কারেকশনবাবু – প্রতীক

শেয়ার করুন

“মানুষডা মইরা গিয়া বাইচ্যা গ্যাছে”। বলে বাবা হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল। কার সম্বন্ধে বলছে বুঝে উঠতে পারছি না দেখে হাতের জিনিসটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বিয়ের কার্ড।

শ্রীশ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ

মহাশয়/মহাশয়া,
আগামী ২২শে জানুয়ারি ২০২২ (৮ই মাঘ ১৪২৮), শনিবার আমার জেষ্ঠ ভ্রাতা ৺শক্তিপদ মুখোপাধ্যায় ও বড় বউদি শ্রীমতি সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র কন্যা কল্যানীয়া কণিনিকার সহিত বিরাটি নিবাসী শ্রী উজ্জ্বলকুমার গাঙ্গুলি ও শ্রীমতি মীনাক্ষী গাঙ্গুলির একমাত্র পুত্র শ্রীমান অনিমেষের শুভ বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে। এতদুপলক্ষে আপনি সবান্ধবে সেদিন সন্ধেবেলা ‘শুভলগ্ন’ অনুষ্ঠান বাড়িতে প্রীতিভোজে যোগদান করিয়া আমাদের বাধিত করবেন।

ধন্যবাদান্তে
কালীপদ মুখোপাধ্যায়।

আমিও হেসে ফেললাম।

“আমরা তো হাসতাছি, কিন্তু শক্তির কথা ভাবলে দুঃখ হয়। ডাক্তার, বদ্যি, সাধু, মৌলবি— কিস্যু বাদ রাখে নাই। তবে গিয়া বিয়ার দশ বচ্ছর পরে এই মাইয়াডা হইছিল। সাধ কইরা শক্তি নাম রাখছিল কনীনিকা। সোখের তারা। সেই মেয়ের বিয়ায় হালায় একখান ভুলে ভরা কার্ড লিখছে, তার মইদ্যে আবার মাইয়ার নামের বানানডাও ভুল!”

বাবার ক্ষোভ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আজকাল আর ওসব কে ভাবে? আমি বললাম “ওদের দোষ না-ও হতে পারে। প্রেসই গুবলেট করেছে হয়ত। আজকাল তো সব কম্পিউটারে হয়, কী টাইপ করতে কী টাইপ করেছে…”

“ক্যান, আজকাল আর প্রুফ-টুফ হয় না?”
কোথায় খাপ খুলতে গেছি! ঠাকুর্দার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলেও আমাদের বাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে আমার বাবাই বরাবর কর্তা। হাঁড়ি আলাদা হয়ে যাওয়ার পরেও সকলের বিয়ে, পৈতে, মুখে ভাত, শ্রাদ্ধের প্রধান ব্যবস্থাপক বাবা। শেষ অনুষ্ঠান ছিল তিন বছর আগে—আমার সেজ জ্যাঠার মেয়ের বিয়ে। সে বিয়েরও গায়ে হলুদের তত্ত্ব থেকে কন্যাযাত্রীর বাস ভাড়া পর্যন্ত সবকিছু বাবার তদারকিতে হয়েছিল। সেই লোককে যা খুশি বোঝাতে চাইলেই কি আর বোঝানো যায়?

“যার অনুষ্ঠান তার হুঁশ থাকতে হয়, বুঝছস?”

