং-এ পরিবেশন করার কথা ভাবেন। ১৯৭১ সালে গানের রেকর্ড হয় এবং গানের শুরুতেই ‘ওই যাঃ!’ কথাটি এমন নাটকীয়ভাবে বলেন যে গানের পরবর্তী অংশটি অর্থাৎ ‘আমি বলতে ভুলে গেছি’র সঙ্গে ঠিকভাবে খাপ খেয়ে যায়। অর্থাৎ কিছু বলতে ভুলে গেলে ‘ওই যাঃ!’ কথাটা আমাদের মুখ থেকে যেভাবে বেরিয়ে আসে, ঠিক সেভাবেই বলেন অখিলবন্ধু। গানটি আবার শুনুন এবং এবার একটু খেয়াল করে দেখুন এখানেই মিল খুঁজে পাবেন শচীন দেববর্মনের ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’র গানে। এই গানটি শুরু করার আগে শচীনকর্তা ‘আঃ’ কথাটি বলে উঠতেন। অখিলবন্ধুর ‘ওই যাঃ! আমি বলতে ভুলে গেছি’ গানে শচীনকর্তার ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’র যে প্রভাব আছে তা অস্বীকার করা যায় না। গানের ভিতর দিয়ে একটা ছবি এঁকে যাওয়া–সে তো ভিন্ন এক কলা, শিল্প যা পুরোদস্তুর রপ্ত করেছিলেন অখিলবন্ধু।
অখিলবন্ধুর আরও একটি বিখ্যাত গান ‘পিয়াল শাখার ফাঁকে এক ফালি চাঁদ বাঁকা ওই – তুমি আমি দুজনাতে বাসর জেগে রই’ গানটি সুর করেছিলেন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। একদিন কোন্ একটা অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন অখিলবন্ধু, সঙ্গে ছিলেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। একটা রোম্যান্টিক গানের আবদার ছিল অনেকদিন থেকেই গৌরীপ্রসন্নর কাছে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় একটা গানের কথা তৈরি করে ফেললেন তিনি আর সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ গুনগুন করতে থাকা সেই সুর দিয়ে ফেললেন গৌরীপ্রসন্নর গানের কথায়। সৃষ্টি হল সেই কালজয়ী গান ‘পিয়াল শাখার ফাঁকে’।
আগেই উল্লেখ করেছি, অখিলবন্ধু সাধারণত নিজের সুরেই গান করতেন, অন্য কারো সুরে গান গাইতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না তাই তাঁর নিজের গাওয়া সিংহভাগ গানই নিজের সুরে যার মূল্য বাংলা সঙ্গীত জগতে আজও অপরিসীম। লিখতে লিখতে এই মুহূর্তে তাঁর সুরসৃষ্ট আরও একটা অসামান্য গানের কথা মনে পড়ছে যেটি তিনি সুর দিয়েছিলেন তাঁর মাতৃবিয়োগের পর। গানের কথা লিখেছিলেন মধু গুপ্ত। “এমনি দিনে মা যে আমার হারিয়ে গেছে ধরার পরে মা হারানো কী যে ব্যথা বোঝাই বলো, কেমন করে”, গানের কথায়, সুরে আর গায়কীতে কাঁদবার এমন একটা এলিমেন্ট আছে যে শুনলে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। মা-কে নিয়ে আরও একটা অসামান্য গান এর অনেক আগে আর এক খ্যাতনামা শিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তী গেয়েছিলেন–‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মা-কে মনে পড়ে আমার মা-কে মনে পড়ে’।
নিজের বেশিরভাগ গানে বৈচিত্র্যময় সুরারোপ করলেও, অন্যের কণ্ঠে অখিলবন্ধুর সুর দেওয়া গান পাওয়া যায় মাত্র দু’টি রেকর্ডে। একটি রেকর্ডে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় দু’টি গান, ‘যমুনা কিনারে’ ও ‘মনে নেই মন’ এবং আর একটি লং প্লেয়িং রেকর্ডের সংকলনে কয়েকটি গানের মধ্যে একটি ভজন ‘গুরু মোহে দে গ্যয়ে’ (গীতিকার: কবীর দাস) অখিলবন্ধু ঘোষের সুরে গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ছায়াছবির জগতেও সুরকার হিসেবে কোনো কাজ করেননি তিনি। শুধুমাত্র ‘শ্রীতুলসীদাস’ (১৯৫০), ‘মেঘমুক্তি’ (১৯৫২) ও ‘বৃন্দাবনলীলা’ (১৯৫৮) ছবিতে অখিলবন্ধু ঘোষের নেপথ্য কণ্ঠ শোনা গেছে, যে ছবিগুলির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন যথাক্রমে অনুপম ঘটক, উমাপতি শীল ও রথীন ঘোষ।
