ভোজ কয় যাহারে (পঞ্চম পর্ব) : পালং শাক – সত্যম ভট্টাচার্য
যা বা যে চলে যায় প্রতি মুহূর্তে সেসবের বা তাদের কথাই কেন মনে হয়? সকালবেলা কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের স্কুল যেতে দেখে মনে পড়ে যায় নিজের স্কুলবেলার কথা। মনে পড়ে যায় কোনো কোনো বন্ধুর কথা, হয়তো নাম মনে পড়ে না, শুধু মুখ ভেসে ওঠে চোখে। হঠাৎ কারুর সাথে আচম্বিতে রাস্তায় দেখা হলে সুমন গেয়ে ওঠেন ভেতর থেকে–
বন্ধু কী খবর বল
কতদিন দেখা হয় না।
কোনো কোনো দিন মনে পড়ে যায় কিশোরবেলার সেই বান্ধবীর কথা যে প্রতিদিন তার রিক্সায় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিত। কোথায় আছে সে? কেমন আছে তারা যাদের রাস্তায় দেখলে এক সময় বুকের ভেতর ঢাক পেটার মতো আওয়াজ শুরু হয়ে যেত। মাঝে মাঝে ফেসবুক খুলে তাদের খুঁজি। কারুর নাম মনে পড়ে, কারুর আবার শুধু মুখ। নিরাশ বিফল হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেলি একখানা।
ঠিক তেমনি এই চলে যাওয়া শীতে, যখন চিবুতে হচ্ছে সজনে ডাঁটা, আরও ভয়ংকর দিন আসছে গরমকালের যখন বেঁচে থাকতে হবে দিনের পর দিন শুধু পটলের ঝোল খেয়ে, শীতের বাজারের প্রথম পালং শাকের কথা খুব মনে পড়ে। ঠিক এরকমই পালং শাকের কথা মনে পড়ত যখন ইউরিক অ্যাসিডের কারণে ডাক্তার বেশ কয়েক বছর হাই প্রোটিন সমস্ত খাওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। তারপর একদিন—বাঁধ ভেঙে দাও।
সেই যে বলেছিলাম এক একটা জেনারেশন চলে যাবার সাথে সাথে চলে যায় তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-লোকাচার। চলে যায় তাদের হাতের রান্নাবান্না-গালগল্প, সব সব। মনে পড়ে শীতে স্কুলে যাবার সময় রান্নাঘরের বারান্দায় বসে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে মায়ের হাতের বানানো পালং শাকের ঝোলের কথা। সবুজ ঝোল, তার মাঝে মাঝে ফুলকপি, আলু আর বেগুন। মা কালোজিরে কাঁচালঙ্কার সেই ঝোলকে, জানি না ভালোবেসে কি না, বলতেন পালং শাকের মোরির ঝোল। পাতলা শাকের সেই সবুজ ঝোল দিয়ে নিমেষের মধ্যে হুপুস-হাপুস করে সাবাড় হয়ে যেত একথালা ভাত। কী যে ছিল সেই পাতলা ঝোলের মধ্যে, কড়াতে রান্না হতে হতেই তার এত সুন্দর গন্ধ বেরুত যে খিদে যেন চনমন করে উঠত পেটের ভেতর থেকে। তারপর তো যা বললাম ওপরে।
আর ছিল পালং শাকের ঘন্ট। ছক্কার মতো করে কাটা আলু, ছোটো ছোটো বড়ি, সাথে বেগুন আর তার সাথে পালং শাক। রোববারের দুপুরে মাংসের আগে এই একটি পদ থাকলেই তা এপিটাইটকে এত সুন্দর রেডি করে দিত যে পদটির উপযোগীতা সম্পর্কে বলার আর কিছু থাকত না। সাদা ভাতের সাথে মাখার আগে বা পরে দেখতেও লাগত চমৎকার।
কথায় যেমন বলে মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না, আমরাও ঠিক তেমনি যতদিন এই সমস্ত পদ খেতে পেয়ে এসেছি তাদের মর্ম বুঝিনি। এখন হাজার লোকের কাছে বলেও যখন সেরকম পদ আর পাওয়া যায় না, মনে হয় ছবি তুলে আর রেসিপিটা লিখে রেখে দিলে ভালো হত। কিন্তু কী আর করা যাবে। যা চলে যাবার তা তো যাবেই। হাজার চাইলেও তাকে ধরে রাখা যাবে না।
চলে আসি সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে। প্রায় বছর পঁচিশেক আগের কথা। মামারা কিছুকাল থাকার কারণে, পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় উপস্থিত হয়েছি তর্কসাপেক্ষে ভারতের সব থেকে ধনী শহর চণ্ডীগড়ে। চারিদিকের জৌলুশ দেখে মফঃস্বল থেকে যাওয়া এই কিশোরের তো চক্ষু ছানাবড়া অবস্থা। তো যাই হোক, মামাদের পরিচিত বিভিন্ন বাড়িতে এক একদিন করে নেমতন্ন থাকছে। তো সেরকমই এক বাড়িতে একদিন খাইয়েছিল পালং পনীর। সত্যি কথা বলতে আমাদের এখানে যতদূর মনে পড়ে তখন পনীর আসেনি বা আসলেও গ্রামেগঞ্জে তা আকছার এখনকার মতো জোটে না। সেই সবুজের মধ্যে সাদা মুক্তোর মতো পনীর, ওপরে একদলা মাখন দেওয়া, সে আস্তে আস্তে গলছে, ধোঁয়া উঠছে খাবারটার থেকে আর তার সাথে অসাধারণ ঘিয়ে ভাজা পরোটা আজও স্মৃতির এককোণায় ঝকঝক করে।
সিজনের শেষের দিকে শীষ পালংও কিন্তু অতি উত্তম। সর্ষে-আলু-বেগুন দিয়ে তার যে পদটি প্রস্তুত হয় গরম ভাতের সাথে সেটি খেয়ে ভেতর থেকে যেন মারহাব্বা কথাটা উঠে আসে। তো এভাবে স্মৃতিতেই ভালো থাক বরং শীতের পালং।