বলে বাবা উঠে গেল, আমি আর কথা বাড়ালাম না। খুব একটা কিছু বলারও নেই, কারণ শক্তিকাকার বাড়ির কারোর যে বানান-টানান নিয়ে মাথাব্যথা নেই তা সত্যি। বরং ওঁর বানান শুধরে দেওয়ার অভ্যাসটাকে ওরা আপদ বলেই মনে করত। মানুষটা মারা গিয়ে আপদ বিদেয় হয়েছে। সবুজগ্রামের অধিকাংশ লোকই তা-ই মনে করে। সবুজগ্রাম হাইস্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই ছিলেন, পঁয়ত্রিশ বছর পড়িয়েছেন আমাদের এলাকার এই প্রাচীনতম স্কুলে। তাই বহু লোক সম্মান করত ঠিকই, কিন্তু আড়ালে বিরক্তিও প্রকাশ করত। শুনেছি দেশভাগের পর যখন বনজঙ্গল সাফ করে আমাদের এই সবুজগ্রাম তৈরি হল, তখন প্রথম দিককার বেশকিছু দোকানপাটের নামকরণ করেছিলেন শক্তিকাকা। তখন এখানে শিক্ষিত লোক আর কেউ ছিল না, নাকি দোকানদাররা শিক্ষিত লোকেদের বেশি গুরুত্ব দিত, বুঝতে পারি না। তবে আমি নিজের চোখে অন্যরকম দেখেছি।

সবুজগ্রাম বাজারে একজন বাসনের দোকান খুলে নাম দিয়েছিল ‘বাসুন ভান্ডার’। সে আবার সবুজগ্রাম হাইস্কুলেরই প্রাক্তনী, মানে শক্তিকাকার ছাত্র। উনি একদিন অদরকারেই তার দোকানে ঢুকে বললেন “হ্যাঁ রে পটলা, তুই তো ইস্কুল ফাইনাল পাস করেছিলিস?”

পটলদা মাথা চুলকে বলল “হ্যাঁ সার। ওই… থাড্ডিভিশন।”

“সে যে ডিভিশনই হোক। একবার বল তো, আমি কি তোদের পড়াতে কোনো ত্রুটি রেখেছি? ফাঁকি দিয়েছি কোনোদিন?”

“আরে সার! কী যে কন…” পটলদা এক হাত জিভ কাটল।

“তাহলে বাসনে উ-কারটা কোথা থেকে আমদানি করলি, বাবা? ভাণ্ডারে দন্ত্য ন করেছিস, সে নয় কষ্ট করে মেনে নিলাম। এখন দিনকাল বদলেছে, আমাদের কালের বানান সেকেলে হয়ে গেছে বলছে লোকে। তা বলে বাসুন? তা ব-এ আ-কারটাও বাদ দিয়ে দিতিস, খদ্দের ভাবত খাতির করে বসতে বলছিস। সে বেশ নতুন ব্যাপার হত। এ কী করলি বল তো?”

পটলদার সঙ্গে দোকানে বসত তার ছেলে। তার তখন বছর আষ্টেক বয়স। ছেলের সামনে এই বেইজ্জতি পটলদাকে হজম করতে হল। দেখলাম মুখচোখ লাল হয়ে গেছে। সে কোনোমতে শক্তিকাকাকে বলল “ও আমি দেখি নাই। সাইনবোডের দোকানে নেগেলপাড়ার পোলাপান কাজ করে, ওদের কি আর পেটে বিদ্যে আছে?”

“যাক, শুধরে নিস” বলে স্যার তো চলে গেলেন, পটলদার রাগ আর পড়ে না। আমি দোকানে ঢুকেছিলাম মায়ের সাথে। মাকে সে বললে “দ্যাখছেন কান্ড? আমার আর কাজ কাম নাই, বানান দেইখ্যা বেড়াইতে অইব। সেই কবে ইশকুলে পড়ছি, উনি এহনো আমার ক্লাস নিতাছেন। যত্তসব।”

তখন আমার চোদ্দ-পনেরো বছর বয়স, শক্তিকাকা কেবল আমার বাবার সহকর্মী নন, দুবেলা আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসেন। আমাদের বাড়ির সবাই কাকাকে ভালবাসত। সেই অধিকারে মা একদিন বলেছিল “আপনি সকলেরে বানান শিখায় বেড়াবেন না। ভাল দ্যাখায় না।”

“কেন বৌঠান? কেউ কিছু বলেছে?”

“আমারে কিছু কয় নাই, কিন্তু যদি আপনারে কয়? আপনি একটা শিক্ষক মানুষ…”

“এ আপনি কী বলছেন? শিক্ষক বলেই তো আমার বলা কর্তব্য। চারদিকে ভুল বানান গিজগিজ করলে ছোটরা কী শিখবে ভাবুন তো? বানান ভুল দেখলে আমার তো গা চিড়বিড় করে।”

আমার বাবা জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক, প্রবল বাস্তবজ্ঞান। বলেছিল “তুই কয়জনের বানান ঠিক করতে পারস? দিনকাল বদলাইতাসে, সক্কলের উপর মাষ্টারি করতে যাইস না। রমা যা কইতাসে ঠিকই কইতাসে। তর ছাত্রগুলারে মন দিয়া পড়া, যাতে ওইগুলান সঠিক বানানটা শেখে, পাঁচজনেরে শিখায়। ইস্কুলের বাইরে লোকের পিছনে লাগতে যাইস না। কোনদিন কে দু কথা শুনায় দিব, তহন আর মান সম্মান থাকব না।”

কাকাকে কিন্তু কিছুতেই বোঝানো গেল না গোলমালটা কোথায়। তিনি কেবলই বলে গেলেন “আমি তো কারোর পেছনে লাগি না! আমি তো যে জানে না তাকে সাহায্য করি। না জানা তো দোষের নয়, আর ভুল তো সকলেরই হয়। আমার তো রোজ ঘুম থেকে উঠে একটা না একটা বানান গুলিয়ে যায়। জিগীষা বানানে কোনটা ই-কার আর কোনটা ঈ-কার, মাঝে মাঝেই ভুলে যাই। বীতংস প্রায়ই মূর্ধন্য ষ মনে হয়। তখন আবার অভিধান খুলে দেখে নিই। এতে দোষের কী আছে?”

আমরা অন্য স্কুলে পড়তাম, কিন্তু শক্তিকাকা আমাকে আর খুড়তুতো বোন শ্যামলীকে বাড়িতে বাংলা আর সংস্কৃত পড়িয়েছিলেন অনেকদিন। একদম বকতে পারতেন না। আমরা পড়া না পারলে এমন কাঁচুমাচু হয়ে যেতেন, যেন দোষটা ওঁরই। ওই মানুষটার মুখ চেয়েই আমরা মন দিয়ে পড়তাম। ফলে আমাদের বাংলা শিক্ষা এবং বানান শিক্ষা বেশ ভালই হয়েছিল। তবে বুড়ো বয়সে যখন সবুজগ্রামে শক্তিকাকার নাম হয়ে গেল কারেকশনবাবু, সে নাম নিয়ে আমরাও যে হাসাহাসি করিনি তা নয়।

বয়স হলে মানুষের এমনিতেই নানারকম বাতিক হয়। শক্তিকাকারও অবসর নেওয়ার কয়েক বছর আগে থেকে বানান শুধরে দেওয়ার বাতিকের সাথে যোগ হল পরিচ্ছন্নতার বাতিক। চিরকাল কাকিমা ওঁর জামাকাপড় কেচে দিতেন, পরের দিকে ছেলেমেয়েরাও। হঠাৎ ডিক্রি জারি করলেন, নিজের জামাকাপড় নিজেই কাচবেন। নিজের বিছানাও নিজে করা শুরু করলেন। এই অব্দি ঠিক ছিল, কিন্তু বাতিকটা এমন পর্যায়ে পৌঁছল, যে বলে বসলেন দিনের যে কোনো সময়েই ওঁর ঘরে ঢুকতে হলে স্নান করে ঢুকতে হবে, ওঁর বিছানায় আর কারোর শোয়া চলবে না। যে কাজ করার অভ্যাস নেই তা বুড়ো বয়সে করতে গেলে যা হয় তা-ই হল। কলপাড়ে কাচতে গিয়ে সাবান জলে পিছলে পড়ে মাথা ফাটালেন, বাড়িতে চরম অশান্তি হল, তবু চালিয়ে গেলেন। কারোর কথাই শুনছেন না, ডাক্তারের কথাও নয়। একদিন কাকিমা এসে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেলেন কাকাকে বোঝানোর জন্যে। বাবা এসে বলল “শক্তির মাথাডা অ্যাক্কেরে খারাপ হইয়া গ্যাছে। কয় বাড়িসুদ্ধ সক্কলে অশিক্ষিত আর নোংরা। অগো সাথে থাকতে পারুম না।”

ওটা অবশ্য কথার কথা। তারপরেও উনি ও বাড়িতেই ছিলেন। তবে একা একা থাকতেন, কারোর সাথেই বিশেষ কথাবার্তা বলতেন না। বরাবরই দু-চারজন ছাত্রকে বাড়িতে পড়াবার অভ্যাস ছিল। যাদের সামর্থ্য ছিল তারা টাকা দিত, যারা পারত না দিত না। চাইতে পারতেন না বলে অনেকসময় যারা দিতে পারে, তারাও দিত না। বাড়ির সকলের সাথে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ওই ছাত্রদের সাথেই যা কথাবার্তা বলতেন, আর আমাদের বাড়িতে এসে গল্পগুজব করতেন। কাগজ পড়তে পড়তে বলতেন “ইশ! বানানের কী অবস্থা করেছে এরা! ছুড়ে, পাউরুটি… চন্দ্রবিন্দু তোদের কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে?” আমাদের বাড়িতেও ততদিনে বাবা, মা আর আমি ছাড়া শক্তিকাকার শুভানুধ্যায়ী কেউ নেই। আমার তুতো ভাইবোনেরা, এমনকি শ্যামলীও, মোড়ের মাথায় কাকাকে দেখতে পেলেই বলত “উফ! ওই আসছে কারেকশনবাবু।” আমারও আধুনিক বানান, লেখার মধ্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার — এইসব নিয়ে রোজ রোজ ওঁর আপত্তি শুনতে ভাল লাগত না। একমাত্র আমার বাবাই ধৈর্য ধরে আলোচনা করত। হয়ত নিজের মতে মিলত বলেই সহ্য করতে পারত। একদিন আমার সামনে দুজনের কথাবার্তা চলছিল। আমি বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর থাকতে না পেরে বললাম “কাকা, সময়ের সাথে সাথে সব ভাষারই বদল হয়। বাংলাই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কত নতুন নতুন শব্দ ভাষায় ঢুকছে, বানানও বদলাচ্ছে। না বদলানো মানে তো থেমে যাওয়া। থেমে গেলে তো মরে যাবে ভাষাটা।”

কাকা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। তারপর বললেন “সে তো ঠিক কথাই। কিন্তু যা বদলালে তা কেন বদলালে, সে কথা তো বলতে হবে। যুক্তি থাকতে হবে তো, নাকি? সেদিন দুটো নতুন অভিধান কিনে আনলাম কলকাতা থেকে। আমার এক ছাত্র ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করে, সে বলল এখন নাকি এ দুটো মেনেই লেখালিখি চলছে। কতগুলো বানানের যে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না বাবা, তোকে কী বলব?
অনেক বানান আবার বলছে এটাও হয়, ওটাও হয়। কী যে সামঞ্জস্য তা তো বুঝছি না। নিজেই যদি না বুঝি, তাহলে শেখাব কী? তার উপর রাস্তাঘাটে ভাষার যা ছিরি হয়েছে। ট্রেনে বাসে দেখলাম বাচ্চা বুড়ো কেউ মানছে না। ছোট ছোট ছেলেরা সব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নোংরা ভাষায় কথা বলে। সবাই শুনছে, কিন্তু না শোনার ভান করছে। ইস্কুল, কলেজের ছেলেমেয়েরা তো আবার এমন ভাষায় কথা বলছে… অনেক কথা বুঝতেই পারলাম না। সে না ইংরিজি, না হিন্দি, না বাংলা। ভাষা কি এভাবে বাঁচবে? কী জানি…”

আমি ঠিক কীভাবে বোঝাব চট করে ভেবে পেলাম না, বাবা হেসে বলল “তুই আমার থিকা মোটে এক বচ্ছর পরে রিটায়ার করছস, এত বুড়া হইয়া গেলি কী কইরা? তর তো দেহি কিছুই মনে ধরে না।”
কাকা বেশ রেগেই বললেন “কী করে ধরবে? কেউ কিচ্ছু পড়ে না, কিচ্ছু জানে না, আবার বললে গোঁসা করে।”

“খাইছে। তুই আবার কলকাতায় কাউরে কিছু কইছিলি নাকি?”