বাংলা আধুনিক গানের পাশাপাশি রাগপ্রধান গানের জগতে তাঁর অবিস্মরণীয় কিছু সৃষ্টি হল ‘আজই চাঁদিনী রাতি গো’, ‘জাগো জাগো প্রিয়’, ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’, ‘আমার সহেলী ঘুমায়’ ইত্যাদি। বেশ কিছু নজরুলগীতিও তাঁর কণ্ঠে অন্য মাত্রা পেয়েছে। ১৯৬১ সালে দু’টি রবীন্দ্রসংগীতও রেকর্ড করেন তিনি – ‘তুমি মোর পাও নাই পরিচয়’ এবং ‘যার মিলন চাও বিরহী’। বেশ কিছু নজরুলগীতি যেমন, ‘রসঘন শ্যাম কল্যাণসুন্দর’, ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’, ‘হংস মিথুন ওগো যাও কয়ে যাও’, ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ ইত্যাদি স্বয়ং কাজী নজরুলকেও মুগ্ধ করেছিল।
সাংগীতিক ভাববিস্তারে অখিলবন্ধু ছিলেন অদ্বিতীয়। গানের কথার মধ্যে ঢুকে যেতেন তিনি। প্রতিটি শব্দের অর্থ ও ভাব বুঝে, তার অন্দরে প্রবেশ করে, তারপর তা উপহার দিতেন শ্রোতাদের। এ ব্যাপারে দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গান গাওয়ার সময় তাঁর চোখদুটি বন্ধ থাকত যেন একটা তদগত ভাব। সেই মুহূর্তে তিনি গানের মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবে যেতেন। তাই শ্রোতাদের কাছে তাঁর সংগীত পরিবেশনা এক অনন্য মাধুর্য সৃষ্টি করত।
এই সুরসাধকের চলে যাওয়াটাও খুব দুঃখজনক। মৃত্যুতেও তিনি অবহেলার শিকার হয়েছেন। অন্ডালে একটি অনুষ্ঠান করে ফিরে এসেছিলেন সেদিন সকালে। দুপুরে হঠাৎ তাঁর শরীরটা খারাপ লাগতে থাকে। তাঁকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে বেশ কিছুক্ষণ চিকিৎসাহীন অবস্থায় পড়ে থাকার পর তাঁকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। অবশেষে সেখানে তাঁর চিকিৎসা শুরু হলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, তিনি তখন ৬৮ বছর বয়েসে পাড়ি দিয়েছেন সুরের অমৃতলোকে। তারিখটা ছিল ১৯৮৮ এর ২০ মার্চ। সারাটি জীবনে তিনি তাঁর যোগ্যতার উপযুক্ত সম্মান পাননি, সে কারণেই হয়তো তাঁর ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম এই মায়াভরা পৃথিবীতে পেয়েছি যতই, তারও বেশি করে হয়তো হয়েছে দিতে’ গানটিতে এক অভিমানী শিল্পীর বেদনা এমন গভীর হয়ে ফুটে উঠেছে (কথা: দীপালী ঘোষ, সুর অখিলবন্ধু ঘোষ)। তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো বিশিষ্ট শিল্পীরাও বলেছেন এ কথা। মৃণাল চক্রবর্তী তাঁর আত্মজীবনী ‘খোলা জানালার ধারে’-তে লিখেছেন, “লেখকদের জগতে যেমন একটা কথা আছে লেখকদের লেখক, অখিলদাকে আমি আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রে গায়কদের গায়ক বলে মনে করি।” একেবারে খাঁটি কথা। অখিলবন্ধুর গায়কি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, নিজস্ব। তাঁর গায়কি অনুসরণ করা একেবারেই সহজ ছিল না। মৃণাল চক্রবর্তীর অনুভবেরই প্রতিধ্বনি করে বলি, আধুনিক বাংলা গানে নিজের নির্জন স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। শোনা যায়, যেদিন অখিলবন্ধু সহসা চলে গেলেন সেদিনই রবীন্দ্রসদনে সন্ধেয় একসঙ্গে দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর অর্থাৎ সতীনাথ ও অখিলবন্ধুর একটি যুগ্ম অনুষ্ঠান ছিল। সতীনাথ আয়োজকদের আগেই বড়োমুখ করে বলে রেখেছিলেন, ‘দেখবেন, দুইবুড়ো কেমন সুরের খেলা দেখায়।’ কিন্তু হায় সেই আসরে দুই বন্ধুর আর একসাথে বসা হয়নি। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেদিন সতীনাথ গেয়েছিলেন, ‘যেদিন রব না আমি (কথা: প্রণব রায়, সুর: রাইচাঁদ বড়াল),’ ‘সব কিছু ফেলে দিয়ে যদি তোমার আগেই চলে যাই’ (কথা: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর: সতীনাথ মুখোপাধ্যায়),–এই গান দুটি। বছর কয়েক আগেই অখিলবন্ধুর জন্মশতবর্ষ খুব নীরবেই চলে গেছে (জন্ম ২০শে অক্টোবর, ১৯২০)। হয়নি কোনো স্মরণসভা, বসেনি কোনো আবক্ষ মূর্তি অথবা হয়নি তাঁর নামে কলকাতায় কোনো রাস্তা। বেতারেও আজকাল খুব একটা শোনা যায় না তাঁর গান। তবে বছরদশেক আগে যখন বিভিন্ন প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলে পুরনো গান পরিবেশিত হত সেখানে দুই একজন নবীন শিল্পীর কণ্ঠে শোনা যেত অখিলবন্ধুর হাতে গোনা কয়েকটি নির্দিষ্ট গান। তবে দূরদর্শনে আজও মাঝেমধ্যে প্রচারিত হয় অখিলবন্ধু ঘোষের সেই সাক্ষাৎকার যেটি নিয়েছিলেন গায়ক জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও সুরকার রতু মুখোপাধ্যায়। সেখানে অখিলবন্ধুর গানের সাথে সাথে তানপুরায় ছিলেন তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী দীপালী ঘোষ। গায়ক ইন্দ্রনীল সেন তাঁর রিমেক এলবাম-এ অখিলবন্ধু ঘোষের দুই একটি বিখ্যাত গান তো গাইলেনই, এমনকি সেই ক্যাসেটের নামও দিলেন অখিলবন্ধুর গানের কথার নামে–“দূরের বলাকা”! বলাই বাহুল্য শান্তি ভট্টাচার্যের কথায় ও অখিলবন্ধুর সুরে গানটি ছিল “ওই যে আকাশের গায় দূরের বলাকা ভেসে যায়!” আসলে অখিলবন্ধু ছিলেন একটি সভ্যতার অথবা সময়ের ফসল তা না হলে প্রতি কয়েক বছর অন্তর একটা করে অখিলবন্ধু জন্ম নিতেন।
অখিলবন্ধুর সেরা দশটি গানের তালিকা লিংকসহ:-
১. মায়ামৃগ সম
২. শিপ্রা নদীর তীরে
৩. কবে আছি কবে নেই এই
৪. ওই যে আকাশের গায় দূরের বলাকা!
৫. ও দয়াল বিচার কর
৬. তোমার ভুবনে ফুলের মেলা
৭. পিয়াল শাখার ফাঁকে
৮. এমনি দিনে মা যে আমার
৯. ঐ যাঃ! আমি বলতে ভুলে গেছি
১০. সারাটি জীবন কী যে পেলাম এই মায়াভরা
তথ্যঋণ :-
১. খোলা জানলার ধারে মাথা রেখে – মৃণাল চক্রবর্তী
২. কথায় কথায় রাত হয়ে যায় – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. শতবর্ষে অখিলবন্ধু – অভীক চট্টোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
৪. ওরা অলকার গান – সোমনাথ শর্মা – শারদীয় আজকাল ১৪২৮
৪. শহর পত্রিকা – বিশেষ সঙ্গীত সংখ্যা — এপ্রিল ২০১২
৫. মার্জিত শোভন সুরসৃষ্টি অখিল বন্ধু ঘোষ – সংকলক সন্দীপ মুখোপাধ্যায়
৬. দূরদর্শনে প্রচারিত অখিলবন্ধু ঘোষের সাক্ষাৎকার