সুপুরিবনের সারিতে – অমিতাভ গুপ্ত

সুপুরিবনের সারিতে – অমিতাভ গুপ্ত

শেয়ার করুন

অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট মানুষের মতো শঙ্খ ঘোষের সঙ্গেও প্রথম দেখা হয়েছিল মিছিলে। দেখা হয়েছিল, এইমাত্র। কোনো কথা হয়নি। বর্তমান প্রতিবেদক তখন নিতান্তই কলেজের অর্বাচীন ছাত্র আর তিনি ইতিমধ্যেই সুখ্যাত, সুপরিচিত। ১৯৬৬ সন। খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ছাত্র বিক্ষোভে, শ্রমিক-কৃষকের বিক্ষোভে মিলিত ধ্বনি উঠেছে “গ্ৰামনগরে ডাক পাঠাই/জোট বাঁধো তৈরি হও”। সেই ক্ষুব্ধ মিছিলে সমবেত হয়েছিলেন অনেক বিশিষ্ট শিল্পব্যক্তিত্ব—কেয়া চক্রবর্তী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, তরুণ সান্যাল এবং আরও অনেকেই নিশ্চয়। এই বিক্ষোভের পরিণতিতে পরের বছর পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছিল প্রথম অ-কংগ্ৰেসী সরকার।

দ্বিতীয়বার শঙ্খ ঘোষকে দেখি ম্যাক্সমুলার ভবনে একটি কবিতা পাঠের সভায় যেখানে জার্মান ভাষায় অনূদিত বাংলা কবিতার লেখকদের মধ্যে কনিষ্ঠ এই প্রতিবেদক, প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ অন্যান্যরা, মধ্যবর্তী শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও কয়েকজন। সেদিন অন্যান্যরা যখন পানাহারে ব্যস্ত তখন শঙ্খবাবুর সঙ্গে একটু বিশদ পরিচয় করার সুযোগ হয়েছিল। পরিচয় বিশদতর হল আশির দশকের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পাদনা-সহায়ক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে। শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় ছিলেন মূল কর্মাধ্যক্ষ, শঙ্খ ঘোষ তাঁর বিশেষ বন্ধু এবং সকলেরই সুবিদিত যে শঙ্খবাবু ততদিনে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। এবার তাঁর পাণ্ডিত্যের বিভিন্ন দিক আমার কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে লাগল—পাণ্ডিত্যের বহুমাত্রিকতার মধ্যে দুটি আকর্ষক মাত্রা অবশ্যই ছিল নিখুঁত তথ্যনিষ্ঠা এবং কঠোর পরিশ্রম।

তাঁর বাড়িতে গিয়েছি বার-তিনেক। একবার গিয়েছিলাম, আমার কাছে ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকার ১৯১০ সনের সম্পূর্ণ সেটটি রয়েছে জেনে তিনি সেটি দেখতে চেয়েছিলেন। দিয়ে এসেছিলাম। কিছুদিন বাদে, সকালবেলা, বাজার থেকে কৃষবাপুষ্ট সবজি ইত্যাদির থলে নিয়ে বাড়ি ফিরে চমকে উঠে দেখি শঙ্খবাবু বসে আছেন। তিনি নিজেই বিদ্যাসাগর আবাসন থেকে যোধপুর পার্কে চলে এসেছেন ‘সুপ্রভাত’ আমাকে ফিরিয়ে দিতে। এর পরে যে অজস্রবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে তা কিন্তু নয়। আমার কন্যার বিবাহে ২০০৬ সালে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম, সেটি ছিল কোনো এক রবিবারের সকালবেলা। বিদ্যাসাগর আবাসনে উপস্থিত হয়ে দেখি অতিরিক্ত কোনো প্রবেশাধিকার নেই এবং আমার ঝুলিতেও নেই অতগুলি আমন্ত্রণপত্র। শঙ্খবাবুকে অনুরোধ করে অপেক্ষা করি ঘণ্টা তিনেক, অবশেষে তাঁকে বিষয়টি নিবেদন করি। খুশি হয়েছিলেন তিনি, এসেছিলেন সস্ত্রীক, কন্যা-জামাতার সঙ্গে তাঁদের ফোটোগ্রাফ মনে হয় সীমন্তিনীর একটি মূল্যবান সংগ্ৰহ।

ইতিমধ্যে কয়েকটি ছোটোবড়ো ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল। ১৯৭৩ সন থেকেই বর্তমান প্রতিবেদক অবক্ষয়ী আধুনিকতার ও পোস্টমর্ডানিজমের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। ১৯৭৩ সনে প্রকাশিত ‘তরুণ কবির সংকট’ প্রবন্ধে মর্ডানিজমের ও পোস্টমর্ডানিজমের যে ভয়াবহ ইউরোকেন্দ্রিকতা, দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি ধৃষ্ট অবমাননা এবং সৃজনমূলক সমালোচনার প্রতি অবজ্ঞার বিরুদ্ধে কিছু মুক্তি এবং পঞ্চাশের দশকের কয়েকজন লেখকের প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমান প্রতিবেদকের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের পরিপূরক মর্ডানিজম এবং পোস্টমর্ডানিজমের সঙ্গে সংগ্ৰাম এখনও আমাদের শিথিল হয়নি। এ সম্পর্কে কোনোকিছু না জেনেই বা জানবার কোনো আগ্ৰহপোষণ না করেই ‘উত্তর আধুনিকতা’ শব্দবন্ধের অপপ্রয়োগ করে থাকেন একালের বাঙালি কথাসাহিত্যিকরা এবং কবিরা।

তাঁদের মতো নেম-ড্রপিং বা টার্ম-ড্রপিং করার স্বভাব ছিল না শঙ্খ ঘোষের। তাঁর শেষের দিকের প্রবন্ধনিচয় পাঠ করলে বোঝা যায় বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অনুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। ইতিমধ্যে বর্তমান প্রতিবেদক শঙ্খ ঘোষের কবিকৃতির সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করে কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনে দিয়েছিলেন, তাঁদেরই নির্দেশে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ‘দিনগুলি রাতগুলি’-র ওপরে আলোচনাটির পরে বাকি অংশ প্রকাশের সুযোগ পত্রিকাটির হয়নি যেহেতু পত্রিকাটিই অন্তর্হিত হয়ে গেল। বলা বাহুল্য মাত্র আমার কাছে লেখাটির কোনো কপি নেই। তবে শঙ্খবাবুর কৃতির ওপরে বিশেষত তাঁর ‘কবিতার মুহূর্ত’ গ্ৰন্থটির উপরে একটি সুদীর্ঘ আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম “মোমেন্টস ইন ইনফিনিটি” (বি. এন. পাবলিকেশন,১৯৯১) গ্ৰন্থে। এই গ্ৰন্থটিতে আমার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এই ধারণাটি প্রতিভাত করা যে অসীমতায় বাংলা কবিতা যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বারবার সেখানে শঙ্খ ঘোষের কবিকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ—গুরুত্বের তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাপমোচন’ সহ আরও বেশ কয়েকটি পাঠের বিশ্লেষণ রয়েছে। ২০০১ সনে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে একটি বক্তব্য রাখবার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে “এসথেটিক্স অফ ইনফিনিটি” শিরোনামে একই বিষয়ের অবতারণা করার চেষ্টা করেছিলাম। অবশেষে ২০০৪ সনে চর্যাপদ থেকে বিশ শতকের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বাঙালি কবিদের ইংরেজি অনুবাদের একটি সংকলন প্রকাশ করা সম্ভব হল, নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে নিজের উদ্যোগে। অতএব সমস্ত নিয়মকানুন অগ্ৰাহ্য করে বইটি শুরু হল শঙ্খ ঘোষের ‘নিহিত পাতালছায়া’ কাব্যগ্ৰন্থের অন্তর্গত ‘সুন্দর’ কবিতাটি দিয়ে,

“তুমি কি সুন্দর নও? আজও কেন আছো পৃথিবীতে?”

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২