হোসে সারামাগোর সাক্ষাৎকার অনুবাদ: গৌতম চক্রবর্তী

হোসে সারামাগোর সাক্ষাৎকার অনুবাদ: গৌতম চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

প্রাথমিক

পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে কিছুটা দূরে উত্তর-পূর্ব দিকে ‘আযিনহাগা’ নামের একটি ছোটো গ্রামে, এক ভূমিহীন কৃষকের ঘরে ১৯২২ সালের ১৬ই নভেম্বর হোসে সারামাগোর জন্ম হয়। তার বাবার নামের মতন তার নামও হয়তো হোসে দি সউসা রাখা হত যদি না রেজিস্ট্রার নিজের উদ্যমে সউসা পরিবারকে তাদের সামনে বা পেছনে পাড়াপড়শিরা যে নামে ডাকত সেই সারামাগো শব্দটিকে তার নামের সঙ্গে জুড়ে দিত। এখানে বলে রাখা ভালো যে ‘সারামাগো’ আসলে এক ধরনের জংলা গাছ যা গরিবগুর্বোরা খাবার জন্য চাষ করে থাকে। এই ধরনের ছোটো ছোটো কাকতালীয় অথচ ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের গভীর অর্থ ও ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রায়শই সারামাগোর লেখা আপাত জটিল আখ্যানগুলোর মূল সূত্র হয়ে দেখা দিয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে ১৯৮৯ সালে তার মুদ্রিত উপন্যাস ‘দা হিস্ট্রি অফ দা সিজ অফ লিসবন’। উপন্যাসের মুল চরিত্র একজন ছাপোষা প্রুফ্র রিডার, যিনি একটি ঐতিহাসিক দলিলকে সম্পাদনা করতে করতে সচেতনভাবে একটি মাত্র শব্দ তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। যার ফলে পর্তুগাল রাষ্ট্র এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের অতীত ঘটনাবলি অন্য অর্থ পায়। একটা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা, যেখানে বাস্তব এবং কল্পনা একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়, জড়িয়ে যায় ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীর দৃষ্টিকোণ আর শোনা যায় একটি স্বতন্ত্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ মিশ্রিত অথচ আবেগপূর্ণ কণ্ঠস্বর। এক কথায়, এই হল সারামাগোর লেখা উপন্যাসগুলোর মূল চরিত্র। ১৯৯৮ সালে প্রথম পর্তুগিজ ভাষী লেখক হিসেবে সারামাগো নোবেল পুরস্কার পান।

সাফল্য অথবা খ্যাতি কোনোটাই সারামাগোর দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে খুব মসৃণ পথে অথবা সোজাসাপটা ভাবে এসেছে বলা যাবে না। যদিও তার প্রথম উপন্যাস ‘টেররা দো পিকাদ’ বা ‘ল্যান্ড অফ সিন’ ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি তার পরের তিরিশ বছর সাহিত্যের এই ধারাটিকে পরিহার করেন। ১৯৭৬ সালে যখন তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ম্যানুয়াল অফ পেইন্টিং অ্যান্ড ক্যালিগ্রাফি’ প্রকাশিত হয় তখন তার সঙ্গে একটি ক্যাপশন প্রকাশ পায়, ‘এন্সাইও দা রোমান্স’, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘একটি উপন্যাস লেখার জন্য মহড়া’। এই ক্যাপশনটির ভেতর হতে লেখার ব্যাপারে সারামাগোর ধ্যানধারণা ভেসে ওঠে। লেখা একটি শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া যার সম্মুখীন লেখককে একমনে বিনয় ও ধৈর্যের সঙ্গে করে যেতে হবে।
সারামাগো এবং তার সমালোচকেরা সাধারণত তার প্রথম দিককার রচনাগুলোকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের কাছে তিনি ১৯৮২ সালে রচিত উপন্যাস ‘বালথাজার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা’র জন্য প্রথম নজরে আসেন। সারামাগোর উপন্যাসগুলির মধ্যে খুব সম্ভবত এই উপন্যাসটি সবচেয়ে পঠিত ও জনপ্রিয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্তুগালের ইতিহাসকে দেখার প্রক্রিয়া সারামাগোর শুরু হয় আঠারো শতকের পর্তুগালের জনজীবনে ‘বালথাজার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা’র হাত ধরে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যা চলতে থাকে সমগ্র আশির দশক জুড়ে। প্রথমে তিরিশের দশকে সালাজারের স্বৈরাচারী শাসনকালের মানুষের যাপনচিত্র ‘দা ইয়ার অফ দা ডেথ অফ রিকার্ড রেইস’ (১৯৮৪ সালে রচিত) ও পরে ‘দা গস্পেল আকরদিং টু জেসাস খ্রীষ্ট’র (১৯৯১ সালে রচিত) মধ্যে।
উপন্যাস ‘দা গস্পেল আকরদিং টু জেসাস খ্রীষ্ট’র ইউরোপিয়ান লিটারারি প্রাইজের জন্য মনোনয়ন তদানীন্তন পর্তুগীজ সরকার খারিজ করে দেয়। এই পদক্ষেপের সরকারি ব্যাখ্যা ছিল, এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সমগ্র ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের ভাবধারায় আঘাত করা হয়েছে। তাই লেখাটিকে কোনো মতেই পর্তুগালের প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া চলে না। এর প্রতিক্রিয়ায় সারামাগো এবং তার স্ত্রী সাংবাদিক পিলার দেল রিও পর্তুগাল ছেড়ে স্প্যানিশ দ্বীপ লানযারতে গিয়ে বাস করতে শুরু করেন। মৃত্যুকাল অবধি (২০১০ সাল) তিনি সেখানেই বাস করেন।
নব্বইয়ের দশকে সারামাগোর লেখায় উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময়ে লেখা তার উপন্যাস ‘ব্লাইন্দনেস’ (১৯৯৫), ‘অল দা নেমস’ (১৯৯৭)ও ‘দা কেভ’ (২০০০) রূপকধর্মী ও দার্শনিক চিন্তাধারায় জারিত। উপন্যাসগুলির ভেতরে কিছু নামগোত্রহীন চরিত্র কোনো অজানা দেশে, কোনো অনুল্লেখিত সময়ে, কোনো মহামারী বা অন্য কোনো গূঢ় সমস্যার সম্মুখীন প্রায়শই হয় এবং এর মধ্য দিয়ে সারামাগো উপন্যাসের পরতে পরতে মানুষের চরিত্রের নানান চেনা-অচেনা দিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার পাঠককে দেখিয়ে চলেন। তবু এইসব চরিত্রদের ভেতরকার শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ কখনোই সীমাহীন হয়ে পড়ে না। তার আগের রচনাগুলোর ভেতরকার দৃঢ় বিশ্বাস যে, যেকোনো গভীর ব্যাধির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছে মানুষের ভেতরে, তার রক্তে বাস করে, সেই বিশ্বাসের সঙ্গে মৈত্রীর চিহ্ন তার এই সময়ে লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যেও পাওয়া যায়। তবে ক্রমশ মনুষ্য জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার বেড়ে চলা হতাশাবোধও তার একনিষ্ঠ পাঠকদের নজর এড়ায় না।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বামপন্থায় বিশ্বাস করতেন এবং জীবনের শেষদিন অব্দি কমিউনিস্ট পার্টির কার্ড হোলড করেছেন। সাহিত্য কেবলমাত্র শিল্পের একটা শাখা নয়, বরঞ্চ জনসাধারণের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার একটা প্রকরণ এবং সেটা করা একজন শিল্পী ও ভাবুকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, এই বিশ্বাসের পক্ষে তিনি মতামত বহু দশক ধরে নানান বক্তৃতা, রচনা ও সাক্ষাৎকারে রেখে গেছেন।

তার লেখা, সাহিত্য ও রাজনৈতিক বক্তব্যের নির্যাস কিছুটা হলেও তার জীবনের শেষ দশকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। নিম্নের লেখাটি সেরকমই কিছু সাক্ষাৎকার থেকে বেছে নেওয়া প্রশ্ন ও উত্তরের সংকলন।

সাক্ষাৎকার

প্রশ্নঃ আপনার বয়স তখন ষাট পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ করে যেন আপনার মধ্যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটা সৃজনীশক্তির বিস্ফোরণ ঘটল। ফলস্বরূপ, আপনার একে একে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি এল। আপনার একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে এই যে ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠা এর ব্যাখ্যা কীভাবে করবেন?

সারামাগোঃ এর ব্যাখ্যা আমি কীভাবে করব জানি না। আমার মনে হয় না, এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে অন্য কোনো ব্যাক্তির পক্ষেও সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হত, মানে এই বিবর্তনের কারণগুলো সঠিকভাবে একজনের ব্যক্তিগত জীবন থেকে ঠিকঠিক নির্ণয় করে, একটা সরলরেখা টেনে সে কীভাবে একজন কেউকেটা হয়ে উঠল বলা সম্ভব নয়। আমার যখন উনিশ বছর বয়স, তখন কেউ আমাকে যখন জিজ্ঞেস করত যে তুমি ভবিষ্যতে কী হতে চাও, আমি বলতাম লেখক হতে চাই। আমি আমার মধ্যে এই ইচ্ছেটাকে বেশিদিন চাপা দিয়ে রাখিনি। আমার যখন মাত্র চব্বিশ বছর বয়স তখন আমার প্রথম উপন্যাস ‘টেররা দো পিকাদ’ বা ‘ল্যান্ড অফ সিন’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর পরের কুড়ি বছর আমি খুবই কম লিখেছি আর কিছুই ছাপাইনি। মজার ব্যাপার হল লেখা যখন আবার আমার কাছে একটা দৈনন্দিন কাজ হয়ে উঠল, তখন আমার কাছে সেই লেখক হওয়ার বাসনাটি আর আগের মতন স্বচ্ছ নয়। আমার সেরকম কোনো বড়ো উদ্দেশ্য ছিল না। আমি অভ্যাসবশত লিখছিলাম আর যা লিখছিলাম, তাই ছাপছিলাম। এইভাবে ১৯৭৪ সাল অব্দি চলেছিল অর্থাৎ সেই বছর অব্দি যেই বছর অবশেষে পর্তুগালে প্রায় পঞ্চাশ বছরের স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটল। ততদিনে আমার মাত্র ছটা বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ভুলে যাওয়া সেই অল্পবয়সে প্রকাশিত উপন্যাসটি, দু-খণ্ড কবিতা ও তিনটে নিউজ পেপার আর্টিকেল ও সম্পাদকীয় সংকলন। আগে লেখা দুটো বই, ‘ম্যানুয়াল অফ পেন্তিং অ্যান্ড ক্যালিগ্রাফি’ আর ‘অলমোস্ট অ্যান অবজেক্ত’ ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়।

১৯৭৫ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক কারণে আমাকে ‘ডাইরো দি নতিসিয়াস’ কাগজের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। আমি তখন নিজেকে বললাম যে তুমি যদি সত্যি লেখক হতে চাও, তাহলে শুরু করার এটাই সেরা সময়। এর কয়েক সপ্তাহ পরে আমি চলে গেলাম শহর থেকে দূরে আলেন্তেজ জেলার গভীরে। সেখানকার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখে ফেললাম উপন্যাস ‘রেসদ ফ্রম দা গ্রাউন্দ’ যা প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। আমি অবশেষে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে আমার হয়তো কিছু বলার আছে যা সত্যি বলার প্রয়োজন আছে। ১৯৮২ সালে যখন আমার ষাট বছর বয়েস তখন ‘বালথাসার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা’ প্রকাশিত হল আর আমি যে ধরনের লেখক হতে চেয়েছিলাম তেমন লেখক বনে গেলাম। এখন কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কীভাবে এমনটি হলাম তখন আমি বলি ‘আমি শুধু লিখি না, আমি যা আমি তাই শুধু লিখি।’ আমার এই লেখক হয়ে ওঠার পেছনে এটাই হয়তো আসল কারণ।

প্রশ্নঃ আশির দশকে আপনার লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো এই ধরুন, ‘বালথাসার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা’ থেকে শুরু করে ‘দা গস্পেল আকরদিং টু জেসাস খ্রীষ্ট’ পর্যন্ত আপনার প্রথম গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ সাইকেল বলা হয়। আপনার অধিকাংশ পাঠক, এই লেখাগুলো ও এরপরে নব্বই দশকে প্রকাশিত আপনার রূপকধর্মী উপন্যাস ‘ব্লাইন্দনেস’, ‘অল দা নেমস’ ও ‘দা কেভ’ এর মধ্যে একটা বিভাজন রেখা টানে। এই দু-দশকের মধ্যে আপনার লেখার যে বহমানতা, ভারসাম্য ও বদল সেটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সারামাগোঃ তুমি যেটাকে আমার প্রথম ন্যারেটিভ সাইকেল বললে সেটার সূত্রপাত ‘লেভান্তাদ দ চাও’ উপন্যাস থেকে হয়। এই উপন্যাসেই আমি প্রথম আমার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর খুঁজে পাই যা এরপর থেকে আমার লেখার বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিতি পায়। আমার দ্বিতীয় সাইকেলের উপন্যাসগুলোর মধ্যে আমার পূর্ব প্রকাশিত ছোটোগল্প সংকলন ‘অল দা অবজেক্টস’-এর প্রভাব সুস্পষ্ট। এছাড়া তারও আগে প্রকাশিত আমার নিউজ পেপার আর্টিকেলস-এর সংকলনগুলোকে ভুললেও চলবে না। আমি মনে করি, আমি যা কিছু পরে লিখেছি তার সবকিছুর শেকড় এই লেখাগুলোর ভেতরে আছে। আর আমার লেখার দুটো সাইকেলের মধ্যখানের বিভাজন রেখার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আমি প্রস্তর মূর্তি ও প্রস্তর খণ্ডর তুলনাটা টানব। ‘দা গস্পেল আকরদিং টু জেসাস খ্রীষ্ট’ অব্দি আমার লেখা উপন্যাসগুলোর সাহায্যে আমি কেবল প্রস্তর মূর্তির বর্ণনা করে চলেছিলাম। প্রস্তর মূর্তিকে তো কোনো প্রস্তর খণ্ডের বহিরূপও তো বলা যায়। তাই না? ‘ব্লাইন্ডনেস’ ও তার পরবর্তী উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমি সেই প্রস্তর খণ্ডের অন্তরে প্রবেশ করলাম। সেইখানে প্রবেশ করলাম যেখানে সেই প্রস্তর খণ্ড নিজেও জানে না যে তার বহিরূপটা আসলে কি? সে কি কোনো প্রস্তরমূর্তি নাকি অন্যকিছু।

প্রশ্নঃ আপনার লেখা অধিকাংশ উপন্যাসে মৃত্যুর উপস্থিতি আমাদের চোখে পড়ে…

সারামাগোঃ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মৃত্যু কোনো না কোনো ভাবে সবসময় উপস্থিত আছে। এমন নয় যে মৃত্যুর প্রতি আমি কোনো আকর্ষণ বোধ করি অথবা এই বিষয়ে আমি চিন্তা করতে ভালোবাসি, তবে এটাও তো ঠিক যে মৃত্যু আমাদের জীবনের অঙ্গ।

প্রশ্নঃ বিশেষ করে ‘ম্যানুয়াল অফ পেন্টিং এন্ড ক্যালিগ্রাফি’ উপন্যাসে চিত্রকর এইচ বলছে যে কিশোর বয়স থেকে সে মৃত্যুকে নিয়ে অবসেস্‌ড…

সারামাগোঃ ‘ম্যানুয়াল অফ পেন্টিং এন্ড ক্যালিগ্রাফি’ উপন্যাসের একটি অংশে কথক বলছে যে তার দুই হাতের মধ্যে তার বাবার করোটি বিরাজ করছে। ওটা আসলে আমি। আমার বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছিল। লিসবনে সব কবরস্থানে একটা বিশেষ জায়গা রাখা হয় সেই সব সৈনিকদের অবশেষের জন্য যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছিল। আমার বাবার অবশিষ্ট একটা ছোটো বাক্সে সেরকম এক কবরস্থানে রাখা আছে। ঠিক কোথায় রাখা আছে আমার এখন ঠিক মনে নেই তবে লিসবনের কোথাও আছে। তবে আমার মনে আছে আমি আমার বাবার খুলি নিজের হাতের মধ্যে অনুভব করেছিলাম যেমন হ্যামলেট ইউরিকের খুলি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে করেছিল। এর মধ্যে কোনো গভীর দার্শনিক চিন্তা নেই; এ কেবলই আমার বাবার স্মৃতি।

প্রশ্নঃ আমার মনে হয়, আপনার সামনে আপনার লেখায় মৃত্যুর উপস্থিতি নিয়ে আমার যে প্রশ্ন, সেটাকে এবার একটু স্বচ্ছ ভাবে তুলে ধরতে পারব। এতদিন যাবৎ আপনার লেখায় মৃত্যু নানাভাবে উপস্থিত ছিল; কিন্ত এখন আপনার উপন্যাস ‘ডেথ উইথ ইন্টারাপশন’ এ মৃত্যু হল প্রধান চরিত্র। এইভাবে মৃত্যুকে উপস্থাপনা করা আপনার মাথায় কীভাবে এল?

সারামাগোঃ মজাটা ঠিক ওইখানেই। আমরা একদিন মারা যাব, এই ধারণাটা আমাদের ভালো লাগে না। কিন্তু এটা তো সত্যি একদিন সবাই মারা যাবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানবজাতির আখ্যান তো এটাই! অবিরত বাঁচতে বাঁচতে আমরা সবাই একদিন মারা যাব। এতে কোনো নাটকীয়তা নেই। শুধু একজনের জীবন শেষ হয়ে গেল। এই গ্রহের ছয় বিলিয়ন বাসিন্দার ক্ষেত্রে এই একই কথা প্রযোজ্য। এক মুহূর্তে সব শেষ। ব্যাপারটা অদ্ভুত! মৃত্যুর রূপ ভয়াবহ অথবা কম সে কম ডিসটার্বিং হওয়া উচিত। কিন্তু আমার উপন্যাস এর মধ্যে ব্যঙ্গ অথবা রসিকতাটা ধরবার চেষ্টা করেছি।
এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি মৃত্যুকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছি! সেটা করা সম্ভবও নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল তাকে এত গুরুত্বই বা দেওয়ার কি আছে! উপন্যাসে মৃত্যু এক নারীর রূপ ধারণ করে এবং সে এক বেহালা বাদকের প্রেমে পড়ে। মোটামুটি ভাবে কিছু পাঠক, বিশেষ করে আমার সমালোচকরা এর থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন যে প্রেমের কাছে মৃত্যু পরাজিত হল। প্রথমত কোনো কিছুই মৃত্যুকে পরাস্ত করতে পারে না। আর এর প্রমাণ আছে উপন্যাসের শেষ লাইনে যা হল উপন্যাসের প্রথম লাইনের পুনরাবৃত্তি। লাইনটা হল ‘পরের দিন, কেউ মারা গেল না।’ তার মানে হল মৃত্যু সেই নারী রূপে খুশি আছে তাই কিছু হল না। মৃত্যুকে কেউ হারাতে পারে না।

প্রশ্নঃ আপনার সম্পর্কে কারোর মনে এই ধারণা আসতে পারে যে একজন নাস্তিক কেন সবসময় ধর্মীয় বিষয় নিয়ে লিখছে? যেমন জেসাসের জীবন নিয়ে লিখছে, মৃত্যুকে একটি চরিত্র হিসেবে পেশ করছে, অন্ধত্বের মহামারী অথবা ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে আইবেরিয়ান পেনিনসুলা ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন সব কথা বলছেন…

সারামাগোঃ এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে সবসময় হতে হয়। আপনি কেন এই সব বিষয় নিয়ে লেখেন? আমি লিখি কারণ আমি যে সমাজে বাস করি সেখানে এইসব কিছুর অস্তিত্ব আছে। আমি একজন নাস্তিক হলেও, নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা যায় আমি হলাম গ্রেকো-খ্রিষ্টান ভাবধারায় লালিত অথবা সেই শিক্ষাধারা পেয়ে বড়ো হয়ে ওঠা একজন মানুষ। আমি সেইসব জিনিস নিয়েই লিখছি যা এতদিন ধরে আমাকে নির্মাণ করেছে। আমাদের চারপাশে ধর্ম সবসময় বিরাজ করছে।

প্রশ্নঃ অথচ এইসব ঐশ্বরিক চরিত্ররা আপনার উপন্যাসে উপস্থাপিত হয় এমন এক মানবিকতা বোধের মাধুরী নিয়ে যা এক কথায় সুন্দর। তাদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চার্চ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদেরকে বিকৃত করে…

সারামাগোঃ তুমি যদি বিশ্বাস করো যে জেসাস একজন ঐশ্বরিক চরিত্রর ব্যক্তি, তাহলে তোমাকে সবার আগে এই বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে ঠিক কখন থেকে সে সচেতন হল এবং বুঝতে পারল যে তার মধ্যে দৈব শক্তি বিরাজ করছে। এই জন্যই আমি ‘গসপেল আকৰ্ডিং টু জেসাস খ্রীষ্ট’ লিখেছিলাম।
জেসাস আমাদের মতনই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন, যিনি সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে ভালোবাসতেন। সে নিজেকে এমন এক পরিস্থিতিতে পায় যার জন্য সে তৈরি ছিল না। আশ্চর্যজনক ভাবে বাইবেলে, গসপেলের মধ্যে, আমি বলব না কোনো একজন মানুষ বলেছিল, তবে সঠিক শব্দের অভাবে আমি বলব, জেসাস খ্রীষ্ট ভগবানের সন্তান এই কথাটা প্রথম ‘শয়তান’ বলেছিল।
ঘটনাটা এরকম: যখন জেসাস একজন মানুষের অন্তর থেকে যেখানে হাজার হাজার দানব বাসা বেঁধেছিল, তাড়াবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন শয়তান বলে উঠেছিল, ‘হে ভগবানের সন্তান নিজেকে তুমি এত যন্ত্রণা দিয়ো না।’ প্রশ্ন হল শয়তান কী করে জানল যে জেসাস ভগবানের সন্তান? আর এটাই বা কি ধরনের অলৌকিকত্ব? দানবেরা মানুষের ভেতর হতে বেরিয়ে এসে শুয়োরদের মধ্যে প্রবেশ করল এবং তারপর সেই সব প্রাণীগুলো দৌড়তে দৌড়তে গালিলির সমুদ্রে ঝাঁপ দিল ও ডুবে গেল! এসব হল কিংবদন্তি, প্রাচীন লোকগাথা যেমন আমরা আরব্য রজনীতে পাই।
সুতরাং এর উৎপত্তি ঠিক কোথায় সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ধর্ম আসলে বিশেষ এক ধরনের মড়ক ছাড়া আর কিছুই নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই লক্ষণগুলো অন্য ছোটো ধর্মের অথবা ধার্মিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও প্রকট হয়ে উঠেছে। এই সব আমার মানুষ সম্পর্কে ধারণাকে আরো দৃঢ় করেছে। সেটা হল এই যে, সে আদতে একটি বিকারগ্রস্ত খ্যাপা প্রাণী বই আর কিছু নয়।

প্রশ্নঃ আর আমার মনে হয় এই বিষয়টা বার বার আপনার বইগুলোয় ফিরে আসে। ‘অবাক’ শব্দটা সঠিক কিনা জানি না তবে অবশ্যই অদ্ভুত লাগে যখন দেখি এই বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এইসব মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের ছত্রছায়ায় বাস করছে…

সারামাগোঃ আমি এই দোষের ভাগীদার নই। আমি এই বিষয়টির সমালোচনা করি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করি, আমার বইগুলোয় এই বিষয়ের উত্থাপন করি; কিন্তু প্রথমত কারোর চেতনাকে বদলানো খুব শক্ত কাজ আর দ্বিতীয়ত সমাজে সেই মানুষটির স্থান। আর সবচেয়ে শক্ত হল কারোর মধ্যে কোনো বিষয়কে সমালোচনা করে তার ভেতর দিয়ে নিজের চেতনা গড়ার শিক্ষা প্রদান করা ও তারপর তাকে তার প্রয়োগ করার জন্য প্ররোচিত করা। মৌলবাদ তো সবকিছুর মধ্যেই বিভাজন আনে। এই দোষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দোষী।

প্রশ্নঃ একদমই তাই। খুব সম্ভবত এরপরের মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি একজন মহিলা হতে চলেছেন যিনি সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস করেন (এই প্রশ্নটি ২০০৬ সালে এক সাক্ষাৎকার নেওয়া কালীন করা হয়)।

সারামাগোঃ আমি আশ্চর্য নই। বেশ কয়েক বছর আগে আমি বার্সিলোনায় এক নোবেল পুরস্কার বিজেতাদের অধিবেশনে গিয়েছিলাম। অভ্যাগতদের মধ্যে পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকরা আমন্ত্রিত ছিল।সাহিত্যিকদের মধ্যে আমি আর ওলে সোয়েঙ্কা হাজির ছিলাম। একটা সময় এক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ বলবার জন্য উঠলেন এবং তিনি কয়েকটা কথা বলবার পর আমরা চমকে উঠলাম। তিনি বললেন আমরা যে সময় বিবর্তনবাদ পড়াই সেইসময় আমাদের সৃষ্টিবাদের কথাও পড়ানো উচিত। দুটো বিষয় তো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। কিন্তু এই কথাগুলো একজন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ বলছেন! আমরা সকলেই নীরব ছিলাম। কেউ একটা কথা বলল না আর তারপর সবকিছু ঠিক আগের মতোই চলতে লাগল ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি।
আসলে ব্রহ্মাণ্ডটি তৈরি করতে তো ঠিক এক সপ্তাহ, মানে আক্ষরিক অর্থে ছ’দিন লাগেনি! সেটা হতে ছটা বিরাট যুগের অবসান হয়ে গেছিল যা পরে দিনে বদলে দেওয়া হয়। এইসব দেখে আমার মনে হয় মানুষকে যা মনে হয়, চিরকাল সে তার থেকে একটু বেশিই বোকা।

প্রশ্নঃ এটা কিন্তু বেশ একটা কৌতূহলোদ্দীপক গল্প কারণ এটা দেখায় যে আমরা চাইলে শব্দকে ইচ্ছেমতন অর্থপ্রদান করতে পারি। ছটা দিন আর ছটা যুগ!

সারামাগোঃ দ্যাখো শব্দেরও একটা সীমা আছে। আর সবকিছু প্রকাশ করার মতন শব্দভাণ্ডার আমাদের কাছে নেই। আর সব কিছু বললে পরেই বা তার অর্থ কী দাঁড়াবে? তুমি যা জানো তাই? তার উপযোগিতাই বা কী?
একটা প্রশ্ন আছে যার কোনো উত্তর নেই অথবা আমি আজ অব্দি তার উত্তর পাইনি। সেটা এইরকম: আমরা কেন চিন্তা করি যা আমরা চিন্তা করি? যখন আমরা বলি ‘আমার ধারণা’, ‘আমার অভিমত’, তখন কি সেগুলো সত্যি আমাদের ধারণা অথবা আমাদের অভিমত হয়ে যায়? ঘটনা হল এগুলো সব তোমার ভেতরে আছে। তুমি যদি সেইসব সকলের সঙ্গে ভাগ করে না নাও তাহলে তার অর্থ কি দাঁড়াবে?
তুমি তোমার অভিমত প্রকাশ করো, সেটাকে ঘোষণা করো, কিন্তু এর পেছনে তোমার চেতনাটা কী? একজন মানুষের চেতনার কতটা ঠিক তার নিজের অন্তরের আর ঠিক কতটা তার মনের বাইরের?

প্রশ্নঃ যদিও আমরা, ‘ডেথ উইথ ইন্টারাপশন’ উপন্যাসটিকে কমেডি হিসেবে দেখছি কিন্তু তা হলেও এর মধ্যে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উঠে আসতে দেখছি, যেমন আজকের পৃথিবী স্বৈরতন্ত্রের ধারালো ছুরির ফলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

সারামাগোঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি বিশ্বাস করি স্বৈরাচার আমার চারপাশে আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে; সেটা উপলব্ধি করবার জন্য আমার সবুজ অথবা খাকি উর্দি দেখার দরকার নেই। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ গেলে সে যদি ইমিগ্রেশনের ভেতর দিয়ে যায় এবং যদি তার কাছে ল্যাপটপ কম্পিউটার থাকে তাহলে সেখানে উপস্থিত ইমিগ্রেশন অফিসিয়ালরা তার কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভটা চাইলে কপি করে নিতে পারে। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয় গণতন্ত্রের নামে! তাহলে আমার নিজের প্রাইভেসির অধিকারের কি রইল?

প্রশ্নঃ এটার একটা সুন্দর পোশাকি নাম আছে “দা পেট্রিয়ট এক্ট”।

সারামাগোঃ ও এটাকে পেট্রিয়ট এক্ট বলা হয়! দারুণ! (তিনি হাসতে থাকেন) তোমার রসিকতা বোধ আছে। আমি মার্কিন দেশে অনেকদিন যাইনি আর যাবোও না।

প্রশ্নঃ আমি এটা না বলে পারছি না যে ‘ডেথ উইথ ইন্টারাপশন’ উপন্যাসে মৃত্যু যখন সংবাদপত্রে চিঠি লেখে তখন তার লেখার ধরনটা অনেকটাই সারামাগোর মতন। সে লোয়ারকেসে অক্ষরগুলো লেখে এবং বেশি যতি চিহ্ন ব্যবহার করে না।

সারামাগোঃ মৃত্যুর হাতের লেখা বর্ণনা করার জন্য আমাকে আমার নিজের হাতের লেখাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়েছে।

প্রশ্নঃ আমার এই প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হল এই যে আপনি কী করে আপনার লেখায় এই ভঙ্গিমা নিয়ে এলেন। কেন-না ‘ম্যানুয়াল অফ পেন্টিং এন্ড ক্যালিগ্রাফি’তে মনে হচ্ছিল যে আপনি এই বাচনভঙ্গিতে প্রায় পৌঁছে গেছেন কিন্তু…

সারামাগোঃ ‘ম্যানুয়াল অফ পেন্টিং এন্ড ক্যালিগ্রাফি’র সময় আমি একটা সাধারণ ম্যানুয়াল টাইপরাইটারে লিখতাম আর এখন আমি কম্পিউটারে লিখি। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। কম্পিউটারে লেখার একটা সুবিধে হল, এখানে লেখাটা অনেকটা কারিগরের কাজ করার মতন। অনেকটা একজন কুমোর যেমন একতাল কাদা নেয় আর তার মাথার মধ্যে যে ভাবনাটা আসে সেটা নিয়ে কাজ করতে বসে যায় আর মৃৎশিল্পের চাকায় মাটি লাগায় তেমন।
টাইপরাইটার বা পেন দিয়ে লিখলে, তোমাকে আগে লাইনটা ভাবতে হবে। কাগজে একবার লিখে ফেলার পর কিছু বদলাবার বা সংশোধন করার সেরকম দরকার পড়ে না। কম্পিউটারে লেখার সময় ব্যাপারটা ঠিক উলটো। তোমার মাথায় একটা ভাবনা এল; তুমি মোটামুটি সেটাকে স্ক্রিনে বসালে আর তারপর ঠিক কুমোর যেমন করে সেইভাবে তুমি তোমার কাজ শুরু করলে। তুমি কিছু জিনিস যোগ করলে; কিছু জিনিস সরিয়ে দিলে; এইভাবে পুরো লেখাটা তুমি শেষ করতে পারো পুরোনো কোনো ব্যাবহৃত শব্দের চিহ্নমাত্র না রেখে, যতক্ষণ না তুমি নিজেকে নিজে বলছো যে ‘হ্যাঁ, আমি ঠিক এইটাই বলতে চাইছিলাম।’

প্রশ্নঃ আপনার লেখায় ফ্যান্টাসির ব্যবহারের বিষয় কিছু বলুন?

সারামাগোঃ তুমি যেটাকে ফ্যান্টাসি বলছ সেটা আসলে এমন একটা কিছু যেটা ঠিক তুমি বুঝতে পারোনি অথবা যা আগে কখনও ঘটেনি। যেমন ধরো, ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’য় গার্সিয়া মার্কেজ লিখছেন যে মেয়েটি একটা চাদরে চড়ে স্বর্গে পদার্পণ করল ও তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। এই ঘটনার সত্যতাটা এখানে কোনো বিষয় নয়। বিষয় হল গল্পের প্রেক্ষিতে এই ঘটনাটা তোমার কল্পনার জগতে কতটা গ্রহণযোগ্য।
আমার উপন্যাস ‘দা এলিফেন্টস জার্নি’তে এরকম বহু ঘটনার উল্লেখ আমি করেছি যা বাস্তবে সম্ভব নয়। কিন্তু গল্প বলার ক্ষেত্রে আমি বলব না সেসব সত্যি হয়ে যায় তবে গল্পের ক্ষেত্রে সেগুলো যুক্তিযুক্ত কিনা সেটা দেখা দরকার। মোদ্দা কথা হল পাঠক পড়বার জন্য ভালো কিছু একটা পেলো কিনা। সেটায় ফ্যান্টাসি থাকল কি থাকল না, তাতে কিছু আসে যায় না।
আমি মনে করি ফ্যান্টাসির ব্যবহার হবে হোমিওপ্যাথির মতন। ছোটো ছোটো ডোসে।

প্রশ্নঃ আপনার অনেক লেখায় ভালোবাসার জন্য একটা আর্তি লক্ষ করা যায়…

সারামাগোঃ নিখিলবিশ্বব্যাপী ভালোবাসা নয় সেটা। ভালোবাসা একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি। তুমি নিশ্চয় এ কথা বলতে চাইছ না যে আমার বইয়ের চরিত্ররা কলকাতার মাদার টেরেসার মতন হাবভাব করে? যিনি মনের গভীর থেকে আদৌ মানুষের জীবন নিয়ে ভাবিত ছিলেন না বরঞ্চ তিনি বেশি চিন্তিত তাদের আত্মার পবিত্রতা নিয়ে। প্রেমজনিত বিষয়ে ধারণাগুলো বেশ গোলমেলে। এই ব্যাপারে মাদার টেরেসার উদাহরণে আবার ফিরে আসি। তাকে দুবার সর্বাধুনিক চিকিৎসার সরঞ্জামে সজ্জিত হাসপাতাল ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি পছন্দ করতেন কোনো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ তার কাছে তাদের অন্তরাত্মার দরজা খুলে দেবে যাতে তিনি তার ঈশ্বরের কাছে তাদের জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। তার কাছে এই হল প্রেম। তবে হ্যাঁ আমি অবশ্যই আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি। কিন্তু এ আমি কল্পনাও করতে পারি না যে তার প্রতি আমার ভালোবাসা ধীরে ধীরে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি ভালোবাসায় অন্তর্ভূত হয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যেই ভালোবাসা আছে।

প্রশ্নঃ আমি যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা উদাহরণ দিয়েই বলি। যেভাবে ‘হিস্ট্রি অফ দা সিজ অফ লিসবন’-এর নায়ক প্রুফ রিডার রেমন্ড সিলভা একটা শব্দ বদলে দিয়ে যেভাবে ক্রুসেড থামিয়ে দিল…

সারামাগোঃ ঐতিহাসিক সত্য বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। সবকিছুই হল ব্যাখ্যা। কোনো একটা বিষয়কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়, তার ব্যাখ্যা দেয়া যায়। রেমন্ড কেবল এই তথাকথিত ঐতিহাসিক সত্যের মুখে দাঁড়িয়ে একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি করে গিয়েছিল। তাই সে যখন ‘না’ শব্দটি যোগ করল তখন কী হল? ক্রুসেডাররা আর ফিরে এল না আর তাই পর্তুগিজরা আবার পুনরায় লিসবনের পুনর্দখল নিয়ে নিল না। যার অর্থ এই দাঁড়ালো যে গল্পটাও ভীষণ রকমের বদলে গেল।

প্রশ্নঃ সবশেষে বলি কিছু সমালোচক আপনার সম্পর্কে বলতে গিয়ে সবার আগে বলে যে আপনি একজন রাজনৈতিক নীতিবিদ।

সারামাগোঃ ‘অলমোস্ট এন অবজেক্ট’-এ কার্ল মার্কস আর ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের লেখা ‘দা হোলি ফ্যামিলি’ থেকে একটা এপিগ্রাফ নেওয়া আছে।
‘যদি মানুষ পরিস্থিতির জন্য বদলে যায়, তাহলে সেই পরিস্থিতিকে মানবিক ভাবে বদলানো জরুরি।’
এইটুকু জ্ঞানই আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল আমি যা হয়েছি তা হবার জন্য অর্থাৎ একজন রাজনৈতিক নীতিবিদ।

অনুবাদ: গৌতম চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২