“বলতে গেলে অনেককে অনেক কথা বলতে হত। অচেনা লোকের সাথে অত কথা আমার আসে না। মুখ বুজে গেছি, এসছি।”

“যাক, তোর কাণ্ডজ্ঞানটা এহনো পুরা যায় নাই।”

শক্তিকাকা এইভাবে দিব্যি ছিলেন, গোলমাল হয়ে গেল চার বছর আগে পুজোর সময়।

আমাদের পাড়ার পুজোটার সেবার সুবর্ণ জয়ন্তী। বিরাট ঠাকুর হয়েছিল, প্যান্ডেল আইফেল টাওয়ারের আদলে। ষষ্ঠী থেকেই ঠাকুর দেখার লাইন শুরু হচ্ছিল সেই বড় রাস্তায়। এক বাক্যে সব পাড়ার লোকই মেনে নিয়েছিল, এমন পুজো সবুজগ্রামের ইতিহাসে হয়নি। পুজো কমিটিতে না থাকলেও আমরা পাড়ার পুরনো বাসিন্দা, ক্ষমতা অনুযায়ী বেশ ভাল টাকা চাঁদা দিই। অতএব আমাদেরও কিঞ্চিৎ দেমাক হয়েছিল। বাড়ির মেয়েবউ, বাচ্চারা তো সারাদিনই পুজো মণ্ডপে। ব্যাটাছেলেরাও অফিস কাছারিতে যতটা পেরেছে ডুব দিয়েছে, যেদিন পারেনি সেদিন যতক্ষণ পাড়ায় ততক্ষণই ওই চত্বরে। রোজই নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল। পঞ্চমীতে পুজো উদ্বোধন করেছিলেন এক জনপ্রিয় সদ্যপ্রাক্তন ক্রিকেটার। ষষ্ঠীর দিন দুঃস্থদের বস্ত্রবিতরণ, সপ্তমীতে পাড়ার কচিকাঁচাদের সিনেমার গানে নাচের প্রতিযোগিতা, অষ্টমীতে এক গানের রিয়্যালিটি শোয়ে প্রথম হওয়া মেয়ে আর দ্বিতীয় হওয়া ছেলের একসাথে অনুষ্ঠান হল। সবই দারুণ সফল। নবমীর দিন সন্ধেবেলা টালিগঞ্জের এক বাংলাদেশি নায়িকার আসার কথা, গান গাইবেন একজন বিখ্যাত শিল্পী। জোর কদমে আয়োজন চলছে, এমন সময় শক্তিকাকাকে দেখতে পেলাম।

দেখে বেশ ভালই লাগল। ইদানীং দিনের পর দিন দাড়ি কামাতেন না। সেদিন কিন্তু কামানো গাল, পাটভাঙা ধুতি পাঞ্জাবি, পায়ের জুতোজোড়াও চকচক করছিল। বললাম “বাঃ, চমৎকার দেখাচ্ছে! কদিন কোথায় ছিলেন? মহালয়ার দিন বাড়ি এলেন, তারপর থেকে আর দেখতে পাইনি তো?”

“বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। শরীরটা কদিন ভাল নেই। আজ ভাবলাম, যাই একটু ঘুরে আসি। ঘরে বসে থাকলেই আরও শরীর খারাপ করবে,” একগাল হেসে বললেন।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, উৎসবের দিনে ঘরে বসে থাকবেন কেন? ঠাকুর দেখে আমাদের বাড়ি চলে যান। বাবা বাড়িতেই আছে, আড্ডা মারুন গে। সকালেই বলছিল আপনার কথা।”

তারপর আমি বন্ধুদের সাথে গল্পে মেতে গেছি। খানিকক্ষণ পরে দেখি শক্তিকাকা বেশ গলা তুলে পুজো কমিটির একটি ছেলেকে বলছেন “ভাই, তোমাদের কর্তাব্যক্তি কে আছে, একটু ডাকো তো।” ছেলেটি সবুজগ্রামে নতুন তৈরি হওয়া ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর একটায় থাকে, বেশিদিন আসেনি। সে নির্ঘাত কারেকশনবাবুকে চিনত না। তাই পাত্তা না দিয়ে বলল “কেন? কী লাগবে আপনার?” কাকাও বেশ দাপটের সঙ্গে “তোমাকে বলে লাভ নেই। তুমি সিনিয়র কাউকে ডাকো। বলো শক্তি স্যার ডাকছেন” বলে একটা খালি চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। ছেলেটার মুখ বিকৃত করে কেটে পড়া দেখে আমার মনে হল ব্যাপারটা ভাল দিকে এগোচ্ছে না। তাই এগিয়ে গেলাম।

“কী হয়েছে, কাকা? কাকে খুঁজছেন?”

“ও হ্যাঁ, তুই-ই তো আছিস। তুই কি পুজো কমিটির মেম্বার?”

“না, তা নই। তবে আমাদেরই তো চেনাশোনা সবাই। আপনি আমাকে বলুন না কী ব্যাপার?”

কাকা উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে প্যান্ডেলের প্রবেশ পথের উপরের লেখাটা দেখালেন। ভারী ঝলমলে কায়দায় লেখা আছে “দেবী দূর্গার আরাধনায় পশ্চিমপাড়া সর্বজনীন”। কী কাণ্ড! এতদিন ধরে প্যান্ডেল বানানো হয়েছে, বড় বড় করে কথাগুলো লেখা হয়েছে, আমরা সবাই কদিন ধরে দুবেলা দেখছি, অথচ কারোর চোখেই পড়েনি ভুলটা। আমি খুঁজতে লাগলাম আশপাশে পুজো কমিটির মাথাদের কেউ আছে কিনা। কাউকে দেখতে পাওয়ার আগেই সেই ছেলেটি ফিরে এসে অকারণে বিশ্রী সুরে জিজ্ঞেস করল “কী হল? দাদুর প্রবলেমটা কী?” আমি তাকে সরিয়ে দিতাম, হঠাৎ শক্তিকাকা ভীষণ ক্ষেপে ধমকে উঠলেন “প্রবলেম হচ্ছে তোমরা অশিক্ষিত। দুর্গা বানানটা পর্যন্ত জানো না।”

ছেলেটা দ্বিগুণ দাপটে “মুখ সামলে কথা বলবেন বলে দিচ্ছি” বলে এমনভাবে কাকার দিকে তেড়ে গেল, মনে হল গায়ে হাত তুলবে। আমি কাকাকে আড়াল করলাম। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে গেল। কারেকশনবাবুকে প্রায় সকলেই চেনে। ছেলেটাকে সিনিয়ররা বোঝাতে লাগল, এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। সে কিন্তু তড়পে যাচ্ছে “আরে তখন থেকে বকবক করে ভেজা খারাপ করে দিচ্ছে মাইরি। সালা এত বড় পুজো হচ্ছে, পুজো কমিটির লোকেরা ওনার জ্ঞান শোনার জন্যে বসে থাকবে এখানে” ইত্যাদি। কর্তাদের মধ্যে যারা কাকাকে চেনে তারা বোঝাচ্ছে, বড় কাজ করতে গেলে ছোটখাটো ভুল হতেই পারে, এত কাজের মধ্যে বানানের দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি, একটা উ-কার আর ঊ-কার দিয়ে কী-ই বা এসে যায়? কাকা কী বলছেন সেসব আর আমার মাথায় ঢুকছে না তখন, কারণ স্পষ্ট দেখছি ওঁর মুখ চোখ ক্রমশ লাল হচ্ছে, একটু যেন কাঁপছেন। সেদিন বেশ মনোরম আবহাওয়া ছিল, অথচ পরিষ্কার দেখছি কাকার জুলপি বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। শেষে যখন দেখলাম কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, তখন ঠিক করলাম ওঁকে এখান থেকে সরিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। ভাবতে না ভাবতেই কাকা কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে পড়ে গেলেন।

তারপর অ্যাম্বুলেন্স, নার্সিংহোম। নবমীর রাত সেখানেই কাটল, সঙ্গে শক্তিকাকার ছেলে। পাড়ার অনেকেই আমাদের ফোন করে বারবার খবর নিচ্ছিল। দু-একজন তো মাঠে বসে খ্যাতনামা শিল্পীর গান শুনতে শুনতেও খবর নিল। সকলেরই প্রায় এক বক্তব্য— কী দরকার ছিল একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত উত্তেজিত হওয়ার? বয়স হলে নিজের শরীরের খেয়াল তো নিজেকেই রাখতে হয়। কারেকশনবাবুর পাগলামি শেষে মৃত্যুর কারণ হলে খুবই আপশোসের ব্যাপার হবে। কাকার ছেলেও সারারাত বলছিল “আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেছে। এইসব আজেবাজে পাগলামি করে দশ বছর ধরে আমি, মা, বোন— কারোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখেনি। দুনিয়ার কেউ নাকি কিচ্ছু জানে না, উনি সব জানেন। আমি ইঞ্জিনিয়ার, বোন এম. এ পাস। মা-ও তো একটা স্কুলের দিদিমণি ছিল রে বাবা। আমরা নাকি অশিক্ষিত। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তাদের ডেকে ডেকে এইসব বলেছে, জানো? ইনসেন লোক। নইলে কেউ ঠাকুর দেখতে গিয়ে বানান নিয়ে মাথা ঘামায়?”

আপশোসের ব্যাপারটা দশমীর দিন সকালেই হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন “ওনার গত কয়েক দিনের মধ্যে আরও কয়েকটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল, হয়ত টের পাননি। হার্টের অবস্থা একদম ভাল ছিল না।”
নার্সিংহোম থেকে বাড়ি, আবার বাড়ি থেকে শ্মশান— গোটা পথটাই আমি সঙ্গে ছিলাম। কাকার বাড়ির কাউকেই খুব একটা কান্নাকাটি করতে দেখিনি, বরং সকলের চোখে মুখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার ছাপ।
কাকার মেয়ের বিয়েতে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না আমার। বাবা জোর করল। “শক্তি বাইচ্যা থাকলে তো যাবি না কইতে পারতাম না আমরা। এহন ও নাই বইল্যা আরও যাওয়া উচিত। আমরা ওর আপন লোক না?”

এলাহি ব্যবস্থা। সাদা ফুল দিয়ে সাজানো প্যান্ডেল, পেল্লাই গণেশের মূর্তি, ফোয়ারা, যেদিকে তাকাই বর-কনের লাইফ সাইজ প্রি-ওয়েডিং ফটোশুটের দৃশ্য, কনের জরিদার ঘাগরা— সব মিলিয়ে একেবারে হিন্দি সিনেমার বিয়ে। মেনুটা প্যান্ডেলের গায়ে সাঁটা, সম্পূর্ণ রোমান হরফে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “ইংরিজিতে মেনু কেন রে বাবা? কোন সাহেব-মেম খেতে এসেছে টুম্পার বিয়েতে?” বাবা পাশ থেকে বলল “ভালই হইছে। কনীনিকার ই-কার, ঈ-কার গুলায়া ফ্যালবার ঝামেলা নাই। কোন ন লিখব সেই নিয়াও চিন্তা নাই। বাপের ভূত বাসর ঘর লণ্ডভণ্ড কইরা দিলে কি ভাল অইত?

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *