১৯শে মে ও বরাক বৃত্তান্ত – সুমন চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

বরাক নদীর উৎসস্থল ভারতের পৌমাঈ নাগা উপজাতি অধ্যুষিত লিয়াই কুল্লেন গ্রামে। সেই বরাক নদীই যখন আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রবেশ করে তার নাম হয়—সুরমা এবং কুশিয়ারা। বরাকের জলধারাই প্রবহমান এই দুই নদী দিয়ে। তার টান উজানে না হয়ে ভাটির দিকে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একথা সত্য যে, আন্দোলনের ঢেউ যদি উজান পানে ধায়, তার তীব্রতা বেড়ে যায় কয়েক সহস্রগুণ। সুরমার তীর ধরেই কি তাহলে প্রবহমান জলরাশি বাংলার ভাষা আন্দোলনের তীব্রতাকে উজানে পৌঁছে দিল একেবারে সুদূর বরাক উপত্যকায়! তাও আবার ন’বছর পর! সেই তরঙ্গই কি রূপ দিল আরও একটি ভাষা আন্দোলনের? আর তার ফলস্বরূপই কি বরাকবাসী ছিনিয়ে নিল বাংলা ভাষার দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি বা মর্যাদা? হয়তো!

বরাক উপত্যকা অহমের বরাক নদীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। দেশভাগের আগে বৃহত্তর কাছাড় জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা গঠিত। বর্তমানে কাছাড় জেলাকে বিভক্ত করে তিনটি প্রশাসনিক জেলায় তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হল কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলা কান্দি জেলা, যা বাংলাদেশের সিলেট জেলাসংলগ্ন। সেই সময় বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস ছিল, যার মধ্যে আশি শতাংশই ছিল বাংলা ভাষাভাষী। উল্লেখ্য, তদানীন্তন অহমের অন্য সব জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে অহমিয়াদের তুলনায় আর্থিক প্রতিপত্তি, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতির প্রশ্নে বাঙালিরা ছিল অগ্রসরমান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নীল নকশানুযায়ী “অহম অহমিয়ার বাবে” (অহম অহমিয়াদের জন্য) -এর মতো একটা ঘৃণাসূচক বোধ অহমিয়া ভাষাভাষী জনগণের মননে, চিন্তনে, ভাবনায় কৌশলগতভাবে ঢুকিয়ে দিয়ে একটা ভাষাভিত্তিক বিভাজনের বীজ বপন করে বসে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অহমিয়াদেরকে বোঝানো হল শিক্ষাদীক্ষা, আর্থিক প্রতিপত্তির প্রশ্নে বাংলাভাষী মানুষেরা অগ্ৰসরমান হওয়ার কারণে শিক্ষাজগৎ থেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাঙালিরাই অগ্রাধিকার পাবে, অথচ ভূমিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও অহমিয়া যুবক-যুবতীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতার কারণে বেকারত্বের যন্ত্রণা নিয়েই বাঁচতে হবে। সাথে সাথে এটাও বোঝানো হল যে, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই অহমিয়া ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য—সমস্ত কিছুই সম্মুখীন হবে এক চূড়ান্ত বিপন্নতার। এহেন প্ররোচনামূলক প্রচারের কারণে ঘনীভূত হল এমন এক জাতিবিদ্বেষ, যা পক্ষান্তরে জন্ম দিল এক ভয়ংকর শ্রেণীমাত্রিক বিদ্বেষেরও। এই জাতি তথা শ্রেণীগত বিদ্বেষের ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঙালি ও বাংলা ভাষার স্বার্থ পরিপন্থী একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বসল তদানীন্তন স্যার বিমলা প্রসাদ চালিহা নেতৃত্বাধীন অহম সরকার। এমনকি অহমিয়া ভাষাভাষী মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় এ সময়টা জুড়ে। এই ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখেই অহমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকার স্বীকৃত ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি নাগাদ বিতর্কিত Assam Official Language Act (ALA-1960) নামে একটি অ্যাক্ট অহম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেওয়া হয় তদানীন্তন অসমের মুখ্যমন্ত্রী স্যার বিমলা প্রসাদ চালিহার নেতৃত্বে।

