সুকান্ত: জন্মদিনে – মালিনী ভট্টাচার্য

শেয়ার করুন

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মাঝবয়সে নতুন করে কবিতায় হাত মক্‌শো করছিলেন তখন যাঁদের অনুপ্রেরণায় ‘রণরঙ্গিনী কাব্যলক্ষ্মীর সাথে মারণপ্রেমের কায়দাকানুন’ শিখছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করেন এক ‘কিশোর সৈনিক’-এর, যে কবিতা লেখে। ‘উদয়-সূর্যের প্রভাত থেকে জগতের কবিরা’ যুগে যুগে হাত ধরে যে সারি দিয়েছে, তার ‘শেষ হাতটি ধরতে হাত বাড়িয়েছে’ সে। নাম না বললেও আমরা জানি কবিতায় অমরত্ব-প্রয়াসী এই সদ্যপ্রয়াত কিশোর সৈনিককে। সহযোদ্ধা সুভাষ মুখোপাধ্যায় সুকান্ত যে বইটি ছাপা দেখে যেতে পারল না এই আক্ষেপের পাশাপাশি ‘ছাড়পত্র’-এর প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লেখেন: তার কবিতায় ‘শুধুই বিরাট সম্ভাবনার ইঙ্গিত নয়, তাতে আছে মহৎ পরিণতির সুস্পষ্ট পদধ্বনি’। কবিতার কলাকৌশলের ওপর গভীর দখলের কথা বলে জানান: ‘আঙ্গিকের মায়ায় সুকান্ত কখনো বাঁধা পড়েনি’।

এরই পাশাপাশি ‘জাত-কবিদের কেলাশে’ তাকে মার্কা দিয়ে রাখাসত্ত্বেও ‘কবিতা’ পত্রিকায় সুকান্ত-স্মারক প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু সুতীব্র ভাষায় মন্তব্য করলেন, ‘পদাতিক’-এ যা ছিল মুগ্ধতার আবেগ, সুকান্তর ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠল ‘সুচিন্তিত দাসত্ব’। আরও বললেন, সুকান্তর রাজনৈতিক কবিতা ‘স্বাধীন মনের স্বচ্ছন্দ কর্মপ্রসূত’ নয়, তা ‘স্বেচ্ছায় আত্মবিলোপ’। সে সময়ের তিনজন প্রতিভাধর লেখক—তাঁদের মধ্যে প্রথম দুজনের মতের একেবারেই বিপরীত মেরুতে তৃতীয়জনের জ্বলন্ত আফশোস, এর থেকে কি তবে এটুকু সিদ্ধান্তই নেব আমরা যে কবিতার যাচাইয়ে শিবির-বিভাজনই শেষ কথা? যার যে রাজনীতি সেই অনুযায়ীই সুকান্তের কবিতার মূল্য, তার বাইরে আর কিছু নেই?

আমি তো অবশ্যই বলব মানিক বা সুভাষের বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি এবং সেটা এই কারণে নয় যে তাঁরা একই ‘শিবির’-এর লোক। বরং বুদ্ধদেব বসু তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ শিল্পের শিবির’কে রক্ষা করতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে তিনি ভুলে গেছেন শিবির-অতিক্রমী ধারণায় তিনিও অন্য দুজনের মতোই একথা স্বীকার করেছেন যে ‘কবি হবার জন্যই জন্মেছিল সুকান্ত’। কথাটির মানে কি? মানিক কীকরে জানলেন যে যুগযুগান্তের পূর্বসূরীদের সঙ্গে হাত মেলাতে হাত বাড়িয়েছিলেন এই কবি? সুভাষ সুকান্তের কবিতার কোন্‌খানে শুনলেন মহৎ পরিণতির পদধ্বনি?

‘জাত-কবি’ মানে তো জন্ম থেকে কবি নয়। সবকিছুকেই যে কবিতায় রূপান্তরিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে, যা ভাষা চাইছে তাকে যে ভাষায় পরিণত করতে পেরেছে সেই তো জাত-কবি। তার সব রচনাই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তার কোনো মানে নেই, কারণ সেই ‘মারণপ্রেমের কায়দাকানুন’ তাকে প্রত্যেকবারই নতুন করে শিখতে হয়। বিশেষ আঙ্গিকের মায়ায় তাই তার বাঁধা পড়লে চলে না। কোথাও অতিশয়োক্তি আসে, কোথাও আড়ষ্টতা, কোথাও আবেগ থেকে ঘটে ভাষার স্খলন, এইসবের মধ্য দিয়ে আবার কখনও কখনও সে মহৎ পূর্বসূরীদের হাত ধরে ফেলে—এইভাবেই তো নতুন সৃষ্টি হয়। সুকান্ত তো তাই করছিলেন।

কিন্তু যা কবিতা নয় তা থেকে কবিতাসৃষ্টির এই ক্ষমতা বুদ্ধদেবও তো খেয়াল করেছিলেন ‘যে-ছেলে কবিতা লিখে কবিতাকে ছুটি দিচ্ছে, গদ্যের হাতুড়িকে আহ্বান করছে ললিত পদাবলীতে’ তার মধ্যে। যেসময়ে সুকান্ত কবিতা লিখতে শুরু করেন সেটা ছিল যে কোনো জাত-কবির পক্ষে এক জীবন্ত সময়। তখন দেশে ও দুনিয়াতে নানা উত্তাল অভ্যুত্থানে সৃজনশীল সাহিত্যের দুনিয়াতেও অ-কবিতা এবং কবিতার মধ্যেকার চিরাচরিত দেওয়ালগুলি চুরমার হচ্ছিল। সেই ভাঙার শব্দ অনুরণিত হচ্ছিল উপন্যাসে, ছোটোগল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে। একজন জাত-কবি কি কখনও সেই রণধ্বনিতে সাড়া না দিয়ে পারে? তার জন্য নিজেকেও ভেঙে গড়তে হয়, পুরোনো ‘আমি’-র বিলোপসাধন করে অপরিচিত অপরের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে এক হবার চেষ্টা না করলে চলে? সুকান্ত তো সেটাই করছিলেন মৃত্যু তাঁর কণ্ঠরোধ করার আগে পর্যন্ত।
যে পূর্বসূরীদের দিকে সুকান্ত তাঁর হাত বাড়িয়েছিলেন দেশকালের ব্যবধানসত্ত্বেও তার মধ্যে আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি মহাকবি শেলীকে, যিনি জানান: এক মহৎ কবিকে হতে হবে তাঁর সময়ের কবি। সুকান্ত যখন বলেন: ‘আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু সূর্যোদয়ের পথে’—তখন কালের এই অগ্রগতির সঙ্গে একাত্ম হবার পিপাসাই তার মধ্যে সূচিত হয়।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *