করোনাকালে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বাল্যবিবাহ – দীপক সাহা

করোনাকালে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বাল্যবিবাহ – দীপক সাহা

শেয়ার করুন

সম্প্রতি ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা-পরবর্তীকালে বিশ্বের প্রায় এক কোটি শিশু হয়তো অভাবের দরুন আর স্কুলে যেতে পারবে না। এই প্রতিবেদন অনুসারে, ১২টি দেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। আর ভারত, বাংলাদেশ সহ আরো ২৮টি দেশে এই সম্ভাবনা মাঝারি বা অত্যন্ত বেশিও হতে পারে। আর এতে করে স্কুল ঝরে পড়া ছাত্রীদের ক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ও বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও যে বৃদ্ধি পাবে সেটাও এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ওয়ার্ল্ড ভিশনের মতে, আগামী দুই বছরে বিশ্বের প্রায় ৪০ লাখ মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে পড়বে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির কারণে আগামী এক দশকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৩০ লাখ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটতে পারে।

‘গার্লস নট ব্রাইডস’ নামক একটি বৈশ্বিক সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১,৪০০টির বেশি সংস্থা নিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধে কাজ করছে। এই সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লক্ষ মেয়ে ১৮ বছরে পা রাখার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ প্রতি তিন সেকেন্ডে একটি মেয়েশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়। এই হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ কোটি মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হবে। ভারত, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ সুদানে অকল্পনীয় হারে বাড়ছে বাল্যবিবাহ।

অভাব-অনটনের বলির শিকার হয় সবার আগে নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যারা। বলা বাহুল্য, এ কারণে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই বাল্যবিবাহের প্রভাব বেশি দেখা যাবে। বর্তমান আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয় দরিদ্র পরিবারের কাছে কন্যাসন্তান আর্থিকভাবে বোঝা স্বরূপ। দরিদ্র, অতি দরিদ্র পরিবার মেয়েদের ভরণ-পোষণ ভার বহন করতে না পেরে বিয়েকেই তাদের আর্থিক সুরক্ষার একমাত্র উপায় বলে মনে করেন অনেক অভিভাবক। তাঁদের ধারণা অল্প বয়সে বিয়ে মেয়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। তাঁদের মতে বিয়ে মেয়েদের অবাধ যৌন সম্পর্ক ও যৌন সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসরুম বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল মেয়েদের বাল্যবিবাহ থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেয়েশিশুদের অবস্থা, বাল্যবিবাহের জন্য চাপ বা তাদের উপর ঘটে যাওয়া সহিংসতার হিসাব রাখতে সহায়তা করে স্কুলগুলো। যখন স্কুল বন্ধ, তখন বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে না। আর দীর্ঘ সময় এসব স্কুলমুখী না হওয়ার ফলে শিশুরা তত্ত্বাবধান ও সুরক্ষার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূলত অসচেতনতা, নারী শিক্ষার অভাব, সামাজিক কুসংস্কার, অনিশ্চিত করোনা পরবর্তী ভবিষ্যৎ এবং দারিদ্র্য এ সময়ে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।

বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা এ সময়টায় দেশে ফিরেছেন। সমাজ বাস্তবতায় প্রবাসে কাজ করা ছেলের ‘পাত্র’ হিসেবে চাহিদা বেশি। আর এই অবরুদ্ধ অবস্থায় কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন অভিভাবকেরা। অন্যদিকে করোনা আবহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এখন কম হচ্ছে। সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ। সমাজের দরিদ্র অনেক অভিভাবকই এ সময় মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে মেয়ে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছে। এই দিকটাও বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক শক্তিগুলোর সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ কমছিল। কিন্তু করোনার কারণে এই সামাজিক শক্তিগুলোর সক্ষমতা কমতে শুরু করে। সব মিলে একধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনও অনেক পরিবারে একটি ছেলেকে অর্থোপার্জনের ও পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য ও মেয়েকে পরিবারের জন্য বোঝা হিসেবে ধরা হয়। তাই অভাব-অনটনে থাকা পরিবারগুলোতে ঘরের মেয়েকে বিয়ের বয়স হওয়া না সত্ত্বেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য অজ্ঞতা কিংবা কুসংস্কারই যে সবসময় বাল্যবিবাহের মূল কারণ ঠিক তা-ও না। অনেক সময় অভাবের কাছে মাথা নত করেই অন্তত নিজের মেয়ের জন্য একটা ভালো জীবনের আশায় কিছু মা-বাবা তাদের কন্যাকে বাল্যবিবাহ দেন। তাছাড়া কিছু প্রভাবশালীর দমন-পীড়ন, কুনজর কিংবা ইভটিজিংয়ের মতো সমস্যায় জর্জরিত হয়েও অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহের বলি হয়।

কারণ যেটাই হোক না কেন, বাল্যবিবাহের ফল কখনোই একজন কিশোরীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। না শারীরিক দিক থেকে, না মানসিক দিক থেকে। আর করোনা মহামারি বাল্যবিবাহের মতো এই অভিশাপকেই আরো শক্তিশালী করে তুলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ মেয়েশিশুদের কাছ থেকে তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকারই কেড়ে নেয়। আর এই সুযোগে পণপ্রথার মতো কুপ্রথাও যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ একটা প্রচলিত কুপ্রথা। আমাদের সমাজে সুদীর্ঘ কাল ধরে মেয়েরা শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য এবং সন্তান উৎপাদনের আধার হিসাবে বিবেচিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় আমলে মেয়েরা বয়ঃসন্ধির আগেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত। বাল্যবিবাহ ও কৈশোর গর্ভধারণ খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল সে যুগে। কিন্তু গভীর উদ্বেগের বিষয় এই ডিজিটাল ও ইন্টারনেটের যুগেও মেয়েরা নানা অমানবিক শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিনিয়ত শিকার ঘরে-বাইরে। বিবাহ নামক সামাজিক ব্যবস্থার যূপকাষ্ঠে জাতি-ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে এখনও নাবালিকারা বলি হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নাবালিকা বিবাহ ও তার ফলে অকাল মাতৃত্ব হওয়ার প্রচুর উদাহরণ আমাদের সমাজের এক ভয়ংকর ক্ষতস্বরূপ। করোনার ক্রান্তিলগ্নে এই সামাজিক সমস্যার শিকড় ক্রমশ আরও গভীরে প্রবেশ করছে।

আমাদের রাজ্যও এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।একটি পরিসংখ্যান মতে, লক ডাউনের আগে আমাদের রাজ্যে বাল্যবিবাহ ৩ শতাংশে নেমে এসেছিল, তা প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায়। সারা রাজ্যের চিত্রটাও যথেষ্ট উদ্বেগের। রাজ্যের ১৯টি জেলার মধ্যে, ইউনিসেফের তথ্য মতো, সবচেয়ে বেশি কমবয়সে বিয়ের সংখ্যা মুর্শিদাবাদ জেলায়, প্রায় ৩৫.৮ শতাংশ। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্য সরকার যথেষ্ট আন্তরিক মেয়েদের স্কুলমুখী করতে। নাবালিকা বিয়ে রোধ করে তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে প্রশাসন থেকে সুরক্ষা কমিশন, সকলেই সচেষ্ট। রাজ্য সরকারের বৈপ্লবিক ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প’ আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রশংসিত। কিন্তু কন্যাশ্রী প্রকল্প ও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা প্রভৃতি প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও নাবালিকা বিবাহ ও অকাল মাতৃত্ব হওয়ার প্রবণতা আশানুরূপ ভাবে কমেনি। গ্রাম এবং বস্তি অঞ্চলের চিত্রটা আরও শোচনীয়।

এই অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে, উচ্চশিক্ষিত নারীর সংখ্যা কমবে, সুশিক্ষিত মায়ের সংখ্যা কমবে, অল্পবয়সি ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতীর সংখ্যা বাড়বে, অপ্রাপ্তবয়সি প্রসূতি মায়ের কারণে জন্ম হবে রুগ্ন শিশুর। এভাবে নতুন জন্মানো শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়বে। ছোঁয়াচে রোগের মতো সমাজে ছড়িয়ে পড়বে নানা অসংগতি।

মেয়েদের উপর বাল্যবিবাহের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে। এর প্রভাব কৈশোরের পরেও স্থায়ী হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় আইনে বাল্য বিবাহ আইন বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আইনসিদ্ধ বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ এবং ছেলেদের ২১ করা হয়। কিন্তু আইন প্রণয়নের এত বছর পরেও প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নাবালিকা মায়ের সন্তান প্রসবের যন্ত্রণার কান্না শুনতে পাই।

রাষ্ট্রকে সজাগ দৃষ্টিতে এই সামাজিক ব্যাধির মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রান্তিক এলাকায় আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারকে সাহায্য করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে বেশি বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার এবং সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে সচেতনভাবে আরও বেশি গঠনমূলক সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, বিশেষ করে শিক্ষক সমাজকে। আমরা আশাবাদী অদূর ভবিষ্যতে সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় এক উন্নত সুস্থ সমাজ দেখতে পাব যেখানে নারীদের মানবাধিকার হবে সুনিশ্চিত, একটিও বাল্যবিবাহ হবে না।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২