অনলাইনে ডুব শিশু-কিশোরদের – দীপক সাহা
সোহেল। নবম শ্রেণিতে পড়ে। পড়ালেখায় ভালোই ছিল। একদিন তার মামা তাকে একটি স্মার্টফোন উপহার দিল। এরপর থেকে শুরু হল তার অনলাইন গেম খেলা। ধীরে ধীরে গেম খেলার পরিসর বাড়তে থাকল। অনলাইনে দেশি–বিদেশি নানা গেমারের (গেম খেলোয়াড়) সঙ্গে পরিচয়—ইয়ারফোনে কথা বলা শুরু হল। সারাদিন গেম নিয়ে ব্যস্ত, মা-বাবার সঙ্গে একসাথে খেতে চায় না, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, গল্পের বইও পড়ে না। ক্রিকেট অন্ত প্রাণ যে ছেলে, আজ কোনো খেলার খোঁজ রাখে না সে। ডিজিটাল পর্দার গেম ছাড়া তার আর কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। বাসায় কয়েক মুহূর্তের জন্য ওয়াই-ফাই বন্ধ থাকলে তার উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। অস্থিরতা শুরু হয়। মা-বাবা রাগ করে তার মুঠোফোনটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই শান্ত-সুবোধ সোহেল অগ্নিমূর্তি হয়ে দুমদাম করে বাসার দরজা আটকে দেয়, মা-বাবাকে কটুবাক্য বলে, চিৎকার করে আবার তার মুঠোফোনটি নিজের কবজায় নিয়ে আসে। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে। ইদানীং স্কুলে তালা। বন্ধ ঘরে মুঠোফোনেই বদ্ধ জীবন সোহেলের।
করোনাকালে লকডাউনে লাগাতার বাড়িতে থাকায় শিশু-কিশোরদের দূরত্ব বন্ধুবান্ধব-ক্লাসঘরের থেকে বেড়েছে তো বটেই। সঙ্গে অনলাইন ক্লাসের অন্যতম মাধ্যম মোবাইল হাতে পাওয়ায় গেম এবং ইন্টারনেটের প্রতি ঝোঁক গত ক’মাসে এতটা বেড়ে গিয়েছে যে বাড়ির লোকের জন্য তো বটেই, সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছেই এখন তা রীতিমতো উদ্বেগের কারণ।
মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটা বড়ো অংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী। এরাই কিন্তু গেমিং আসক্তি হওয়ার সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কখনও তাদের দেখা যায় মোবাইলে কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলছে, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, কেউ-বা নানা সফটওয়্যার বা এসব নিয়ে মশগুল আর কেউ-বা ফেসবুক সহ নানান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে দিনের বেশিরভাগ সময়। নয় থেকে বারো বছরের পড়ুয়ারাও এই নেশায় ডুবে যাচ্ছে।
সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোন সহ নানা যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দেন ব্যস্ত মা-বাবারা। তাঁরা নিজেরাও মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকেন। বাচ্চার হাতে মুঠোফোন-ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তি অনুভব করেন, যা শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেটে আসক্ত করে ফেলে। বাবা-মা নিজেরাও যদি সারাদিন ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মগ্ন থাকেন তাহলেও সন্তানের মধ্যে আসক্তির প্রবণতা বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের সুবিধার জন্য কেউ হয়তো কষ্ট করেই একটা স্মার্টফোন কিনেছেন, কিন্তু কোন্ সাইট লক করতে হবে, কীভাবে তাকে মনিটর করতে হবে, সকলের কি সেটা জানা সম্ভব? ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হয়ে মায়ের চোখের আড়াল হলেই গেম খেলে।
এই সমস্যা বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন জরিপ আর গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মাদকাসক্তির মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে মাত্রাতিরিক্ত থাকা বা গেম খেলাও আসক্তি। এটা আচরণগত আসক্তি।
এই আসক্তির লক্ষ্মণগুলো কী কী?
একজনের দিন শুরুই হবে ইন্টারনেট ব্যবহার বা গেম খেলার আকুতি দিয়ে। নতুন কিছুর চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকেই জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করবে। দিন দিন অনলাইন গেম খেলার সময় বাড়তে থাকবে। জীবনের সব আনন্দের উৎস হবে ইন্টারনেট বা গেম। পড়ালেখা বা অন্যান্য কাজ সবকিছু ব্যাহত হবে। পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হতে থাকবে। কর্মদক্ষতা কমে যাবে। দেখা যাবে কোনো কারণে ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তাতে সে অস্থির হয়ে পড়ছে, অভব্য আচরণ করছে। ঘুমের সমস্যা দেখা দেবে। দিনে ঘুমাবে আর রাতে জাগবে। খাবার গ্রহণে অনিয়মিত হয়ে উঠবে। তাড়াতাড়ি খাওয়া যায় এমন খাবার গ্রহণ করবে, যেমন ফাস্টফুড।বাসায় সবার সঙ্গে না খেয়ে নিজের ঘরে বসে খাবে। মিথ্যা কথা বলবে। নিজের ত্রুটিগুলো ঢাকতে তথ্য গোপন করবে। পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। বাথরুমে বেশি সময় কাটাবে, বাথরুমে মুঠোফোন নিয়ে যাবে। সামাজিকতা কমে যাবে। নিজেকে গুটিয়ে রাখবে। চারপাশ ভুলে গিয়ে ইন্টারনেট ডিভাইসে মগ্ন হয়ে একাকিত্বকে সঙ্গী করাই এই আসক্তির প্রধান লক্ষণ।
এই আসক্তি দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিণতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাবে। পারিবারিক জীবন বাধাগ্রস্ত হবে। বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকবে। সামাজিক দক্ষতা কমে যাবে। নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা কমে যাবে। ব্যক্তিগত জীবনও বাধাগ্রস্ত হবে। অপুষ্টিতে ভুগবে, কারণ উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করবে না। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়ার ফলে স্বাভাবিক যৌনজীবন নষ্ট হবে। পড়ালেখা ও কর্মজীবনের মান কমে যাবে। গেমিং ডিজঅর্ডারের সঙ্গে অতি উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা এবং তীব্র মানসিক চাপের মতো মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া বা সাইবার জগতের অপরাধে জড়িয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে।
এই জ্বলন্ত সমস্যার সমাধানের উপায় কী?
এর কোনো চটজলদি সমাধান নেই। আবার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাবা-মায়েদের যথাসম্ভব উদ্যোগী হওয়া ছাড়া বিকল্পও নেই। তাই অভিভাবকদের সতর্ক হতেই হবে। আদরের মাধ্যমে বোঝানো এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ে শিশু-কিশোরদের তাদের ভাষায় বোঝাতে হবে। তাতেই এই সমস্যার সমাধানের সূত্র লুকিয়ে। বাবা-মায়েদেরই অনেক বেশি উদ্যোগী হতে হবে। শাসনের ঢঙে নয় অনুশাসনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করাই বাঞ্ছনীয়।
গ্যাজেট আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিন। সন্তানকে প্রথমেই বুঝিয়ে বলুন যাতে নিয়মগুলো পালন করে। সময় মেনে চলতে উৎসাহিত করুন। বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে রাখুন। শিশু যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে, সেদিকে গুরুত্ব দিন। নিরাপত্তামূলক অনেক সফটওয়্যার আছে। সেগুলো ব্যবহার করুন। এ বিষয়ে আপনার ইন্টারনেট সংযোগদাতা বা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন। শিশুকে গুণগত সময় দিন। মা-বাবা নিজেরাও যদি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। পরিবারের সবাই মিলে বাসায় ক্যারম, লুডো, দাবা, ইত্যাদি খেলার চর্চা করুন। নিয়ম করে সবাই মিলে বেড়াতে যান। মাঠের খেলার প্রতি উৎসাহ দিন। একসাথে লাঞ্চ, ডিনার করুন। গল্পের আঙ্গিকে নিজের পরিবারের পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে, নিজের এলাকার ইতিহাস ও ভূগোল সম্পর্কে জানান। সন্তানকে সাথী করে নিয়ে বাগানে গাছের পরিচর্যা করুন। রাতের আকাশে তারাদের সাথে পরিচিত করান। বাড়িতে একটা সাংস্কৃতিক মহল তৈরি করুন। সেখানে আপনি ও পরিবারের সকলে যোগদান করুন। একটা আনন্দময় সুস্থ স্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশে সকলে মিলেমিশে থাকুন। সুন্দর পরিবার সুন্দর প্রজন্মের উৎসস্থল। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহয্যে এই আসক্তি দূর করুন।
শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক এই তিনের মধ্যে সুসামঞ্জস্য থাকলে পড়ুয়ার সার্বিক মানোত্তীর্ণ হয়। এক্ষেত্রে স্কুলেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ কাউন্সেলিং বা নানা কাজের মাধ্যমে বাচ্চাদের ব্যস্ত রেখে সমস্যার গোড়ায় আঘাতের চেষ্টা করছেন। কোনও কোনও স্কুলে জোর দেওয়া হচ্ছে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির উপরে। আলাদা ক্লাস রাখা হচ্ছে সে জন্য। শহরের অনেক স্কুল ওয়েলনেস সেশন নামে একটা ক্লাস শুরু করেছে। সেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে শিক্ষকরা কথা বলেন। তারা গান, আবৃত্তি, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এ ভাবে যতটা সম্ভব বাচ্চাদের অন্য দিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিন্তু শুধুমাত্র অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষে এই জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন সহ পৃথিবীর অনেক দেশে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের দৈনিক নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের উপর লাগাতার নজরদারি করা হয়। কিন্তু আমাদের সরকার এখনও শীতঘুমে আচ্ছন্ন। রাষ্ট্রকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া এই জটিল আবর্তে সমাধানের পথ খোঁজা অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার সামিল।