বুনো রামনাথ : বিস্মৃতির অন্তরালে এক আদর্শ শিক্ষকের জীবনকথা – দীপক সাহা
একসময় ভাগীরথী–জলাঙ্গীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত নবদ্বীপের জ্ঞানচর্চার কথাও ভূ-ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে স্মৃতি, জ্যোতিষ, তন্ত্রশাস্ত্র, বেদ, ব্যাকরণ, পুরাণবিদ্যা, ধর্ম, সংস্কৃতিচর্চার বিস্ময়কর প্রসার ঘটেছিল। চৈতন্যোত্তর নবদ্বীপ, তক্ষশীলা, কাশী, মিথিলা, মথুরা ও বৃন্দাবনের সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের শ্রীপাট হিসেবে সম্মান-শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছে। তাই শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, বিদ্যা, ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুশীলনে নবদ্বীপের ভূমিকাটি একটি মহাসঙ্গমের। নবদ্বীপের সেই খ্যাতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ ছিলেন এক অতি দরিদ্র বাঙালি পণ্ডিত। যাঁর কাছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্রেরা পড়তে আসতেন। তিনি পাঠদানের মধ্যে দিয়েই সমাজের জন্য সুনাগরিক তৈরি করতেন। সে ছিল এক গৌরবের কথা। কালের অন্তরালে গঙ্গার জলে অস্তমিত সেই গৌরব। দুঃখের কথা, তাঁর জীবনের পূর্বাপর কাহিনী তেমন বিশদভাবে জানা যায় না। লোকশ্রুতিই ভরসা।
আমরা রাজা রামমোহন রায়ের প্রবল ব্যক্তিত্বের কথা শুনেছি। জেনেছি বিদ্যাসাগরের অদম্য জেদের কথা। কিন্তু এই আশ্চর্য বাঙালি চরিত্রের কথা আম বাঙালির কাছে বিস্মৃতপ্রায়। খুবই পরিতাপের বিষয়, তাঁর প্রামাণিক জীবনী নেই। তাঁর না আছে জন্মতারিখ, না আছে তিরোধান দিবস। যদিও তাঁর সমকালীন পণ্ডিতদের যথেষ্ট পরিচয়সমৃদ্ধ একাধিক পুঁথি পাওয়া যায়। শিক্ষক দিবসের সন্ধিক্ষণে সেই বিস্মিত প্রতিভার প্রতি আজ আমাদের স্মৃতিতর্পণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আজ তাঁর জীবনকথা।
নাম রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত। বুনো রামনাথ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। জন্মেছিলেন নবদ্বীপে আজ থেকে ২৫০ বছর আগে। জন্মসাল আনুমানিক ১৭৭০। ইতিহাসের বিচিত্র খেয়ালে, একই সময় দুইজন রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত বাস করতেন নবদ্বীপে। একজন নৈয়ায়িক আর অন্যজন স্মার্ত। যিনি স্মার্ত, তাঁকেই বলা হত বুনো রামনাথ। আর অন্য জনকে গেঁয়ো রামনাথ। বুনো রামনাথের পিতা অভয়রাম তর্কভূষণ খুবই সাধারণ মানুষ ছিলেন। শুধুমাত্র বিঘা দুয়েক জমি ছাড়া আর কোনও সম্বলই ছিল না মানুষটার। দুই পুত্র ওনার , রামনাথ ও চন্দ্রনাথ।
রামনাথ নাকি জগৎ ভুলে জ্ঞানান্বেষণে বিভোর হয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। তাই তাঁর নাম বুনো রামনাথ। বর্তমান অনেক গবেষকদের অবশ্য ভিন্ন মত। বর্তমান অনুসন্ধান বলছে যে রামনাথের জন্মভিটা ছিল নবদ্বীপের ধাত্রীগ্রামের কাছে সহজপুর গ্রামে। সহজপুরে, ওনার বাড়ির পাশে “বুনো” নামে একটি বৃহৎ পুকুর ছিল। রামনাথ স্বয়ং পুকুরটির নাম অনুযায়ী নিজেকে ‘বুনো রামনাথ’ বলে পরিচয় দিতেন। বনের প্রান্তে বাস করার জন্য তাঁর নাম বুনো রামনাথ হয়নি। আজও সহজপুরে ‘বুনো’ নামক পুকুরটি খুবই অবহেলায় আছে। কেউ সংস্কার করেনি। সহজপুর গ্রামে বুনো রামনাথের বংশধররা আছেন। স্মৃতি, আবেগ ও ঐতিহ্যবাহী বুনো রামনাথের জন্মভিটাও সরকার ও সাধারণ মানুষের উদাসীনতার শিকার।
কান্তি চন্দ্র রাঢ়ি মহাশয়ের ‘নবদ্বীপ মহিমা’ পুস্তক থেকে জানা যায় যে দরিদ্র পিতা রামনাথকে ভর্তি করে দিলেন সেই সময়ের নবদ্বীপের বিখ্যাত নৈয়ায়িক রামনারায়ণ তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠী গুরুকুলে। ‘চতুঃ’ শব্দটি চারি বেদের দ্যোতক। অর্থাৎ যে শিক্ষায়তনে চতুর্বেদের চর্চা হয়। সে আমলে সমস্ত শাস্ত্রের অধ্যাপনা ও পঠনপাঠনের আধার ছিল চতুষ্পাঠী বা টোল। ছাত্র বা শিষ্যরা গুরুগৃহে বাস করে পাঠ গ্রহণ করত। অনেকটা এখনকার আবাসিক বিদ্যালয়ের মতো। গুরুপত্নী তাদের জন্য রান্নাবান্না করতেন। কিছু অবস্থাসম্পন্ন গুরু শিষ্যদের কাছ থেকে সম্মানদক্ষিণা বা ‘সিধা’ নিতেন না। উদ্দেশ্য, বিদ্যাদান করে পুণ্য সঞ্চয় করা। তবে বেশিরভাগ গুরু ছাত্রদের কাছ থেকে সম্মানদক্ষিণা গ্রহণ করতেন। অনেক সময় রাজা বা ভূস্বামীরা চতুষ্পাঠীর ব্যয়ভার বহন করতেন। যেমন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মহাপণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশের বিশালাকার চতুষ্পাঠীর সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন।
মেধাবী রামনাথ গুরুর খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। টোলের শেষ পরীক্ষায় উজ্জ্বল কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে রামনাথ গুরুকুল থেকে ‘তর্কসিদ্ধান্ত’ উপাধি লাভ করেন। পাঠপর্ব শেষে বিদায়লগ্নে গুরুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে গুরু রামনারায়ণ তর্ক পঞ্চানন রামনাথের মাথায় হাত দিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন—জ্ঞান ও সত্যনিষ্ঠায় তুমি মা সরস্বতীর আশীর্বাদ লাভ করবে এবং বিদ্যোৎসাহী রাজার অনুগ্রহে তুমি লক্ষ্মীর আশীর্বাদধন্য হবে। কিন্তু গুরুর ভবিষ্যৎবাণীর দ্বিতীয় অংশকে সার্থক করতে শিষ্যের কোনো প্রচেষ্টাই ছিল না।
ছাত্র অবস্থাতেই পিতা অভয়রাম কিশোর রামনাথের অনিচ্ছায় তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন এক বালিকার সাথে। পাঠগ্রহণ শেষে আর্থিক অসচ্ছলতাকে সঙ্গী করে এবার সাংসারিক ও কর্মজীবনে রামনাথের প্রবেশ। সে আমলে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল—যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুগ্রহ লাভ করেনি তাঁর ব্রাহ্মণত্ব পরিপূর্ণ নয়। কিন্তু নিয়মের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন—রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত যিনি বুনো রামনাথ নামেই বেশি পরিচিত। গতানুগতিক স্রোতে বুনো রামনাথ গা ভাসিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করেননি।
রামনাথ নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার ধারাটাই বদলে দিয়েছিলেন নিজের জ্ঞানের গৌরব দিয়ে। সেকালে নিয়ম ছিল পড়াশোনা শেষে নদীয়ারাজের দরবারে গিয়ে নিজের বিদ্যার পরিচয় দিয়ে নিষ্কর জমিসহ প্রভূত অর্থ সাহায্য পাওয়া। তা দিয়ে টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু করা। রাজকোষ থেকে নিয়মিত আর্থিক অনুদান পেতেন তাঁরা। কিন্তু চতুষ্পাঠী খুলতে তিনি রাজার অনুগ্রহ লাভ করেননি। বুনো রামনাথ রাজার দরজায় গিয়ে সাহায্য ভিক্ষা করলেন না। তিনি বিদ্যাকে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যবহার করতে চাননি। রামনাথ মনে করতেন বিদ্যাই সব থেকে বড়ো ধন। নবদ্বীপের শোভাযাত্রা ও সংকীর্তনের কোলাহলময় পরিবেশে সারস্বত আরাধনায় বিঘ্ন হওয়ায় রামনাথ সস্ত্রীক জঙ্গলে কুটির স্থাপন করলেন। জলাঙ্গীর ধারে কোলাহলহীন প্রকৃতির নিবিড় কোলে শিষ্যদের সহযোগিতায় বাঁশ, দড়ি, খড় ও মাটি দিয়ে পর্ণকুটির তৈরি করে টোল স্থাপন করে নব্যন্যায়ের চর্চা শুরু করলেন। সেখানেই তিনি তপোবনের আদলে বসবাস এবং অধ্যাপনা করতেন। তখন থেকেই তাঁর নাম হয় বুনো রামনাথ।
বিদ্যাচর্চা ছাড়া রামনাথের অন্য ধ্যানজ্ঞান ছিল না। সেকালে শিক্ষকরাই ছাত্রদের খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করত। কিন্তু রামনাথের সে সাধ্য ছিল না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত গরিব। তাঁর নিজেরই দু’বেলা খাবার জোটে না, তিনি ছাত্রদের ব্যয় বহন করবেন কী করে? কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য ও অধ্যাপনা নৈপুণ্যের গুণে দিনে দিনে টোলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তেই লাগল। রামনাথ অসহায় ভাবে ছাত্রদের জানালেন, “আমি নিতান্ত দরিদ্র। তোমাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করার সামর্থ্য আমার নেই।” উত্তরে শিক্ষার্থীরা তাঁকে বলেছিলেন, “গুরুদেব আমরা বিদ্যার্থী হয়ে এসেছি, আহারার্থী হয়ে নয়। আমাদের ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করব। আপনি শুধু আমাদের পাঠদান করুন।” তারপর থেকেই নবদ্বীপের টোল পরিচালন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। পণ্ডিতমশাইদের আর ছাত্রদের ভরণ-পোষণের ভার নিতে হত না। রামনাথের সংসারে স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিল না। ছাত্ররা শিক্ষকের কাছে কোনওরকমে থাকলেও, খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিত।
প্রকৃতি মাতার শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশে দিনরাত পঠনপাঠন ও ন্যায়শাস্ত্র চর্চায় মগ্ন থাকেন রামনাথ। এদিকে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসার কীভাবে চলবে সেদিকে তাঁর বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিল না। আবার অন্যের সাহায্যও তিনি নিতেন না। খ্যাতিমান এই পণ্ডিতের স্ত্রীও ছিলেন খুবই সাদামাঠা। অন্তরে স্বামীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা, ভক্তি। দারিদ্র্য দুর্দশায় তাঁদের সংসারে অবশ্য শান্তি বিঘ্নিত হয়নি। রামনাথ সম্পর্কে একটি কাহিনি লোকমুখে বহু প্রচলিত। এই সেই কাহিনি।
তখন তিনি খ্যাতির মধ্য গগনে। দিনরাত নিমগ্ন নব্যন্যায়ের জটিল প্রশ্নোত্তরে। একদিন সকালে টোলে যাচ্ছেন রামনাথ। এদিকে ঘরে খাবার বাড়ন্ত। তাঁর স্ত্রী জানতে চাইলেন আজ তো ঘরে কিছুই নেই। কী রান্না হবে। পণ্ডিতমশাই সাংসারিক বিষয়ে উদাসীন। কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি নির্বিকার ভাবে উঠোনের তেঁতুলগাছটা দেখতে দেখতে কুটির থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর মধ্যাহ্নে যথারীতি টোলে পাঠদান শেষে কুটিরে ফিরলেন রামনাথ। ভারতবিখ্যাত নৈয়ায়িকের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে সেদিন ব্রাহ্মণী পরিবেশন করলেন এক আশ্চর্য পদ। মোটা চালের ভাতের সঙ্গে তেঁতুলপাতার ঝোল। পরমতৃপ্তিভরে তাই খেয়ে গৃহিণীকে প্রশ্ন করলেন, “এই অপূর্ব আহার্য তুমি কী দিয়ে প্রস্তুত করলে?” ব্রাহ্মণী তো অবাক। তিনি খুশিঝরা গলায় বলে উঠলেন, “কেন নাথ, উঠোনের ওই তেঁতুলগাছের দিকে তাকিয়ে আপনিই তো সকালবেলায় বলে গেলেন।” শুনে শিশুর মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন রামনাথ। দাওয়া থেকে উঠোনে নেমে তেঁতুলগাছের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ব্রাহ্মণী আমাদের আর চিন্তা নেই। গাছের তেঁতুলপাতা তো আর ফুরিয়ে যাবে না। এ বার আমি নিশ্চিন্ত মনে ন্যায়চর্চা করতে পারব।”
রামনাথের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অদ্ভুত। সে আমলে গুরুগৃহে বিভিন্ন আকারের বেত থাকত। বেত্রাঘাত তখন শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান আবশ্যিক অঙ্গ ছিল। কিন্তু বুনো রামনাথ ছাত্রদের কখনও শারীরিক শাস্তি দিতেন না। তাঁর শাস্তির বিধানও ছিল অদ্ভুত। তাঁর শাস্তিদানের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। যে ছাত্রটি শাস্তি পেয়েছিলেন, তিনি গোবিন্দ চন্দ্র (পরবর্তী কালে তিনি ন্যায়তীর্থ উপাধি পান)। শিক্ষক ছিলেন বুনো রামনাথ। একবার চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে নদীয়ারাজের প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণনগরের বারো দোল উৎসব উপলক্ষে তিনি ছাত্রদের পর পর তিন দিনের ছুটি দেন এবং সেই সঙ্গে বাড়িতে পড়ার জন্য কিছু পাঠও দেন। মেলায় আনন্দ করতে গিয়ে তাঁর ছাত্র গোবিন্দ চন্দ্রের আর বাড়ির পাঠ করা হয়ে ওঠেনি। যথারীতি ছুটির পর টোল খুললে গুরু পড়া ধরলে গোবিন্দ পড়া বলতে পারল না, কোনও উপযুক্ত কারণও দেখাতে পারল না। পড়ায় অবহেলা করার জন্য গুরু ছাত্রের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। রামনাথ গৃহিণীকে ডেকে বললেন, গোবিন্দর পড়া না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে অভুক্ত থাকবেন। স্বামী অভুক্ত থাকলে স্ত্রী খান কী ভাবে? সুতরাং গৃহিণীও উপবাস করবেন বলে জানালেন। বাকি ছাত্ররাও একই পথের পথিক হল। এই সমস্ত ঘটনা দেখে গোবিন্দ অনুতাপে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। সে ছুটতে ছুটতে বাড়ি গিয়ে না খেয়েদেয়ে সন্ধের মধ্যে তিন দিনের পড়া তৈরি করে ফেলল। গুরুর কাছে পড়া বলতে পারার পর সকলের খাওয়ার ব্যবস্থা হল।
কিন্তু ভৈরব মজুমদারের শাস্তিটি ছিল বড়োই নির্মম। গুরু তাকে চুরি করার অপরাধে টোল থেকে জীবনের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ সন্তান! গুরুগৃহে চুরি। পাঠ অবহেলায় তবুও ক্ষমা করা যায়, কিন্তু চুরির মতো গর্হিত অপরাধের ক্ষমা নেই। কিন্তু শিষ্য ভৈরব নিজের জন্য চুরি করেনি। তাহলে? ভৈরব ধনী পিতার সন্তান ছিলেন। দুধ-ঘি-ননী তার পাতে নিত্যবরাদ্দ। কিন্তু সহপাঠীদের বেগুনপোড়া বা শাকান্ন গ্রহণ করতে দেখে তার কোমল মন কেঁদে উঠত। গুরু ও গুরুপত্নীও প্রায় দিনই অর্ধাহারে থাকতেন। তাই বাড়ি থেকে চাল ও অন্যান্য সবজি সকলের অলক্ষ্যে নিয়ে এসে রান্নাঘরে চুপিচুপি রেখে দিত। কোন একদিন ভৈরবের এই কুকর্ম কীভাবে গুরুর কানে পৌঁছে যায়। আর যায় কোথায়! ভয়ংকর রেগে গেলেন গুরু। প্রচণ্ড তিরস্কার করে ভৈরবকে চিরদিনের জন্য চতুষ্পাঠী থেকে বিদায় করে দিলেন। অন্য চতুষ্পাঠীতেও তার স্থান হল না। তবে একলব্যের মতো গুরুর বাতিল খড়মযুগলকে সাক্ষী রেখে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। অপুত্রক গুরুপত্নী সেটি উপহার দিয়েছিলেন ক্রন্দনরত ভৈরবকে। শোনা যায় ভাগবৎ তাঁর ঠোটস্থ ছিল। তবে উপাধি লাভ না করলেও পরবর্তীতে নিজগুণে ও বুদ্ধিতে লব্ধপ্রতিষ্ঠ ভূস্বামী হয়েছিলেন ভৈরব মজুমদার।
আর এক ব্যতিক্রমী কাহিনি। রামনাথের জ্ঞানগৌরবের অঙ্গ ছিলেন তাঁর স্ত্রী। একবার নবদ্বীপের গঙ্গায় স্নান করতে এসেছেন নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজমহিষী। দাসী পরিবৃত হয়ে ঘাট জুড়ে নিশ্চিন্তে স্নান করছেন রানি। এমন সময় দ্রুত পায়ে নদী থেকে উঠে এলেন এক ব্রাহ্মণ রমণী। তাঁর ভিজে কাপড় থেকে জলের ছিটে লাগল রানির গায়ে। কিন্তু তরতরিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকা রমণীর সে দিকে ভ্রূক্ষেপও নেই। জীর্ণ ‘ঠেটি’-পড়া বামনীর এমন স্পর্ধা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রানি। ছিন্ন বস্ত্র, অলংকার দূরে থাক হাতে শাঁখা-পলা পর্যন্ত নেই। এয়োতির চিহ্ন বলতে কবজিতে জড়ানো লাল রঙের সুতো। ঘা লাগল রাজকীয় অহংকারে। কঠিন মুখে মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন, “ভারী তো দু’গাছা লাল সুতো। তার আবার এত দেমাক। ওই সুতো ছিঁড়তে কতক্ষণ?” কথা শেষ হতেই ঘুরে দাঁড়ালেন রমণী। রানির চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বললেন, “এই লাল সুতো যে দিন ছিঁড়ে যাবে, সে দিন নবদ্বীপ অন্ধকার হয়ে যাবে।”
নবদ্বীপ তথা বাংলার গর্ব বুনো রামনাথের স্ত্রীর মুখে এ কথা মানাত।
রানিমা কৃষ্ণনগরে ফিরে গিয়ে তাঁর অপমানের সমস্ত বৃত্তান্ত মহারাজের কাছে নালিশ করলেন। মহারাজ তখন গোপনে লোক মারফত ওই স্ত্রীলোক ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে বিশদে খোঁজখবর নিলেন। খোঁজ নিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হলেন, তাঁর রাজ্যে এ রকম একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত অতি কষ্টে জঙ্গলে চতুষ্পাঠী নির্মাণ করে বিদ্যাদান করছেন। অথচ তিনি এই ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। মহারাজার কানে গেল রামনাথের অর্থাভাবের কথা। লোকমুখে শুনলেন রামনাথের অদ্ভুত নিষ্ঠা ও পাণ্ডিত্যের কথা। লোক মারফত সাহায্যের প্রস্তাব পাঠিয়ে ব্যর্থ হওয়ায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বড়ো রাজপুত্র শিবকৃষ্ণকে প্রেরণ করলেন বুনো রামনাথকে সাহায্য করতে। তিনিও বিফল মনোরথে ফিরে আসলেন। রাজপুত্র শিবকৃষ্ণের সাহায্য তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। পার্থিব সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতি তাঁর ছিল প্রবল অনীহা। নির্লোভ, নির্লিপ্ত জীবনযাপন করতেন। সাংসারিক কোনো মোহ তাঁকে আবিষ্ট করতে পারেনি। ছিলেন নির্মোহ।
অবশেষে একদিন মহারাজা নিজেই এসে উপস্থিত হলেন রামনাথের পর্ণ কুটিরে। তাঁর সুপ্ত ইচ্ছা ছিল, জ্ঞানী এই পণ্ডিতকে কিছু সাহায্য করা। দেখলেন গভীর অধ্যয়নে নিমগ্ন রামনাথ। ওনাকে বিরক্ত না করে, নিশ্চুপে রাজা বসলেন এক পাশে। কেটে গেল বেশ কিছু মুহূর্ত। পড়ন্ত বিকেলে একমনে প্রায় বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পাতার পর পাতা একাগ্রচিত্তে পালটে চলেছেন একজন মানুষ, আর শান্তভাবে সেই দিকে চেয়ে আছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন রামনাথের ভ্রূক্ষেপ নেই কোনোদিকে। যখন সম্বিৎ ফিরল আর বুঝতে পারলেন যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং এসেছেন, তখন তাঁকে খাতির করে বসালেন এবং কুশল জিজ্ঞাসা করলেন।
রাজা এই মহাপণ্ডিতকে সরাসরি অর্থাভাবের কথা না বলে প্রারম্ভিক আলাপের পর বললেন, “আপনার কী কোনও অনুপপত্তি আছে?” অনুপপত্তি কথাটির অর্থ অভাব বা অসুবিধা। পণ্ডিত রামনাথ ভাবলেন, মহারাজ বুঝি জানতে চাইছেন, ন্যায়শাস্ত্রের কোনও জটিল প্রশ্নের সমাধানে তাঁর কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না? রামনাথ বললেন, “মহারাজ, মিথিলার মহাপণ্ডিত গঙ্গেশ উপাধ্যায় এই চিন্তামণি শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। এটি ন্যায়শাস্ত্রের একটি আকর বা প্রধান গ্রন্থ। এর যথোচিত ব্যাখ্যা, টীকা-টিপ্পনী পণ্ডিত সমাজে ন্যায়শাস্ত্রের আলোচনায় পাণ্ডিত্যের মাপকাঠি হিসাবে গণ্য হত। আমি সেই চার খণ্ড চিন্তামণি শাস্ত্রের উৎপত্তি করেছি। আমার তো কোনও অনুপপত্তি নেই।”
কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, “না, আমি ঐ অনুপপত্তির কথা বলিনি। আপনার কোনও অভাব বা প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইছি। যদি আমি আপনার কোনও কাজে লাগতে পারি।” রামনাথ বললেন, “না, আমার তো কিছু প্রয়োজন আছে বলে মনে পড়ছে না। তবে গিন্নির কিছু দরকার আছে কিনা জিজ্ঞেস করছি।” গিন্নিকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনিও বললেন, “না, কিছুই দরকার নেই।” কর্তা-গিন্নি দুজনেই ছিলেন নির্লোভ , সামান্য জিনিসেই চলে যেত। রাজা দান দিতে চাইলেও তাঁরা কিছু নিলেন না।
রামনাথের পাণ্ডিত্যের ব্যাপারে প্রচলিত একটি কাহিনির উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কলকাতায় মহারাজ নবকৃষ্ণের সভায় এক দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত এসেছেন। একে একে সেই পণ্ডিতদের কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন নবদ্বীপের প্রধান নৈয়ায়িক শিবনাথ বিদ্যাবাচস্পতি এবং বাঁশবেড়িয়ার দাপুটে পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। বাংলার মান যায় যায়। উপায়ান্তর না দেখে বাংলার মান রক্ষার্থে মহারাজ তড়িৎ দূত মারফত খবর পাঠালেন বুনো রামনাথের কাছে। রামনাথ পাণ্ডিত্যের ঢক্কানিনাদ একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু নিজভূমির মান রক্ষায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি রাজসভায় উপস্থিত হলেন। তুমুল তর্কবিতর্কের পর তাঁর পরাক্রমী পাণ্ডিত্যের কাছে হার মানলেন সেই দিগ্বিজয়ী অহংকারী পণ্ডিত। নবদ্বীপ ও বাংলার মুখ রক্ষা হল। রাজা নবকৃষ্ণ বেজায় খুশি। আপ্লুত মহারাজ প্রচুর ধনরত্ন উপঢৌকন দিতে চাইলেন রামনাথকে। কিন্তু সাংসারিক স্থাবর বিষয়ে প্রবল অনীহা পণ্ডিতের। সেই পুরস্কারকে ‘কাকবিষ্ঠা’ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন বুনো রামনাথ।
রামনাথের রাজঅনুগ্রহ না নেওয়ার কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে দীনবন্ধু মিত্র তাঁর দীনবন্ধু রচনাসংগ্রহ পুস্তকে ত্যাগী পুরুষ সম্পর্কে লেখেন—
“বুনো রামনাথ ভট্টাচার্য বিজ্ঞবর
বিভব-বাসনা-হীন, জ্ঞানে বিভাকর;
…সমাদরে মহারাজা বহু ধন দিল,
অধ্যয়ন রিপু বলি তখনি ত্যজিল”
এবার একটি মজার ঘটনা। রাজনারায়ণ বসু ১৭৯৪ শকের (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ) ১১ চৈত্র তত্ত্ববোধিনী সভায় সেকাল ও একাল তুলনা করে এক বক্তৃতায় বুনো রামনাথের একটি গল্প বলেছিলেন। বুনো রামনাথ তাঁর পুঁথি, তাঁর বই, তাঁর বিভিন্ন বছরের পাঁজি নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন। একবার তাঁর স্ত্রী কোনও কাজে অন্যদিকে গেছেন, আর রামনাথকে বলে গেছেন, উনুনে মাটির হাঁড়িতে ডাল বসানো আছে, একটু দেখার জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে ডালের উথলিয়ে পড়ার সময় হল। বুনো রামনাথ তাঁর পৈতে ও পাঁজি নিয়ে সেই ডাল উথলাবার পর কী করা উচিত, পথ খুঁজে পেলেন না। এক নামে বিদগ্ধজনরা তাঁকে চেনেন, কিন্তু সংসারের সামান্য বিষয়ে তিনি কতটাই অসহায় ছিলেন, এই ঘটনা তার প্রমাণ দেয়। অতি জ্ঞানীব্যক্তিদের সাংসারিক জীবনবোধ এরকমই হয়।
শিক্ষার অহমিকায় রামনাথ দারিদ্রকেও আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন। নব্যন্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত সম্পর্কে ‘বাঙালির সারস্বত চর্চা’ গ্রন্থের প্রথম ভাগে বঙ্গে নব্যন্যায়চর্চা প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, “তাঁহার বিষয়নিঃস্পৃহতা শাস্ত্রব্যবসায়ীর আদর্শ লোকসমাজে উদ্বুদ্ধ করিয়া ধন্য হইয়া ছিল।” নবদ্বীপের পণ্ডিতমণ্ডলী তখন নব্যন্যায়ের দুনিয়া শাসন করছেন। সেই সময়ে এই দরিদ্র দম্পতির জীবনযাপনকে নিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে ভেসে বেড়ায় নানা কাহিনি। দেশবিদেশের ছাত্রদের মুখে মুখে সেসব পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পরে দেশ থেকে দেশান্তরে।
বুনো রামনাথের বাস্তুভিটাতে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার নবদ্বীপ তথা ভারতের সুপ্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহের সভাপতিত্বে এবং অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় দেশের পণ্ডিতমণ্ডলী এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকদের নিয়ে সংস্কৃত চর্চাকে পুনঃজাগরণের উদ্দেশ্যে “বঙ্গ বিবুধ জননী সভা” স্থাপন করা হয়েছিল। বুনো রামনাথের বাস্তুভিটায় যেখানে টোল ছিল সেখানে লক্ষ্মৌ নিবাসী ব্যবসায়ী বাবুলাল আগরওয়ালার আর্থিক সাহায্যে পাকা ঘর তৈরি হলে সেটি ‘পাকাটোল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে সেই জরাজীর্ণ বাড়িটি বুনো রামনাথের পরবর্তী বংশধরদের কাছ থেকে ১৯৩৫ সালে “বঙ্গ বিবুধ জননী সভা” কিনে নেয়। পরবর্তীতে ওই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ১৯৪৯ সালের ৩রা নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় হরেন চৌধুরী মহাশয় এবং নবদ্বীপের কৃতী সন্তান বিশিষ্ট সংস্কৃতানুরাগী সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি রাখালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সুযোগ্য পুত্র ড.বিজনকুমার মুখোপাধ্যায় মহোদয়ের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং নবদ্বীপের পণ্ডিতমণ্ডলীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নবদ্বীপ রাষ্ট্রীয় মহাবিদ্যালয় (নবদ্বীপ গর্ভমেন্ট সংস্কৃত কলেজ) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ত্রিশ বছর পর্যন্ত এই মহাবিদ্যালয় অনেক প্রশংসা অর্জন করেছিল। ১৯৮০ সাল থেকেই এই মহাবিদ্যালয়ের ক্ষয়িষ্ণু চেহারা। ২০০০ সালের বন্যায় মহাবিদ্যালয়ের প্রচুর ক্ষতি হয়। এমনকি গ্রন্থাগারের প্রচুর দুষ্প্রাপ্য পুঁথিও নষ্ট হয়ে যায়। ১১ই জানুয়ারি ২০১৭ সালে বিদ্যোৎসাহীরা বুনো রামনাথের বাস্তুভিটাতে একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেন। বুনো রামনাথের কল্পিত চেহারা থেকে মূর্তিটি তৈরি করেন শিল্পী অলোক ভট্টাচার্য। তিনি রামনাথের একটি কল্পিত ছবিও আঁকেন। আজকের পাতায় তাঁরই আঁকা ছবি লেখাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমানে টিমটিম করে চলছে এই ঐতিহ্যবাহী মহাবিদ্যালয়। খুবই দৈন্যদশা।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল তাঁর বিখ্যাত বই ‘রূপমঞ্জরী’, প্রথম ভাগ উৎসর্গ করেছিলেন পণ্ডিতপ্রবর বুনো রামনাথকে। লেখক লিখেছেন—
মহর্ষি
রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত
শ্রীচরণারবিন্দেষু,
রাজানুগ্রহমণ্ডিত নিষ্কর ব্রহ্মত্রা বা বৃত্তি, পণ্ডিতসমাজের উপাধিদানের প্রস্তাব আর ছাত্রদের সম্মানদক্ষিণা বা ‘সিধা’ তুমি ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছিলে।
দু’শ বছর স্বর্গবাসের পর তোমার মতটা কি কিছু পাল্টেছে?
তাহলে
ধূলিধুসরিত চরণপ্রান্তে এই অর্ঘ্যটি সমর্পণের সৌভাগ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না।
শ্রদ্ধাবিনম্র
নারায়ণ সান্যাল
১.১.৯০
বুনো রামনাথ একজন সৎ আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। শাস্ত্রে একজন শিক্ষকের দুটি বিশেষ গুণের উল্লেখ আছে— এক, তিনি হবেন ‘অবৃজিন’ অর্থাৎ নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ; দুই, তিনি হবেন ‘অকামহত’ অর্থাৎ অপরের হিত ছাড়া তাঁর আর অন্য কোন চিন্তা থাকবে না। সরল জীবনযাপন ও সমুন্নত চিন্তা হবে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। আত্মমর্যাবোধের জীবন্ত প্রতীক, ছাত্রহিতে নিবেদিত মনপ্রাণ বুনো রামনাথ সর্বকালের শিক্ষকদের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। চাণক্যের সেই বিখ্যাত শ্লোকটি যেন আমরা বুনো রামনাথের জীবনে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি—‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজে বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।’
বুনো রামনাথের জন্মের আড়াইশো বছর। আমাদের কোনো হেলদোল নেই। অতীত ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালির অনুসন্ধিৎসু মন তলানিতে। ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম ঝাপসা হয়ে গেলেও লোকমুখে আজও তাঁর জীবনকথা ভেসে বেড়ায়। রাজানুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করে আজীবন অরণ্যচারী আত্মাভিমানী পণ্ডিত ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে রইলেন—বুনো রামনাথ নামে। সারা ভারতের শিক্ষাব্রতী আদর্শ শিক্ষক আজও—বুনো রামনাথ।
ছবি ঋণঃ বুনো রামনাথের বংশধর, বিপ্লব ভট্টাচার্য
তথ্যঋণ:
১। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান
২। নারায়ণ সান্যাল—রূপমঞ্জরি (১ম খণ্ড)
২।মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল: নবদ্বীপের ইতিবৃত্ত। নবদ্বীপ সাহিত্য সমাজ।
৩। পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ মহাশয় সংকলিত: ‘নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস’
৪।ড. দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য: ‘বঙ্গে নবন্যায় চর্চা’
৫।কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি: ‘নবদ্বীপ মহিমা’ ও ‘নবদ্বীপ তত্ত্ব’
৬।‘কিংবদন্তী বুনো রামনাথ ও নবদ্বীপ বঙ্গ বিবুধ জননী সভা–পুস্তিকা। স্বত্বাধিকারী–নবদ্বীপ বঙ্গ বিবুধ জননী সভা (প্রকাশকাল ২০১৭)
৭। নবদ্বীপ রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়—একটি সমীক্ষা—ড. শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত
মান্যবরেষু
আমি খুবই আনন্দিত এবং আপ্লুত হলাম।
বুনো রামনাথের বংশধর হয়ে আমি গর্বিত।
তাঁর আদর্শের পথে যদি সামান্যতম যেতে
পারি তাতেই আমি নিজেকে গৌরাবণ্বিত
বলে মনে করবো।