১৯৬০ সালের পূর্বেও, সংখ্যাধিক্য থাকার কারণে বাঙালিরা অহম রাজ্যে তাদের স্বীয় অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই, অহমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও অন্যতম রাজ্যভাষা তথা দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে মুখর হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের ধাঁচেই বরাক উপত্যকার আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। এবং বাঙালিদের এই আন্দোলনের প্রতি অন্য ভাষাভাষী গোষ্ঠীরও নিঃশর্ত সংহতিজ্ঞাপন একটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন রূপে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল এবং আন্দোলনের মূল রাশ ছিল তাদেরই হাতে। তবে সব কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় যখন অহম প্রদেশ কংগ্রেস ওই সর্বনাশা ভাষা বিলকে সমর্থন করে বসে। কংগ্রেসের এই সমর্থন জ্ঞাপনের কারণে আন্দোলনকে চূড়ান্ত ও সর্বাত্মক রূপ দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো গত্যন্তর থাকে না বাঙালিদের হাতে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধে মুখর হয়ে ওঠে বরাক উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমূহ। “জান দেব তবু জবান দেব না”—এই স্লোগানে প্রকম্পিত হতে দেখা যায় বরাক উপত্যকার দশদিক-দশদিগন্তকে। রাস্তায় রাস্তায় সংগঠিত হতে থাকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। মানুষ যে কোনো মূল্যে নিজের ভাষাকে সমুন্নত রাখার প্রশ্নে যেন অঙ্গীকারবদ্ধ। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। অহমের খাসিয়া, গারো, বোরো, মিশামী, ডিমসা, মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়াসহ সংখ্যালঘু প্রায় সব জনগোষ্ঠীই এতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়ে বসলেন। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল আন্দোলন প্রতিবাদ, ধর্মঘট, সভা সমিতির মতো কর্মসূচির মাধ্যমে।

আন্দোলনের রাশ অ-অহমীয়াদের হাতে চলে যেতে দেখেই ১৯৬০ সালের ২১ এবং ২২ এপ্রিল অহম প্রদেশ কংগ্রেস প্রস্তাব গ্রহণ করে ‘অহমিয়াকে রাজ্য ভাষা করতেই হবে।’ অহমের মুখ্যমন্ত্রী স্যার বিমলা প্রসাদ চালিহা এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘দাবিটা রাজ্যের অ-অহমীয়দের কাছ থেকে আসুক’। কিন্তু সেই প্রস্তাব আসার জন্য অপেক্ষা না করে, মাস দু’য়েক যেতে না যেতেই বিধানসভায় তিনি ঘোষণা করলেন, ‘অহমিয়াকে রাজ্যভাষা করার জন্য সরকার শিগগিরই একটি বিল আনতে চলেছে।’ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তাণ্ডব তখন গৌহাটী গোরেশ্বরেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষাকে রাজ্য তথা দপ্ততরিক ভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে ততদিনে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে কাছাড় ছাড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পর্যন্ত। ২ জুলাই, ১৯৬০, শিলচরে ডাকা হয় ‘নিখিল অহম বাঙলা ও অন্যান্য অ-অহমীয়া ভাষা সম্মেলন’। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন লুসাই-খাসিয়া-গারো-মণিপুরি-বাঙালি সবাই। সর্বসম্মতিক্রমে ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিষয়টি নিয়ে সংবেদনশীল বিবেচনা ও হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়।

নরমেধযজ্ঞ শুরু হল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকা ছেড়ে সংখ্যালঘুরা পাড়ি দিলেন পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় অববাহিকা এবং উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ১৯৬০ সালের ১৫ আগস্ট, কলকাতায় শোক দিবস পালিত হল। উগ্র জাতীয়তাবাদী বর্বরতার প্রতিবাদে স্বাধীনতা দিবসের সরকারি-বেসরকারি সমস্ত অনুষ্ঠান বয়কটের ডাক দেওয়া হল। পরবর্তী লোকসভা অধিবেশনে আলোড়ন উঠলে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ড্যামেজ কন্ট্রোল পদক্ষেপ হিসেবে গোবিন্দবল্লভ পন্থকে শান্তিদূত করে পাঠালেন। পন্থজীর ফর্মুলা বাদী-বিবাদী কোনো পক্ষই মেনে নিল না—বস্তুত তা নির্দ্বিধায় নাকচ হয়ে গেল।

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি, শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে করিমগঞ্জে সম্মেলন ডাকা হল। শিলচর সম্মেলনের প্রস্তাব নতুন করে ঘোষণা করা হল। সমগ্র কাছাড় জেলায় বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠল। ভাষার প্রশ্নে সমগ্র কাছাড় এক মন এক প্রাণ হয়ে শপথ নিল—‘জান দেব, তবু জবান দেব না!’ মাতৃভাষার মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সেদিন জান, মান – দুটোই ছিল সতত কবুল। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে কাছাড় জেলা জনসম্মেলন আহ্বান করা হল। সম্মেলনের একমাত্র দাবি ‘বাংলাকে অহমের অন্যতম রাজ্য এবং দপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।’ অহম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের ভেতর তাদের এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর আবেদন পর্যন্ত করা হল। ১৩ এপ্রিলের মেয়াদ শেষ হলেও অহমের কংগ্রেস সরকার রইল নিরুত্তর। অতএব সমুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর আর রইল না। রাতারাতি ঘরে ঘরে সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি হয়ে গেল। এক নতুন মন্ত্রে যেন দীক্ষিত হল কাছাড় অঞ্চলের আমজনতা।

এছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ, সুধীসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল এমনকি ছাত্রযুবরাও ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রথমদিকে, এই আন্দোলনের গতিবিধিকে সভা, মিছিল, সত্যাগ্রহ, পদযাত্রা, হরতাল এবং অবস্থান ধর্মঘটের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যেই আবদ্ধ রাখা হয়েছিল। চলতে থাকা আন্দোলনকে তীব্রতর করতে, সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করে বিষয়টিকে সার্বজনীনতা প্রদানের লক্ষ্যে আন্দোলনকারীরা ছিলেন অবিচল। সামগ্রিক প্রয়াসকে সংগঠিত করতে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সমগ্র বরাক উপত্যকায় ‘পক্ষকালব্যাপী পদযাত্রা’র কর্মসূচি শুরু করে। এ পদযাত্রায় ব্যাপক সংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয় এবং কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রাম অঞ্চল ঘুরে পায়ে হেঁটে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়।

একটি ঐতিহাসিক তারিখ ঘোষিত হল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। আগের দিন ১৮ মে, ছাত্রসমাজের ডাকে করিমগঞ্জ শহরে যে শোভাযাত্রা বের হয় তা এক প্রকার গণ-অভ্যুত্থানের সমতুল্য আকার ধারণ করে। সর্বস্তরের মানুষ সেদিন ভুলে গিয়েছিল যে সেটা ছিল শুধু ছাত্রসমাজের শোভাযাত্রা। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যোগ দিয়েছিলেন মাতৃভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আয়োজিত সেই শোভাযাত্রায়। করিমগঞ্জের সংগ্রাম পরিষদের দুই নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন ও নলিনীকান্ত দাস সহ ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাসকে ১৮ মে গ্রেফতার করে শিলচর নিয়ে যাওয়া হল। প্রত্যেকটি জনপদ যেন বিক্ষোভে আরও ফুঁসে উঠল। কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সেদিনের ধর্মঘট তা শোনা যাক লেখক অলক রায়ের জবানিতে। তিনি ‘ভাষা আন্দোলনে কাছাড়’ বইয়ে লিখেছেন- “১৯ মে, ১৯৬১, করিমগঞ্জ রেল-স্টেশন। ভোরের ট্রেন আটকাতেই হবে—এই লক্ষ্যে অবিচল থেকে সত্যাগ্রহীরা রেল-লাইন আগলে বসলো। কয়েকজন আবার রেল-লাইনের উপর উপুড় হয়ে শুয়েও পড়লো। রেলের চাকা যদি চলে ওদের উপর দিয়ে পিষে বেরিয়ে যায় যাক, ক্ষতি নেই। আচমকা পুলিশ ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো উদ্যত লাঠি হাতে। পেটাতে লাগলো। কিন্তু সত্যাগ্রহীদের রেল লাইন থেকে সরাতে পারলো না। সত্যাগ্রহীদের স্লোগানে চারদিক মুখর হয়ে উঠলো- ‘জান দেবো, তবু জবান দেবো না’।”

পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতেই অহমের কংগ্রেস সরকারের পুলিশ জান্তব জিঘাংসায় জনতার ওপর লাঠি উঁচিয়ে চড়াও হয় এবং শুরু হয় নির্মমতম পুলিশি নিগ্রহ। এতে উত্তেজনা আরও ব্যাপকতা লাভ করে। অতঃপর কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই আধাসামরিক বাহিনীর সেনারা নিরস্ত্র বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর নির্বিচারে রাইফেলের গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে কমলা ভট্টাচার্য সহ এগারোজন বাঙালি তরুণ একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই এগারো জনের মধ্যে ন’জন ঘটনার দিন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দু’জন তরুণ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের লড়াই লড়তে লড়তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঘটনার দিন যে ৯ জন শহীদ হন তারা হলেন—কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। ঘটনার দু’দিন পর অর্থাৎ ২১ মে যে দু’জন শহীদ হন তারা হলেন—বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেব।

উল্লেখিত ১১ শাহাদতবরণকারীদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষাসৈনিক। তিনি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামরামন ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তার পারিবারের অন্যান্য সদস্যরা বাংলাদেশ ছেড়ে অহমের কাছাড় জেলার শিলচরে চলে আসেন। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইন্সটিটিউটের ছাত্রী হিসেবে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসেন ১৯৬১ সালে। বরাক উপত্যকায় চলতে থাকা ভাষা আন্দোলনের গতিবিধির বিষয়ে কমলা ছিলেন যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এবং গোপনে আন্দোলকারীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য পর্যন্ত করেছেন। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ১৮ মে ১৯৬১ সালে তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন বলে মনস্থির করেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের ওজর আপত্তি তোয়াক্কা না করে কমলা ১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে বোন মঙ্গলাকে সাথে নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের আপত্তি থাকলেও কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী মেয়ে কমলাকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে দেখে খুশিই হন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পুলিশের কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে এক টুকরো কাপড় কমলার হাতে গুজে দেন। কমলার সঙ্গে কমলার ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়ে ধর্মঘটে সামিল হতে। অবস্থান ধর্মঘট চলাকালীন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিচার্জ শুরু করে, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা আক্রান্ত মঙ্গলার সাহায্যে এগিয়ে গেলে একটি বুলেট তার চক্ষু ভেদ করে মাথায় আঘাত করে এবং মুহূর্তে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই বাঙালির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষার জন্য আত্মাহুতি দেন। মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে প্রথম নারী ভাষাসৈনিকের, কমলা ভট্টাচার্যর আত্মাহুতি সমগ্র বাঙালি নারী সমাজকে করেছে মহিমান্বিত।

১৯৬১ সালের ১৯ মে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলনের দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। এ রকম পরিস্থিতিতে দিল্লির কেন্দ্রীয় কংগ্রেস চলতে থাকা অচল অবস্থা থেকে উত্তরণের রাস্তা বাতলানোর দায়িত্ব দেয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী Assam (official) Language Act (ALA-1960) সংশোধনের ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলি দেন:
১. অঞ্চলে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সরকারি ভাষা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হোক।
২. বৃহত্তর কাছাড় জেলা, পার্বত্য অঞ্চল ও প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে সরকারি পত্রালাপ বা যোগাযোগের মাধ্যম হবে ইংরেজি।
৩. প্রাদেশিক পর্যায়ে সরকারি ভাষা হিসেবে অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা চালু থাকবে।
৪. ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রচলিত ভাষার অস্তিত্ব ও অক্ষুণ্ণতা রক্ষার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে প্রাদেশিক সরকারকে।
বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতারা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর এ প্রস্তাবে প্রাথমিক পর্যায়ে বিরোধিতা করলেও পরবর্তী সময়ে কিছুটা নমনীয় ও সতর্ক সাড়া দেন। অবশেষে অহমের প্রাদেশিক সরকার লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর প্রস্তাবের সূত্র ধরে ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে Assam (Official) Language Act (ALA-1960) সংশোধন করে বাংলাকে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলা কান্দি জেলায় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে ১৯৫২ সালের বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, আন্দোলনের কৌশল এবং আন্দোলনোত্তর বাংলা ভাষার স্বীকৃতি অনেকটা একই ধারায় পরিচালিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটা বলা যায়, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আন্দোলনের রণকৌশল, এমনকি ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঘটনা পথপ্রদর্শক হিসেবে নিঃসন্দেহে অহমের আন্দোলকারীদের জুগিয়েছিল সাহস এবং সেখানকার বাঙালিরা ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং তারই পথ ধরে বাংলা ভাষাকে করেছে প্রতিষ্ঠা। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, সেদিন যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও।

এমন একটি মহান ঘটনা স্মরণ করা এবং শহীদ হওয়া ভাষাসৈনিকদের আজ কোনো এক দুর্জ্ঞেয় কারণে ঠাঁই হয়েছে বিস্মৃতির অগম্য কুঠুরিতে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে শুধু ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ঘিরে বাংলা ভাষাপ্রেমিকদের মধ্যে যে পরিমাণ উন্মাদনা, উৎসাহ বা উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় তার ছিটেফোঁটাও জোটে না আমাদেরই দেশের বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের কপালে। সারা বছর এই ভাষা শহীদদের স্মৃতি তর্পণের তেমন কোনো উদ্যোগ বা ভাষাভিত্তিক কর্মকাণ্ডও পরিলক্ষিত হয় না যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *