স্বপন চক্রবর্তী : একটি স্মৃতিকথা – স্বাতী মৈত্র
অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তীর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ হয়েছে বার কয়েক মাত্র।
জাতীয় গ্রন্থাগারে আমি তখন নিয়মিত। স্বপন চক্রবর্তী ডাইরেক্টর। খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজতে খুঁজতেই
কখনও-সখনও আলাপ আলোচনা। “বেঙ্গল ম্যাগাজিন? বেশ বেশ, দেখো”, এই জাতীয় উৎসাহ-দান। তখনও
জানতাম না এর আরও কিছুদিন পর তাঁর কিছু কাজ আমাকে গবেষণার এক নতুন দিশা দেখাবে। জানলে হয়তো আরেকটু ভালো করে আলাপ করে রাখতাম!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আর্লি মডার্ন যুগের (সাধারণ পাঠক হয়তো এই যুগকে রেনেসাঁ অথবা শেক্সপিয়ারের যুগ বললে চিনতে পারবেন) সাহিত্যচর্চা নিয়ে নতুন কিছু বলবার নেই—তাঁদের উল্লেখযোগ্য লেখার লিস্টটা খুলে বসলেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। স্বপন চক্রবর্তীর Society and Politics in the Plays of Thomas Middleton ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের Collected Works of Thomas Middleton গ্রন্থের কন্ট্রিবিউটিং এডিটরও ছিলেন। ইংরেজির মতন বাংলা লেখাতেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন এবং বাঙালির ইংরেজি সাহিত্যচর্চার (২০০৬) মতন গ্রন্থ তাঁর কলম দিয়ে বেরিয়েছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা কেন্দ্রের নাম দা স্কুল অফ কালচারাল
টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস। মুদ্রণ ও গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা ও হাতেকলমে কাজ, ডিজিটাল হিউম্যানিটিজের মতন নতুন
পথে চলা, এ সমস্ত কিছুই এই গবেষণা কেন্দ্রে হয়ে থাকে। ২০০৯ সালে ‘প্রিন্টিং অ্যান্ড বুক প্রডাকশন ইন বেঙ্গল’
নামে একটি অসামান্য একজিবিশন করেছিলেন তাঁরা। এ ছাড়াও নিয়মিত আলোচনা সভা, প্রকাশনা, তো আছেই। ভারতবর্ষে বুক হিস্ট্রির মতন স্বল্পচর্চিত বিষয়ে এক কথায় দিগদর্শক বলা যায় এই গবেষণা কেন্দ্রটিকে। এবং এইখানেই আবার স্বপন চক্রবর্তীর কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা ভাষায় মুদ্রণ ও গ্রন্থচর্চার ধারা বেশ বলিষ্ঠ একটি ধারা। সুকুমার সেন থেকে নিখিল সরকার, বিনয় মজুমদার, অথবা গৌতম ভদ্র থেকে শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনতাসির মামুন থেকে বরুণ চক্রবর্তী—ছাপাখানা সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা হয়েছে অনেকরকম। স্বপন চক্রবর্তী সম্পাদিত মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষায় বরং তুলনামূলক ভাবে এই প্রসঙ্গে চর্চা অনেক কম, যদিও হালে অনিন্দিতা ঘোষ, তাপ্তি রায়, ফ্রান্সেস্কা অর্সিনি, উলরিকে স্টার্কদের মতন গবেষকদের কাজ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। অভিজিৎ গুপ্তর সাথে সম্পাদিত চারটি বইয়ের সিরিজে তাঁরা এই সমস্যার কথাই তুলে ধরেন। বিএস কেশবনের History of Printing and Publishing in India-র মতন অমূল্য গ্রন্থও যে শেষমেশ সাহিত্য আলোচনার গতেবাঁধা পথে এগিয়ে যায়, সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করে চক্রবর্তী ও গুপ্তর সম্পাদিত চারটি গ্রন্থ ভারতবর্ষে মুদ্রণ ও গ্রন্থচর্চার নতুন দিক খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে।
স্বপন চক্রবর্তীর মৃত্যুর সাথে সাথে ভারতবর্ষে মুদ্রণ ও গ্রন্থচর্চার ক্ষেত্র একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরকে হারাল।